সময়ের ঘড়িতে বাধা চিকিৎসা, সেবা নাকি বাণিজ্য
একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক— ‘একজন অসুস্থ মানুষ যখন তার শেষ সম্বলটুকু গুঁজে শহরের নামজাদা হাসপাতালের দোরগোড়ায় পৌঁছান, তখন তার প্রত্যাশা ঠিক কী?’ কেবল রোগমুক্তি? না—সে খোঁজেন একটু মমতা, এক ফোঁটা মনোযোগ, আর মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বীকৃতি। কিন্তু আজকের বাংলাদেশের চিকিৎসা বাস্তবতায় সেই মানবিকতার আলো যেন নিভু নিভু প্রদীপ; ছুঁতে গেলেই নিভে যায়। একজন রোগীর অভিজ্ঞতা—বেলা দেড়টার অ্যাপয়েন্টমেন্ট, কিন্তু দেখা মিলল সাড়ে তিনটায়; আর ডাক্তার সাহেব সময় দিলেন মাত্র ‘তিন মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড’—কেবল তার নয়, কোটি মানুষের অভিন্ন ক্রন্দন। এই ছোট্ট সময়টুকুই যেন আজকের চিকিৎসাব্যবস্থার নতুন সংজ্ঞা: ‘সময়’ এখন সেবা নয়, এক ঠান্ডা বাণিজ্যের মুদ্রা।
যে পেশা একদিন ছিল মানবতার মহাকাব্য, তা আজ কোনো অদৃশ্য প্রলোভনের টানে রূপ নিয়েছে নিস্পৃহ বাণিজ্যে। ২০১৫ থেকে ২০২৫—এই দশ বছরে শহর জুড়ে হাসপাতালের অট্টালিকা যত উঁচু হয়েছে, চিকিৎসার নৈতিকতা ততই তলিয়ে গেছে। যে ডাক্তার একদিন গ্রামবাংলার চোখে ছিলেন "মানুষরূপী ঈশ্বর", আজ তিনি হয়ে উঠেছেন এক অদৃশ্য দেয়াল—এক পাশে বিপুল অর্থ, অন্য পাশে কমিশনের পর্বত—আর মাঝখানে ক্লান্ত, পরিত্যক্ত রোগী।
ঠিক যেমন জীবনানন্দ দাশ একবার লিখেছিলেন, “মানুষের ভিড়ে মানুষ খুঁজে পাওয়া বড় দায়”-সময়ের স্রোতে সেই কথাটি যেন আজ চিকিৎসার অঙ্গনেই সবচেয়ে নির্মমভাবে সত্য হয়ে উঠেছে। চিকিৎসা কি তবে সেবা নয়, মিনিটের খণ্ডে বিক্রি হওয়া এক বেদনাময় বাণিজ্য?
ক. খরচের বোঝা ও OOP-এর ঊর্ধ্বগতি: ২০২৫ সালের তথ্যানুসারে, স্বাস্থ্য খাতে আউট-অব-পকেট (OOP) বা ব্যক্তির পকেট থেকে খরচের হার প্রায় ৬৯.৫% থেকে ৭০% এর কাছাকাছি এসে ঠেকেছে। ২০১৫ সালেও এই হার ছিল প্রায় ৬৪%। WHO-এর মানদণ্ড থেকে এই হার অনেক বেশি—এটি প্রমাণ করে যে, চিকিৎসার বোঝা সাধারণ মানুষের কাঁধেই চাপানো হচ্ছে। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রধান কারণ হলো অপ্রয়োজনীয় ডায়াগনস্টিক টেস্টের পেছনে একজন রোগীকে মোট খরচের ২৫% থেকে ৩০% ব্যয় করতে হচ্ছে।
খ. ডাক্তার-রোগী বৈষম্য এবং অপেক্ষার প্রহর: ২০২৫ সালে ডাক্তার-জনসংখ্যার অনুপাত এখনো ১:১৬৫০-এর কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো এর অসম বণ্টন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে প্রতি ১০০০ জনে ১.৫ জন ডাক্তার পাওয়া গেলেও, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই অনুপাত ১:৬০০০-এরও বেশি। এক জরিপে দেখা গেছে, শহরের চেম্বারে একজন রোগী অ্যাপয়েন্টমেন্টের পরেও গড়ে ১.৫ থেকে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। এই দীর্ঘ অপেক্ষার কারণ হলো ডাক্তারদের 'ওভার-বুকিং' প্রবণতা—যেখানে প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ১৫-২০ জন রোগী দেখা সম্ভব হলেও, প্রায় ৩০-৪০ জনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়। এটি রোগীর রোগের করুণ অবস্থা বিবেচনা না করে, ডাক্তার কেবল অর্থের দিকে মনোযোগ দেন। এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রায় ২০% রোগী সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে পারেন না।
গ. কমিশনের চক্র ও ওষুধের বাজারজাতকরণ: রোগীকে যখন চাপ দিয়ে বলা হয়, "আমাদেরই হসপিটাল থেকে টেস্ট করুন, অন্য কোথাও করাবেন না", এর নেপথ্যে থাকে কমিশনের এক বিশাল চক্র। নির্ভরযোগ্য গবেষণায় দেখা গেছে, একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ২৫% থেকে ৫০% পর্যন্ত কমিশন পাওয়ার লোভে রোগীর পকেট খালি করতে দ্বিধা করেন না। শুধু টেস্ট নয়, ওষুধ কোম্পানিগুলোও ডাক্তারদের 'উপহার' দিয়ে প্রলুব্ধ করছে, যার ফলে ৬২% ক্ষেত্রে ডাক্তাররা অপ্রয়োজনীয় বা দামি ওষুধ প্রেসক্রাইব করছেন। রোগীর পূর্বের প্রেসক্রিপশনকে গুরুত্ব না দিয়ে নতুন টেস্ট দেওয়াটাই প্রমাণ করে যে, চিকিৎসকের প্রথম লক্ষ্যই থাকে এই কমিশন সিস্টেমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন।
বাংলাদেশের ডাক্তার তৈরির প্রক্রিয়াটি কঠিন হলেও, প্রতি বছর হাজার হাজার ডাক্তার পাস করার পরও কেন তাদের মানসিকতা এমন হয়? কারণটি খুব সরল: এখন ডাক্তারি আর সেবা নয়, দ্রুততম সময়ে অর্থ উপার্জনের অন্যতম সেরা উপায়।
২০২৫ সালের তথ্যে, যেখানে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মাসিক আয় বেসরকারি চেম্বারে ২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, সেখানে সরকারি হাসপাতালে তাদের বেতন তুলনামূলকভাবে কম। এই আয়ের বিশাল পার্থক্যই তাদের নৈতিকতা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। প্রায় ৮০% ডাক্তার সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারিভাবে প্র্যাকটিস করেন এবং ৫০% এর বেশি ডাক্তার দিনে গড়ে ৮-১০ ঘণ্টা চেম্বারে কাটান। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের নেশা তাদের মানবিকতাকে গ্রাস করেছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (BMDC)-এর বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও, নৈতিক স্খলনের দায়ে গত ১০ বছরে শাস্তিপ্রাপ্ত ডাক্তারের সংখ্যা ১০০-এর নিচে। এই উদাসীনতা অপরাধকে আরও উৎসাহিত করে।
রোগীর অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে ডাক্তারদের কাছে রোগ নির্ণয়ের চেয়ে, টেস্টের মাধ্যমে কমিশন নিশ্চিত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটাই তাদের মানসিকতার সবচেয়ে খারাপ দিক, যেখানে মানবিকতা ৯০% ক্ষেত্রে উপেক্ষিত।
এই অব্যবস্থাপনার জন্য শুধু ডাক্তাররা নয়, হাসপাতাল প্রশাসনও দায়ী। যেখানে একটি ডিজিটাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম রয়েছে, সেখানেও রোগীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এর কারণ হলো:
১. জরুরি অবস্থা ও ভিআইপি প্রথা: হাসপাতালের ভিআইপি প্রথা বা 'অবৈধ সিরিয়াল' বাবদ ১০% থেকে ২০% সিরিয়াল ম্যানেজ করা হয়, যা সাধারণ রোগীর সময়কে আরও বাড়িয়ে দেয়।
২. দুর্বল 'রিসিভ টাইম' ব্যবস্থাপনা: হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ 'রিসিভ টাইম' দিয়েও ডাক্তারকে অতিরিক্ত রোগী দেখার সুযোগ করে দেয়, যা একটি নৈতিক অন্যায়।
এই অব্যবস্থাপনার ফলস্বরূপ, রোগীরা ডাক্তার দেখাতে এসে জীবনের সেই কষ্টের সময়টুকু ভুলে গিয়ে কেবল আফসোস আর করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। এই হতাশা থেকেই ২০% রোগীর মধ্যে ডাক্তারের ওপর আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যায়, যা সামগ্রিক চিকিৎসা পরিবেশকে নষ্ট করে। চিকিৎসার শেষে রিপ্রেসেন্টেটিভদের ভিড় প্রমাণ করে, হাসপাতাল এবং মার্কেটিং চক্রের একটি গোপন যোগসাজশ রয়েছে, যেখানে ব্যক্তিগত অসুস্থতাকে একটি মুনাফা অর্জনকারী নাটকে পরিণত করা হয়েছে।
যদি বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকে, তবে ২০২৫ সাল থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে এই খাতের চিত্র কেমন হবে, তা একটি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়:
বছর OOP (ব্যক্তিগত খরচ) পূর্বাভাস ডাক্তার-রোগী অনুপাত পূর্বাভাস নৈতিক স্খলন/অনিয়ম বৃদ্ধি হারঅপেক্ষার গড় সময় (মিনিট)
২০২৫ ৬৯.৫% ১:১৬৫০ ১ (ভিত্তি) ১২০+
২০৩০ (যদি পরিবর্তন না আসে) ৭২.৫% ১:১৫৫০ (শহরকেন্দ্রিক) ১.৬ গুণ বৃদ্ধি ১৫০+
২০৪০ (যদি পরিবর্তন না আসে) ৭৬% ১:১৪৫০ (তবুও ঘাটতি) ২.২ গুণ বৃদ্ধি ১৮০+
২০৪০ (যদি সংস্কার আসে) ৫৯% ১:১২২০ (ভারসাম্যপূর্ণ) ০.৪ গুণ হ্রাস ৩৫-৪০
যদি এই অব্যবস্থাপনা চলতে থাকে, ২০৪০ সাল নাগাদ স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে এবং দরিদ্র মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার হার ১৫% বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে, যদি কঠোর সংস্কার আসে—যেমন ডাক্তারদের জন্য ন্যূনতম ১০ মিনিটের পরামর্শ সময় এবং কমিশন বন্ধে আইনি ব্যবস্থা—তাহলে ব্যক্তিগত খরচ ৬০% এর নিচে নামিয়ে এনে অপেক্ষার সময় ৩৫-৪০ মিনিটে নামিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আপামর রোগীর এক নীরব ক্রন্দন। ডাক্তার দেখানোকে একটি 'স্বর্ণের কপি' বা 'নাটক' বানানোর প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। চিকিৎসা কোনো ব্যবসা নয়, এটি মানুষের জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা। তিন মিনিট চল্লিশ সেকেন্ডের চিকিৎসা প্রমাণ করে, এই দেশে মানবিকতা এখন অর্থের কাছে বশ মেনেছে। এই করুণ চিত্র বদলাতে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ এবং ডাক্তার সমাজের আত্মসমালোচনা একান্ত প্রয়োজন। "যেখানে মানুষের জীবনের চেয়ে টাকার হিসেব বড়, যেখানে রোগীর অশ্রু কমিশন চক্রের কাছে মূল্যহীন; সেখানে ডাক্তার তুমি চিকিৎসক নও, তুমি এক নির্মম বণিক! আমাদের জীবন তোমাদের করুণার পাত্র নয়, অধিকার।
জেগে ওঠো বিবেকের ডাক্তার, ফিরিয়ে দাও মানবিকতার সেই পবিত্রতা, নতুবা এই জাতির অভিশাপ তোমার পেশার প্রতিটি প্রহরকে বিষাক্ত করে তুলবে। আর নয় অপেক্ষা, এবার লড়াই হোক সময়ের বিরুদ্ধে, টাকার বিরুদ্ধে, মানবিকতার পক্ষে!"
