সততা কি মূল্যহীন এই বাংলায়?

Bangla Post Desk
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান
প্রকাশিত:১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩৭ পিএম
সততা কি মূল্যহীন এই বাংলায়?
প্রতীকী ছবি

এক দশক আগেও কোনো দপ্তরের দরজায় পা রাখলেই ঘুষের শব্দ কানে ভেসে উঠত বটে, কিন্তু হৃদয়ের গহিন প্রদেশে তখনও লুকিয়ে থাকত এক সুক্ষ্ম দ্বিধা—এক ধরনের নীরব লজ্জা, যা মানুষকে অন্তত নিজের চোখের দৃষ্টি এড়াতে বাধ্য করত। দাতা ও গ্রহীতা দু’পক্ষের মনেই তখন জমে থাকত অপরাধবোধের ম্রিয়মাণ মেঘ। কিন্তু সে সময়ের আকাশ আজ যেন বিলুপ্ত এক ঋতুর মতো দূরে—বেশি দূরে, পাঠক।আজ সমাজের দিকে তাকালে বোঝা যায়, সেই কালো মেঘ আর নিছক মেঘ নয়; তা রূপান্তরিত হয়েছে এক সর্বগ্রাসী, বিষাক্ত ঘূর্ণিঝড়ে—এক এমন মহাপ্লাবন, যার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সকলে, হয় সরাসরি শিকার, নয়তো তার নিঃশব্দ অনুগামী।

ভাবুন, একটি ব্যাংকের শাখায় আপনি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ জমা দিতে। অপেক্ষমাণ কুড়িজনের চোখে ঝরে পড়ছে ক্লান্ত সময়ের ধুলো। ঠিক তখনই পেছন থেকে এক অভ্যস্ত চাতুর্যের হাসি নিয়ে এগিয়ে আসে এক ধূর্ত মানুষ। সে জানে এই আমলাতন্ত্রের কোন রন্ধ্রে দুর্বলতা, জানে কীভাবে দীর্ঘসূত্রতার মরচেধরা শিকল ছিঁড়ে দ্রুত পথ তৈরি করতে হয়। হাতে অবৈধ টাকার হালকা নোটমালা নিয়ে সে এগিয়ে যায় কাউন্টারের পেছনের সেই পরিচিত মুখটির দিকে—এক নীরব অশুভ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় সেখানে।এক মুহূর্তেই আপনার বৈধ প্রতীক্ষা পরাজিত হয়, কুড়িজনের নৈতিক দৃঢ়তা ভেঙে পড়ে। এবং সেই ব্যক্তি—যিনি অনৈতিক শর্টকাটের মাধ্যমে আপনাদের সবাইকে লঙ্ঘন করলেন—হাসিমুখে কাজ সেরে বাইরে বেরিয়ে যান, রেখে যান অপমানের অদৃশ্য কালি, যা সমাজের বিবেকে আরও এক দাগ গভীর করে।

এই চিত্রটি শুধু একটি ব্যাংকের নয়, এটি সমগ্র সমাজের চিত্র। টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ)-এর একটি সাম্প্রতিক (যেমন: ২০১৮-২০২২ সালের) জরিপ অনুযায়ী, সেবা খাতে ঘুষের হার আজও উদ্বেগজনকভাবে বেশি। এর ফলে সৎ মানুষটি কেবল কাজ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে না, তার মনে জন্ম নিচ্ছে এক গভীর হতাশা এবং সমাজ ও ব্যবস্থার প্রতি তীব্র অবিশ্বাস। এই ঘটনা শুধু লেনদেনের দুর্নীতি নয়, এটি সময়ের এবং সততার প্রতি এক নির্মম অবিচার।

আরো ভয়ঙ্কর এক চিত্র হলো, যখন একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী সৎ থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার হয়তো ঘুষ নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই, কিন্তু আমাদের সমাজের সেই 'সুবিধাভোগী' অংশটি তাকে ছাড় দেয় না। সেই অনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নিজেদের কাজ হাসিল করার জন্য, ভালো কাজের 'পুরস্কার' হিসেবে বা দ্রুততার অজুহাতে—অপ্রত্যাশিতভাবে ঘুষের অর্থ এগিয়ে দেয়। এটি এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানে সততা দুর্বলতা হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে।

এই অনৈতিক চাপ, বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসন বা ভূমি অফিসের মতো স্পর্শকাতর জায়গায়, কর্মচারীদের এক প্রকার মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। এই প্রবণতাটি প্রমাণ করে, দুর্নীতি এখন আর শুধু 'চাহিদা-ভিত্তিক' নেই, তা 'সরবরাহ-ভিত্তিক'-ও হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ, যারা ঘুষ দিতে আগ্রহী, তারা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করছে যেখানে 'না' বলাটা অসম্ভব হয়ে ওঠে।

অর্থনীতির ওপর ঘুষের এই সাম্রাজ্যের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় সাধারণ মানুষের জীবনে। কল্পনা করুন, একজন মধ্যবিত্ত মানুষ তার কষ্টে উপার্জিত সীমিত অর্থ দিয়ে একটি প্রয়োজনীয় পণ্য বা সম্পত্তি কিনতে বাজারে এসেছেন। কিন্তু সেখানে আরেকজন অসৎ উপায়ে উপার্জিত বা কালো টাকার মালিক সেই জিনিসটি কিনতে চাইছেন। এই অসৎ ব্যক্তি অধিক মূল্য দিতে প্রস্তুত, কারণ সেই অর্থ তার কাছে পরিশ্রমের নয়, বরং ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে পাওয়া।

এর ফল হয় দ্বিমুখী। প্রথমত, যে সৎ ক্রেতাটি সঠিক মূল্য দিতে প্রস্তুত, সে কেবল তার টাকার অভাবে পণ্যটি কিনতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সেই পণ্যের প্রকৃত মূল্য (Cost Price) থেকে তা অনেক অধিক মূল্যে বিকৃত হয়, কারণ তাতে ঘুষ বা কালো টাকার 'মিষ্টি বিষ' মিশে যায়। এই ঘটনা বাজারের সরবরাহ ও চাহিদার স্বাভাবিক নীতিকে ভেঙে দেয় এবং ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পণ্যের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বারবার জরিমানা বা আইনগত ব্যবস্থার পরেও যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সেকেন্ডে বাড়ে আর কমার গতি থাকে ধীর, তখন বুঝতে হবে এই ভেজাল ও মূল্যের অস্থিরতার মূলে রয়েছে সেই অদৃশ্য ঘুষের অর্থ। ক্ষুদ্র জরিমানা অভিযুক্ত ব্যক্তির মুখে হাসি ফোটালেও সাধারণ মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে।

একটি কথার চরম সত্য: আমাদের দেশে আইন সকলেই জানেন, কিন্তু সকলেই মানেন না। ভোক্তা অধিদপ্তর সংরক্ষণ আইনের অধীনে যারা কাজ করে যাচ্ছেন, তারা জরিমানা সহ জেলের ব্যবস্থা করছেন, কিন্তু ভেজাল ও দুর্নীতি কমছে না। এর কারণ—শাস্তির বিধানটি যেন অনেকটা হাস্যকর। যখন কোনো ভেজালকারী বা অতিরিক্ত দাম গ্রহণকারীকে সামান্য অর্থ জরিমানা করা হয়, তখন অভিযুক্ত ব্যক্তি সেই অর্থ কর্তৃপক্ষের মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে ভাবে, "এই অর্থ আমি আবার এক সেকেন্ডে তুলে নিতে পারব।" এই উদাহরণের বাস্তবিকতা হলো, শাস্তির তীব্রতা অপরাধের লাভজনকতার তুলনায় অনেক কম।

অতএব, প্রয়োজন আইনের সংস্কার এবং শাস্তির বিধানকে কঠোরতম করা। আইনের শাসনকে জাতির শাসন থেকে শুরু করে নির্বাহী স্তর পর্যন্ত সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রেখে দেশে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। এটিই হবে সমাজের সবথেকে তেজস্ক্রিয় অ্যান্টিবায়োটিক।

বাংলাদেশের কোটি কোটি বেকার যুবক-যুবতী, যাদের শক্তি ও মেধা এই দেশকে বদলে দিতে পারে, তারা যখন দেখেন চাকরি পেতেও ঘুষ দিতে হয়, তখন তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। এই বাজে অভ্যাস এবং ঘুষের সাম্রাজ্য দূর করতে হলে শুধু প্রশাসনকে নয়, আমাদের বেকার যুবসমাজকে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মূল স্রোতে আনতে হবে। ২০২০ সালের পর থেকে বিভিন্ন সংস্থা এবং এনজিও-কে এগিয়ে আসতে হবে জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন এবং কাজ নিয়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যারা ঘুষ দিতে আগ্রহী, তাদের অনৈতিক অভ্যাস পরিবর্তন করার জন্য সামাজিক চাপ তৈরি করা। যদি আমরা এই পথেই চলতে থাকি, তবে দুর্নীতি ও ঘুষের প্রভাব ২০২৫ সালে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে এটি ২০৪০ সালের মধ্যে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

কালক্রম

অবস্থা/প্রবণতা (যদি বর্তমান ধারা বজায় থাকে)

পরিবর্তনের প্রত্যাশিত ক্ষেত্র (যদি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়)

২০২৫-২০৩০

ঘুষ ও কালো টাকার লেনদেন ২০%-৩০% বৃদ্ধি পাবে। জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। জনগণের মধ্যে চরম হতাশা বাড়বে।

ই-গভর্নেন্স-এর ব্যাপক প্রসারে দুর্নীতির সুযোগ কমতে শুরু করবে। শাস্তির বিধান কঠোর হলে হার ৫-১০% কমতে পারে।

২০৩০-২০৩৫

আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। দুর্নীতি অর্থনীতিকে স্থবির করে দেবে। সৎ কর্মকর্তার সংখ্যা আরও কমতে থাকবে।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনগণের বিদ্রোহের ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি বড় সামাজিক আন্দোলন তৈরি হবে। বেকারত্ব দূরীকরণে প্রভাব পড়বে।

২০৩৫-২০৪০

সমাজ সম্পূর্ণ অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য চরম আকার নেবে। আইনের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে পৌঁছাবে।

আইনের কার্যকর শাসন এবং ডিজিটাল লেনদেনের কারণে ঘুষের লেনদেন উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে পাওয়া যাবে।

আমাদের এই জীর্ণ সমাজের প্রতি, প্রতিটি সৎ হৃদয়ের প্রতি, এবং সেই সকল নীরব শহীদদের প্রতি, যারা ঘুষের কাছে মাথা নত করেননি—একমাত্র সংকল্পই হলো পরিত্রাণ।

‘শোনো, হে জাতি! শোনো, হে বিবেক! তোমাদের রক্তে যে সততার স্পন্দন আছে, তাকে আজ আর ঘুমিয়ে থাকতে দিও না। আর কতকাল তোমরা অন্যায়কে অন্যায় বলতে ভয় পাবে? আর কতকাল ঘুষের কাছে তোমাদের মেরুদণ্ড বিক্রি হবে? তোমাদের ঘাম ঝরানো উপার্জনের ওপর যারা কালো ছায়া ফেলছে, তাদের মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলো! মনে রেখো, নীরবতা কখনোই বিপ্লব আনে না, বিপ্লব আনে শুধু এক বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর! আজই শপথ নাও—আমরা অন্যায়কে অন্যায় বলব, ন্যায়কে তার আসনে প্রতিষ্ঠিত করব! দুর্নীতির এই প্রাসাদ একদিন ধূলিসাৎ হবেই, কারণ আমাদের সাহসের তেজ সেই পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার চেয়েও শক্তিশালী—যে তেজে সমাজ একদিন পরিশুদ্ধ হবেই!’