প্রবীণদের একাকীত্ব ও অবহেলার প্রভাব
একা জীবনের বোঝা টানছে প্রবীণরা, বাংলাদেশের সমাজে একটি অতি গুরত্বপূর্ণ ও দুঃখজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ থেকে দশ বছর আগে একদিন আমি যখন একজন প্রবীণকে রাস্তায় একা হেঁটে যেতে দেখলাম, তার চোখে আমি শুধু বয়সের ছাপই দেখিনি, বরং তার মধ্যে ছিল এক গভীর বিষণ্নতা, যা যেন তাকে একা পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে। তার পরিবারের কোন সদস্য তাকে পাশে রাখতে আসেনি, আর সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কার্যত অকার্যকর। আমাদের সমাজে প্রবীণদের জন্য সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা তেমন নেই। তাদের প্রতি অবহেলা যেন আমাদের চিরকালীন চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবীণদের প্রতি এই অবহেলা, যাকে আমরা সাধারণভাবে 'একাকী জীবন' বলি, কেবল তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং পুরো সমাজের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর প্রতি সামাজিক অবহেলা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পরিবারে গুরুত্ব হারিয়ে অনেক বয়স্ক মানুষ একাকীত্ব ও মানসিক অবসাদে ভুগছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে বয়স্ক নিবাসে আশ্রয় নিচ্ছেন, যেখানে মানবিক যত্নের ঘাটতি ও মানসিক সঙ্গবঞ্চনা তাঁদের জীবনের শেষ অধ্যায়টিকে আরও কষ্টকর করে তোলে। পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া এবং কর্মজীবী প্রজন্মের ব্যস্ততা প্রবীণদের জন্য নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবনযাপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
‘বয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রতি অবহেলা: একা জীবনের বোঝা টানছে প্রবীণরা’
নীরব সন্ধ্যা
চোখের কোণে গল্প জমে, কথা কয় না কেউ,
জীবনের শেষ প্রহরে দাঁড়িয়ে, তারা আজ খুবই নীরব ও একাকী।
ছেলে-মেয়ের ব্যস্ত শহরে, খোঁজ পড়ে না আর,
পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়, কেবল ঘড়ির কারবার।
যে ঘর ছিল হাসির খোঁজে, তা আজ নিঃসঙ্গ আশ্রয়,
বৃদ্ধাশ্রমের দেয়ালে যেন, জমে থাকে দীর্ঘশ্বাসের মায়া।
তবুও তারা চায় না কিছু, চায় না নতুন চাওয়া,
শুধু একটু ভালোবাসা, একটু সময়, আর আপন কেউ পাশে পাওয়া।
বয়স্ক জনগণের প্রতি অবহেলা শুধু তাদের একাকীত্বকেই বৃদ্ধি করে না, বরং এটি সামাজিক অস্থিরতার কারণও হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যা একজন প্রবীণের মৌলিক অধিকার, তা অসম্পূর্ণ এবং দুর্বল। যেমন, একটি পরিবারে প্রবীণ বাবা-মায়ের দেখাশোনা করার দায়িত্বের কথা বলা হলে, অনেক সময় দেখা যায় সন্তানরা তাতে অবহেলা করে। আজকালকার কর্মব্যস্ত সমাজে, যেখানে তরুণরা তাদের কাজের চাপের মধ্যে আটকে, প্রবীণদের প্রতি খেয়াল রাখতে ভুলে যায়, সেখানে একাকী জীবন প্রবীণদের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। যেমন, ২০২১ সালে সেন্টার ফর সোসিও-ডেমোগ্রাফিক স্টাডিজের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৩০% প্রবীণ ব্যক্তি একাকী জীবনযাপন করছেন। এই একাকী জীবন তাদের মানসিক চাপ ও শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টি করছে। যদি অবহেলা চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে প্রবীণদের অবস্থা আরও সঙ্গিন হতে পারে, যা সমাজে অসন্তোষ এবং অস্থিরতার সৃষ্টি করবে।
যদি প্রবীণদের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা ব্যবস্থা তৈরি না হয়, তবে এর প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে পড়বে। একদিকে, প্রবীণদের একাকীত্ব এবং অবহেলা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে দুর্বল করে তুলবে, অন্যদিকে, তাদের জন্য কোনো সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকলে, রাষ্ট্রের উপর চাপ বৃদ্ধি পাবে। এমনকি, দেশে জেনারেশন গ্যাপও বৃদ্ধি পাবে, যার কারণে তরুণদের মধ্যে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কমে যাবে। এমনকি, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা তাদের স্বাস্থ্য সেবা এবং জীবনযাত্রার মানকে আরও খারাপ করতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি এমন একটি উদাহরণ যা বাংলাদেশের প্রবীণদের সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। তার উদ্যোগে তৈরি হওয়া সামাজিক ব্যবসা প্রকল্পগুলি প্রবীণদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। ইউনূস সেন্টারের মাধ্যমে, প্রবীণরা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সক্ষম হচ্ছেন। এটি কেবল তাদের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করছে না, বরং তাদের সামাজিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। সামাজিক নিরাপত্তা এবং সহায়তার এ ধরনের পদক্ষেপ, যেমন ড. ইউনূস এর কার্যক্রম, বাংলাদেশের প্রবীণদের প্রতি অবহেলা কমাতে সাহায্য করতে পারে, এবং দেশকে আরও একটি সমৃদ্ধ এবং মানবিক সমাজে পরিণত করতে পারে।
বয়স্ক জনগণের প্রতি অবহেলা একটি সমাধানযোগ্য সমস্যা, তবে এর জন্য আমাদের সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি কোনো দুর্দশার বিষয় নয়, বরং একটি সুযোগ যা আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। ড. ইউনূসের মতো উদ্যোগগুলো আমাদের শিখিয়েছে, যে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। তাই, আমাদের প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং তাদের জন্য একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুললে, বাংলাদেশের উন্নয়ন আরও কার্যকর হবে।
‘যতটুকু স্নেহ, ততটুকু সম্মান; প্রবীণদের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধই আমাদের সঠিক পথ দেখাবে।’
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
