সময় ও স্রোত কারও জন্য থেমে থাকে না
শ্রীচরণেষু দাদা-২৪
সময় ও স্রোত কারো জন্য থেমে থাকে না। এই সত্যিটাই মানুষের জীবনের সবচেয়ে নির্মম শিক্ষা। জীবন যেন এক অনবরত প্রবহমান নদী, কখনও শান্ত, কখনও উত্তাল, কখনও স্নিগ্ধ আলোয় ভরা, কখনও অন্ধকারে ঢেকে যায়। কারও সুখ, কারও বেদনা, কারও প্রার্থনায়, এই সব কিছু পেরিয়ে সময় চলে যায় নিজের গতিতে।
মানুষ ভাবে, সব কিছু নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু সময় হাসে তার মুখে। হঠাৎ এক ঝটকায় ভেঙে দেয় সযত্নে গড়া স্বপ্ন, বদলে দেয় জীবনের মানে।
সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল অরুণ দাদার জীবনে। জীবনের গতি ছিল মসৃণ। কিন্তু কে জানত, সেই নিরবচ্ছিন্ন সময়ের স্রোতে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা লেখা আছে। অরুণ দাদার জন্য, আর তাঁর পুরো পরিবারের জন্য। শুভ্রের আজও সেই দিনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে।
১৯৯৫ সালের জুলাই মাস।
বিকেলের দিকে লন্ডনের আকাশে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল, সেই রকম বৃষ্টি, যা শহরটাকে যেন এক কোমল বিষণ্ণতায় ভিজিয়ে দেয়। শুভ্র সেদিন অফিসের কাজ আগেভাগেই শেষ করে বাড়ি ফিরে আসে। হাতে এক কাপ গরম চা, জানালার ওপাশে টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ, আর ফোনের ওপারে বৌদির পরিচিত কণ্ঠস্বর, অরুণ দাদার স্ত্রী, যাকে শুভ্র সারাজীবন শ্রদ্ধা আর স্নেহে নিজের মায়ের মতো ভালবেসেছে।
শুভ্র তখনও অবিবাহিত, কিন্তু বিয়ের দিন ক্ষণ সব ঠিক হয়ে গেছে। আগস্টের প্রথম দিকেই অনুষ্ঠান। আজকের ফোনটা ছিল সেই খবরটা জানানোর জন্যই।
“বৌদি, একটা সুখবর দেব?”
ওপাশে হাসির ঝলক।
“কিতা সুখবর দিবেন?”
শুভ্র একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিল,
“বিয়ের তারিখ ঠিক হইছে বৌদি। আগস্টের শুরুতেই বিয়ে করছি।”
বৌদি হেসে উঠলেন, সেই মায়ামাখা পরিচিত হাসি—
“খুব বালা খবর দিছেন। আপনি কবে দেশে আইবেন? আপনার দাদা প্রতিদিনই বলে, শুভ্র কবে আইবো! কতদিন দেশে আসে ন। এইবার বিয়া থা কইরা নতুন বউ নিয়া আইয়েন!”
শুভ্রও হেসে বলেছিল,
“আসবো বৌদি, সব কিছু একটু গুছিয়ে নেই।”
ওপাশে আবার একবার হাসির ঝংকার, তারপর নিঃশব্দে ফোনটা কেটে গেল।
সেই হাসিমাখ কথাগুলোই ছিল শেষ কথা।
আর এক ঘণ্টা পরেই পৃথিবী যেন থেমে গেল—
সময় থেমে দাঁড়াল, কিন্তু কেবল এক মুহূর্তের জন্য, বাকি জীবনটা বদলে দেওয়ার মতো।
পুরনো ঢাকার কাঁচাবাজার। দুপুরের গরম তখনও পুরোপুরি নামেনি। বাজারের ভেতর ঘন গন্ধ। শাকসবজির, মাছের, মাটির, ঘামের মিশ্রণে ভারী হয়ে আছে বাতাস। চারদিক থেকে হাঁকডাক ভেসে আসছে—
“বেগুন দশ টাকা কেজি!”
“তাজা ইলিশ নেন আপা!”
“টমেটো দেখেন টমেটো!”
“আপা, কি লাগবো?”
অরুণের স্ত্রী সেদিন একাই বেরিয়েছিলেন বাজারে। সঙ্গে ছিল ছোট্ট সুমন। শুভ্রর ভাগিনা, বয়স তখন সাত-আটের বেশি নয়। শহরে এসেছে বাবার চিকিৎসার জন্য, মাও এসেছে। অরুণ দাদার এখানেই উঠেছে। কয়েকদিনের জন্য থাকবে বড় মামার বাসায়। বুদ্ধিমান, চঞ্চল ছেলে। স্কুলে ভালো পড়ে, সবার প্রিয়।
বৌদি হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
“তুই তো এখন বড় হয়ে গেছিস, সুমন। তুই নাকি স্কুলে এবার প্রথম হইছিস?”
সুমন একটু গর্ব মেশানো হাসি দিয়ে উত্তর দিল,
“হ্যাঁ, মামী।”
বৌদি মমতাভরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ভালা কইরা পড়াশুনা করিস।“
বাজারের ভেজা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুমনের চোখ ঘুরছে এদিক-ওদিক। তাজা সবজির রং, মাছের ঝাঁপি, মানুষের চিৎকার, ভ্যাপসা গরমে ভেজা বাতাস, সব কিছুই তার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা।
সে খুশিতে বলল,
“মামী বাজারটা কত মজার!”
বৌদি হেসে বললেন,
“ঢাকা সবসময়ই এমন, দেহসনা কত্তো মানুষ”
তারপর বললেন,
“চল, ওই দোকানটা থেকে ইলিশটা দেখি।”
এই সাধারণ, উষ্ণ মুহূর্তটুকু তখনও কেউ জানত না, একটি জীবনের সবচেয়ে অমোঘ স্মৃতি হয়ে থাকবে চিরদিনের জন্য।
বৌদি কপালের হালকা ঘামটুকু আঙুলের ডগায় মুছে নিয়ে থমকে দাঁড়ালেন মাছের দোকানের সামনে। বাতাসে কাঁচা মাছ, নুন আর রোদে পচা বরফের গন্ধ মিশে ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশ।
“ভাই, এই ইলিশটা একটু ওজন কইরা দামটা কইবেন?” — শান্ত গলায় বললেন তিনি।
দোকানি হাসিমুখে তাজা রুপোলী ইলিশটা তুলতেই—
হঠাৎ যেন বাতাস থেমে গেল।
বৌদির মুখখানা অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল, চোখ দুটো ফ্যাকাসে হয়ে উল্টে গেল উপরের দিকে।
ডান হাতটা কাঁপতে কাঁপতে নিস্তেজ হয়ে ঝুলে পড়ল পাশে। ঠোঁট বেঁকে গেল একপাশে, মুখ থেকে অস্পষ্ট একটা শব্দ বেরোল—
“আআহ্—!”
চারপাশের মাছওলা, ক্রেতারা থম মেরে তাকিয়ে রইল।
ইলিশটার চকচকে আঁশের মতোই জমে গেল মুহূর্তটা। সময় যেন এক নিমেষে দাঁড়িয়ে পড়ল!
সুমন মামীর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে বলল, “মামী! কী হইছে তোমার?”
কোন উত্তর নেই।
সুমন মামীকে চোখের সামনে ঢলে পড়তে দেখলো। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লো বাজারের ভেজা মাটিতে। চারপাশে ছিটকে পড়ল দোকানির কিছু মাছ, পানি। মানুষের পা ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল এক আঁচল। একটি হাত এসে পড়লো সুমনের পায়ে।
দোকানিরা চিৎকার করতে লাগল, “পানি দাও! কেউ একটা রিক্সা ডাকো!”
একজন পানি ছিটাল মুখে, আরেকজন রিক্সা থামাতে ছুটল।
সুমন তখন কাঁদছে হাউমাউ করে, “মামী, মামী!”
সে বুঝতেই পারছে না কী করবে। তার ছোট্ট হাতটা মামীর গালে রাখতেই টের পেল, গালটা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। একজন বৃদ্ধ দোকানি এগিয়ে এসে আরেক জনকে বলল, “ও ভাই, তাড়াতাড়ি হাসপাতাল নেন! স্ট্রোক হইছে মনে অইতাছে!”
দু’জন লোক মিলে তাঁকে উঠিয়ে বেবি ট্যাক্সিতে তুলল। সুমন ট্যাক্সির ভিতরে মামীর কোলে মুখ গুঁজে কাঁদছিল।
রাস্তায় গাড়ি ছুটছে, হর্ন বাজছে, আর সুমনের কানে শুধু একটা শব্দ, মামীর নিঃশ্বাসের ভারী ওঠানামা।
গাড়ি থামল মিটফোর্ড হাসপাতালে। নার্সরা ছুটে এলো।
মিটফোর্ডে খবর পেয়ে অরুণ দৌড়ে এলেন। সবাই ছুটাছুটি করে এলো। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে এম্বুলেন্সে করে পিজিতে নেওয়া হলো।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো। ডাক্তার চুপচাপ বললেন, “ম্যাসিভ ব্রেইন স্ট্রোক”
অরুণ কেমন যেন নিঃশব্দ হয়ে গেলেন। তাঁর সামনে স্ত্রী অকেজো দেহে শুয়ে আছেন, চোখ খোলা কিন্তু দৃষ্টি শূন্য।
তারপর ধীরে ধীরে স্ত্রীর পাশে বসলেন, হাত ধরলেন, ফিসফিস করে বললেন, “তুমি চিন্তা করো না… আমি আছি। তোমাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাবো।”
সেই বিকেলের কাঁচাবাজারের দৃশ্যটি যেন আর কোনোদিন মুছে যায়নি কারও স্মৃতি থেকে।
বাজারের ভেজা গন্ধ, কোলাহলের মধ্যে পড়ে থাকা এক নারী, আর ছোট্ট সুমনের ফোঁপানির আওয়াজ—
সবকিছু মিলেমিশে হয়ে গেল এক অমোঘ মুহূর্ত, যা বদলে দিল অরুণের গোটা জীবন। সেই মুহূর্তে সময় থেমে গিয়েছিল।
শুধু বেঁচে ছিল ভালোবাসা, নিঃশব্দ, অসীম, আর অনন্ত।
রাত পেরিয়ে সকাল হলো। বৌদি এখনো নিথর। মেশিনের আলো টিমটিম করছে, স্যালাইনের নল ঝুলছে, আর অরুণ তাঁর হাত ধরে বসে আছে। ডাক্তার এসে বললেন, “উনি নড়া-চড়া করতে পারবেন না,কথা বলতে পারবেন না, নিজের হাতে খাওয়া দাওয়া করতে পারবেন ন। কিন্তু উনি সবই শুনতে পারবেন, বুঝতে পারবেন, অনুভব করতে পারবেন।“
অরুণ ধীরে ধীরে স্ত্রীর কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি আছি, ভয় পেয়ো না।”
স্ত্রীর চোখের কোণে তখন এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।সেই ছিল তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া,যা হয়ে রইল পরবর্তী তেইশ বছরের একমাত্র ভাষা।
বছরগুলো গড়িয়ে যেতে লাগল। হাসপাতালের ঘর থেকে ধীরে ধীরে তাঁদের বাসার একটি রুমে স্থান হলো। বৌদি তখন সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। নড়াচড়া নেই, কথা নেই, চোখও অন্ধ, কিন্তু তাঁর কান এখনো শোনে, মন এখনো বোঝে। প্রতিদিন সকালে অরুণ তাঁকে স্নান করিয়ে দেন, মুখে তেল মাখান, চুল আঁচড়ে দেন। ফুল এনে পাশে রাখেন। তারপর চুপচাপ বসে গান গেয়ে শোনান, “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে…”কখনো বা “মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে…।“ গানের প্রতিটি শব্দ যেন তাঁর শূন্য ঘরে নরম আলো ছড়িয়ে দেয়।
রাত নামলে বৌদির ঘর থেকে টুকটুক শব্দ আসে। সেটা অরুণের চেয়ারের শব্দ, যেখানে সে প্রতিদিন বসে স্ত্রীর পাশে গল্প করে। নিজের জীবনের, সন্তানদের, শুভ্রর খবর বলে। বৌদি কিছুই বলতে পারেন না, কিন্তু অরুণ জানে, তিনি শুনছেন। মাঝে মাঝে স্ত্রীর ঠোঁট নড়ে, শব্দ হয় না, তবু অরুণ বলে, “তুমি কথা বলো, আমি শুনেছি।” এভাবেই কেটে যায় বছর, ঋতু, সময়।
সন্তানরা বড় হয়, সংসার গড়ে, নাতি-নাতনির কোলাহলে ভরে ওঠে বাড়ি। তবুও অরুণের সকাল-সন্ধ্যা একই ছন্দে বাঁধা থাকে। একই সময়ে ওষুধ, একই সময়ে রেডিও খুলে পুরনো গান, একই সময়ে বারান্দার চেয়ারে বসে সেই শূন্য চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে থাকা।
অরুণ সন্ধ্যা নামলেই ধীরে ধীরে বলে ওঠে—“ও ঘুমায় না, আমি কেমনে ঘুমাই?”
শহরের উৎসব, বিবাহ, পারিবারিক আমন্ত্রণ, সবই তার কাছে অচেনা শব্দের মতো মনে হতে লগলো।
বাড়ির লোক বলে,“দাদা, আপনি নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন।”
অরুণ শুধু মৃদু হেসে বলে,“ভালোবাসা কষ্ট নয়... এটা শ্বাসের মতো।”
তারপর নিঃশব্দে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেখান থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আলো পড়ত তাঁর মুখে। কখনো গভীর কণ্ঠে গান গায়।
এভাবেই পেরিয়ে যায় তেইশ বছর। বসন্ত আসে, বর্ষা যায়, উৎসবের ঢাক বাজে। কিন্তু অরুণের ঘরে সময় থেমে থাকে এক নিঃশব্দ ছবির মতো।
২০১৮ সালের এক শীতের ভোরে হঠাৎ অরুণের ঘুম ভেঙে যায়। জানলার ফাঁক দিয়ে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একফালি আলো ঢুকে ঘরে। অরুণের বুকের ভেতর কেমন একটা ঠাণ্ডা শূন্যতা। সে তাড়াতাড়ি উঠে স্ত্রীর দিকে তাকায়।
তার হাতটা ধরতেই শরীরটা যেন পাথর হয়ে গেলো। ঠাণ্ডা, অথচ মুখে এক অদ্ভুত শান্তি। ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি, চোখের কোণে একফোঁটা জল, যেন চুপিচুপি শেষ বিদায় বলে গেছে।
অরুণের কণ্ঠ যেন হঠাৎ শুকিয়ে যায়। ঠোঁট কাঁপে, শব্দ বেরোয় না। তারপর হঠাৎ সে স্ত্রীর নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে হু-হু করে কেঁদে ওঠে—
“কেন গেলে তুমি! কেন আমাকে একা রেখে গেলে?”
সে স্ত্রীর ঠাণ্ডা হাত দুটি নিজের কোলের ওপর তুলে নেয়, বুকের কাছে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“তুমি তো বলেছিলে, আমরা একসাথে বুড়ো হবো… আজ আমাকেই একা ফেলে দিলে। একবার ডাকলে না, একবারও না!”
তার কণ্ঠ ভেঙে যায়। হঠাৎ সে ঘরের বাইরে চিৎকার করে ওঠে—
“রূপা! রুপা! ওরে তোরা তাড়াতাড়ি আয়। তোদের মা… তোদের মা কিছু বলছে না রে।”
রূপা ছুটে আসে, সবাই আসে।
অরুণ কান্নার ভেতরেই বলে চলে—
“তোদের মা আমাকে ছেড়ে চলে গেল… আমি তো বলেছিলাম, আমিও যাব সাথে… তুমি একা কীভাবে গেলে রে?”
রূপা কাঁপতে কাঁপতে মায়ের গাল ছোঁয়, “মা… চোখ খোলো না মা, আমি এখানে।”
অরুণ মেয়ের কাঁধে হাত রাখে, তার চোখও লাল হয়ে গেছে।
“ও আর ফিরবে না রে, মা… ও এবার শান্তিতে ঘুমোচ্ছে… কিন্তু আমার তো শান্তি গেল।”
রূপা ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর অরুণ মায়ের নিথর শরীরের পাশে বসে বিড়বিড় করছে।
বাইরের কুয়াশা ভোরের আলোকে ঢেকে দিয়েছে। ঘরের মধ্যে শুধু কান্নার শব্দ, দোতলার দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে—
এক পুরুষের অসহায় চিৎকার,
“আমাকে কেন ফেলে গেলে তুমি… কেন?”
২০১৮ সালের সেই শীতের ভোর ছিল অদ্ভুত নীরব। জানলার ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় অরুণের বুকের ভেতর একটা অজানা শূন্যতা ঢেউ খেল। সে ধীরে ধীরে স্ত্রীর হাত ধরতেই চমকে উঠল।
শরীরটা ঠাণ্ডা, অথচ মুখে অদ্ভুত শান্তি। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি, চোখের কোণে জমে থাকা একটি বিন্দু জল, যেন নিঃশব্দে বলে গেছে শেষ বিদায়।
অরুণ কিছু বলতে পারছিল না। কণ্ঠ শুকিয়ে এল। তারপর হঠাৎ তাঁর বুক ফেটে এল কান্নায়।
“তুমি গেলে কেন… আমাকে একা রেখে গেলে কেন?”
সে স্ত্রীর ঠাণ্ডা হাত দুটি নিজের কোলের ওপর তুলে নেয়, বুকের কাছে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“তুমি তো বলেছিলে, আমরা একসাথে বুড়ো হবো… আজ আমাকেই একা ফেলে দিলে। একবার ডাকলে না, একবারও না!”
তার কণ্ঠ ভেঙে যায়। হঠাৎ সে ঘরের বাইরে চিৎকার করে ওঠে—“রূপা! রুপা! ওরে তোরা তাড়াতাড়ি আয়। তোদের মা… তোদের মা কিছু বলছে না রে।”
রূপা ছুটে এল। ঘর ভরে উঠল কান্নার শব্দে, কুয়াশার মতো ভারী, অচেনা।
অরুণ শুধু বলছিল—
“ও এখন শান্তিতে ঘুমোচ্ছে… কিন্তু আমার তো শান্তি গেল রে।”
গ্রামের বাড়ীতেই অন্তোষ্টিক্রিয়া হয়। সবাই আবার ফিরে আসে ঢাকায়। একদিন এক রাতে পুরনো ঢাকার বাসায় একা বসে ছিল অরুণ। টেবিলের উপর স্ত্রীর পুরনো ছবি, একখানা সাদা শাড়ি আর ফুলের মালা। জানালার বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল ধীরে ধীরে। সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি না থাকলেও আমার সকাল-সন্ধ্যা তোমার সাথেই। তুমি তো এখনো এখানেই আছো, আমার নিঃশ্বাসে।” তারপর জানালার দিকে তাকিয়ে আবার ফিসফিস করে বলল, “তুমি আমার আলো। আমি আসছি তোমারই পথে।”
সেই রাতের পর থেকেই অরুণের ভেতরের আলো ধীরে ধীরে নিভে যেতে লাগল। শরীর ক্লান্ত, চোখে শূন্যতা, কিন্তু মুখে সবসময় একটা শান্ত হাসি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, “সে তো এখানেই আছে।”
রুপা বাবাকে নিয়ে চলে আসে নতুন ঢাকায়। সেখানেই শেষের কয়েক বছর মেয়ে রুপার সাথেই কাটায়।
বছর খানেক পর অরুণেরও মৃত্যু হলো নিঃশব্দে।
লন্ডনে খবরটা পাওয়ার পর শুভ্র অনেকক্ষণ স্থির বসে রইল। জানালার বাইরে হালকা বৃষ্টি—
ঠিক সেই দিনের মতো, যেদিন বৌদির সাথে শেষ কথা হয়েছিল।
তারপর সে চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। মনে হচ্ছিল, দূরে কোথাও বৃষ্টি মিশে যাচ্ছে হাসির শব্দে। বৌদির সেই নরম হাসি, যা একদিন থেমে গিয়েছিল কিন্তু আজও শোনা যায় বাতাসে।
বৃষ্টির শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল দূরের নিস্তব্ধতায়। শুভ্র জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল দীর্ঘক্ষণ। তার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা যেন একটু থেমে গেছে, ঠিক যেমন থেমেছিল সেদিন, ১৯৯৫ সালের সেই দিন। কত বছর কেটে গেছে, কিন্তু সময়ের সেই এক মুহূর্ত এখনো তার বুকের গভীরে জমে আছে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও জানালার কাচে ছোট ছোট ফোঁটা ঝুলে রইল, যেন বৌদির হাসি আর দাদার অশ্রু একসাথে মিশে তৈরি করেছে সময়ের এক চিরন্তন চিহ্ন।
শুভ্র ধীরে ধীরে ডেস্কের দিকে গেল। টেবিলের কোণে পড়ে আছে শুভ্রের পুরনো একটি ডায়েরি। ডায়রিটি খুলতেই চোখে পড়লো ভাঁজ করা পুরনো একটি চিঠি। অরুণ দাদা লিখেছিলো শুভ্র যখন মস্কোতে ছিলো। চিঠির শেষ অংশে এক জায়গায় লেখা—
“ভালোবাসা মানে প্রার্থনা নয়, প্রতিদিনের শ্বাস নেওয়া।
যাকে ভালোবাসো, তাকে হারিয়েও বাঁচতে হয় তার ভিতরেই।”
শুভ্র ডায়েরিটা বন্ধ করল আস্তে করে, বুকের কাছে তুলে নিলো। তার চোখে তখন জল, কিন্তু সেই জলে কোন হাহাকার নেই, আছে এক শান্ত, দীপ্ত কৃতজ্ঞতা। বাইরে আকাশে আবার মেঘ জমছে। বৃষ্টির গন্ধ মিশে যাচ্ছে বাতাসে। আর শুভ্রর কানে যেন আবার ভেসে আসে সেই কণ্ঠস্বর। বৌদির নরম হাসি, দাদার নিঃশব্দ ফিসফিসানি।
সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল,
“সময় তো থামে না, কিন্তু তোমরা থেমে গেলে একে অপরের ভেতর, ভালোবাসার সবচেয়ে নির্মল জায়গায়।”
দূরে হঠাৎ এক টুকরো আলো ফুটে উঠল আকাশের গাঢ় মেঘের ভেতর থেকে। শুভ্র বুঝতে পারলো, প্রেম মরে না, কেবল আকাশ বদলায়। জীবনের সমস্ত সাফল্য, নাম, অর্থ, সবকিছু মিলিয়েও এই এক মুহূর্তের ভালোবাসার মতো সত্য আর কিছু নেই। সময় তাকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে, কিন্তু ভালোবাসা তাকে ফিরিয়ে এনেছে শুরুতে, যেখানে কেবল এক হাসি আর এক নিঃশব্দ প্রার্থনা।
মনে হলো, সময় তার বয়ে চলা বন্ধ করেনি, কিন্তু অরুণ দাদা ও বৌদির ভালোবাসা সময়ের ওপারেই একটি অমর স্থির নদী হয়ে রয়ে গেছে। চিরন্তন, অনন্ত, এবং অবিনশ্বর।
সময় থামে না, কিন্তু কিছু ভালোবাসা সময়কেও থামিয়ে দেয়।
হঠাৎ সুতপার আওয়াজ শুনতে পেলো শুভ্র।
(শেষ পর্ব)
লেখক: শিক্ষক, গবেষক ও কলামিষ্ট।
