শ্রীচরণেষু দাদা-২২

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:০১ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৯ পিএম
শ্রীচরণেষু দাদা-২২

জীবনের স্রোত যেন অদৃশ্য এক নৌকা।

কখন যে জীবন থেকে অনেকগুলো বছর গড়িয়ে গেল, অরুণ টেরই পায়নি। শুভ্রও কলেজ পাশ করেছে। মীনাক্ষীরও কোল জুড়ে এসেছে নতুন সন্তান। সময় ও অভিজ্ঞতার স্রোতে ভেসে যেতে যেতে সুবীর আর সঞ্জয় ধীরে ধীরে আলাদা রকমের চিন্তাধারার মানুষ হয়ে উঠল। সুবীরের মন বসলো ব্যবসায়। নিজের লাভ-ক্ষতির হিসাবেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সংসার তার কাছে যেন দূরের কোনো দায়, নিজের জগত নিয়েই সে সবসময় ভাবনায় ডুবে থাকে। 

অন্যদিকে, সঞ্জয় বেছে নিলো ভিন্ন পথ। আসলে সঞ্জয় কখনোই খুব মেধাবী ছাত্র ছিল না। সে বুঝতে পারল, ঢাকার কলেজ থেকে পাস করা তার পক্ষে সহজ হবে না। কোন এক বন্ধু পরামর্শে দক্ষিণ বঙ্গের কোন এক ছোট শহরের এক কলেজে ভর্তি হওয়ার ভাবনা মাথায় আসে। অর্ডিনরি ডিগ্রীতে শেষ পর্যন্ত সেই দূরের অচেনা শহরের কলেজেই ভর্তি হলো সে। শুভ্র তখন ঢাকায়ই পড়াশুনা করছে। সিদ্ধান্তটা সহজ ছিল না, বিশেষ করে দাদার প্রবল আপত্তির মুখে, কিন্তু সঞ্জয় এবার নিজের পথ বেছে নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অভিমানের ছায়া মুখে ভাসলেও দাদা আর কোনো কথা বললেন না। পরিবারের শান্তর কথা ভেবে মুখ বুঝে সহ্য করলেন।

বিয়ের দুই বছরের মাথায় সংসারের আলো জ্বেলে অরুণের প্রথম সন্তান জন্ম নিলো। তার পরে এলো আরও দু’জন। তবুও কেন জানি না, ছোট মেয়ে রুপাই যেন হয়ে উঠল অরুণের হৃদপিণ্ড। রুপার সামান্যতম কষ্টও অরুণের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হতো না। শুভ্র ছোটবেলা থেকেই এসব দৃশ্য দেখেছে। রুপা যদি একটু হাঁচিও দেয়, সঙ্গে সঙ্গে অরুণ দাদা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতেন।

“কি রে, এত ঠাণ্ডা লাগছে কেন? তোর মা তোর কোন যত্ন নেয় না, তাই বুঝি!” — বলে তিনি তৎক্ষণাৎ বৌদিকে ডাক দিতেন।
“শুনছো, রুপাকে ভালো করে দেখছ তো? এভাবে চললে মেয়েটার শরীর যাবে।”
বৌদি হয়তো একটু বিরক্ত স্বরে বলতেন,
“আরে, হাঁচি দিছে। এইডা দেইখ্যা ভয় পাইলে অইবনি? ঢং আর সহ্য অয় না। বাচ্চাদের একটু-আটটু হইয়াই থাকে। এতো চেঁচামেচি -চিল্লা-চিল্লী করার কিতা আছে?”
তখন অরুণ মুখ ভার করে উত্তর দিতেন,
“আম বুঝি চেঁচা-মেচি করি? তুমি বোঝো না!” তারপর রুপাকে কোলে নিয়ে বলতে থাকেন “আমার রুপার কোন কষ্ট হলে আমি কিন্তু বাঁচব না।”

একবার ঘটলো এক ঘটনা। রুপা তখন মাত্র বছর দু’য়েকের। হাঁটতে শেখার আনন্দে সারাদিন এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াত রুপা। একদিন বারান্দায় দৌড়াতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। হাঁটুতে হালকা আঁচড় পড়েছিল শুধু। অরুণ দা ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন। বৌদি রান্নাঘরে। শুভ্র পড়ছিল। রুপার কান্না শুনে অরুণ দাদা তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে উঠলেন—
“ওরে বাপরে! রুপা পড়ে গেল!”
তিনি দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন। ব্যথায় নয় বরং বাবার বিকট চীৎকারে রুপা কেঁদে মুখ লাল করে ফেলেছে। অরুণ তাড়াহুড়ো করে বললেন,
“শুনছো, ওর হাঁটুতে রক্ত বেরোচ্ছে! তাড়াতাড়ি কিছু লাগাও!”
বৌদি হেসে বললেন,
“এ আর এমন কিতা অইছে! বাচ্চা তো দৌড়াইতে শিখতাছে, একটু পইড়া গেলে এমনত অইবই। ওর কিচ্ছু অয় নাই।”
অরুণ গম্ভীর গলায় বললেন,
“না, তুমি এসব হালকা করে দেখো না। আমার রুপার যেন কোন কষ্ট না হয়।”
শুভ্র তখন এইসব শুনছিল। মনে মনে ভাবলো—“এতটুকু আঁচড়েই যদি দাদার এ অবস্থা, তবে রুপা বড় হলে কি হবে?

একবার তো ঘটনা এত দূর গড়াল যে রুপার সামান্য জ্বরেই অরুণ সারারাত বিছানার পাশে বসে রইলেন।
ঘরের এক কোণে ঝুলে থাকা টিমটিমে বাল্বের হলুদ আলোয় ঘরটা কেমন যেন অস্বস্তিকর-ভাবে নীরব। বাইরে গলির ভাঙা লাইট-পোস্টে আলো জ্বলছে–নিভছে। দূরে রিকশার ঘণ্টা আর কুকুরের ডাক মিলেমিশে আসছে ভেতরে।
ছোট্ট রুপা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে, কপাল তপ্ত। ভেজা কাপড় কপালে রাখতেই সে কুঁকড়ে উঠল। অরুণ দাদার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে রাতভর জেগে থেকে। প্রতি মুহূর্তে তাঁর বুক কেঁপে উঠছে, যেন নিজের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
বৌদি বিরক্ত হয়ে বললেন,
“তুমি কি সারাডা রাইত ঘুমাইতা না?
অরুণ কণ্ঠ ভারী করে বলল,-“আমার রুপা জ্বর নিয়ে কাতরাচ্ছে, আর আমি নিশ্চিন্তে ঘুমব? কি কও তুমি? মাথা ঠিক আছে”
রাতভর তিনি সেঁক দিলেন, ভেজা কাপড় কপালে রাখলেন। আর শুভ্র চুপচাপ মনে মনে ভাবল, এই সংসারে দাদার সত্যিকারের দুর্বলতা যদি কেউ থাকে, তবে সে শুধু রুপা।

সে সময় শুভ্ররা থাকত পুরাণ ঢাকার কসাইটুলী-লগ্ন মাহুত-টুলীর এক ভাড়া বাসায়। পুরনো দোতলা একটি বিল্ডিং। ভাঙাচোরা সিঁড়ি, ছাদের প্লাস্টার খসে পড়া, আর গলির ভেতর চিরদিনকার স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। বিল্ডিংয়ের দুতলার এক পাশের মাত্র দুটি ঘরেই অরুণের গোটা সংসার গুটিয়ে থাকত। এক ঘরে স্ত্রী আর তিন সন্তান, আরেক ঘরে থাকে অরুণের তিন ভাই। জায়গা বড়জোর বারো হাত বাই দশ হাত, কিন্তু সেই সীমিত দেয়ালের ভেতরেই তাদের হাসি-কান্না, স্বপ্ন আর বেঁচে থাকার লড়াই। শুভ্র যতদিন ঢাকায় ছিল, প্রায় সবসময়ই দেখেছে অরুণ দাদা মেঝেতে একটা মাদুর পেতে শুয়ে থাকতেন। নিজের জন্য বিছানার দাবি তিনি কোনোদিন তোলেননি।

পুরাণ ঢাকার সেই মহল্লায় সকাল হলেই এক অদ্ভুত শব্দ-গন্ধের মিশেল ভেসে আসত। সরু গলির ভেতর কসাইদের দোকান, ঝোলানো গরুর মাংসের কাঁচা গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকত। কোথাও কোথাও খোলা ড্রেনের পাশে পচা পানির দমকা গন্ধ, আবার খানিকটা দূরেই হালিম, নিহারির দোকানের মশলার ঘ্রাণ। স্যাঁতসেঁতে ভেজা গলির সাথে মিশে যেত বিরক্তিকর নর্দমার গন্ধ। রোদ কম আসে এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন গলির মাঝে সবসময় জমে থাকত আধ-পচা ময়লা পানি। মাঝে মাঝেই খোলা ম্যান-হোল থেকে দুর্গন্ধের সঙ্গে ভেসে আসত মশার ঝাঁক। মুখে রুমাল চেপে হাঁটে হতো।
শুভ্রর মনে হতো, পুরাণ ঢাকা কখনো ঘুমোয় না। এই গলির শব্দ, গন্ধ, ভিড় যেন তার শ্বাসে মিশে আছে। এতো নর্দমার মাঝে সে সময় পুরনো ঢাকা শুভ্রের খুব ভালো লাগতো।

সরু গলি দিয়ে কটু হেঁটে গেলেই প্রস্থ রাস্তা। রাস্তায় সারাদিন কোলাহল লেগেই থাকত। রিকশার ঘণ্টার ঝনঝনানি, হকারদের হাঁকডাক, ছেলেপুলেদের চিৎকার, মনে হতো পুরাণ ঢাকা কখনো ঘুমোয় না। বিকেল গড়িয়ে রাত হলেও রাস্তার মোড়ে বাতির নিচে দাঁড়িয়ে থাকত লোকজন। কেউ বিড়ি টানছে, কেউ আড্ডা মারছে। তবে এই এলাকার প্রায় সবাই ছিলো খাঁটি ঢাকাইয়া। 

এই ভিড়ভাট্টার, শব্দ-দুর্গন্ধে ভরা পরিবেশেই অরুণরা তাদের জীবন চালাত। সংসারে একদিকে টানাটানি, অন্যদিকে স্বপ্ন। ভাইদের পড়াশোনা, গ্রামে মা ও ছোট ভাইয়ের ভরন পোষণ বাচ্চাদের স্কুলের খরচ, বাজার, সব মিলিয়ে সংসারের ঘানি টেনে চলা ছিল কঠিন। তবু অরুণের চোখে ছিল এক অদম্য আলো। ছোট মেয়ের একটু হাঁচি-কাশিতেই তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন, কিন্তু নিজের ক্লান্তি কিংবা অভাব নিয়ে কোনোদিন আক্ষেপ করতেন না।

সংসারে অল্প খাবার হলেও ভাগাভাগি করে খাওয়া চলত। কখনো কেবল ডাল-ভাত, তার সাথে আলুর ভর্তা, তবুও যেন সেই ভাতই ছিল তাদের কাছে অমূল্য। শীতের রাতে অনেকসময় মশারি ঝুলানোর মতো অবস্থাও থাকত না। ভাইয়েরা গায়ে চাদর জড়িয়ে পাশাপাশি শুয়ে থাকত। রুপা ছোট্ট বিছানায় মায়ের পাশে, আর অরুণ দাদা নির্দ্বিধায় মেঝেতে পড়ে থাকতেন।

তবু এই অভাব-অপ্রতুলতার ভেতরেও তাদের স্বপ্ন ছিল। শুভ্রদের মনে হতো, একদিন তারা বড় হবে, ভালো পড়াশোনা করবে, এই অন্ধকার গলি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে আলো-হাওয়ার প্রশস্ত দুনিয়ায়। অথচ বাস্তব ছিল কঠিন। প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রাম, প্রতিটি শ্বাসে অভাব।

তার পরেও সংসারে ছিলো এক প্রশান্তির ছোঁয়া। এই ছোট্ট বাসাটাই যেন হয়ে উঠল বেঁচে থাকার পরম তৃপ্তির আপন ঠিকানা।
ঘরে হুল্লোড়, বাইরে দায়িত্ব। নানা উত্থান–পতন, ভাঙা–গড়া, আনন্দ–উল্লাসের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। সেই সময়ের এক কৌতূহলী বাঁকে, একদিন শুভ্রও চলে যাবে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য। এ কথা তখনও কেউ জানে না, শুধু সময় জানে।

বাইরে লন্ডনের নরম বৃষ্টির শব্দ, অথচ শুভ্রর চোখে তখনও ভেসে উঠছে ঢাকার কসাইটুলীর গলিঘুপচি, শুকরের পাল, আর বারান্দায় দাদার ক্লান্ত মুখ।

জানালায় টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে যেন এক অন্তহীন সুরের আয়োজন চলছে। ভিজে রাস্তায় মানুষেরা ছাতা মাথায় তাড়াহুড়ো করে হাঁটছে, গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে কানে। কখনও ঝড়ো, কখনও স্নিগ্ধ গুঞ্জনের মতো। শুভ্রর লাইব্রেরী কাম অফিস রুমটা রাস্তার ঠিক পাশে, ড্রাইভওয়ের ধারে টানা কাঁচের জানালা। সামনের দিকে রাস্তার ওপারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি পুরনো বাড়ি প্রতিদিন শুভ্রর চোখে নতুন করে ধরা দেয়। লেদারের চেয়ারে হেলান দিলেই, চোখের ভেতর যেন এক অদৃশ্য দরজা খুলে যায়। শুভ্র চোখ বন্ধ করতেই অতীতের স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে ঢেউয়ের মতো। একটার পর একটা দৃশ্য এগিয়ে আসে, ঠিক যেন অন্ধকার হলে চলতে থাকা সিনেমার রিল। এখন এই মুহূর্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেই দিনগুলো, কলেজ জীবনের শেষ প্রান্তের সময়। যেন তখনকার হাসি, অশান্তি, স্বপ্ন আর অদেখা ভয়। সব একসাথে ভেসে এসে বুকের ভেতর বাজতে শুরু করে। দাদার অনন্ত স্বপ্নের ভিতর বোনা ডাক্তার হওয়ার গল্প আর তার নিজের অচেনা সমুদ্রের দিকে ছুটে যাওয়ার গোপন আকাঙ্ক্ষা। দুটি স্বপ্নের ধাক্কায় বুকের ভেতর জেগে ওঠে এক অদ্ভুত টান, করুণ অথচ দীপ্ত।

সেই বছরটির কথা মনে পড়লেই শুভ্রর শরীর জুড়ে ছমছমে ঠাণ্ডা নেমে আসে। যেন সকালের কুয়াশা মনের ভেতর ঢুকে হাড় পর্যন্ত শীতল করে তোলে।
বারান্দার কাঠের পুরনো চেয়ারে বসেছিলেন অরুণ দাদা। হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ। ভোরের আলোয় তাঁর মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, অথচ চোখে যেন অদম্য আশার দীপ্তি। অল্প পরেই স্নান সেরে খেয়ে কাজে বেরুবেন। এই নিয়মিত ছন্দের ভেতরেই চলছিল তাঁর জীবন।
সেই সময়টায় চারদিক যেন নিজস্ব সুরে বেজে উঠত। দূরে কোথাও নামাজ শেষে ভেসে আসত আজানের দীর্ঘ প্রতিধ্বনি, পাখিরা ছাদের এন্টেনা থেকে অন্য ছাদের এন্টেনায় উড়তে উড়তে ডেকে উঠত। ডানার ঝাপটায় ভেসে বেড়াত। বারান্দার গ্রিল দিয়ে তাকালে দেখা যেত কসাইটুলীর কর্দমাক্ত ছোট্ট খোলা জায়গা। বৃষ্টির জল জমে কাদা হয়ে আছে, আর তাতে কয়েকটা শুকর দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের গায়ে কাদা লেগে চকচক করছে সকালের আলোয়।
পাশের বাড়ির বুয়া তখন হয়তো শুভ্রদের বারান্দা ঘেঁষা ছাদে কাপড় মেলে দিচ্ছেন। ভেজা শাড়ি আর গামছাগুলো রঙের ছটা ছড়িয়ে দোল খাচ্ছিল হালকা হাওয়ায়। কোথাও কোথাও রান্নার ধোঁয়া মিশে গন্ধে ভরে যাচ্ছিল বাতাস। পোড়া কাঠের কষা গন্ধ, আর ভেজা মাটির কটু সৌরভ একসঙ্গে মিশে যাচ্ছিল।
ঢাকার সেই পুরনো ভোরগুলোর মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক জীবন-চাঞ্চল্য, যেখানে দারিদ্র্য, অস্বস্তি, আবার সরল আনন্দ একসঙ্গে মিশে থাকত। অরুণ দাদা চায়ের কাপে ধোঁয়া ভেসে যেতে যেতে যেন সব দৃশ্যের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। শুভ্রর ছোট্ট চোখে তখন এই পুরো ছবিটাই এক রহস্যময় জগত—যা আজও ভেসে ওঠে মনে, সেই বছরটির প্রতিটি স্মৃতির সঙ্গে।

হঠাৎই অরুণ দাদা বললেন,
—“দ্যাখ, শুভ্র, তুই পড়াশোনায় ভালো। আমাদের কারও কপালে লেখাপড়া হল না। তোকে নিয়েই আমাদের সব স্বপ্ন। জানিস, আমরা কত দুঃখ-কষ্টে কাটিয়েছি? ভেবেছিলাম, একটু আলো আসবে, কিন্তু সুখের পথেই বাবা চলে গেলেন। একফোঁটা সুখও চোখে না দিয়েই হারিয়ে গেলেন। চিকিৎসার অভাবে তাঁকে বাঁচাতে পারিনি। যদি তুই একদিন ভালো ডাক্তার হতে পারিস, গরীব মানুষদের উপকারে আসবি। মা’র মুখে হাসি ফুটবে, আর আমার বুকটাও হালকা হবে।”
কথাগুলো শুনে শুভ্রর বুকের ভেতর যেন এক অদৃশ্য শপথ গেঁথে গেল। অরুণ দাদার গলায় তখন যে বেদনা মিশে ছিল, তা শব্দের বাইরে। সেটাই যেন শুভ্রর কাছে পরম দায় হয়ে উঠল।
সে অনুভব করল, এখন থেকে তার প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি রাতজাগা পড়াশোনা, প্রতিটি স্বপ্ন শুধু নিজের জন্য নয়। দাদার বুকের ভার লাঘব করার জন্য, মায়ের মুখের হাসি ফিরিয়ে আনার জন্য। আর বাবার মৃত্যুর দুঃখকে আশার আলোয় রূপান্তর করার জন্য।
বারান্দার নিস্তব্ধ সকালের মতোই তখন শুভ্রর মনও স্থির হয়ে উঠল, অটল প্রতিজ্ঞায় ভরা, এক অদৃশ্য দীপশিখার মতো।
শুভ্র মাথা নেড়েছিল, ঠোঁটে হাসি, চোখে তবু ধরা না পড়া এক দ্বিধা।
—“চেষ্টা করব, দাদা”
কোচিং চললো, মক টেস্ট, রাতে বৌদির হাতে বানানো গরম খিচুড়ির গন্ধ, দাদার “আরেকটু কর”–ধরনের কোমল কঠিন তাড়া। কিন্তু ভিতরে ভিতরে শুভ্রর মন ডাক্তারির সাদা এপ্রোনে আটকে থাকলো না। ছুটে যেতে চাইল সমুদ্রের দিকে, দূরের শহরের দিকে, অচেনা ভাষার ক্লাসরুমের দিকে।
পরীক্ষার দিন এসে গেল। প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে সাধ্যমতো লিখল শুভ্র। তবুও হল থেকে বেরিয়েই বুকের ভেতর অদ্ভুত শূন্যতা ভর করল। মনে হলো, কপাল তার সহায় নয়। চোখেমুখে অচেনা এক অস্থিরতা।

রেজাল্ট বেরোনোর দিন সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল এক নিমিষে। ভর্তি পরীক্ষায় সে ব্যর্থ। খবরটা সবার আগে জানাল বৌদিকে। যেন ঘরে ফেরার আগেই ভারটা একটু হালকা হয়।
বৌদি তার হাতটা আলতো করে চাপা দিয়ে বললেন—
—“মন খারাপ কইরেন না। যা হবার তাই অইব। আপনি তো কম চেষ্টা করেন নাই।”
শুভ্রর বুকটা কেঁপে উঠল। অথচ কথাগুলো তাকে অদ্ভুত শান্তি দিল।
সেই সময় অরুণ দাদা কাজে। নিয়ম মতো সন্ধ্যা ছ’টায় ফিরবেন। আর শুভ্র জানে, আজ দাদা ঠিকই খবর জানতে চাইবেন। তাই দাদার সামনে পড়া এড়াতে সে বন্ধুর বাড়ি চলে গেল। ফেরা হলো সন্ধ্যার অন্ধকারে। বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে, এমন সময় টিভি দেখতে দেখতে দাদা ডাক দিলেন—
—“শুভ্র, এদিকে আয়। বস।”
মনে হলো বুকের ভেতরটা হঠাৎ থমকে গেল। নীরবে গিয়ে সামনের চৌকিতে বসল শুভ্র। মুখে কোনো শব্দ নেই। বাতাস ভারী হয়ে আছে। মনে হচ্ছিল, ঝড় আসছে।
দাদা একটুখানি চুপ করে থেকে হঠাৎ বললেন—
—“হেরে গেলে উঠে দাঁড়াতে হয়। তুই পারবি। ডাক্তারি হইল না, এই জন্য মন খারাপ করিস না। অন্য জায়গায় ভর্তি হবি। জীবন এখানে থেমে যায় না।”
শুভ্র অবাক হয়ে তাকাল দাদার দিকে। মনে করেছিল হয়তো রাগ করবেন, হয়তো হতাশ হবেন। কিন্তু দাদার চোখে শুধু ছিল নিঃশর্ত বিশ্বাস আর অদ্ভুত শান্তি। সেই মুহূর্তে শুভ্রর বুক ভরে উঠল এক অচেনা আলোয়। মনে হলো, দাদাই তার অটল ভিত্তি। নীরবে, মনে মনে প্রণাম করল দাদাকে।
সেদিনের সন্ধ্যায় বারান্দার বাতাস ছিল স্তব্ধ, দূরে গলির কোলাহল ম্লান হয়ে আসছিল। কিন্তু শুভ্রর অন্তরে তখন জ্বলে উঠেছিল নতুন এক প্রদীপ। ব্যর্থতার ছাইয়ের ভেতর থেকে অদম্য বিশ্বাসের অগ্নিশিখা। দাদা আছে, দাদার ভরসা আছে। আর সেই ভরসাই তাকে আবার দাঁড় করাবে।

সেদিনের রাতটা, যা শুরু হয়েছিল এক স্নিগ্ধ শান্তিতে, শেষ হলো এমন এক শব্দে, যা চিরদিনের জন্য বদলে দিলো তাদের সংসারের প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি স্বপ্ন।
বারান্দার নিস্তব্ধতা তখন হঠাৎ যেন ভারী হয়ে উঠল। শুভ্র অজান্তেই অনুভব করল, দাদার হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে অচেনা এক ক্লান্তি, এক গভীর ছায়া, যার মানে সে তখনও বুঝতে পারেনি।

-চলবে


ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট