ভাইরাল হলো বগার বউয়ের রিল
বগার বউ সব জানে পর্ব-২
বিয়ার পর থেইক্যা বগার হাব-ভাবে ফালগুইন্যা হাওয়া লাইগছে। হগল সময়ই মনটাতে একটা টুনটুন পাখি গুনগুন কইরা যেন কথা কয়। চোখ দুইটাতে সমুদ্রের আথালি-পাথালি ঢেউ। ফুর ফুইরা মেজাজে ভাব সাব কইরা হেইল্যা-দুইল্যা চলা-ফেরা করে। আগের মতো আর যখন তখন কাউকে দেখলে প্রশ্ন করে না। এসব ভগবান সিংয়ের আবার দৃষ্টিগোচর হয়। মনে মনে খুশীই হন। বগা বুঝি এবার বউ পেয়ে মানুষ প্রজাতি হইতে লাগল।
ইদানিং গেরামের হাওয়াও যেন কিছুটা বদলাইয়া গেছে। চারিদিকে যেন ইরিং-বিরিং-তিরিং নাচার মতো একটা ধামাকা হাওয়া বইতাছে। আগে সন্ধ্যা হইলেই আশপাশের লোকজন উঠানে চট মাইড়া বসত। ডাবর ডাবর কইরা গল্প ঢালত, কেউ লাঠিখেলার কেরামতি দেখাইতো, কেউ লুডু খেলত। ছোট ছোট বাচ্চা হগল এদিক-সেদিক দৌড় ঝাপটা দিয়ে বেড়াইত। মোটকথা, গেরামটা তখন ছিল একদম পৌষ সংক্রান্তির লাইভ মেলা। তা ছাড়া ভগবান সিংয়ের বাড়িতে ছিল অন্য রকম ব্যবস্থা। মাঝে মাঝে বড়ো গামলায় ঝালমুড়ি বানানোর হিড়িক পড়তো এ বাড়িতে। কিন্তু এহন? এহন তো পুরো কেচ্ছাটাই উলটাইয়া গ্যালো।
সন্ধ্যা মানেই এখন অন্যরকমের কাম কারবার। পাড়া প্রতিবেশীদের অনেকেই নিজের কাম কর্ম নিয়া লাইগ্যা থাকে। হিন্দি সিরিয়ালে কেউবা ডুকরে ডুকরে বুক চাপড়ায়। বড়ো বড়ো চোখ কইরা টিবির স্ক্রীনে তাকাইয়া থাকে। কারো কারো বাড়ির উঠান আর বারান্দা হইয়া গেছে একেকটা মিনি স্টুডিও। মোবাইল হইয়া গেছে জীবনের পরম দোসর।
আগে সন্ধ্যা হইলেই পুকুর থেইক্যা বাড়ির হাঁস হগল যহন ডানা ঝাঁপাইয়া ক্যাঁক ক্যাঁক কইরা দল বাঁইদ্যা ঘরে ফেরত, শেখ বাড়ির রমিজ কাকা তখন হুঁকো সাজিয়ে বসতো। এখন দেহি কলকাতার বাংলা সিরিয়ালে ডুবে থাকে। মাঝে মাঝে এমনভাবে ডুকরে কান্দে যে পাশের ঘরের হেনা ভাবী তিনবার দৌড়াইয়া আইসা হাঁপাইতে হাঁপাইতে কইবো—
“চাচা, কেডা মরল? শ্যামার কিছু অয় নাই ত?”
রমিজ কাকা নাক ঝাড়তে ঝাড়তে ধমকের সুরে বলে, “অহন কথা কইস নাতো?”
এদিকে উঠতি বয়সের পোলা-পাইনরা? ওরা তো একেবারে অন্য দুনিয়ায় চইল্যা গেছে। রং এর পৃথিবীতে। যেন আনন্দ-উল্লাসের বৃষ্টি পুরো শরীরটাতে ঝম ঝম কইরা পড়তাছে। তাদের মুখে এখন দিনে কমপক্ষে কুড়িবার শোনা যায়, “মোবাইলটা কই?” “চার্জ আছে তো?”“ওইটা দেইখছ? ট্রেন্ডিং রিল!”
একেকজন মোবাইল হাতে নিয়া এমনভাবে ঘুরে বেড়ায়, মনে হয় পুরা গেরামের দিশা পোলাপাইন না দিলে সূর্যই উঠবো না। কেউ উঠানে দাঁড়াইয়া শরীর নিংড়িয়ে নাচে। ডান হাত ওপরে, বাম হাত নিচে, মুখে অদ্ভুত হাসি। “ক্যামেরা অন আছে তো? এই নাউ, ফাইভ, সিক্স, সেভেন…অ্যাকশন!” কেউ আবার মুরগি ধইরা রিল বানাইতে যায়। মুরগির পিছনে বান্দরের মতো বাঁকা হইয়া দৌড়াইতে থকে। মুরগিই হাঁক ছাড়তে ছাড়তে পালায়।“আর একবার ধরলে ঠোকর দিমু!”
এদিকে বুড়োরা পরিবেশ দেখে শুধু মাথা দোলায়, “আগের দিন কতো না ভালো আছিল… এখন সবই গজবের কাণ্ড।” বগাদের পাশের বাড়ী বিভূতি কাকাতো প্রতিদিনই বুলি আওড়াতে আওড়াতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে-“এইডা কলি যুগের আলামত।“
মোট কথা, গেরামের সন্ধ্যা এখন আর সন্ধ্যা নাই। এটা একদম ডিজিটাল পাগলামির বিশেষ সংস্করণ। ক্যামেরাযুক্ত পাগল, তালে-তালে নাচা কিশোর-কিশোরী, সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষ, আর চার্জার-খোঁজা মাইয়া-পোলারাই এখন গেরামের নতুন ‘দৃশ্যমান জনসংখ্যা।’
আর বগা?
ইদানীং এসবই গ্রামের এদিক-সেদিক ঘুইরা-ফিইরা খোঁস মেজাজে দেইখ্যা বেড়ায়। মনে মনে ভাবে “এই গেরামটা মনে হয় সোজা টিকটকের ভেতরে ঢুইকা গেছে!”
বগা যেদিন প্রথম এ সব আজগুবি আলামত দেখল সেদিন ব্যাপারটা বুঝতেই পারলোনা। ভক্ত পাড়ার ছোট্ট সুজন ভক্ত, যে এখনো গামছা পইড়া কঁচি বাঁশের মতো পা দুটি দিয়ে ধিন ধিন কইরা হাঁইটা বেড়ায়, যেইডা মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে, হঠাৎ স্কুলের পাশের রাস্তার মাঝখানে ঠারা কইরা দাঁড়াইয়া হাত নাচায়, পা নাচায়, মুখ বাঁকা করে “ট্রেন্ডিং সাউন্ড” এর তালে তালে। দুই কানে দুটো তুলোর মতো সাদা বলের মতো কিছু একটা গুঁইজ্যা থুইছে।
বগা চোখ বড় কইরা কইলো—
“কিতারে সুজন, এইডা কি করসছ আবার?”
সুজন শরীরটা বাঁকা কইর মাথাটা ঘুরাইয়া কয়, “বগাদা, এইডা রিল বানাইতাছি। একদিনে ভাইরাল হইয়া যাইতাম!”
বগা মাথা চুলকাইয়া ভাবে, “এইডা কি আবার? গেরামের নতুন পাগলপানা নাকি?”
এদিকে বগা যখন এইসব দেখে মাথা দোলায়, তখনই হঠাৎ পাশ থেইকা কেউ একজন কইল, “বগা, একবার সাইড দে, আমি ‘স্লো-মোশন ওয়াক’ দিমু।”
বগা পিছনে তাকাইয়া দেখে, মল্লিক বাড়ীর নিরেন্দ্র কাকা! পঞ্চাশ পেরাইছে, চার ছেলে মেয়ের বাপ, কিন্তু মোবাইল হাতে ধরে এমনভাবে ক্যামেরার সামনে পোজ দিছে, মনে হয় মুম্বাই ছবির মার্কা মারা হিরো।
বগা মুখ চাওয়া–চাওয়ি করে বলে, “কাকা, এইডা আবার কিতা করেন?”
কাকা হাঁটু চেপে সোজা হইয়া বলে, “বগা তুই এইডাও জানস না? এইটা স্লো–মোশন ট্রেন্ড। রিল কারে কয় জানস? আমার রিল গত হপ্তাহে তিন হাজারটা ভিউ অইছে। বড় লোক হওয়ার শেষ দৌড়, বুঝলা? যত ভিউ তত মাল কামাইবি”
বগা মাথা দুলায়, কিন্তু কিছুই বুঝল না। মনে মনে ভাবলো-
“বুঝলাম। গেরামে নতুন জ্বালা শুরু হইছে। ”
তবে বগার মাথায় এহনো রিলের ব্যাপারটা ক্লিয়ার না। গোবর ভর্তি মাথায় কত কিসিমের প্রশ্ন ভেজিটেল লাবড়ার মত ঘুর পাক খাইতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো এবার বউকে জিজ্ঞাস করবে।
একদিন সকালে বউয়ের গা ঘেঁসে বসে খুব নরম সুরে বউকে সুধায়-“আচ্ছা কওতো রিল কারে কয়? রিল কইরা কিতা হয়?”-বলেই বউয়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল কইরা তাকাইয়া থাকে।
বউ তখন ভাতের হাড়িতে ঢাকনা চাপাইতেছে। বগা গা ঘেঁষে বসতেই বউ সন্দেহের চোখে তাকায়।
বউ: “এই রে বগা। এতো সাত সকালে এভাবে গা চাপড়াইয়া বইস ক্যা? আবার নতুন কিছু ফন্দি আছে নাহি?
বগা গম্ভীর মুখ করে মাথা দুলায়।
বগা: “না রে বৌ, ফন্দি-টন্দি কিছু না… তয় একখান কথা জিগাইতাম।”
বউ: “হ, জিগাও। সকালে মুষড়ে বইস না যেন… হুনলাম গতকাল নাকি সুজনরে রিল বানাইতে দেইখ্যা চুপচাপ দাঁড়াইয়া ছিলা? বকাবাদ্য নাকি করছ”
বগা মুখ চুলকায়, “এইডাই তো! তুমি জানো, রিল–টিল কারে কয়? রিল কইরা কিতা হয়? আমাগো গেরাম তো এক্কেরে যেমুন বাউলা হইয়া গেছে। আগেত এগুলি দেহি নাই। আর নিরেন্দ্র কাকা কইলো রিল কইরা নাহি বড়লোক হওয়া যায়।”
বউ হাঁড়ির ভাত নেড়ে–চেড়ে বগার দিকে তাকায়।
বউ: “ওহ্! এইডা বুঝি একটা প্রশ্ন। এইডাত এ যুগের হগ্গলেই জানে। দেহনা ঐ বাড়ীর সবিতাদের কাজের মাইয়া কিতা কয়? এইডা নাহি ‘ডিজিটাল যুগ। পুরা বাংলাদেশটাই নাহি ডিজিটাল হইয়া যাইব।“
বগা: “হ, কইলেই বা কি? রিল মানে কিতা? রিল দিয়া কেমনে মাল আইবো? ঘরে চাইল আইবনি? বড়লোক কেমনে হয়?”
বউ হাঁ করে তাকায়।
বউ: “চাল পাইবানে। মালও আইবো। ভালো কইরা রিল কইরতে পারলে বড়লোকও হইতে পাইরবা। রিল মানে হলো মোবাইলে ছোট্ট ভিডিও! মানুষ দেখে, লাইক দেয়, কমেন্ট করে। হাজার হাজার ভিউ হইলে টাকা আইবো। এই টাকা দিয়া কেউ কেউ আবার গাড়ি–বাড়ি কামায়।”
বগা চমকে ওঠে। “কিতা কও। কিতা হুনাইলা তুমি। ভিডিও বানাইলে গাড়ি–বাড়ি পাওয়া যায়? তাইলে নিরেন্দ্র কাকা যে স্লো–মোশন হাঁটা দিতেছিল, তার কি গাড়ি আইতেছে?”
বউ আবার হাঁড়ে ঢাকনা তোলে। “এইডা অইলো গা বুইড়া বয়সে ভীমরতি। আবার স্লো–মোশন! ওইসব দেইখা গাড়ি–বাড়ি পাওয়া যায়না। রিল ভাইরাল হইলে টাকা কামান যায়। ফেইসবুক, ইউ টিউব মোবাইল–ওয়ালা কোম্পানি, ইন্টারনেট–ওয়ালা কোম্পানি টেহা দেয়।
বগা হতাশ মুখে
বগা: “মানে… হেইডা হইলো পাগলামি?”
বউ গর্ব করে
বউ: “তাও না। কেউ কেউ খুব সুন্দর রিল বানায়। রান্না, গান, গল্প, নাচ, জ্ঞান–বুদ্ধি… আর অনেক গেরাইম্যা মানুষেরা বানায় ‘মুরগি ধইরা রিল’।”
বগা আবার মাথা চুলকায়। “মানে রিল কইরা বিখ্যাত হওয়া যায়?”
বউ: “হ, যায়। তবে পাগলামি না কইরা ভালো কিছু করলে যায়। তোমারওত স্মার্ট ফোন আছে। শুধ গ্রামের গান হুনা ছাড়াত আর কিছুই করতে পার না। তুমিও একটা কইরা দেহ। গোরু দোহনের রিল?”
বগা একটু গর্ব করে, “গোরু দোহন কেন? আমি চাইলে ‘বিরিয়ানি বানাইন্যার রিল দিমু!”
বউ:“ঐডা আবর কেডা দেখব। তুমি ঠিক মতো কথাই কইতে পারনা। আর গ্রামের বিরিয়ানি-টিরিয়ানি লোকজন খাইতে চায় না। তুমি ঢাহার বিরিয়ানি বানাইতে পারো?”
বগা থতমত।
বগা: “না মানে, আমি ভাবিতেছিলাম, যদি আমি রিল বানাই… বউ, তুমি দাঁড়াইয়া থাইকবা, আমি বলুম, ‘এই হলো বগার বাড়ির বাতাস।’ ”
বউ হাত কোমরে দিইয়া কয়— “বগা, তোরে একটা কথা কই? তোরে দেইখা মনে হয় না তুই রিল–টিল বানাইতে পারবা। তুই বরং রিলের ভিউ দেখবি। নিজের মাথায় রিল ঢুকানোর চেষ্টা করবি না।”
বগা হতাশ হয়ে-“তাহলে আমি বিখ্যাত হইতে পারমু না?”
বউ:“হইবা কেন? বিখ্যাত হইয়া কি করবা? এখনই তো গেরামের মানুষরে দেইখা তুই লজ্জা পাস, বিখ্যাত হইলে তো বাসায় ঢুকতেই পারবি না।”
বগা চুপচাপ বসে থাকে। একটু পর ধীরে ধীরে বলে, “তুমি চাইলে আমি তোমার সাথে রিল বানাইতে পারি… দুজন মিইল্যা। বৌ-জামাই রিল।”
বউ থমকে যায়। “আমার সাথে রিল? কোনটা? প্রেম–টেম?”
বগা হাসে। না রে বউ। তুমি বকবা, আমি ভয় পাইয়া পালাইতে থাকলাম—এইটাই ভাইরাল হইবো!”
বউ হাতের খুন্তি নিয়ে তেড়ে আসে। “থাম! এখনই একটা বাস্তবিক স্লো–মোশন দৌড়ানি দিমু!”
বগা দৌড় দিতে দিতে চিৎকার করে।
বগা: “এইডা রিল বানাইস না! লোকে ভাববো বাসায় গৃহযুদ্ধ লাগছে!”
বউ পেছন থেইকা “গৃহযুদ্ধ না—গেরামের প্রথম ‘রিয়েল’ রিল!”
বউয়ের কাছ থেকে বগা রিলের মোদ্দা ব্যাপার-স্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পারলো। মোবাইলটা ভালা কইরা দেইখ্যা নিলো বেশ কয়েকদিন। সারা দিন রাত ইচ্ছা কইরা নানা কিসিমের রিল দেইখ্যা নিলো। কখনো কখনো হাসিতে খাটে গড়াগড়ি দিছে। মনে হলো রিলে বুঁদ হইয়া গেছে বগা।
একদিন বগা ভাবলো, “সবাই যহন বানায়, আমি বানাইলে দোষ কি?”
বাজারে করিমের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া সে মোবাইলটা নিজের সামনে ধরে, ক্যামেরাটা অন করে। মুখটা পেঁচাইয়া কইতে লাগে, “হ্যালো বন্ধুগণ, এইডা আমার প্রত্থম রিল…”ঠিক এই সময়ে তার পিছনে দাঁড়ানো একটা গরু মাথা ঘুরাইয়া লাফাইয়া উঠে বগা “হ্যালো” বলতে না বলতেই, ধপ্! ছাতফাত!সরাসরি কাদার ভেতরে লাফ! চায়ের দোকানে হাসির ঝড় উঠে তখন।
পাশে সেন্টু কাকা তো হাসতে হাসতে শুদ্ধ কাঁপতে লাগল, “বগারে, এইডা যদি ভাইরাল হয়, গরুই হিরো হইয়া যাইব!”
বগা ভেজা কাপড় আর কাদা মাখা গায়ের দশা লইয়া ঘরে ঢুকতেই বউ লক্ষ্মী চোখ পাকাইয়া বলল, “এইডা আবার কোন যুদ্ধ থেইক্যা আইলা?”
বগা ধীরে ধীরে সব বলল। রিল বানানো, গরুর লাফাইয়া উঠা, চায়ের দোকানের লজ্জা, সব। লক্ষ্মী দুই হাত কোমরে রেখে গলায় দাম বাড়াইয়া কয়, “আমি না কইছিলাম? এইডা তোমার ধান্দা না। তুমি রিল বানাইতে গিয়া গেরামের গরুরে হিরো বানাইয়া ফালাইছো!”বগা চুপ মেরে থাকে।
লক্ষ্মী আবার কয় “একটা কথা কই, রিল বানাইলে কামাই-রোজগার হয়?”
বগা বলে, “আমারটা দেখি কামাইর বদলে ধাক্কাই হইছে।”
লক্ষ্মী হাঁহা করে হাসে।“তোমার জন্য গেরামের রিল-টিকটক আলাদা শাখা খুলতে হইব, ‘অলৌকিক দুর্ঘটনা বিভাগ’। ”
পাড়া-গাঁয়ের পোলাপাইনদের শুরু হইলো নতুন এক পাগলামি। পরদিন বগা দেখল,গেরামের খোকা-খুকিরা স্কুলের বই খোলার আগেই বলা-বলি করতাছে- “ওই যে ভাইরাল ডান্সটা, চল ট্রাই করি!” একজন মাঠে ঘাসের উপর বই রাইখ্যা তার উপর পা তুইল্যা ঘুরতাছে, আরেকজন বেঞ্চের উপর উঠটাছে আর নামতাছে, তৃতীয়জন কইতাছে, “এডিট দিমু, ভালা কইরা”
বগা মাথায় হাত দিয়ে ভাবে,“কলিজার পোলাগুলা ভিউয়ের জন্য জীবন দিতেও রাজি।”
উঠানে দাঁড়াইয়া বগা তার বৌকে এই সব নিয়াই কইতেছিলো। তখনই বগার বউ দাঁত কেলিয়া মুখটা নৌকার মতো প্রসস্থ কইরা আওয়াজ দেয়, “তোমার বয়সে তুমিও পড়ার বদলে গেরামে টু টু কইরা ঘুইরা বেড়াইতা।, কিন্তু ঐডা শেয়ার-টেয়ার হইত না। আর এরা তো এখন সোজা ‘ভাইরাল হইবো’ বইলা টাইটপ্যান্ট পরে নাচে! এইডা হইছে ডিজিটাল কলি যুগ”
বগা বলে, “তুমি কি এই সব জানো নাকি?”
লক্ষ্মী হাসে, “তাইতো গেরাম কইতেছে, বগার বউ সব জানে! কথাডা এক্কেবারে সত্যি।”
লক্ষ্মী উঠান ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, “দেখো, রিল বানানোতে দোষ নাই। কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা যদি সারাদিন রিল দেখে, পড়া-শোনা নাই, ঘুম নাই, চোখে ব্যথা, তখনই সমস্যা। মোবাইল যদি জীবন চালায়, তহন জীবন এক্কেরে চপ্পল খায়।”
বগা মাথা দোলায়, “বুঝলাম।”
হঠাৎ একদিন বগা দেখে, লক্ষ্মী উঠানে দাঁড়াইয়া একটা ডাল হাতে নিয়া কারো সঙ্গে কথা কইতেছে।
বগা জিগায়, “কি করস?”
লক্ষ্মী বলে., “রিল বানাইতাছি। আজকে দেখামু বউদের জন্য ‘বাসন ধোয়া হ্যাক’। ভাইরাল হইলে দুনিয়া জানবো, বগার বউ-ও পারে!”
বগা চোখ বড় করে, “তুমি? তুমি রিল বানাইবা?”
লক্ষ্মী বলে, “জ্ঞান আছে, বুদ্ধি আছে, ফোন আছে, কেন বানামু না? তবে আমি শিক্ষা দিমু, পাগলামি না।”
লক্ষ্মী ২০ সেকেন্ডের রিল বানাল। বাসন ধোয়া, হাসাহাসি, টুকটাক উপদেশ। পরদিনই গেরামে সবাই বলল, “লক্ষ্মীর রিল ভাইরাল! এক রাতেই তিরিশশো ভিউ!” বগা হতবাক।
লক্ষ্মী গামছা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে, “দেখলা? বুদ্ধি দিয়া বানাইলে ভাইরাল হয়। গরুর ধাক্কা দিয়া না।”
বগা নিচু গলায় বলে, “হ, বুঝলাম… বউ সব জানে।”
লক্ষ্মী গর্বে বুক উঁচু করে, “অইডাই তো!”
গেরাম এবার নতুন প্রবাদ শিখল, “রিল-টিকটক শিখতে হইলে, বগার বউয়ের কাছেই শিখো!”
লেখক- শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিস্ট।
