আঁধারের শহরে মানুষের কান্না কি আলো আনতে পারে?

Bangla Post Desk
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান ঢাকা
প্রকাশিত:০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৫ পিএম
আঁধারের শহরে মানুষের কান্না কি আলো আনতে পারে?
প্রতীকী ছবি

শুরুটা হোক আমাদের অমানবিক নগরজীবনের এক তিক্ত সত্য দিয়ে—রমিজ সাহেবের মেয়ে তিশার বিষণ্ণতা। জানুয়ারির ১ তারিখ, ভোর ৪:১৫ মিনিট। সাভারের শ্রমিক কলোনির সেই ছোট্ট রুমে তিশার ঘুম ভাঙে একরাশ মন খারাপ নিয়ে। ঘন পাহাড়ের মতো চেপে থাকা বহুতল ভবনগুলো তার জানালার আকাশটাকে চুরি করে নিয়েছে। ঢাকার প্রায় ৩৪ শতাংশ বাসাবাড়িতে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো নেই নগর উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন ২০২২, এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়, এটি লক্ষ লক্ষ তিশার মনের অন্ধকার। এই অন্ধকার যে শুধু স্থান দখল করে তা নয়, কেড়ে নেয় আত্মার শান্তি।

গ্রামের ৭২ শতাংশ বাড়িতে আলো পৌঁছালেও বিবিএস ডেটা ২০২২, শহরে তা মাত্র ৪২ শতাংশ; এই ৩০ শতাংশের ব্যবধানই আমাদের নগর জীবনের করুণ আর্তনাদ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডব্লিউএইচও রিপোর্ট ২০২০ বলছে, দেশের প্রায় ১৮.৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উদ্বেগ আর বিষণ্ণতার শিকার, আর এই অন্ধকারাচ্ছন্ন বাসস্থানই তাদের জীবনের বিষ ঢালছে।

 ২০২৫ সালে এসেও যখন মাথাপিছু স্বাস্থ্যব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৫ মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৫, তখন সামান্য আলো নিশ্চিত না করতে পারাটা আমাদের ব্যর্থতা নয় কি? রমিজ সাহেবের পরিবারে ৫ থেকে ৬ জন মানুষ এক রুমে থাকেন আবাসন ও জনস্বাস্থ্য জরিপ ২০২১, তাদের স্বপ্নগুলো যেন সেই ছোট জানালার ফাঁকেই আটকে আছে। ২০০০ সালে যেখানে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৫ শতাংশ, তা ২০১৫ সালে বেড়ে ৬.৯ শতাংশ হয়েছিল অর্থনৈতিক সমীক্ষা। কিন্তু এই উন্নতির বিপরীতে, বায়ুদূষণের হার ২০০০ সালের ১৫০ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ১৯০ হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন। ২০২৫ সালে সরকারি খাতে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ বেড়েছে ২০ শতাংশ জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬, কিন্তু এর বাস্তবায়ন হার এখনও ৩০ শতাংশের নিচে সিপিডি বিশ্লেষণ।

এই অন্ধকার যে কতটা নির্মম, তা বোঝাতে কোনো গবেষণার দরকার হয় না, দরকার হয় একটি মায়ের চোখের জল। "লাইটিং ইন দ্য হোম অ্যান্ড হেলথ" এর বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য জার্নাল কর্তৃক বিশ্লেষিত, ২০২৩ আমাদের শেখায়—আলোর অভাবে মস্তিষ্কে সেরোটোনিন কমে, জীবন গ্রাস করে গভীর বিষণ্নতা। যখন অল্প আলোয় দিন কাটে, রাতের নিস্তব্ধতাও রক্ষা পায় না—মানসিক রোগ নির্ণয়ের হার দ্রুত বাড়তে পারে। ২০২৫ সালে এসে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার ৬৭ শতাংশে পৌঁছালেও বিবিএস শ্রম জরিপ ২০২৫, এই নীরব বিষণ্নতা তাদের কর্মক্ষমতা ২২ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করছে শ্রমিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০২৩। এই অন্ধকারে যেন স্বপ্ন নয়, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফোটে।

 তবুও, এই অন্ধকারেও আশার বীজ বুনেছেন ডঃ ইউনূস তাঁর “গ্রামীণ ফোন লেডি” মডেলে। প্রযুক্তি ও মানবিক সহমর্মিতার হাত ধরে গ্রামীণ শক্তি মডেলের মাধ্যমে ২ লাখের বেশি বাড়িতে আলো পৌঁছেছিল গ্রামীণ শক্তি মডেল, ২০২৪। এখন শহরেও দরকার সেই মানবিক বিপ্লব। ২০২৫ সালে যখন খেলাপি ঋণ ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৫, তখন বুঝতে হবে এই বিপুল অর্থ দিয়ে কতগুলো ঘরে আলো ফিরিয়ে আনা যেত। আমাদের প্রয়োজন মানবিক স্থাপত্য বিপ্লব। ২০০০ সালে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল ৩৫ শতাংশ পরিবার পিডিবি, যা ২০২৫ সালে ৯৯ শতাংশে পৌঁছেছে সরকার ডেটা, কিন্তু বিদ্যুতের গুণগত মান এবং নিরবচ্ছিন্নতা এখনও ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে কনজুমার্স রাইটস রিপোর্ট ২০২৪।

এই প্রেক্ষাপটে আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকানো জরুরি। দুই হাজার চল্লিশের দিকে যখন আমরা ৮০০০ মার্কিন ডলার মাথাপিছু জিডিপি এবং ২ শতাংশ দারিদ্র্য হ্রাসের স্বপ্ন দেখছি পরিকল্পনা কমিশনের প্রক্ষেপণ, তখন বায়ুদূষণ ১৫০-এর নিচে নামিয়ে আনা এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫ শতাংশে উন্নীত করা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন জাতীয় শক্তি পরিকল্পনা ২০৪০। ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ৮.০ শতাংশে এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার ১০.০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। ২০২৫ সালে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৪ কোটি ছাড়িয়েছে বিটিআরসি, কিন্তু ডিজিটাল এই সংযোগও ঘরের ভেতরের অন্ধকার কাটাতে পারেনি। বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বাজেট মাত্র ০.৫ শতাংশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডেটা, ২০২৫, এই অবহেলা আমাদের প্রজন্মকে শেষ করে দিচ্ছে। ২০৪০ সালের মধ্যে দেশের শ্রমশক্তির ২০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদী মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ২০২৪—এই পূর্বাভাস আমাদের গালে থাপ্পড়।

রমিজ সাহেব ও তিশার মতো মানুষেরা তাদের দিনের শেষে ফেরা কোণটিতে একটুখানি আলোর ছোঁয়া পাক। এই অন্ধকার আমাদের চেতনাকে বিষাক্ত করে, স্বপ্ন ভেঙে দেয় ও প্রয়োজনে কাজ করার শক্তি কেড়ে নেয়। ২০২৫ সালের অর্থনৈতিক সংকটকালীন সময়ে ৫.৫ শতাংশ জিডিপি ধরে রাখলেও বাংলাদেশ ব্যাংক, আসল যুদ্ধটা এখন ঘরের ভেতরেই। যেথায় আলো ফিরে আসে, সেখানেই অন্ধকারের বিষণ্নতা নীরবে ছিন্ন হয়। শহরের আকাশ আজ সূর্য কাড়ুক; তবু, হৃদয়ের কুটিরে জ্বালো আলো—বিষাদ-ভীতি ভেঙে জাগুক তারুণ্য, এ মাটি আলোরই তো কাঙ্গাল!

লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।