মোবাইলই তাহলে জীবনের সবচেয়ে বড় ঘাতক?

Bangla Post Desk
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান
প্রকাশিত:১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:১৫ পিএম
মোবাইলই তাহলে জীবনের সবচেয়ে বড় ঘাতক?
ছবি: সংগৃহীত

আমরা আজ এমন এক নীরব মহামারীর মুখোমুখি, যার নাম ‘অযথা ফোন চালানো’ বা ডিজিটাল আসক্তি। এই ব্যাধি শরীরকে না হলেও আমাদের আত্মাকে, বিবেককে এবং সর্বোপরি সম্পর্কগুলোকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ভাবুন তো, একটা সময় আমাদের হাতে ছিল এক টুকরো সময়, এক বুক আশা আর পৃথিবীর পথে এগিয়ে যাওয়ার দুর্বার শক্তি; আর আজ হাতে শুধু একটি যন্ত্র, যা জীবনের প্রতিটি মূল্যবান মুহূর্তকে গ্রাস করে চলেছে।

আমরা এখন এতটাই যন্ত্রনির্ভর যে, আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কীভাবে চলে যাচ্ছে, তা আমরা টেরও পাচ্ছি না। যে সময়ে আমরা নতুন কিছু শিখতে পারতাম, কোনো সৃজনশীল কাজে মগ্ন হতে পারতাম, কিংবা প্রিয়জনের হাত ধরে হেঁটে যেতে পারতাম প্রকৃতির পথে, সেই সময়টা এখন কেবল স্ক্রল করার, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ভেসে থাকার উপকরণ হয়েছে।

এই আসক্তির সবচেয়ে হৃদয়বিদারক চিত্রটি দেখা যায় আমাদের শিশুদের ক্ষেত্রে। বর্তমানে অনেক মা-বাবাই যেন এক চরম নির্বুদ্ধিতার আশ্রয় নিয়েছেন। তারা ভাবেন, খাবার টেবিলে ফোনটি এগিয়ে দিলেই বুঝি তাদের দায়িত্ব শেষ! কিন্তু শিশু যখন ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে, রঙিন ভিডিওতে মগ্ন হয়, তখন তারা যন্ত্রের মোহে খাবার গ্রহণ করে, যা তাদের স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। অভিভাবকরা এই সহজ জ্ঞানটুকুও অর্জন করতে পারলেন না যে, তারা তাদের সন্তানকে কতটা ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন!

মেডিকেল সায়েন্সের তথ্য অনুযায়ী, একটি শিশু যখন খাবার খেতে খেতে স্ক্রিনে মনোযোগী হয়, তখন তার মস্তিষ্কের ‘মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র’ সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে না। এর ফলস্বরূপ, তার কনসেন্ট্রেশন পাওয়ার মারাত্মকভাবে কমে যায়। আর তারচেয়েও ভয়ংকর হলো- সে কি খাচ্ছে, সেই খাবারের স্বাদ, গন্ধ বা অনুভূতি – কোনো কিছুই তার মধ্যে প্রবেশ করে না, যা তার সংবেদনশীল অনুভূতির বিকাশকে থামিয়ে দেয়। 

পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই ফোনে আসক্ত করার কারণে শিশুদের চোখে চশমাই যেন নিত্যসঙ্গী। বর্তমানে দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষীণদৃষ্টি বা মায়োপিয়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে জাতিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারকারী শিশুদের মধ্যে এই চোখের সমস্যা শুরু হয়েছিল এবং ২০৪০ সালের মধ্যে তা দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আমাদের আলোচনায় উঠে আসা সেই ভয়াবহ পরিণতি: যদি কোনো একদিন, মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়? এই চিন্তাটি আমাদের বর্তমান আসক্তির গভীরতা বোঝায়। যাদের ইন্টারনেট ছাড়া এক সেকেন্ডও চলে না, তাদের মস্তিষ্কে রক্ত বিকিরণ হয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম হওয়াটা হয়তো আক্ষরিক অর্থে নাও ঘটতে পারে, তবে তীব্র মানসিক উদ্বেগ বা উইথড্রয়াল সিনড্রোমের শিকার হয়ে অনেকেই যে প্যানিক অ্যাটাকে ভুগবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হিউম্যান সাইকোলজি বলছে, ডোপামিন নামক রাসায়নিকের তাৎক্ষণিক পুরষ্কারের কারণে মানুষ এমন একটি দুষ্টচক্রে আটকা পড়ে গেছে, যেখানে বাস্তব জীবনে প্রাপ্ত আনন্দের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতের আনন্দ অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষিত।

এখানেই জেনারেশন জি (Gen-Z)-এর সবচেয়ে করুণ অবস্থা। অনেকেই মনে করছেন, তারা প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে তারা পিছিয়ে পড়ছে আসল বা বাস্তব জ্ঞান থেকে। তারা বুঝতেও পারল না, তারা কী হারাচ্ছে! যেখানে তাদের উচিত ছিল মাঠেঘাটে ছুটে বেড়ানো, বইয়ের পাতায় মগ্ন হওয়া, সেখানে তারা ভার্চুয়াল জগতে হাজারো তথ্যের ভারে চাপা পড়ে যাচ্ছে, যার অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয় বা মিথ্যা। সাইকোলজিস্টরা এই প্রবণতা থেকে মুক্তির জন্য কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (সিটিবি) বা আচরণ পরিবর্তনের কৌশল শেখানোর ওপর জোর দিচ্ছেন।

বৃদ্ধ বয়সে মানুষ আত্মীয়-স্বজন ও নিকটজনের সান্নিধ্য চায়। কিন্তু আজকের দিনে সেই সম্পর্কগুলোও ফোনের কাছে হার মানছে। গ্রাম-গঞ্জের সেই চিত্রটি আজ শহুরে জীবনেও প্রকট: নাতি এসে দাদির পাশে বসে আছে, কিন্তু দাদির সঙ্গে কথা না বলে সে ডুবে আছে ফোনের নীল স্ক্রিনে। দাদির একাকীত্ব দূর হলো না, বরং চোখের সামনেই এক অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হলো।

আর এই অবাধ ব্যবহারের কারণে বর্তমান বিশ্ব খুব অশ্লীলতা ও নীতিহীনতায় ডুবে যাচ্ছে। ফোননির্ভর শিক্ষার্থীরা খুব অল্প বয়সেই এসব খারাপ দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। এর ফলস্বরূপ সমাজে যৌন হয়রানি, রেপ, নারীকে ছোট করে দেখা, এবং নারীকে কেবল ভোগের বস্তু বানিয়ে ফেলার মতো জঘন্য মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। 

২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইম এবং সাইবার বুলিং-এর ঘটনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে সাইবার আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া সমাজে নৈতিকতার পতন ঠেকানো কঠিন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের চিত্রও আজ হতাশাজনক। শিক্ষকের সামনেই ফোন চালানো কোনোভাবেই শুধু সময়ের অপচয় নয়, এটি একজন শিক্ষকের প্রতি চরম অপমান এবং শিক্ষা পরিবেশের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ।

প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষ এখন ভিডিও এবং ছবি তুলছে, যা অন্যের ব্যক্তিগত প্রাইভেসিকে অত্যন্ত বাজেভাবে নষ্ট করছে। আইনও এটিকে সমর্থন করে না, কিন্তু আমাদের বিবেকের কাছে এর কোনো দাম নেই। 

শুধু তাই নয়, একজনের ফোনে থাকা আরেকজনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রেখে দেওয়া, ব্যবহার করা বা ফাঁস করে দেওয়া এক ধরনের ধোঁকার কাজ, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

আর ফেসবুক! এটি যেন এক ‘ওপেন সিক্রেট বিচার মাধ্যম’ বা ব্যক্তিগত নাট্যমঞ্চে পরিণত হয়েছে। এখানে মানুষ কোনো রকম জ্ঞান-বিবেক ছাড়াই নিজের জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত ও গোপনীয় ঘটনাগুলো পোস্ট করছে। তারা কতটুকুই বা নির্বোধ হতে পারে, যারা পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন—বাবা-মাকেও যে কথাটি বলে না, সেই কথাটি এসে হাজারো অচেনা মানুষের সামনে খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করে! এই অনৈতিক ও বোকামির কাজ ভবিষ্যতের জন্য এক চরম ভোগান্তি ডেকে আনবে, কারণ সাইবার অপরাধীরা সহজেই এই তথ্য ব্যবহার করে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই আসক্তির চিত্র ক্রমশ ভয়াবহ হচ্ছে: 

বছর

স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা (আনুমানিক)

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত তরুণ (শতাংশ)

সাইবার অপরাধের হার (বৃদ্ধির হার)

২০২৫

১৫ কোটির কাছাকাছি

২০% (উদ্বেগ, হতাশা)

বার্ষিক ১৫-২০%

২০৩০

১৭ কোটি ছাড়িয়ে যাবে

৩০% (আসক্তি ও মনোযোগের অভাব)

বার্ষিক ২০-২৫%

২০৪০

২০ কোটি অতিক্রম করবে

৪০% (তীব্র আসক্তি ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা)

নিয়ন্ত্রণহীন

এই পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, যদি আমরা এখনই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে না আসি, তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশের এক বিশাল অংশকে আমরা এক তীব্র মানসিক সংকটে ঠেলে দেব।

এই যে নির্বোধের মতো হারিয়ে যাওয়া প্রজন্ম, জেগে ওঠো! তোমার জীবনের চাবিকাঠি ঐ যন্ত্রের হাতে তুলে দিও না। আগুন জ্বালানোর ক্ষমতা তোমার আঙ্গুলে নেই, আছে তোমার হৃদয়ের গভীরে—বিদ্রোহী হয়ে উঠুক তোমার পদক্ষেপ, ফোন ফেলে ধরো জীবনের হাল, আজ নয়তো আর কক্ষনো নয়!

সাইকোলজিক্যাল দিক থেকে এবং সামাজিক মাধ্যম থেকে আমাদের উচিত এই মহামারী থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসা। নতুন নতুন থিওরি বা সামাজিক উদ্যোগ উদ্ভাবন করা উচিত, যেখানে মানুষ এই ধরনের রোগ থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারবে। গবেষক ও বিজ্ঞানীরা নতুন ‘ডিজিটাল ওয়েলবিং মডেল’ উদ্ভাবন করুন। বিশেষ করে, শিশুদেরকে এই আসক্তি থেকে দূরে রাখার জন্য পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে। বয়স্কদের একাকীত্ব দূর করতে তৈরি করতে হবে ‘আন্তঃপ্রজন্ম মিথস্ক্রিয়া প্রকল্প’। 

আসুন, আমরা এই নীরব রোগ সম্পর্কে সচেতন হই, একে খুব ভালোভাবে ছড়িয়ে দিই, যাতে প্রতিটি মানুষ এই বিপদ সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং নতুন জন্ম নেওয়া শিশু সন্তান থেকে শুরু করে বৃদ্ধ দাদির একাকীত্ব পর্যন্ত দূর করার মাধ্যমে আমাদের সমাজকে এক নতুন মানবিক পথে পরিচালিত করতে পারে।

লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।