হুন্ডিই তাহলে গ্রাস করছে প্রবাসীর রক্ত-ঘাম?

Bangla Post Desk
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান ঢাকা
প্রকাশিত:০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:২১ পিএম
হুন্ডিই তাহলে গ্রাস করছে প্রবাসীর রক্ত-ঘাম?
প্রতীকী ছবি

আষাঢ়ের কালো মেঘে ঢাকা আকাশটা যেন কোটি প্রবাসীর বিষাদের প্রতীক। পশ্চিমের উত্তপ্ত মরুভূমিতে কিংবা দূর ইউরোপের শীতপ্রধান নগরে, প্রতিটি শ্রমিক তার রক্ত-ঘাম দিয়ে যে টাকাটা পাঠায়, তা মূলত তার সন্তানের মুখের হাসি কেনার চুক্তি। কিন্তু সেই কষ্টার্জিত অর্থ যখন দেশে ফেরে, তখন 'হুন্ডি' নামক অদৃশ্য এক চোরাবালি সেই অর্থের একটা বড় অংশ গিলে ফেলে।

এই বেদনা শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডেও এক গভীর ফাটল সৃষ্টি করে। ২০০০ সালে যেখানে বার্ষিক রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল মাত্র ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে জানা যায় বাংলাদেশ ব্যাংক ডেটা থেকে, সেই সামান্য অর্জনই ছিল কোটি মানুষের নির্ভরতা। ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সালের এই এক দশকে, এই প্রবাসীদের রক্তক্ষরণ বেড়েছে কয়েক গুণ, যেন অর্থনীতির অদৃশ্য ক্ষত— যা দিনে দিনে আরও গভীর হচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা এই প্রবাসী আয়। ২০১০ সালে এটি এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১১.৬ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করতে শুরু করে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছিল। কিন্তু এই বিপুল আয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব দীর্ঘদিনের এক জটিল সমস্যা। ২০১৫ সালে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে এলেও, ২০২০ সালে কোভিড-পরবর্তী সরকারি প্রণোদনার কারণে তা এক লাফে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, যা ছিল সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় সহায়ক। ২০২৫ সাল নাগাদ বার্ষিক রেমিট্যান্স প্রবাহ ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি থাকবে বলে আমরা ধারণা করতে পারি বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্বাভাস পর্যালোচনা করে, এই বৃদ্ধি সত্ত্বেও হুন্ডির ছায়া কাটছে না।

অবৈধ হুন্ডি চ্যানেলে প্রতি বছর আনুমানিক ৪০ শতাংশ রেমিট্যান্স পাচার হচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, যা প্রায় ৮ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার এবং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে থামিয়ে দিচ্ছে। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশ, কিন্তু হুন্ডির ব্যাপক প্রসারের কারণে ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধি কমে ১০ শতাংশে নেমে আসে, যা দেশের অর্থনীতিতে নীরব ক্ষতের সৃষ্টি করে।

হুন্ডির এই কালো প্রভাব কেবল রেমিট্যান্সের সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। ২০২১ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যখন ৪৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল, তখন হুন্ডির কারণে রিজার্ভের উপর চাপ বাড়ায় ২০২৪ সালের মধ্যে তা ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিপোর্ট থেকে আমরা বুঝতে পারি। এই রিজার্ভ হ্রাস দেশের আমদানি ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করেছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। ২০২২-২০২৩ সালের দিকে ডলার সংকটের চরম সময়ে হুন্ডি মাফিয়ারা ডলারের দামকে খোলা বাজারে ১০ থেকে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেয়, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেয় এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। ২০২৫ সালে দেশের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে থাকার পূর্বাভাস রয়েছে বিবিএস ডেটা অনুযায়ী, যার অন্যতম কারণ এই অবৈধ লেনদেন এবং আর্থিক অস্থিরতা। ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে হুন্ডির কারণে সরকার প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে বলে বিভিন্ন আর্থিক গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, এই বিপুল অর্থ জনকল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

২০১৫ সালে বিদেশে কর্মী যাওয়ার বার্ষিক সংখ্যা ছিল ৫ লাখের নিচে, যা ২০২৫ সালে বেড়ে প্রায় ১২ লাখে পৌঁছালেও BMET রিপোর্ট দ্বারা প্রমাণিত, এর মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি অদক্ষ কর্মী, যা আয়ের স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। ২০২৫ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার ৬৭ শতাংশে পৌঁছালেও বিবিএস শ্রম জরিপ ২০২৫ থেকে জানা যায়, দক্ষ কর্মীর অভাবে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার হচ্ছে না।

আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনায় এক নতুন দিগন্ত উঁকি দিচ্ছে। ২০২৫ সালের পর থেকে ডিজিটাল ওয়ালেট এবং ব্লকচেইন-ভিত্তিক রেমিটেন্স চ্যানেলগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করবে। এর ফলে টাকা পাঠানোর খরচ অনেক কমে আসবে, যা ২০২৫ সালে গড়ে ৫ শতাংশের বেশি ছিল তা ২০৩০ সালের মধ্যে ২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক গাইডলাইন অনুসারে, যা প্রবাসীদের বৈধ পথে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করবে। অবৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠানো অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে, যার ফলে ২০৩৫ সাল নাগাদ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ২০ শতাংশে নেমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে, যা দেশের রিজার্ভকে আরও শক্তিশালী করবে।

প্রবাসীদের জন্য বিশেষ বিনিয়োগ বন্ড বা 'ডায়াস্পোরা বন্ড' চালু করার মাধ্যমে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবাসী বিনিয়োগকে দেশের উন্নয়নে সরাসরি কাজে লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে, যার মাধ্যমে বছরে ২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব, যা নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনে সহায়তা করবে। ২০২৫ সালে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) এর মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসার হার ছিল মাত্র ৮ শতাংশ, যা ২০৪০ সাল নাগাদ ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে, যা লেনদেনকে আরও সহজ করবে। তবে, এর জন্য সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি, কারণ ২০২৩ সালে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আত্মসাতের ঘটনা ১০ শতাংশ বেড়েছিল সাইবার নিরাপত্তা রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পারি, যা নতুন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ২০৪০ সাল নাগাদ প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে রেমিট্যান্সের লেনদেন সময় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, যা সুবিধাভোগীদের হাতে দ্রুত টাকা পৌঁছাবে।

এই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পেছনে লুকিয়ে আছে কিছু কালো মেঘ। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা বা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রবাসী আয়ের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২৯ সালে একটি বৈশ্বিক মন্দার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে, যা প্রবাসীদের ওপর নির্ভরশীল লাখো পরিবারকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেবে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ সরাসরি রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল জনমিতি গবেষণা থেকে জানা যায়। ২০২৫ সালে মাথাপিছু স্বাস্থ্যব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৫ মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৫ অনুসারে, রেমিট্যান্স কমলে এই ব্যয় বহন করা কঠিন হবে, যা স্বাস্থ্যসেবাকে সীমিত করবে।

অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধি এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাবও প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০২৫ সালে একজন অদক্ষ শ্রমিকের বিদেশ যেতে খরচ হয় তার বার্ষিক আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ অভিবাসন ব্যয় সমীক্ষা দ্বারা নির্ধারিত, যা তাদের আয়ের বড় অংশ ঋণ পরিশোধেই চলে যায় এবং তাদের পরিবারের কষ্ট বাড়ায়। ২০৪০ সাল নাগাদ দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি না বাড়ালে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হতে পারে, যেখানে বর্তমানে ৬০ শতাংশ কর্মী অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ। ২০৫০ সাল নাগাদ রেমিট্যান্স প্রবাহ স্থিতিশীল রাখতে হলে দক্ষ শ্রমিকের অংশ ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে, যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা অসম্ভব নয়। সরকার বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে, যা ২০২৫ সালে ২ শতাংশ ছিল, তা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব রয়েছে, যা হুন্ডিকে অপ্রাসঙ্গিক করবে। অভিবাসন প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও ব্যয়সাশ্রয়ী করা এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে জোর দেওয়া উচিত। ২০৩৫ সাল নাগাদ দক্ষ কর্মীর অংশ ৬৫ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (BMET) এর লক্ষ্য অনুসারে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের শ্রমের মূল্য বাড়াবে।

যদি এই সমস্যাগুলো সমাধান না হয়, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি এক কঠিন সংকটের মুখে পড়বে। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাবে, যা দেশের আমদানি ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেবে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৫০ শতাংশ, কিন্তু রেমিট্যান্সের অভাবে তা মেটানো কঠিন হবে। ২০৪০ সাল নাগাদ আমদানি কমানো না গেলে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি জিডিপির ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন। ২০২৫ সালে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ জিডিপির ৩১ শতাংশ হলেও, রেমিট্যান্স কমে গেলে তা ২০৩০ সালের মধ্যে ২৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা নতুন শিল্পায়ন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে এবং কর্মসংস্থান কমিয়ে দেবে। ২০৫০ সাল নাগাদ চরম দারিদ্র্যের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে এখনই এই সমস্যার সমাধান করা অপরিহার্য।

এই দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে জানে, সংগ্রাম করতে জানে। লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর বুকভরা ভালোবাসা আর রক্ত-ঘাম যখন দেশের অর্থনীতিকে প্রাণ দিচ্ছে, তখন সেই আবেগকে আমরা আর হুন্ডির হাতে হারাতে দিতে পারি না। সময় এসেছে প্রথা ভেঙে নতুনত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়ার, যেখানে প্রতিটি প্রবাসীর শ্রমের মূল্য দেওয়া হবে এবং তাদের পাঠানো অর্থ দেশের প্রকৃত উন্নয়নে সহায়ক হবে। আমরা বিশ্বাস করি, এই অসীম মানবিক শক্তি একদিন সকল অর্থনৈতিক অন্ধকারকে জয় করবে।

লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।