শ্রীচরণেষু দাদা-২১


শুভ্রের ভাবনায় কতো কিছুই না ঘুরপাক খায়।
জীবনের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে যেনো দাদার ছায়া তাকে জড়িয়ে আছে। দাদার কারণেই তো সে আজ এতদূর আসতে পেরেছে। গ্রাম থেকে আসা রাজধানীশহরটা তার কাছে প্রথমে ছিলো কত অচেনা, কত বন্ধুহীন! কিন্তু সেই অচেনাশহরের অন্ধকার গলিপথে দাদাই হয়ে উঠেছিলেন তার আলো, তার আশ্রয়।
পুরো পরিবারটিই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছে। অথচ সেই উত্থানের পেছনে কতটাত্যাগ, কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে তা কেউ জানে না। অরুণ দাদা নিজের সব সাধআহ্লাদ, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, এমনকি ব্যক্তিগত স্বপ্নকেও জ্বালিয়ে দিয়েছেনপরিবারের জন্য। যেনো তিনি নিজেকে ভুলে গিয়েছিলেন, কেবল ভাই-বোনদেরহাসি আর মায়ের চোখের জল মোছাতেই বেঁচে ছিলেন।
অচেনা শহরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তাকে কত কষ্টই না সহ্য করতেহয়েছে। দিনভর কঠোর পরিশ্রমের পর যখন শরীর ভেঙে পড়তো, তখনো তিনিভেঙে পড়েননি। একাকীত্ব তাকে গ্রাস করতে চেয়েছিলো, কিন্তু তিনি ডুবেননি। বরং দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিটি কষ্টের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।
ভালবাসতে গিয়েও তিনি ভালোবাসা পাননি, স্বপ্নভঙ্গ তাকে বারবার ক্ষত-বিক্ষতকরেছে, তবুও তিনি দুমড়ে পড়েননি। তার হৃদয়ের গভীর ক্ষত তিনি আড়ালকরেছেন পরিবারের জন্য। কারও সামনে নিজের দুঃখের কথা বলেননি। তিনি মনেকরতেন, পরিবারকে সাহস জোগাতে গেলে তাকেই অটল থাকতে হবে। সে যেপরিবারের বড়ো ছেলে।
এক এক করে ভাইবোনদের তিনি নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন। ছোটদেরপড়াশোনার খরচ, খাবারের যোগান, মাথার ওপর একটা নিরাপদ ছাদ, সবকিছুনিশ্চিত করেছেন ধীরে ধীরে। শুভ্র আর বিকাশ তখনো বাবা-মায়ের কাছে থেকেইপড়াশোনা করতো। তবে শুভ্রর প্রতিটি পদক্ষেপেই দাদার প্রেরণা, দাদার হাত ধরেএগোনো। মেট্রিক শেষ করার পর শুভ্রকেও ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
দাদার দৃঢ়তা, অকৃত্রিম ত্যাগই একসময় পরিবারকে নতুন করে দাঁড় করালো। শূন্যথেকে গড়ে উঠলো নতুন ভিত্তি। আর শুভ্র প্রতিদিন উপলব্ধি করতে লাগলো—
“আমি যদি আজ কিছু হতে পারি, যদি মানুষের মতো বাঁচতে পারি, সবটুকু কৃতিত্বদাদার। বাবা হারানোর পর আমাদের পরিবারকে ভেঙে পড়তে দেননি, তিনিই নতুন আলো জ্বালিয়েছেন।”
সময় যেন এক অদম্য নদী। বহমান, নিরন্তর, থেমে থাকার সুযোগ নেই তার। কারো জন্য সে থামে না, অপেক্ষা করে না। অথচ মানুষের জীবন, স্বপ্ন আরসম্পর্ক সবই এই অচলায়তন সময়ের স্রোতে ভেসে চলে।
নীল আকাশের নিচে ঢাকা শহরের কোলাহল যখন প্রতিদিন নতুন রঙ মেখে ওঠে, তখনই মীনাক্ষীর ভেতরে জমতে থাকে এক অচেনা সুর। দশম শ্রেণির ছাত্রী সে। বয়সে ছোট হলেও মননশীলতায় অনেক বড়। সরলতায় মোড়া তার স্বভাব, তবেচোখের ভেতর যেন খেলে বেড়ায় তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসার ঝিলিক। বই ছিল তার সবচেয়েআপন সঙ্গী। কাগজের গন্ধে আর অক্ষরের গাঁথুনিতে সে খুঁজে নিত নিজস্বপৃথিবী।
গ্রামের ধুলো–মাখা উঠোন পেরিয়ে একদিন যখন মীনাক্ষী এসে দাঁড়াল ঢাকার ব্যস্তনগরে দাদার সংসারে, তখন অনেকের কাছেই তা যেন এক আশ্চর্যের গল্প। কারওদৃষ্টিতে বিস্ময়, কারও কথায় ঈর্ষার কাঁটা। তবুও এসব কোলাহল যেন এক বিন্দুওছুঁতে পারত না তাকে। মীনাক্ষীর দৃষ্টি ছিল অন্তর্গত। সেখানে ছিল কেবল স্বপ্নেরদীপ্তি আর অদেখা আলোকে ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা। এই সংগ্রামী জীবনে তার আশ্রয়ছিল বৌদি। সংসারের হাল ধরে থাকা সেই নারী মীনাক্ষীর কাছে শুধু দায়িত্ববানগৃহিণীই নন, ছিলেন এক নিবিড় মমতার প্রতীক। মা গ্রামে থেকে গেলেও, বৌদিরস্নেহে সে প্রতিদিন নতুন করে মায়ের ছায়া খুঁজে পেত। রান্নাঘরের গন্ধে, সকালেরডাকাডাকিতে, কিংবা পরীক্ষার আগের নির্ঘুম রাতগুলোতে বৌদিই তাকে বুক ভরাসাহস দিতেন। আর বৌদির কাছে মীনাক্ষীও ছিলো খুব কাছের বন্ধু।
ঢাকার শহুরে মেয়েদের পোশাক-আচরণ, মেকআপ, স্বাচ্ছন্দ্য জীবন, সবই যেনআলাদা এক পৃথিবী। সেখানে গ্রামের মেয়ের সরলতা মাঝে মাঝে অচেনা মনেহতো মীনাক্ষীর নিজের কাছেই। কিন্তু এ ভিন্নতা তাকে লজ্জিত করত না, বরং এক নতুন দৃঢ়তায় গড়ে তুলেছিল ভেতরের মানুষটিকে। মীনাক্ষীর কিশোর হৃদয় তখনধীরে ধীরে খুঁজে নিচ্ছিল নিজের ভাষা, নিজের আকাশ। তার জীবনকথা হয়েউঠেছিল এক অনবদ্য উপন্যাসের সূচনা, যেখানে প্রতিটি শব্দ ছিল সংগ্রামের, প্রতিটি বাক্য ছিল স্বপ্নের, আর প্রতিটি অধ্যায় এক অদম্য সম্ভাবনার ইঙ্গিত।
ঠিক তখন থেকেই আসতে শুরু করল বিয়ের প্রস্তাবগুলো। কেউ বলছে, “মেয়েটিররূপ আছে, গুণ আছে, সময় থাকতে ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত।” সমাজের প্রচ্ছন্নচাপ যেন প্রতিটি প্রস্তাবের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল। অরুণের বাবা-মাও ভেবেবসেছিলেন, ভালো পরিবারে, সৎ ছেলেটি যদি মেলে, তবে আর দেরি না করে মীনাক্ষীর ভবিষ্যৎটা বাঁধা উচিত।
একদিন এমনই একটি প্রস্তাব এলো। ছেলে সদ্য চাকরি পেয়েছে সরকারি ব্যাংকে। ভবিষ্যৎ নিশ্চিত, সমাজে সম্মানও আছে। তবে পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমনউজ্জ্বল নয়। কিন্তু অরুণ প্রথম দেখাতেই ছেলেটির চোখেমুখের সততা, তার ভদ্রআচরণে আকৃষ্ট হয়ে গেল। তবু অরুণের মনে হল, মানুষের প্রকৃত পরিচয় লুকিয়েথাকে তার কলমের অক্ষরে। হাতের লেখা, যেন মনের আয়না। তাই ছেলেটিকেতার কাজের ঠিকানাটি একটি কাগজে লিখে অরুণকে দিতে বললো। লিখাকাগজটি দেখতেই তার চোখ বিস্ময়ে স্থির হয়ে রইল। কি অপূর্ব লেখা! প্রতিটি অক্ষর যেন খোদাই করা শিল্পকর্ম। নিখুঁত, সুশৃঙ্খল, পরিপাটি। সেই লেখার ভেতরেঅরুণ যেন দেখতে পেল এক স্থিরচিত্ত, সংযত, মর্ম-বোধসম্পন্ন মানুষেরপ্রতিচ্ছবি। ঠিকানাটা এক নজর পড়ে তার চোখ ভিজে উঠল। মনে হল, এই হাতেরলেখার মতোই হবে ছেলেটির জীবনযাপন। পরিষ্কার, সৎ আর শৃঙ্খলাবদ্ধ। আরদেরি করল না অরুণ। সেদিনই ছেলেটির বাবার কাছে কথাটা পাকা করে দিল।
সময়ের নদী তখনও বহমান, কিন্তু সেই স্রোতে মীনাক্ষীর জীবন যেন নতুন এক আশার তটে ভিড়ল।
মীনাক্ষীর বিয়ের কয়েকটি দিন এখনো শুভ্রর চোখে জ্বল জ্বল করছে। বিয়েরদিনটি ছিলো একেবারে আনন্দের উৎসব। ভোর থেকেই বাড়ির উঠোনে চলছিলোতোরজোড়। শ্বেত চুনে আঁকা রঙিন আলপনা, পাড়ার মেয়ে-বৌদের গলায়উলুধ্বনি, আর ঢাকির তালে তাল মিলিয়ে গমগম করছিলো পুরো পরিবেশ। উঠোন-জুড়ে সামিয়ানা টাঙ্গানো, চারপাশে ফুল আর আলোর সাজ।
শুভ্রর মন ভরে উঠছিলো আনন্দে। সন্ধ্যার আলো মেখে যখন হঠাৎ বর যাত্রীদেরনিয়ে বিশাল এক বাস এসে দাঁড়াল স্কুলের মাঠে, তখন যেন চারপাশ কেঁপে উঠলোঢাকের তালে। সেখান থেকে একে একে নেমে আসতে লাগলো বরযাত্রীরা। কারোহাতে আতসবাজি, কারো গলায় হারমোনিয়াম, আবার কারো গলায় ঝোলা থেকেউঁকি দিচ্ছে মিষ্টির প্যাকেট।
দূর থেকেই মনে হচ্ছিলো যেন এক বিরাট মিছিল এগিয়ে আসছে বিয়েবাড়িরদিকে। ঢাকের শব্দে তাল মিলিয়ে বাচ্চারা লাফাতে লাফাতে চিৎকার করছে—
—বর আসছে! বর আসছে!
ছোট কাকা নিজে বরযাত্রীদের সামলে নিয়ে আসছিলেন। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়েপাড়ার মানুষ হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। আর মুহূর্তের মধ্যেই হাসি-আনন্দ, উলুধ্বনি আর কোলাহলে কানায় কানায় ভরে গেলো পুরো বাড়িটা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে বিয়ের আসল পর্ব। উঠোন-জুড়ে এক দল বরযাত্রীদেরজন্য কোলাহল। কেউ আদর-আপ্যায়নে ব্যস্ত, আবার কেউ মিষ্টির প্লেট হাতেএগিয়ে যাচ্ছে অতিথিদের দিকে। রসগোল্লা, সন্দেশ, মোয়া, সবকিছুই যেন উচ্ছ্বাসেভরে উঠেছে।
বাড়ির প্রতিটি ঘর, বারান্দা আর উঠোনে বসার আলাদা আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোথাও দড়ির খাটিয়া, কোথাও মোড়া, কোথাও বা পাতা বিছানো। অতিথিরা গল্পগুজব আর হাসাহাসিতে মেতে আছে।
এদিকে, বাড়ির ভেতরের এক কক্ষে চলছে মীনাক্ষীর সাজগোজ। লাল বেনারসিরআঁচল টেনে দিতে দিতে মায়ের হাত কাঁপছে, খালা-পিসিরা মিলে কপালে টিপদিচ্ছে, হাতে শাঁখা-পলা পরাচ্ছে। কনের মুখে লাজুক হাসি, কিন্তু চোখেমুখে এক অদ্ভুত দীপ্তি।
ঠিক তখনই উত্তর পাড়ার এক পিসি হেসে বললেন—
—আর একটুও নড়িস না মা, টিপটা একপাশে চইল্যা গেলে আর কিচ্ছু মানাইবোনা!
মীনাক্ষী মৃদু হেসে বললো—
—আহা, পিসি! এত মানুষ এত ঘাড় ধইরা বসলে কেমনে স্থির থাকি বলো?
পাশ থেকে পাশের বাড়র কেউ এক জন ঠাট্টা কইরা উঠলেন—
—অই, এখন তোকে কষ্ট হইতাছে। কাল থেইক্যা বরের সংসারে গিয়া বেগুনকাটতে কাটতে হাত ব্যথা হইলে কারে ডাকবি?
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
এক বোনঝি এগিয়ে এসে ফিসফিস করে কনেকে বললো—
—দিদি, বরটা নাকি বেশ দেখতে, টোপরটা পরা মানাচ্ছে দারুণ! খুব লম্বা। তোকেদেখে তো একেবারে দেবদেবীর জুটি লাগতেছে। তুর ভাইগ্যটা খুবই ভালা।
মীনাক্ষীর গাল লাল হয়ে উঠলো, মুখ নামিয়ে ছোট্ট করে বললো—
—যাও না, এসব কথা এখন করতে হয়?
এদিকে জানালার ফাঁক দিয়ে শুভ্র সবকিছু দেখছিলো। তার মনে হচ্ছিলো, বিয়েরএই সাজগোজের কোলাহল, হাসাহাসি আর খুনসুটি, এমন দৃশ্য জীবনে আরকখনো ফিরে পাওয়া যাবে না।
হঠাৎ করেই চারদিক কেঁপে ওঠে উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনিতে। পাড়ার বৌ-ঝিরা তালমিলিয়ে ডাকতে থাকে—
—উলু উলু উলু...!
শুভ্রর মনে হলো, যেন সমগ্র পরিবেশ বিয়ের আনন্দে দুলছে, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি আলো আর প্রতিটি হাসি এই মুহূর্তকে অবিস্মরণীয় করে রাখছে।
হঠাৎ পাশ ফিরে শুভ্র দেখতে পায় তার ছোট কাকা ফিসফিস করে শুভ্রর বাবাকেচিন্তিত স্বরে কিছু বলছেন—
—দাদা, দেখছেন না কারবারটা? কইছিলো শ`খানেক মানুষ আইবো। এহন তোদেখতাছি দেড়শো ছাড়াইয়া গেছে। এইত্তো জনের খাওনের কি অইবো?
বাবা হেসে বললেন—
—এইডা তো বিয়া বাড়ী। তুই অত চিন্তা করিস না। দরকার পরলে বাজারেরহোটেল থেইক্যা খাবার আনাইমু। আর এতজন এক রাইতে থাকবোও না। বিয়েরপরেই সবাই চইল্যা যাইবো।
কাকা অসন্তুষ্ট গলায় বললেন—
—তা ঠিক, কিন্তু এইত্তো লোকের ভিড়ে উঠোনে জায়গা অইবো কই?
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন—
—গ্রামের মানুষজন। হগ্গলে ছেলেকে পছন্দ করে। গ্রামের প্রথম ছেলে যে এতোশিক্ষিত। বর বাড়ীতে খাইতে আইসা সবাই নাকি বাসে হুর হুর করে ঢুইক্যা পড়ে। এই সবই আশীর্বাদ।
কাকা আর কিছু কইলেন না, হনহন করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। সেখানেতখন বড় বড় হাঁড়িতে খাসির মাংস, মাছের ঝোল, আর গরম গরম লুচি ভাজাচলছিলো। ধোঁয়া আর ঘ্রাণে চারপাশ ভরে গেছে।
এদিকে, বরকে ঘিরে চলছে আচার। দরজায় কনে পক্ষের ছেলেরা মজা করছে—
—বর মশাই, আগে গেইট ভাড়া দিতে হইবো, তারপর ঢুকতে পারবেন!
সবাই হেসে ওঠে, কনেপক্ষের মেয়েরা হেসে খুন।
অবশেষে মঙ্গল ঘরে নিয়ে আসা হলো বরকে। শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনিতে কাঁপতেলাগলো চারদিক। ফুলশয্যার সাজানো গৃহে মীনাক্ষী আসলো পিঁড়ির উপর বসে। মাথায় লাল ঘোমটা, হাতে শঙ্খ-পলা আর লোহা, গায়ে লাল-সাদা শাড়ি। তাকেদেখে মনে হচ্ছিলো যেন একেবারে পূজার দেবী।
এরপর শুরু হলো সাত-পাক। ভাইপোরা কনেকে পিঁড়ির উপর তুলে বরকে প্রদক্ষিণকরালো সাতবার। ঢাক বাজছে, শঙ্খ বাজছে, উলুধ্বনি কানে বেজে উঠছে। শুভ্ররবুকটা কেমন করে উঠলো।
তারপর এলো সেই মুহূর্ত। সিন্দুরদান। বর কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলো, কনে চুপচাপ চোখ নামিয়ে রাখলো। চারপাশে সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো—
—হইয়া গেলো, হইয়া গেলো, এখন থেকে ওরা একসাথে!
মীনাক্ষীর চোখ ভিজে উঠলো, শুভ্ররও বুকের মধ্যে কেমন কেমন লাগলো। কোলাহল, গান, হাসি, আতশবাজি। সব মিলিয়ে বিয়ের রাতটা যেন গ্রাম জুড়েএক মহা-উৎসব হয়ে উঠলো।
কিন্তু পরের দিন ঘটে গেল সেই ঘটনা যা আজও শুভ্রর মনে রক্তক্ষরণ ঘটায়।
দিনের আলোতে, কনেকে নিয়ে বরযাত্রীরা ধীরে ধীরে বাড়ি ছাড়লো। মুহূর্তের মধ্যেআলো ঝলমলে উঠোন অন্ধকারে ডুবে গেল। মঙ্গল সুর থেমে গেল, উলুধ্বনিরআওয়াজ মিলিয়ে গেল। শুধু শোনা যাচ্ছিল মীনাক্ষীর হাহাকার—
—মা গো, আমায় ছাইড়া দিও না… দাদা, আমাকে একবার বুকে জড়াইয়ারাখো…বাবাগো…..
মীনাক্ষীর সেই আর্তনাদে যেন গোটা আকাশটা ভেঙে পড়ছিল। কখনো মায়েরবুকে মুখ গুঁজে কাঁদছিলো, কখনো দাদা অরুণের বুক আঁকড়ে ধরছিলো। কিন্তুসময়ের নিয়মের কাছে সব অসহায়। শেষমেশ সবাই চোখের জলে বিদায় দিলো।
যখন বরযাত্রীর গাড়ি রাস্তায় মিলিয়ে গেল, সারা বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। সামিয়ানার নিচে পড়ে রইলো ছেঁড়া ফুল, নিভে যাওয়া প্রদীপ আর কান্নার ভারীগন্ধ। সেই নীরবতা যেন কারও গলা টিপে ধরছিলো।
অরুণের পক্ষে এই বিদায় মানা সম্ভব হলো না।
আদরের বোন, যার হাত ধরে খেলাধুলা করেছে, যার হাসি দেখে বড় হয়েছে, যেপ্রতি সকালে স্কুলের ইউনিফর্ম পড়ে কাঁধে স্কুলের ব্যাগটা ঝুলিয়ে দাদা আসছি বলেবেড়িয় যেতো, সে হঠাৎ যেন এক অচেনা জীবনের দিকে চলে গেল। বুকেরভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছিলো তার। মনে হচ্ছিলো, জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকেহারিয়ে ফেললো সে।
বেলা তখন গভীর, নিঝুম ঘরে নেমে এসেছে এক অদ্ভুত শূন্যতা। ঘরের ভেতরেকারও পদচিহ্ন নেই। সকলেই রান্নাঘরে, যেখানে মা মেয়ের বিদায়ের শোকেবুকফাটা বিলাপে অন্যদের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে, অরুণ নিঃশব্দে পা টিপে বারান্দার লাগোয়া ঘরে ঢুকে পড়ল। টেবিলের উপর রাখা ঘুমের বড়ির শিশি খুলে যেন মৃত্যুর সঙ্গে এক নিষ্ঠুর সন্ধিকরল সে। একটির পর একটি বড়ি মুখে পুরে নিতে লাগল।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই তার দেহ ভারী হয়ে এলো, চোখের পাতা আর উঠল না। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে রইল অচেতন।
রান্নাঘরের কান্না থেমে গেল হঠাৎ। একটি হাহাকার ছুটে এলো ঘরের ভেতর থেকে। সকলেই আঁতকে উঠে ছুটল তার কাছে। শুরু হলো ডাকা ডাকি। তারপর দৌড়েগেল হাসপাতালে।
কয়েকদিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে হিংস্র এক লড়াই চলল। সাদা দেয়ালে প্রতিদিন ভেসে উঠল ডাক্তারদের নিস্তব্ধ মুখ, মায়ের প্রার্থনার শব্দ।
অবশেষে ডাক্তাররা বললেন—
“সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে। কিন্তু এই মানসিক আঘাত… এত গভীর, কোনোদিনওমুছে যাবে না।”
ওদিকে মীনাক্ষীও শূন্যতায় ডুবে ছিলো শ্বশুরবাড়িতে। নতুন সাজপোশাক, ঝলমলে ঘর, ফুলের মালা, সবই তার চোখে শূন্য লাগছিলো। হঠাৎ মনে হচ্ছিলো, এই সব কিছু মায়া, সবকিছুই তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে তার আপনজনদের কাছথেকে।
মীনাক্ষীর বুক থেকে আসছিলো নিঃশব্দ আর্তনাদ।
সময় যেন থেমে থাকে না, তার নিজস্ব গতিতে বয়ে চলে।
মীনাক্ষী এখন শ্বশুরবাড়িতে সুখের আলোয় ভেসে আছে। শুরুর দিনগুলোতে মনবসতো না কিছুতেই— বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠতো অকারণেই। কিন্তুশ্বশরের অগাধ স্নেহ-ভালোবাসা আর স্বামীর কোমল মমতায় ধীরে ধীরে নিজেকেআপন করে নিলো এই নতুন পরিবারে।
অরুণের সংসারও নতুন স্বপ্নে রঙিন হয়ে উঠছে। কন্যা সন্তানের আগমনে ঘর যেনআলোকিত হয়ে উঠেছে আনন্দে। গ্রামের দায়-দায়িত্বের ভার এখন অরুণের কাঁধে, আর সেই দায়িত্বই তাকে দিন দিন আরও দৃঢ় ও পরিণত করে তুলছে।
শুভ্র ছোটবেলা থেকেই ছিল চঞ্চল, কল্পনায় ভরপুর, স্বপ্ন-বাজ এক কিশোর। কিন্তুজীবনের নির্মম পরিহাস যেন তার স্বপ্নের পথ আটকে দিল অকালেই।
তখনো সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বয়স মাত্র তেরো-চৌদ্দ, অথচ হঠাৎ করেই সবকিছুওলটপালট হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে শৈশবের উচ্ছল হাসি ঢেকে গেল অচেনাঅন্ধকারে।
এক দিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই বাবার অসুস্থ হয়ে পড়া যেন পুরোপরিবারটিকে শূন্যতায় ঠেলে দিল। শুভ্র তখনও বুঝতে পারেনি, এ ভোরটাই তারজীবনের সবচেয়ে কালো সকাল হয়ে থাকবে। দুপুর গড়ানোর আগেই বাবার প্রাণনিভে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো, শুধু মায়ের বুক-ভাঙা কান্না আরআত্মীয়-পরিজনের শোক-আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়লো উঠোন-জুড়ে।
শুভ্র, যে তখনো কিশোর, হতভম্ব হয়ে বসেছিল। যে হাত একদিন তাকে আদরে, শাসনে আর নির্ভরতায় আগলে রেখেছিল, সেই হাত এক ঝটকায় অদৃশ্য হয়েগেল। বড়ভাই বিকাশ দাদা হাহাকার করে বাবার মৃতদেহের পাশে মূর্ছা যাচ্ছিলেনবারবার। শুভ্র কিছুতেই কাঁদতে পারছিল না। বারান্দার এক কোণে বসে শুধু বুকফাটানো গোঙানিই বের হচ্ছিল তার ঠোঁট থেকে।
সন্ধ্যা নামতেই দূর ঢাকা থেকে ছুটে এলেন অরুণ দাদা, বৌদি ও বাকিরা। খবরপেয়েই মীনাক্ষীদি ছুটে আসলেন গ্রামে। উঠোনে ঢুকেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সেইমুহূর্তে যেন গোটা পরিবারটাই ভেসে যাচ্ছিল দুঃখের স্রোতে।
কিন্তু সেই অন্ধকার সময়ের ভেতরেই অরুণ দাদাই হয়ে উঠলেন পরিবারের একমাত্রআলো। তিনি শুধু দায়িত্ব নিলেন না, ভেঙে পড়া ঘরের ভেতর নতুন প্রাণের সঞ্চারকরলেন। ছোট ভাইবোনের মুখে আবার হাসি ফোটানো, মায়ের চোখের অশ্রু মুছেদেওয়া, এটাই হয়ে উঠলো তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। মাঝে মাঝে মায়ের হাতধরে বলতেন—
“ভয় পেও না, মা। আমি আছি। এ পরিবারকে আমি আবার দাঁড় করাবো।”
তার সেই দৃঢ় কণ্ঠস্বর, সীমাহীন স্নেহ আর অবিরাম ত্যাগ ধীরে ধীরে ভেঙে যাওয়াপরিবারকে আবার গড়ে তুললো। ছোট ভাইবোনেরা পড়াশোনায় এগিয়ে যেতেপারলো, আর শুভ্রও খুঁজে পেল নতুন পথচলার শক্তি।
মেট্রিক পরীক্ষার পর শুভ্রকে সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে এলেন অরুণ দাদা। ভর্তিকরালেন একটি সরকারি কলেজে। নতুন শহর, নতুন সংগ্রাম, নতুন স্বপ্ন, কিন্তুশুভ্র জানতো, তার পেছনে দাদার অদম্য সাহস আর ছায়া রয়েছে।
অরুণ দাদা কেবল বড় ভাই ছিলেন না। তিনি হয়ে উঠেছিলেন পিতার প্রতিচ্ছবি। শূন্য থেকে যে ভিত্তি তিনি গড়ে তুলেছিলেন, সেটাই একদিন রূপ নিলো পরিবারেরদৃঢ় আশ্রয়ে।
-চলবে
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট