ডিজিটাল ‘ডোপামিন’ আসক্তি: কৃত্রিম আনন্দের খোঁজে বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা
আজকের পৃথিবী প্রযুক্তির সাগরে ভাসছে, যেখানে ডিজিটাল যোগাযোগ ও সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিপুল তথ্যের মধ্যেও এক ধরনের নতুন আসক্তি তৈরি হয়েছে, যা তরুণদের মনোযোগ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলছে—ডিজিটাল ‘ডোপামিন’ আসক্তি।
স্মার্টফোনে ডুবে থাকা, ভিডিও স্ক্রলিংয়ের নেশায় মগ্ন থাকা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তাৎক্ষণিক আনন্দের জন্য দৌড়ানো, এসব হয়ে উঠেছে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অঙ্গ। তবে এই অদৃশ্য ‘ডোপামিন’ তাদের বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করছে, তাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে।
উদাহরণস্বরূপ- বাংলাদেশের শহরের তরুণরা তাদের সময়ের অধিকাংশই সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটাচ্ছে, যেখানে তারা দ্রুত ফলাফল বা প্রতিক্রিয়া আশা করে। তাদের জীবনব্যাপী অস্থিরতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি হচ্ছে, কারণ তারা সত্যিকার সুখ ও শান্তির জন্য বাস্তব জীবনে পৌঁছাতে পারছে না।
স্ক্রিনে ঝলমলে রঙিন আলো,
আনন্দের খোঁজে ছুটে চলে তরুণেরা ছোঁয়ায়।
ক্লিক, স্ক্রোল, লাইক, শেয়ার —
এক অদৃশ্য নেশার বন্দী হয়ে যায় মন।
বাস্তবতার খুঁটিনাটি হাসি—
হারিয়ে যায় ভার্চুয়াল গেমের গন্ধে।
ডোপামিনের কৃত্রিম রসে মগ্ন,
জীবনের সঙ্গী হয় একাকিত্বের ছায়া।
মিথ্যা আনন্দের জালে আটকে,
তারা ভুলে যায় প্রকৃতির গান।
হৃদয় হয় নিঃশব্দ, দূরত্ব বেড়ে যায়,
ডিজিটাল দুনিয়ায় হারিয়ে যায় মানবতা।
ডিজিটাল ‘ডোপামিন’ আসক্তির মূল কারণ হচ্ছে শর্ট ভিডিও ও ‘ইনস্ট্যান্ট রিওয়ার্ড’ কালচার। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলিতে তরুণরা সময় নষ্ট করে যায়, অবিরাম ভিডিও দেখে অথবা দ্রুত রিওয়ার্ড পাওয়ার জন্য তাদের মনোযোগ স্থানান্তরিত করে। এই প্রক্রিয়া তাদের মধ্যে মনোযোগের অভাব, ধৈর্যের অভাব, এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই শর্ট ভিডিওগুলির মাঝে সুরভিত আনন্দ খোঁজার জন্য তরুণরা বাস্তব জীবন থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তরুণরা এখন একে অপরের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে বা কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, কারণ তারা দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ডিজিটাল বিশ্বের উপর। এই ডিজিটাল আসক্তি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে, যা তাদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলছে।

যদি এই আসক্তি অব্যাহত থাকে, তবে তার প্রভাব শুধুমাত্র তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের সীমিত থাকবে না, বরং এর প্রভাব বাংলাদেশের কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতির ওপরও পড়বে। আগামী দিনে, যারা এই আসক্তির ফাঁদে পড়বে, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস পাবে। তরুণরা যখন সত্যিকার কাজের জন্য মনোযোগ দিবে না এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে, তখন তাদের ভবিষ্যৎ পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মসংস্থান ব্যবস্থায়, যে সমস্ত তরুণরা ডিজিটাল আসক্তির শিকার তাদের কর্মজীবনে প্রভাবিত হবে, তারা নিজেদের সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলবে এবং কর্মসংস্থানে অগ্রসর হতে পারবে না। এই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক উন্নতির পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫০০ জন তরুণ উদ্যোক্তা “সার্কুলার ব্লু ইকোনমি” গড়ে তোলার লক্ষ্যে যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, তা দেশের টেকসই উন্নয়ন চিন্তায় এক নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। বাংলাদেশ ব্লু ইকোনমি ডেভেলপমেন্ট স্টাডি (২০২4) অনুযায়ী, উপকূলীয় অর্থনীতি দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৪.১% অবদান রাখে, অথচ এর প্রায় ৬৩% তরুণ কর্মশক্তি এখনো বেকার বা আংশিক কর্মসংস্থানে জড়িত। এই বাস্তবতায় তরুণ উদ্যোক্তারা Green Human Resource Management (GHRM) ও Circular Entrepreneurship ধারণাকে একত্র করে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য শক্তি, এবং সামাজিক দায়বদ্ধ ব্যবসায়িক মডেলকে সংযুক্ত করছেন।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় (Rahman & Alam, 2025, Journal of Sustainable Development Studies) দেখা যায়, এমন সামাজিক উদ্যোক্তা উদ্যোগগুলো স্থানীয় কর্মসংস্থানে গড়ে ২৭% বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে ৩২% দক্ষতা বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ডিজিটাল নির্ভরতার এই যুগে, এসব বাস্তব উদাহরণ তরুণদের শিখিয়ে দিচ্ছে—প্রযুক্তি কেবল বিনোদনের নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ারও হতে পারে। এই নতুন প্রজন্ম বুঝতে শুরু করেছে, উদ্ভাবন তখনই অর্থবহ, যখন তা মানুষের জীবন, পরিবেশ এবং জাতীয় উন্নয়নকে একই সূত্রে গাঁথে।
ডিজিটাল ‘ডোপামিন’ আসক্তি বাংলাদেশের তরুণ সমাজের জন্য একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে, যা তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার করে তুলতে পারে। তবে, সঠিক উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়ে তাদের এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের মতো প্রবর্তকদের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, প্রযুক্তি যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় তবে তা আমাদের জীবনে উন্নতি আনতে সাহায্য করবে। তরুণদেরকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানোর মাধ্যমে আমরা একটি সুস্থ সমাজ গঠন করতে পারি, যা দেশের সামগ্রিক উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
‘প্রযুক্তি আমাদের শক্তি হতে পারে, যদি আমরা এটি আমাদের পক্ষে কাজে লাগাতে জানি, তাহলে কোনো কিছুই আমাদের সামনে বাধা হতে পারবে না।’
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
