শ্রীচরণেষু দাদা-২৩


সেই রাতেই শুভ্র ছাদের কার্নিশে বসে আকাশ দেখছিল।
চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল আকাশ ভরা নক্ষত্র যেন নিঃশব্দে তার অস্থির বুকের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, নীল আকাশের ভেতর লুকোনো অচেনা সমুদ্র তাকে এক অদৃশ্য টানে ডাকছে। চোখ মেলে সেই ডাক শুনতে শুনতে শুভ্রর ভেতরে হঠাৎই জন্ম নিলো এক সিদ্ধান্ত। এই সমুদ্রকে কাছ থেকে দেখতে হবে। শুধু কল্পনায় নয়, চোখের সামনে, নিজের নিঃশ্বাসের ভেতরে।
মুহূর্তেই মনে পড়ল তার সেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথা, যে পাশের মহল্লায় থাকে। পরিবারের সাথেও তার যাতায়াত আছে, আর ভালো ছাত্র বলে অরুণ দাদারও স্নেহভাজন। ভাবল, এই বন্ধুর সঙ্গেই যাবে কক্সবাজার।
কিন্তু কীভাবে বলবে? দাদাকে বোঝানোর মতো সাহস কি তার আছে? সেই ভাবনাতেই বুকটা ধুকপুক করে উঠল।
পরদিন সকালে চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে। টেবিলের সামনে বসে অরুণ দাদা খাতার পাতায় টুকটাক হিসাব মেলাচ্ছেন। প্রতি সপ্তাহের এই বন্ধের শুক্রবার সকালে এটাই তার অভ্যাস। প্রথমে ব্যবসার খতিয়ান গুছিয়ে নেওয়া, তারপর সোজা সেলুনে গিয়ে দাড়ি–গোঁফ ছাঁটা।
সেই নীরব মুহূর্তে শুভ্রর বুকের ভেতর যেন একটি কাঁপুনি উঠল। গলা শুকিয়ে এলেও সাহস সঞ্চয় করে কাঁপা গলায় বলল,
—“দাদা… একটা কথা ছিল।”-দাদা চোখ তুলে তাকালেন।
—“বল।”
—“মেরিন একাডেমীর ভর্তি পরীক্ষা আছে নাকি সামনে। ভাবলাম বসে দেখি। আমার আরমানিটোলার বন্ধুটিও পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা হবে চট্টগ্রামে।”
অরুণ চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন। ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি।
—“ডাক্তারের পরে নাবিক! তা চট্টগ্রামে কা?”
-মেরিন একাডেমী ত ঐ জায়গায়। তাই ভর্তি পরীক্ষা ঐখানেই হয়।“-শুভ্র উত্তর দেয়
বৌদি রান্নাঘর থেকে মাথা বেড় করে বললেন,
—“নাবিক কিতা। জাহাজের মাঝি নাকি? আর কোন কিছু নাই?”
সবাই হেসে উঠল। কিন্তু অরুণ আবার সিরিয়াস হয়ে বললেন,
—“শুনছি মেরিনে পড়াটা নাকি একেবারে কঠিন। মিলিটারিদের মতো কড়া ট্রেনিং, পরীক্ষাও ভীষণ ঝক্কির। সীট তো হাতে গোনা, তার ওপর সবই ইংরেজিতে। তাছাড়া লোকজন আবার বলে, এসব জায়গায় হিন্দুরা নাকি চান্সই পায় না।”-একটু থেমে আবার বললেন
—“দেখ, যেটা ভালো মনে করিস।”
অরুণ দাদার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, তবে চোখে মায়ার ছায়া। শুভ্র চুপচাপ মাথা নেড়ে সায় দিল। ভেতরে ভেতরে ঢেউ খেলে গেল বুকের মধ্যে। অকথিত গোপন পরিকল্পনাটা দাদার চোখে ধরা পড়েনি জেনে যেন একটু স্বস্তি, আবার খানিক অপরাধ-বোধও অনুভব করলো।
চায়ের কাপে ধোঁয়া মিলিয়ে গেল বাতাসে। সকালটা বাইরে যেমন শান্ত, শুভ্রর ভেতরটা ততটাই অস্থির।
সেদিন বিকেলে আরমানিটোলার পুরনো বন্ধুটির সঙ্গে দেখা হলো। দীর্ঘ আলাপের পর সব ব্যবস্থাই পাকাপাকি করলো। ঠিক হলো, পরীক্ষার দু’দিন আগেই রওনা হবে। ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম এ সপ্তাহেই জমা দিয়ে দেবে। কিন্তু তাদের চোখে-মুখে যে উচ্ছ্বাস, তা পরীক্ষার জন্য নয়, বরং পরীক্ষার ফাঁক গলিয়ে বেড়িয়ে আসার জন্যই সমস্ত পরিকল্পনা। পরীক্ষাটা যেন একপ্রকার বাহানা, আসল উদ্দেশ্য কক্সবাজারের বালুকাবেলায় দুদিন নির্ভার সময় কাটানো।
পরিকল্পনা মতো এক ভোরে দুই বন্ধু একটি রিকশা ডেকে সোজা রওনা হলো কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকে। স্টেশনের ভিড়, কোলাহল, বাঁশির সুরের ভেতর তারা জায়গা করে নিল সকাল সাতটার চিটাগাং এক্সপ্রেসে। গন্তব্য একেবারে নির্ধারিত। কোনও বিরতি নয়, শুধু কুমিল্লায় ট্রেন খানিকটা দাঁড়াবে, তারপর আবার গতিময় ছুটে চলা।
চার ঘণ্টা অতিক্রম করতেই দিগন্তে ভেসে উঠল পাহাড় ঘেরা বন্দরনগরী। চট্টগ্রাম পৌঁছতে পৌঁছতে ঘড়ির কাঁটা প্রায় দুপুর ছোঁয়াচ্ছে। শহরের হুল্লোড় কাটিয়ে তারা সোজা চলে গেল নন্দনকাননের পাশে ছোট্ট এক হোটেল “বান্দরবনে।“ জায়গাটা ডিসি হীলের কাছাকাছি, নিরিবিলি এবং তাদের জন্য একেবারে উপযুক্ত। সেখানেই ঠিক হলো থাকার ব্যবস্থা।
সময়ের মতো পরীক্ষাটাও হলো। প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র সবকিছুই যথারীতি শেষ হলো, কিন্তু তাদের মনে সেটি কোনও বড় ঘটনা নয়। আসল উত্তেজনা জমে আছে পরদিনের জন্য।
পরীক্ষার পরের সকালেই তারা আবার রওনা দিল সেই কাঙ্ক্ষিত পথে, কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। সাগরের নীল, ঢেউয়ের স্রোত, আর নিস্তব্ধ আকাশের নিচে দুদিনের স্বপ্নময় অবকাশই ছিল তাদের সত্যিকার গন্তব্য।
বাস ছাড়তেই বন্ধু শফিক ফিসফিস করে বলল,
—“শুভ্র, তোর দাদা জানে?”
শুভ্র জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল,
—“জানে—আমি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।”
শফিক খিলখিল করে হাসে।
ধীরে ধীরে রাত নেমে আসে। সারাদিনের ট্রেনযাত্রা আর বাসের ধকল শেষে ক্লান্ত, তবুও চোখেমুখে উত্তেজনার দীপ্তি। পৌঁছে গেল তারা কক্সবাজারে। শহরের আলো-ঝলমলে রাস্তা পেরিয়ে রিকশা এসে থামল সস্তা অথচ রঙিন সাইনবোর্ড ঝুলানো এক হোটেলের সামনে “সাগর-নিবাস”।
রিসেপশনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন গোঁফওয়ালা এক ভদ্রলোক। তাঁর গোঁফ যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই ঘন আর পাকানো। নাম তাঁর লোকমান। কাউন্টারে কাত হয়ে বসে আছেন, যেন বহুদিন ধরে এখানকার রাজা তিনি।
লোকমান বললেন,
—“ক’টা রুম চাই, বাবারা?”
শুভ্র চটপট জবাব দিল,
—“একটা। যদি সমুদ্র–ফেসিং হয় তো সবচেয়ে ভালো।”
লোকমান হেসে দাঁত বের করে বললেন,
—“সব রুমই সমুদ্র–ফেসিং। পর্দা টানলেই দেখবেন পাহাড়।”
হঠাৎ হোটেল লবি ভরে উঠল হো হো করে হাসিতে। শুভ্র রেজিস্টারে কলম চালাতে লাগল। ইংরেজিতে নাম আর ঠিকানা লিখতেই লোকমান চোখ কপালে তুলে মুগ্ধ স্বরে বললেন,
—“বাহ! ইংরেজি তো জম্পেশ। ছাত্র?”
শুভ্র গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,
—“জি, কলেজে পড়ি। গতকাল মেরিনে ভর্তির পরীক্ষা দিলাম।”
লোকমান এক চিলতে হাসি খেলালেন ঠোঁটে।
—“দারুণ! তা হলে তোমাদের জন্য রুম ২০৩। এই নাও চাবি। গরম পানি চাইলে বেল টিপে দিও। তবে শোনো, রাত বারোটার পর ছাদে যেও না।”
শফিক বিস্ময়ে চমকে উঠল।
—“কেন? কি আছে ছাদে?”
লোকমান কণ্ঠ নিচু করে রহস্যময় ভঙ্গিতে বললেন,
—“ছাদের ভূত সাগরের গান গায়।”
এক মুহূর্তের জন্য লবিতে নেমে এলো শীতল নীরবতা। দূরে ঢেউয়ের গর্জন যেন হঠাৎ কাছে এসে দাঁড়াল।
শফিক হাঁ করে তাকিয়ে রইল,
—“ভূত? গান গায়?”
শুভ্র মুচকি হেসে চোখ টিপল,
—“ভূত মানে বাতাস। গান মানে ঢেউ।”
কিন্তু তবুও, শফিকের বুকের ভেতর কেমন এক অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতি খেলে গেল। সমুদ্রের রাতে, অপরিচিত শহরে, আর ভূতের গানের গল্পে—রাতটা যেন আরও গভীর, আরও রহস্যময় হয়ে উঠল।
রুমে উঠে জানালা খুলতেই ঢেউয়ের নিষ্ঠুর কোমল শব্দ গায়ে লেগে গেল। শুভ্র বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকল। মেরিন একাডেমীর সিলেবাস, ইংরেজি প্রশ্ন, নটিক্যাল সায়েন্স, সব মাথায় ঘুরে ফিরেও স্থির হলো না, কিন্তু ইংরেজি নিয়ে ভয় হলো না, সেই কলেজ-জীবনের বিশেষ কোচিং–এর জন্য। স্যার বলতেন—“ভাষা হলো চাবি, শুভ্র। দরজাটা যতই শক্ত হোক, চাবি ঠিক হলে খুলবে।”
রাতে খাবার খেতে নেমে “সাগর–নিবাস”–এর নিচতলার ছোট্ট রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই মাছ ভাজার গন্ধে মাথা ঘুরে যায়। শেফ–কাম–ওয়েটার, মাঝবয়সী এক মহিলা, হাসতে হাসতে বললেন,
—“কি খাইবা, ভাইনরা? রূপচাঁদা আছে, চিংড়ি আছে, ভাত আছে, ক্ষুধা থাকলে সবই আছে।”
শফিক বলল, —“আপা, মাছ ভাজা আর ভাত দিলেই হবে। সাথে একটু সস দিও”- শুভ্রর চোখে সমুদ্রের গন্ধ ভেসে উঠছিল, আর তার বুকের ভেতর জমছিল অনিশ্চয়তা।
মহিলা মুখ বাঁকিয়ে, —“সাগর–কুলে আইসা সস খাইবা নাকি? লেবু–লবণেই খাও, সস দিয়া মাছের গন্ধ মাইর দাও কেইন?”
টেবিল ফেটে পড়ে হাসিতে। শুভ্র বলল, —“আপা, যেমন আপনি বলেন।”
—“এহন কথা!”—মহিলা থালায় করে লবণ–কাঁচামরিচ এগিয়ে দিলেন।
ভাত–মাছের মধ্যে কথার ঢেউ এসে লাগে। শফিক প্রশ্ন ছোঁড়ে,
—“শুভ্র, তুই বিদেশে যাবি নাকি?”
শুভ্র খুঁটিয়ে বলে, —“মন চায়। কিন্তু দাদা…”
শফিক থামিয়ে দেয়, —“দাদা তো তোর আশ্রয়। আশ্রয়ের কাছে সত্য কথাই বলা লাগে।”
শুভ্র জানালার বাইরে অন্ধকার সমুদ্র দেখে বলে, —“ঠিক বলেছিস।”
দু’দিন যেন চোখের পলকে কেটে গেল। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই তারা ছুটে যেত সমুদ্রতটে। সূর্য উঠবার আগেই ঢেউয়ের সাদা ফেনা ভিজিয়ে দিত তাদের পা, আর লবণাক্ত বাতাস মেখে যেত চুলে–মুখে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে বলত,
—“এটাই জীবনের সবচেয়ে মুক্ত সময়, শফিক!”
প্রথম দিনের দুপুর কাটল ঝাউ-বনের ছায়ায়। রোদ্দুরের তীব্রতা গায়ে লাগলেও মন ভরে গেল সেই শীতল বাতাসে। তারা বসে খেয়েছিল সস্তা এক দোকানে গরম ভাত, শুঁটকি ভর্তা আর টক-মিষ্টি ডাবের পানি। খাবারের স্বাদে আর হাসিঠাট্টায় দুপুর গড়িয়ে গেল।
বিকেলবেলায় তারা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করল। ঘোড়া দৌড়াচ্ছে সমুদ্রের ধারে, আর তারা দু’জন হাত মেলে দিচ্ছে বাতাসে। পথের ধুলো, মানুষের ভিড়, সবকিছু মিলেমিশে হয়ে উঠল একরকম উৎসব।
রাত নামল সমুদ্রের অদ্ভুত গর্জন নিয়ে। তারা উঠল হোটেলের ছাদে। লোকমানের সেই কথাটা মনে পড়ল—“ছাদের ভূত সাগরের গান গায়।“ ছাদের ওপরে রাত বারোটার পর এক অদ্ভুত সুর ভেসে আসে। ঢেউয়ের গর্জনের সাথে মিশে যায়, যেন অচেনা কেউ গান গাইছে। অনেকে বলে ওটা ভূতের সুর। সত্যিই, ঢেউয়ের ছন্দে বাতাসের শিস মিশে তৈরি হলো এক রহস্যময় সুর। শফিক কাঁধে হাত রেখে বলল,
—“ভূত হোক, বাতাস হোক—এমন গান আমি আগে শোনিনাই।”
দ্বিতীয় দিনে তারা ভোরেই বেরিয়ে গেল কক্সবাজারের আরও দূরে, লাবণী বিচ ছাড়িয়ে নির্জন এক প্রান্তে। সেখানে সমুদ্র ছিল শান্ত অথচ গভীর, যেন নিঃশব্দে কিছু বলতে চাইছে। শুভ্র ভিজে বালুর ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল দীর্ঘ সময়, আর শফিক ছুটে ছুটে ঝিনুক কুড়োচ্ছিল।
দুপুরে তারা গিয়েছিল এক মাছবাজারে। সেখানকার কোলাহল, রঙিন মাছের সারি আর মানুষের টানাটানি, সবকিছুই যেন ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। সন্ধ্যায় আবার তারা ছুটল সমুদ্রের কাছে। সূর্য যখন ধীরে ধীরে সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছিল, তখন আকাশ রঙিন হয়ে উঠল লাল, কমলা আর বেগুনি আভায়।
রাতটাও কাটল সমুদ্রের ঢেউ গুনে গুনে। হাসি, খেলা, গল্প আর নীরবতার ভেতর মিলেমিশে তৈরি হলো এক চমৎকার পরিবেশ।
বাসে ওঠার আগ মুহূর্তে, সমুদ্রকে শেষবারের মতো দেখল শুভ্র। ঢেউ আছড়ে পড়ে, ফিরে যায়, আবার আসে। ঠিক যেন অরুণ দাদার জীবনের মতো। আত্মত্যাগের ঢেউ এসে সবাইকে বাঁচায়, তারপর নিঃশব্দে ফিরে যায়।
কয়েক সপ্তাহ পরে ডাকপিয়ন এসে দিয়ে যায় একটা খাম। বাসায় আসতেই বৌদি শুভ্রকে খামটা দেয়। দরজায় দাঁড়িয়ে চিঠিটা খুলতেই বুক ধড়ফড় করে উঠলো—
“You are shortlisted for Marine Engineering and Navigation Course.”
শুভ্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে পড়ে শোনালো। অরুণ দাদা সিঁড়ি বেয়ে উপরে এসে দাঁড়ালো। শুভ্রের কথাগুলো শুনে চোখ চকচক করে উঠল,
—“দেখলি! আমি বলেছিলাম না, তুই পারবি। এখন শুধু ভাইবা আর মেডিকেল। দে দে চিঠিটা দে”
বৌদি হেসে উঠলেন,
—“আচ্ছা, আমাগো শুভ্র তাইলে সত্যিই জাহাজে চইরা সমুদ্র পাড়ি দিব, নাগো?”
অরুণ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
—“তাইত দেখছি। আমার ভাই সমুদ্র জয় করবে। তবে আগে সবগুলা পরীক্ষা-ত পাশ করতে দাও। যাও যাও কাওরে দিয়া একটু মিষ্টি আনার ব্যবস্থা কর। আর একটু ঝাল মুড়ি বানাইয়া দাও। কত্তো বড়ো একটা খবর”
অরুণ বুক চাপড়ে উঠলেন,
—“সাবাশ!”
তবুও শুভ্রর বুকের ভেতর শঙ্কা। পাতলা গড়ন, দুর্বল শরীর। মেডিকেলে হয়তো টিকবে না। সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
—“দাদা… যদি না হয়?”
অরুণ আশ্বস্ত করলেন,
—“আমি আছি তো।”
কয়েকদিনের মধ্যেই প্রমাণ হলো, তিনি সত্যিই আছেন। ভাইবাতে শুভ্র পাস। এবার মেডিক্যাল টেস্ট। দাদা চিটাগাং এর এক পরিচিত আত্মীয় ডাক্তারকে ফোন করে নিশ্চিত করলেন কোন ভয় নেই। উনি ব্যবস্থা করবেন। করেছেনও তাই। ফলাফল এলো: “Fit for Marine Academy.”
এরপর শুরু হলো ভর্তি প্রস্তুতি। কাগজপত্র, বন্ড সই, ইউনিফর্ম, ট্রাঙ্ক, অগুনতি আয়োজন। অরুণ বড়ো জাহাজের ছবিওয়ালা একটি ক্যালেন্ডার কিনে আনলেন। দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলেন। প্রতিদিন তার সামনে দাঁড়িয়ে গর্বভরা কণ্ঠে বলতেন,
—“একদিন আমার ভাইও এভাবেই সমুদ্র ভেসে যাবে।”
শুভ্র শুধু মুচকি হাসত, বুকের ভেতর চাপা ব্যথা জমে উঠত।
অবশেষে ভর্তি-দিন ঘনিয়ে এলো। অরুণ দাদা আনন্দের সঙ্গেই অদ্ভুত এক ভয়ের কথাও বৌদিকে ফিসফিস করে বললেন,
—“যদি মাসের পর মাস সমুদ্রে থেকে কোনো বিপদ হয়?”
বৌদি থামালেন,
—“কিতা সব আবোল-তাবোল ভাবতাছ। আশীর্বাদ কইরো, সব ভালোই অইব।”
কিন্তু অরুণের বুক শান্ত হলো না। মা-কে নিয়ে চট্টগ্রাম গেলেন। একাডেমী ঘুরে এসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিলেন—
—“শুভ্র ভর্তি হবে না। আমি আমার ভাইকে সমুদ্রের হাতে তুলে দিতে পারবো না।”
শুভ্র নির্বাক। মায়ের দীর্ঘশ্বাস, আর অরুণের দৃঢ় সিদ্ধান্ত, সব মিলে ভর্তি আর হলো না।
কয়েক মাস পর ভাগ্য নতুন দরজা খুলল। সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করে শুভ্র এবার রওনা হলো দূর দেশে, মস্কোতে উচ্চশিক্ষার জন্য।
কয়েক মাসের অপেক্ষার পর সবকিছু প্রস্তুত হলো। কাগজপত্র, ভিসা, পাসপোর্ট, সব হাতে। এবার শুভ্র যাচ্ছেই। গন্তব্য দূর দেশ—মস্কো। আর বাহন, সোভিয়েত এয়ারলাইন্স “এরোফ্লট”–এর ঝকঝকে এক বিমান।
এটাই তার জীবনের প্রথম উড়াল। বুকের ভেতর শিহরণ, ভীতি, উত্তেজনা, সব একসাথে বাজছে।
বিদায়ের দিন এলো। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিড়, ট্যাক্সি, কোলাহল। সবকিছুর ভেতরেও শুভ্রর চোখ শুধু খুঁজছিল দাদাকে। অরুণ দাদা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, মুখ শক্ত করে রেখেছেন। ভিতরে অশ্রুধারা বইছে, কিন্তু বাইরে একটুও ফোঁটা ঝরতে দিচ্ছেন না।
শেষ মুহূর্তে শুভ্রর হাত ধরে তিনি বললেন,
—“যা ভাই। ভয় পাবি না। তুই শুধু নিজের নয়, আমাদের সবার স্বপ্ন বয়ে নিয়ে যাচ্ছিস।”
বৌদির চোখ ভিজে উঠল। মা শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন। মীনাক্ষী দিদি আঁচলে মুখ লোকালেন। কান্না যেন থামাতে পারছেন না। অরুণ দাদা দাঁড়িয়ে ছিলেন পাহাড়ের মতো দৃঢ় হয়ে। চোখ শুকনো, কিন্তু বুকের ভেতর সমুদ্রের ঢেউ কাঁপছিল। শুভ্র স্পষ্ট বুঝতে পারল, তার দাদা কাঁদছেন, শুধু অশ্রু ঝরতে দিচ্ছেন না। ইমিগ্রসনে ঢুকার আগে শুভ্র শেষবারের মতো ঘুরে তাকাল। দূরে দাঁড়িয়ে আছেন দাদা। অটল, অবিচল, তবুও ভেতরে ঝড়। চোখে জল নেই, কিন্তু সেই চোখে জ্বলজ্বল করছে অব্যক্ত ভালোবাসা আর গোপন যন্ত্রণা।
এক সময় ইঞ্জিনের গর্জন শুরু হলো। বিমান রানওয়ে ছেড়ে আকাশে উঠতে লাগল। জানালার কাঁচে শুভ্র দেখল, ঢাকার মাটি ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে তার দাদা হয়তো দাঁড়িয়ে আছেন পাহাড়ের মতো দৃঢ় হয়ে।
শুভ্রর বুকের ভেতর কেঁপে উঠল এক অনন্ত বেদনা। সে জানল, আজ শুধু সে-ই উড়াল দিচ্ছে না, তার সঙ্গে উড়ছে দাদার সব স্বপ্ন, ত্যাগ আর অদৃশ্য আশীর্বাদ।
অরুণ দাদা নিজের জীবনটা উৎসর্গ করেছেন ভাইবোনদের ভবিষ্যতের জন্য। তিনি নিজে রইলেন মাটিতে, অদৃশ্য নাবিক হয়ে। আর তার ছোট ভাই উড়াল দিল আকাশে, নতুন দিগন্তের খোঁজে।
সেই মুহূর্তে আকাশে ভেসে যাওয়া বিমানের শব্দের ভেতর লুকিয়ে ছিল এক ভাইয়ের হৃদয়ের ধ্বনি—
“আমার স্বপ্ন নয়, ওর স্বপ্ন পূর্ণ হোক।”
-চলবে
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট