রিকশার ভিড়ে ঢাকা কি তবে অচল?
৫ আগস্ট ২০২৪। এই তারিখটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দ্বিধাবিভক্ত অধ্যায়। একদিকে, ১৭ বছরের পুরোনো শাসনের জীর্ণ কঙ্কাল ধসে পড়ল, অন্যদিকে ঢাকার বুকে জন্ম নিল এক নতুন ট্র্যাজেডি—লক্ষাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার নীরব দখল। সেদিন ঢাকার মানুষ ভেবেছিল তারা এক নতুন দিগন্তে আলো খুঁজে পেল, কিন্তু হায়! সেই আলোর নিচে ঢাকা পড়ে গেল ঢাকার চিরচেনা শৃঙ্খলা। এই শহর এমনিতেই রিকশার যন্ত্রণায় অভ্যস্ত ছিল, কিন্তু আগস্টের পরে মফস্বলের আনাচে-কানাচে থেকে যেন এক অপ্রত্যাশিত প্লাবন এলো– প্রশিক্ষণহীন, ধারণাহীন চালকের হাতে লাখ লাখ অটোরিকশা।
৫ আগস্টের পর প্রান্তিক এলাকা থেকে ঢাকায় আগত রিকশার সংখ্যা ১,০০,০০০ (এক লাখ) ছাড়িয়েছে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ৩০০% বৃদ্ধি। দৈনিক গড়ে ৫০০-৮০০ নতুন রিকশা ঢাকায় প্রবেশ করেছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। ঢাকার রাজপথ পরিণত হলো এক বিশালাকৃতির, ধীরগতির জটলার।
ঢাকার গতি এমনিতেই করুণ, ২০১৫ সালে প্রতি ঘণ্টায় যা ছিল প্রায় ১৫ কিমি, ২০২০ সালের মধ্যে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছিল ৬ কিমি-এ। কিন্তু আগস্ট ২০২৪-এর পর, অনিয়ন্ত্রিত রিকশার দাপটে তা নেমে এসেছে ৪.৫ কিমি-এর আশেপাশে।
কল্পনা করুন সেই স্কুলগামী শিক্ষার্থীর কথা, যে সঠিক সময়ে পরীক্ষা হলে পৌঁছাতে পারলো না, কারণ এই রিকশার ভিড়ে তার অফিসগামী বাবার গাড়িটি ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা ধরে আটকে ছিল। এই যানজটের কারণে ঢাকায় বছরে জিডিপির ৩% থেকে ৫% (প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার) আর্থিক ক্ষতি হয়। অথবা ভাবুন সেই মুমূর্ষু রোগীর কথা, যার জীবন বাঁচানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্সকে রাস্তায় কাটানো লাগলো আরও ২০-৩০ মিনিট বিলম্বিত হয়ে, যা মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে অক্ষমতার কারণ। সড়ক দুর্ঘটনার হার, যা আগস্টের আগে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছিল, তা এই অপরিকল্পিত আগমনের ফলে ২০% থেকে ২৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীর সংখ্যা আগস্টের পর ১৫% বেড়েছে, যার ৩০% এর বেশি রিকশা সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা। অপ্রশিক্ষিত চালকদের কারণে দিনে গড়ে ৫-১০টি বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটছে।

এই বিশৃঙ্খলার মূল দায় কার? শুধুই কি চালকদের? না। এই দায়ভার প্রধানত তিনটি স্তম্ভের ওপর—বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (BRTA), সিটি কর্পোরেশন এবং ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর। BRTA কর্তৃক এই বাহনগুলোর নিবন্ধনের সুনির্দিষ্ট নীতি না থাকা এই সমস্যার মূলে। সিটি কর্পোরেশনের হাতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিকশার সংখ্যা ১ লক্ষের কম হলেও, অবৈধভাবে চলছে ৫ লক্ষেরও বেশি রিকশা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শিথিলতা বা মনোযোগের পরিবর্তন এই অনিয়ন্ত্রিত প্রবেশকে উৎসাহিত করেছে। প্রভাবশালী মালিক সমিতিগুলো দৈনিক ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা চাঁদা তুলে এই অবৈধতাকে একটি 'বাস্তবতা' দিয়ে দিলো। রিকশা/ভ্যান মালিক সমিতিগুলোর প্রভাবশালী অংশ দ্বারা এই অবৈধভাবে দৈনিক/মাসিক চাঁদা আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় রিকশা চলাচলে দৃশ্যমান কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সমন্বিত গণপরিবহন পরিকল্পনার (যেমন: বাস রুট রেশনালাইজেশন) বাস্তবায়নে ধীরগতি এই রিকশাগুলোকে একটি আপাত সমাধান হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে।
রিকশার এই অনিয়ন্ত্রিত অনুপ্রবেশ কেবল রাস্তায় নয়, আঘাত হেনেছে ঢাকার সামাজিক ও পরিবেশগত কাঠামোতেও। গ্রামীণ এলাকা থেকে আসা চালকদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা নেই, ফলে ঢাকার বস্তিগুলোতে ভাড়া ১০% থেকে ১৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন বস্তি বা অস্থায়ী আবাসনের সংখ্যা আগস্টের পর ৫-৮টি নতুন এলাকায় তৈরি হয়েছে, যা শহরের পরিবেশগত চাপ বাড়াচ্ছে। এই চালকদের ৯৫ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সম্পর্কিত মৌলিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত।
সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো বিদ্যুতের চুরি। প্রতিটি রিকশা দৈনিক ২ থেকে ৪ ইউনিট বিদ্যুৎ অবৈধভাবে ব্যবহার করে। লক্ষাধিক রিকশার জন্য প্রতিদিন যে ২ লাখ থেকে ৪ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে, তা পিক-আওয়ারে লোডশেডিংয়ের পরিমাণকে ১০ থেকে ১৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে সরকার বছরে অবৈধভাবে ২০০ কোটি থেকে ৪০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে। অপরিকল্পিত চার্জিং গ্যারেজগুলো বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট এবং ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি ৩০% বৃদ্ধি করেছে। এছাড়াও, ৬ মাস থেকে ১ বছর পর ফেলে দেওয়া ব্যবহৃত ও নষ্ট ব্যাটারিগুলোর সীসা (Lead) দূষণজনিত পরিবেশগত ঝুঁকি ৫০% পর্যন্ত বাড়িয়ে তুলেছে, যা ঢাকা শহরের পরিবেশ দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত রিকশা গ্যারেজের জন্য জায়গা দখলের কারণে নগরীর খোলা স্থান (পার্ক বা মাঠ) ৮% কমে গেছে।
অন্যদিকে, ঢাকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার (২০১৫ সালে প্রায় ৮%) বজায় রাখার জন্য পরিবহন খাতে দ্রুত পরিবর্তন জরুরি। এই পরিস্থিতিতে, হঠাৎ করে ৫,০০,০০০ (পাঁচ লাখের বেশি) শ্রমজীবী মানুষকে কর্মহীন করা সামাজিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে। পরিবহন খাতে বেকারত্বের হার ১২% থেকে ১৫% পর্যন্ত বাড়তে থাকায়, এই রিকশাগুলো একটি আপাত সমাধান হিসেবে কাজ করেছে, যেখানে স্বল্প পুঁজির বিনিয়োগে দৈনিক ৮০০-১২০০ টাকা উপার্জনের সুযোগ মেলে।

তাহলে কি আমরা এদের রাতারাতি বন্ধ করে দেবো? মানবিকতার দিক থেকে তা সম্ভব নয়। আমাদের দায়িত্বশীলদের মানবিক ও স্থিতিশীল সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা শহরের মেইন হাইওয়েতে ১০০% রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে এবং উপশহর বা স্থানীয় সড়কের জন্য রুট ম্যাপ তৈরি করে তা কার্যকর করা। ৫০,০০০ চালককে বাস রুট রেশনালাইজেশন, মেট্রো রেল বা অন্যান্য সরকারি/বেসরকারি পরিবহন প্রকল্পে ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুক্ত করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে স্বল্পমূল্যে (যেমন দৈনিক ৳২০) অস্থায়ী ডরমিটরি বা আবাসন তৈরির পাইলট প্রকল্প শুরু করা আবশ্যক। নির্দিষ্ট স্থানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় 'চার্জিং স্টেশন' তৈরি করে সঠিক মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং অবৈধ সংযোগ ১০০% বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। রিকশা মালিকদের পুঁজি অন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায় বা ই-কমার্সের ডেলিভারি ভ্যান/সার্ভিসে বিনিয়োগের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ বা প্রণোদনা দেওয়া জরুরি। আইন লঙ্ঘনকারীদের জন্য কঠোর জরিমানা (যেমন, প্রথমবার ৳৫০০, দ্বিতীয়বার ৳১০০০) এবং পরবর্তীতে রিকশা জব্দ করার নীতি চালু করা দরকার।
আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ। আমরা যদি এই সমস্যাকে এখনই নিয়ন্ত্রণ না করি, তবে ২০২৫ সাল নাগাদ এই রিকশার সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। যদি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল থাকে, তবে ২০৩০ সাল নাগাদ তা ৮ লাখে পৌঁছে ঢাকার গতিকে কার্যত ২ কিমি/ঘণ্টায় নামিয়ে আনবে। ২০৪০ সালের সেই দুঃস্বপ্নের ঢাকা হবে পৃথিবীর সবচেয়ে অচল নগরীগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে পরিবেশ দূষণ, দুর্ঘটনা ও যানজটে জনজীবন স্থবির হয়ে যাবে। আমরা কি সেই ভবিষ্যৎ দেখতে প্রস্তুত?
"হে ঢাকা, তোমার বুকে যে হাজারো শ্রমিকের ঘাম আর সীসার বিষ জমেছে, সে কান্না বৃথা যেতে পারে না! আজ যে ট্র্যাফিক তোমার গতি রোধ করেছে, সেই জঞ্জাল সরাতেই হবে। আমরা আর চোখের জল ফেলবো না, আমরা চাই শৃঙ্খলা, চাই মানবিকতা—আমরা আমাদের প্রিয় শহরের শ্বাসরোধকারী এই দুঃস্বপ্ন ভেঙে দেবোই। আর কোনো অচল মুহূর্ত নয়, এখন শুধু পথ চলার সময়!"
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
বিপি/এনএস
