বিশ্বাসই এখন আসল বিক্রয় পণ্য?

Bangla Post Desk
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান
প্রকাশিত:১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৬ পিএম
বিশ্বাসই এখন আসল বিক্রয় পণ্য?
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান।ছবি: সংগৃহীত

এ যেন আস্থার এক হারানো মানচিত্রের অনুসন্ধান—মানব মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা সম্পর্কের সেই সূক্ষ্ম সেতুবন্ধনের খোঁজ। চারপাশে তাকালেই দেখা যায় এক করুণ দৃশ্যপট—অসংখ্য মানুষ, যাদের হাতে আছে অসাধারণ পণ্য বা সেবা, অথচ তারা পৌঁছাতে পারছেন না মানুষের অন্তরে। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে বিক্রয় মানে এখনো জোরজবরদস্তি, এক অনবরত চাপ—যেখানে বিশ্বাস হারিয়ে যায়, আর সংযোগ হয়ে পড়ে নিঃশব্দ বাণিজ্য।

এ ধারণাটিই আমাদের ব্যর্থতার মূল কারণ। বিক্রয় বা 'সেলস'-এর প্রকৃত অর্থ হলো—ভালোবাসার ছোঁয়ায়, বিশ্বাসের বুননে—মানুষকে এমন এক বিন্দুতে নিয়ে যাওয়া, যেখানে সে নিজেই উপলব্ধি করে যে তার এই পণ্যটি খুব প্রয়োজন, সে স্ব-ইচ্ছায় তা কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই দু'য়ের মধ্যে যে বিশাল মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব, তা বুঝতে না পারলেই আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। একটা ইন্টারভিউ ক্র্যাক করা থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবনে মনের কথা বোঝানো পর্যন্ত, এই দক্ষতা আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা দেখেছি, জীবনে সফল মানুষ প্রায়শই এমন একটা ফল লাভ করেন, যা তিনি চেয়েছিলেন—আর অন্যরা বুঝতেও পারে না যে, কেন এমনটি হলো।

বিক্রয় বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রথম শর্তটিই হলো—'বিক্রি করা বন্ধ করুন, সমাধান করা শুরু করুন।' আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল হলো বেশি কথা বলা। আমরা যেন এক নিরন্তর ধারায় নিজেদের কোম্পানির জন্মকথা, ইতিহাস, নিজেদের গুণগান গেয়ে চলি। আমরা ভাবি, যত তথ্য দেব, ক্রেতা তত কনভিন্সড হবেন। কিন্তু ক্রেতা আপনার অতীত জানতে চান না, তিনি চান তার বর্তমানের যন্ত্রণার মুক্তি। জিগ জিগলারের সেই অমর উক্তিটি এখানে স্মরণীয়: ‘আপনার জীবনে যা চাইছেন, তার সবই আপনি পাবেন, যদি আপনি অন্য মানুষকে তাদের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেতে সাহায্য করতে পারেন।’

আমাদের কাজ হলো সেই যন্ত্রণার জায়গাটা খুঁজে বের করা। আমরা এখন থেকে পণ্য বেচবো না, বরং তার সমস্যার কারণটা মনোযোগ দিয়ে শুনবো এবং সেই সমস্যার একটি সঠিক ও কার্যকর সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবো। এটিই স্বয়ংক্রিয় বিক্রয়ের পথ। এই প্রসঙ্গে আসে সেই বিখ্যাত ৮০/২০ নীতি। আমরা বহু গবেষণায় দেখেছি, একটি সফল সেলস মিটিংয়ে বিক্রেতাকে অবশ্যই ২০% সময় কথা বলতে হবে এবং ক্রেতাকে ৮০% সময় কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। আমরা যেন সবসময় প্রশ্ন করি: ‘আপনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?’, ‘এই সমস্যাটি সমাধান হলে কী পরিবর্তন আসবে?’, ‘আগে কী চেষ্টা করেছিলেন?’—এই প্রশ্নগুলো কাস্টমারকে তার গল্পের গভীরে নিয়ে যায়, তাকে তার স্বপ্নের কথা বলতে বাধ্য করে। কাস্টমার যখন নিজেই হিসাব করে বলে যে আপনার সেবা পেলে তার লাভ কত হবে, তখন বিক্রয়ের কাজ অর্ধেক হয়ে যায়।

মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষেত্রে ব্রায়ান ট্রেসির এই সূত্রটি ধ্রুব সত্য—সিদ্ধান্ত প্রথমে আবেগ দিয়ে আসে, যুক্তি আসে তাকে ন্যায্যতা দিতে। আমরা প্রথমে আবেগের বশে একটি পিৎজা অর্ডার করে ফেলি, তারপর যুক্তি সাজাই—আরে! গত দুই মাস তো খাইনি, এটা 'চিট মিল' হিসেবে চলতেই পারে। একজন সফল বিক্রেতা হিসেবে, আপনাদের দায়িত্ব হলো—প্রথমে আবেগের জায়গাটিতে আঘাত করে তাকে কেনার সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করা। একবার সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়ে গেলে, এরপর লজিক বা যুক্তি দিয়ে তার আবেগের সিদ্ধান্তকে মজবুত করা।

এখানেই আসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল—জি-হুজুর না হয়ে তর্ক করা। অনেকে ভাবেন, ক্লায়েন্ট যা বলছে, সব মেনে নিলেই বুঝি ডিল ক্লোজ হবে। এটি ভুল! ক্লায়েন্টরা বরং সেই বিক্রেতাদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন, যারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন এবং বলেন, "না ভাই, আপনি যেটা ভাবছেন, সেটা সঠিক পথ নয়, বরং এই পথে গেলে আপনার সত্যিকারের উপকার হবে।" যে মানুষটি নিজের পজিশনের ব্যাপারে স্ট্রং অপিনিয়ন দেয়, সেই মানুষটিই সেলসে সবসময় জয়ী হয়।

বিক্রয়ের দুনিয়ায় অ্যালেক্স হরমোজির মতো আধুনিক বিশেষজ্ঞদের আলোচনা আমাদের শেখায়, একটি অফারকে কীভাবে অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে হয়। একেই বলা হয় 'গ্র্যান্ড স্ল্যাম অফার'। আপনার পণ্যের দাম বা ছোটোখাটো খুঁত গ্রাহক ভুলে যাবে, যদি আপনার অফারটি এত শক্তিশালী হয় যে তা ঝুঁকিহীন মনে হয়। শুধু 'ফেসবুক ম্যানেজ করে মাসে ১০ হাজার টাকা দিন' বললে কাজ হবে না। বরং বলুন: ‘আমি আপনার জন্য দুই মাস বিনামূল্যে কাজ করব। এই সময়ে আমি আপনার গত তিন মাসের বিক্রির পরিমাণ দ্বিগুণ করার চেষ্টা করব। যদি এই দুই মাস পরে আপনি দেখেন আপনার ব্যাবসা সত্যিই লাভবান হয়েছে, তবেই আপনি তৃতীয় মাস থেকে আমাকে ফি দেবেন।’ এ ধরনের প্রস্তাব, যা বিক্রেতার পক্ষ থেকে আত্মত্যাগ ও ঝুঁকি উলটে দেয়, তা গ্রাহকের মনে গভীর বিশ্বাস তৈরি করে।

সেলসের করুণতম অধ্যায় হলো—একটি ডিলকে ‘ঝুলিয়ে রাখা’। যখন সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকে, তখন গ্রাহক হয়ত প্রতিযোগীর কাছে চলে যায়, নয়তো আবেগের সেই মুহূর্ত থেকে সরে এসে সিদ্ধান্তটিকে ভুলে যায়। তাই ‘এখনই ক্লোজ করা’ জরুরি। ক্লায়েন্ট যখন বলেন, ‘আমি আমার ওয়াইফ বা পার্টনারের সাথে কথা বলে জানাবো’, আমরা বুঝি যে ডিলটি হাত ফসকে যাওয়ার পথে। তখন আমরা তাকে বলি: ‘এই মুহূর্তে কী করলে আপনার ডিসিশনটি নিতে সুবিধা হবে? যা চাইছেন, বলুন! কারণ আপনার লক্ষ্যও গ্রো করা, আমাদেরও তাই।’ প্রয়োজনে রিফান্ড গ্যারান্টি বা সামান্য ডিসকাউন্ট দিয়ে হলেও সিদ্ধান্তটি সেই মুহূর্তেই নিতে উৎসাহিত করতে হবে।

আর এই ক্লোজিংয়ের পথকে মসৃণ করে ফলোআপের ম্যাজিক। ব্রায়ান ট্রেসির সূত্র বলছে: ৮০ শতাংশ সেলস পাঁচবার ফলোআপের পরই ক্লোজ হয়। প্রথম কন্টাক্টে মানুষ 'না' বলবেই। দ্বিতীয়বার তারা আপনাকে মনে রাখবে, তৃতীয়বার বিবেচনা করবে, চতুর্থবার ভরসা করবে এবং পঞ্চমবারে গিয়ে অবশেষে কিনবে। এই ধৈর্য এবং লেগে থাকার মানসিকতা ছাড়া কখনোই একজন ভালো বিক্রেতা হওয়া যায় না। যারা একবার 'না' শুনেই হাল ছেড়ে দেন, তারা জীবনের বড় ডিলগুলো হারান।

বিক্রয় কি তবে মানুষকে ঠকানো? নাকি একটি বিশ্বাসযোগ্য ও লাভজনক সম্পর্ক তৈরি করা? এই বিশ্বাস ধরে রাখার জন্য কতই না আয়োজন, মানুষের ব্যক্তিগত দিকগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া। একটি কাস্টমার প্রোফাইল তৈরি করা—তার পছন্দের খেলা, তার ব্যাবসার চ্যালেঞ্জ, এমনকি তার প্রতিযোগীরা কী করছে—সবকিছু নোট করা। ফলোআপ সবসময় কাজের কথা নাও হতে পারে। তার প্রিয় দল জিতলে অভিনন্দন জানান, বা তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সাফল্যের একটি স্ক্রিনশট পাঠিয়ে তাকে একটি পরামর্শ দেওয়া। রেডারে থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যে সবসময় কাছাকাছি থাকে, দিনের শেষে ডিলটা সেই পায়। এক কথায় বিশ্বাস নিয়ে খেলার একটি ছক আঁকা। যে বুদ্ধিমত্তার থেকে আবেগ দিয়ে বেশি চিন্তা করে ডিসিশন নেবে, সে সর্বক্ষেত্রেই ঠকেই যাবে। তাইতো, সমানুভূতিসম্পন্ন মানুষেরা আবেগে ভেসে যদি ক্রেতার ভূমিকাও পালন করে , ১০০% সম্ভাবনা থাকে সে হেরে যাবেই। বিশ্বাসের মূল্য দিতে পারবে এমন ধরনের সমানুভূতিসম্পন্ন বিক্রেতা যদি উভয়ই বিজয়ই হবে এমন চিন্তার আলোতে থাকে, কেবল তখনই বিশ্বাস ও আস্থার সংযুক্তীকরণ সম্ভব। 

তাইতো, নিচের কবিতায় বিক্রয়কে শুধুই ব্যাবসা নয়, বরং এক আবেগময় মানবিক সংযোগ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে—যেখানে বিশ্বাসই আসল মূলধন। এটি স্মরণ করিয়ে দেয়, আজকের পৃথিবীতে সাফল্য আসে না কৌশলে, আসে সততা ও সম্পর্কের গভীর মানবিক বোধে।

‘এই বিশ্বাস যেন না হয় কেবলই  বিক্রির মুদ্রা।
বরং, ম্লান গোধূলির এক দীর্ঘশ্বাস,
মানুষের হৃদয়ে জ্বলে নিভৃত-নীরব-সংকুচিত প্রদীপ, 
স্তিমিত আলোয় জেগে থাকা অব্যক্ত আভাস,
বিক্রয় নয় কৌশল—এ এক বহমান খরস্রোতা ঝরনা বুঝি, 
বুঝি বড় বড় ডেউয়ে বহতা  নদী, 
বয়ে যায় অনুভবের তীরে,
যেখানে মিথ্যার উচিত মাথা নুইঁয়ে হারিয়ে যাওয়া , 
ডুবে যাওয়া অন্ধকারের গলিতে, 
সত্য ভাসে স্বপ্নের নীড়ে।’

বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে মুখের কথা এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কই ব্যাবসার মূল ভিত্তি, সেখানে এই 'রিলেশনশিপ বিল্ডিং' এর গুরুত্ব এখন আকাশছোঁয়া। ২০১৫ সালে আমাদের বাজারে ডিলের সাফল্যের ক্ষেত্রে পণ্যের বৈশিষ্ট্য ও প্রচারের জোর (Product Push Index বা PPI) ছিল প্রায় ৮০%, আর মানবিক সম্পর্ক ও বিশ্বাস (Relationship Index বা RI) ছিল মাত্র ২০%। ২০১৭ সাল নাগাদ যখন ই-কমার্স ও ফেসবুক ব্যাবসা শুরু হলো, PPI নেমে এলো ৭৫% এ, কিন্তু RI সামান্য বেড়ে ২৫% হলো। ২০১৯ সালে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আধিপত্য বৃদ্ধির ফলে PPI ৬২% এ নামল, বিপরীতে RI বেড়ে দাঁড়াল ৩৮%। ২০২১ সালে, করোনাকালীন অনিশ্চয়তায় যখন বিশ্বাস ও নির্ভরতা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠল, তখন এই সূচকগুলি প্রায় সমান হয়ে গেল—অর্থাৎ PPI ৫০% এবং RI ৫০%। ২০২৩ সালে বাজারের প্রতিযোগিতা চরমে উঠলে, ভালো সম্পর্কের গুরুত্ব আরো বাড়ে, PPI ৪০% এ নেমে আসে এবং RI পৌঁছায় ৬০% এ। ২০২৫ সালের শেষ দিকে আমরা অনুমান করছি, PPI ৩০% এর আশেপাশে থাকবে, আর সম্পর্কের গুরুত্ব ৭০% স্পর্শ করবে।

যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব (RI) প্রায় ৮৫% এ পৌঁছাবে, কারণ সমস্ত সাধারণ তথ্য ও ফিচার এআই সহজেই সরবরাহ করতে পারবে। ২০৪০ সাল নাগাদ, যখন প্রযুক্তিগত স্বয়ংক্রিয়তা তুঙ্গে থাকবে, তখন মানুষের আবেগ, সহানুভূতি এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাসযোগ্যতা—অর্থাৎ RI প্রায় ৯৫% বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করবে। তখন কেবল সেই বিক্রেতারাই সফল হবেন, যারা ক্রেতার জীবনকে স্পর্শ করতে পারবেন। আমাদের তরুণ সমাজকে বুঝতে হবে, এই মানবিক দক্ষতা অর্জন না করলে তারা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারবে না।

সুতরাং, বিক্রয় কখনোই কেবল একটি কৌশল নয়—এটি এক মনস্তাত্ত্বিক যাত্রা যেখানে লক্ষ্য হলো মানুষকে বোঝা, তার আবেগ অনুধাবন করা এবং বিশ্বাসের ওপর সম্পর্ক গড়ে তোলা। বিক্রয়ের প্রকৃত সার্থকতা সেখানে, যেখানে ক্রেতা নিজেকে প্রতারিত নয়, বরং মূল্যায়িত মনে করে এবং সত্যিই তাকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। তাই একজন দক্ষ বিক্রেতা শুধু পণ্য বিক্রি করে না—সে গড়ে তোলে বিশ্বাসের এক অদৃশ্য সেতু, যেখানে সহানুভূতি হয় মূলধন, আর সততাই হয় লেনদেনের ভাষা। এই উপাখ্যান আমাদের মনে করিয়ে দেয়—‘যদি ভাবো, মিথ্যার জালে ডিল জেতা যায়, তবে তুমি ভুলে গেছ তোমার ভেতরের মানুষটিকে।’

উঠে দাঁড়াও, ভাঙো সেই পুরোনো ধারণার বেড়াজাল; বিশ্বাসকে বানাও তোমার শক্তি, সম্পর্ককে করো তোমার অস্ত্র। বিক্রেতা নয়, আজ থেকে তুমি হবে মানুষের সমস্যার নির্ভীক সারথি—যে জানে, সত্য ও সহমর্মিতাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়।

লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।