জিম্মিদশা থেকে মফস্বল অর্থনীতির মুক্তি কোন পথে?
এক সময় মফস্বলের হাটে-বাজারে নতুন ব্যবসার জন্ম মানে ছিল এক উৎসবের ঢাক বাজা, জীবনের নতুন সম্ভাবনার গন্ধে ভরে উঠত বাতাস। বাবা তার ছেলেকে কারখানার চাবি তুলে দিতেন- যেন এক উত্তরাধিকার নয়, এক স্বপ্নের দায়িত্ব— ‘আগামীকাল হয়তো বদলে যাবে আমাদের ভাগ্য।’
কিন্তু আজ সেই হাসি ম্লান, সেই হাটে আর শোনা যায় না আশার গুঞ্জন। ছোট শহরগুলোর বুকজুড়ে নেমে এসেছে এক নীরব অন্ধকার, যার নাম ‘অদৃশ্য অর্থনীতি’। এটি কোনো সরকারি নীতি নয়, কোনো বাজারের মন্দার গল্পও নয়—এ এক অদৃশ্য শিকল, স্থানীয় মাফিয়া চক্রের লোহার মুঠো, যা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অর্থনীতির ধমনীগুলো নিঃশব্দে চেপে ধরেছে। ‘সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অন্ধকার সে-ই,’ যেমন লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘যে অন্ধকারে মানুষ নিজের চোখ হারায়।’
আজ মফস্বলের মানুষ ঠিক সেই অন্ধকারেই পথ হারাচ্ছে—যেখানে ব্যবসা আর স্বপ্ন একে একে নিভে যাচ্ছে, আর অর্থনীতির স্পন্দন থেমে যাচ্ছে ধীরে, যেন ভোরের আগে শেষ নিঃশ্বাস।
২০১৫ সাল থেকে শুরু করে যদি আমরা আজকের ২০২৫ সাল পর্যন্ত দশ বছরের চিত্র দেখি, তবে পরিসংখ্যানগুলো শুধু সংখ্যা নয়, যেন হাজারো উদ্যোক্তার চাপা দীর্ঘশ্বাস। ২০১৫ সালের আশেপাশেও ব্যবসার লাভ থেকে যে ‘মাসোহারা’ বা ‘কমিশন’ দিতে হতো, তা ছিল অনিয়মিত এবং বিচ্ছিন্ন, হয়তো মুনাফার ৩-৪%। কিন্তু গত এক দশকে এই চাঁদাবাজি সুসংগঠিত হয়ে ব্যবসার একটি অলিখিত ব্যয়ে পরিণত হয়েছে। এখন ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, ছোট শহরের ব্যবসা ও শিল্প-কারখানার মুনাফার প্রায় ৮% নীরবে মাফিয়াদের পকেটে চলে যাচ্ছে। কল্পনা করুন, একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে টাকা লাভ করছেন, তার প্রায় এক-দশমাংশ চলে যাচ্ছে চাঁদাবাজদের হাতে। এটি কেবল আর্থিক ক্ষতি নয়, এটি উদ্যোক্তার মনোবল, সৃজনশীলতা এবং ঝুঁকি নেওয়ার সাহসকে প্রতিদিন একটু একটু করে গলা টিপে মারছে।
এই মাফিয়া চক্রের ভয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্পের সংখ্যাও যেন প্রতি বছর পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। ২০১০ সালে যেখানে ২% ক্ষুদ্র শিল্প শ্বাস নিতে না পেরে বন্ধ হয়েছিল, ২০২৫ সালে সেই হার ৭% ছুঁয়েছে, অর্থাৎ প্রতি ১০০টি স্বপ্নের মধ্যে সাতটিই পুঁজি বা বাজার হারায়নি, বরং হারিয়েছে নিরাপত্তাহীনতার কাছে।
একাধিক গবেষণামূলক রিপোর্ট ও স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই অদৃশ্য লেনদেন, যার মধ্যে ঠিকাদারী নিয়ন্ত্রণ, বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং বিশেষত বালু উত্তোলন অন্তর্ভুক্ত, তার বার্ষিক মূল্য এখন প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা। এই টাকা যদি দেশের উন্নয়নমূলক খাতে ব্যয় হতো, তবে মফস্বলগুলির চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যেত। 
অবৈধ বালু উত্তোলনের এই লুণ্ঠন শুধু পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ নয়—এটি এখন বাস্তব জীবনের এক ভয়াবহ ঘটনা। গত মে মাসে সুনামগঞ্জের এক নদীপাড়ের গ্রামে গভীর রাতে ড্রেজার মেশিনের গর্জনে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নদীর পাড় ধসে পড়ে, হারিয়ে যায় তিনটি বাড়ি, ক্ষতিগ্রস্ত হয় এক কৃষকের ফসলের জমি। পরদিন সকালে স্থানীয়রা প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেও প্রশাসনের কেউ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়নি। এমন ঘটনাই প্রমাণ করে, এই অবৈধ লেনদেনের মূল ভিত্তি হলো বালু মাফিয়াদের দাপট—যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবৈধ উত্তোলনের বার্ষিক আর্থিক মূল্য এখন ৩,০০০ কোটি টাকারও বেশি। নদী-সংলগ্ন অঞ্চলজুড়ে এটি যেন এক প্রকাশ্য লুণ্ঠন; ড্রেজারের শব্দে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির নিঃশ্বাস, অথচ স্থানীয় প্রশাসন থাকে ‘অজ্ঞাত’। কারণ, মাফিয়া চক্রের অদৃশ্য হাত ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে ক্ষমতার কেন্দ্র পর্যন্ত—যেখানে নীরবতা বিক্রি হয় প্রভাবের বিনিময়ে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে আতঙ্ক আরও বাড়ে। আমাদের আশঙ্কা, ২০৩৫ সালের পূর্বাভাস অনুযায়ী, স্থানীয় উদ্যোক্তারা যখন নতুন বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক ঋণ নেবেন, তখন সে ঋণের ১২% অর্থও ‘কমিশন’ হিসেবে মাফিয়াদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হবেন। অর্থাৎ, একজন উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ নিলে, ১২ লক্ষ টাকাই তাকে দিতে হবে ভয় আর হুমকির বিনিময়ে। এই পরিস্থিতিতে, নতুন শিল্পায়ন বা অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের আশা করা অসম্ভব।
যদি এই নিয়ন্ত্রণ ২০৪০ সাল পর্যন্ত বজায় থাকে, তবে পরিস্থিতি হবে আরও করুণ। ২০৪০ সালের একটি মধ্যবর্তী পূর্বাভাস অনুযায়ী, শহরের বাইরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার কমপক্ষে ৩০-৩৫% কমে যাবে, যা ২০৫০ সালের পূর্বাভাসে ৪০% ছুঁয়ে যাবে। এর ফলস্বরূপ, আঞ্চলিক বৈষম্য আরও তীব্র হবে। গ্রামের তরুণরা কাজের সন্ধানে শহরমুখী হবে, মফস্বলের জনজীবন স্থবির হয়ে পড়বে। একইসঙ্গে, এই চক্রের কারণে স্থানীয় সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আদায় ২৫% ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়নে।
এই অন্ধকার দূর করতে, এই অদৃশ্য অর্থনীতিকে গুঁড়িয়ে দিতে একটি সম্মিলিত বিদ্রোহী পদক্ষেপ দরকার। এই সংগ্রাম শুধু প্রশাসনের নয়, প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের।
প্রথমেই, এই মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একটি জাতীয় প্রতিবেদন তৈরি করা অত্যাবশ্যক। এর ফলে সমস্যাটির ভয়াবহতা জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব পাবে। দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য নাম প্রকাশ না করে অভিযোগ করার নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যাতে ভয়কে জয় করে তারা কথা বলতে পারে। এই প্ল্যাটফর্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই।
স্থানীয় ঠিকাদারী ও সরকারি টেন্ডারে স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল লটারি পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন, যাতে ক্ষমতাশালীর প্রভাবের বদলে যোগ্যতার ভিত্তিতে কাজ হয়। স্থানীয় পুলিশের উপর এই চক্রের প্রভাব কমাতে স্বাধীন তদন্ত দল গঠন করা উচিত, যারা নিরপেক্ষভাবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। পরিবেশ রক্ষার্থে ও অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে স্যাটেলাইট মনিটরিং ও কঠোর জরিমানা আরোপ করা জরুরি।
যে ক্ষুদ্র শিল্পগুলো এই শোষণের কাঁটাতারে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, তাদের পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রয়োজন কোমল অথচ দৃঢ় আর্থিক সহায়তা—কম সুদের পুনর্বাসন ঋণ, যেন তারা আবার নতুন ভোরের আলো দেখতে পারে। এই ছোট কারখানাগুলোই তো একসময় আমাদের মফস্বলের প্রাণ, ধোঁয়ায় মিশে থাকা শ্রমের গন্ধে গড়ে উঠেছিল এক টুকরো স্বপ্নের অর্থনীতি। আজ সেই স্বপ্ন ভেঙে পড়েছে, আর আমরা তাকিয়ে আছি অবশ চোখে।
স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে—কারণ জবাবদিহিতাই পারে ভাঙতে এই অন্ধকার শৃঙ্খল। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে স্পষ্ট: ২০৩০ সালের মধ্যে স্থানীয় অর্থনীতি থেকে অবৈধ লেনদেনের হার নামিয়ে আনতে হবে ৩ শতাংশের নিচে। এই লক্ষ্য শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার—আমাদের সন্তানদের জন্য এক সৎ ও নিরাপদ আগামী গড়ে তোলার শপথ।এই পরিবর্তন আনতে হলে ছোট শহরগুলোতে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে, কিন্তু বিনিয়োগের আগে চাই নিরাপত্তা, চাই আইনি সুরক্ষার নিশ্চয়তা। উদ্যোক্তা যেন আর ভয় না পায় নিজের শহরে বিনিয়োগ করতে; যেন বিশ্বাস ফিরে আসে, সাহস ফিরে আসে। আর এজন্যই স্থানীয় চেম্বার অফ কমার্সকে দিতে হবে আইনি সুরক্ষা—যাতে তারা মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে, নির্ভয়ে দাঁড়াতে পারে সত্যের পক্ষে, হয়ে উঠতে পারে প্রতিরোধের প্রতীক।
সব তথ্য, সব পরিসংখ্যান, সব বাস্তবতার পর একটাই সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে—আমাদের ছোট শহরগুলোর অর্থনীতি আজ এক নীরব জরুরি অবস্থায় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এই অন্ধকার শুধু টাকার চুরি নয়; এটি আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের আশা, আমাদের জন্মভূমির মর্যাদাকেও লুণ্ঠন করছে। তবু আমরা নীরব থাকব না। আমরা আর দর্শক নই, আমরা সেই দ্রোহের সন্তান—যে হাতে আমাদের স্বপ্নের মুনাফা ছিনিয়ে নেওয়া হয়, আজ সেই হাত গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা, প্রতিটি বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা আজ এক একেকটি প্রতিবাদের আগুন।ভয় নয়, লড়াই হবে। কারণ মফস্বলের রক্তক্ষরণ আর নয়—আমাদের অর্থনীতি আমাদেরই এবং আমরা-ই এর মুক্তিদাতা!
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
