শেষ বিকেলের গল্প: একাকীত্বের মহাকাব্য
নদীর ঘাটে বসে আছেন সত্তরোর্ধ্ব জমির উদ্দিন। শেষ বিকেলের হালকা আলোয় তার সাদা দাড়িগুলো আরও সাদা দেখাচ্ছে। একসময় যে জমিতে ফসল ফলিয়েছেন, আজ তা উঁচু দালানে ঢাকা। ছেলেমেয়েরা সবাই শহরে। বছরের পর বছর অপেক্ষার পর, এখন তাদের কেবল ঈদের সময় দেখা মেলে। জমির উদ্দিনের শরীরটা ভালো নেই, কিন্তু চিকিৎসার জন্য শহরের বড় হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য বা সাহস কোনোটাই তার নেই। এমন চিত্র কেবল জমির উদ্দিনের নয়, বাংলাদেশের লাখ লাখ প্রবীণের। তারা যেন এক নীরব নদীর মতো, যা একসময় জীবনের উৎস ছিল, এখন কেবল শুকিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন জাগে, এই নীরবতার কারণ কী? কেন তারা নিজেদেরই তৈরি করা সমাজে আজ এত একা?
একসময় যৌথ পরিবার ছিল আমাদের সমাজের প্রাণ। প্রবীণরা ছিলেন সেই পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। সন্তানেরা তাদের দেখভাল করত, সম্মান করত। কিন্তু আজ সেই যৌথ পরিবার ভেঙে ছোট ছোট এককের জন্ম হয়েছে। শহরের জীবন, যেখানে ব্যস্ততা আর প্রতিযোগিতা প্রধান, সেখানে প্রবীণদের স্থান সংকীর্ণ হয়ে আসছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫%, তখন তারা মূলত পরিবারের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখন এই সংখ্যা প্রায় ৮%। পরিবারের ভাঙন ও শহুরে জীবনের ব্যস্ততার কারণে প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা এক জটিল চ্যালেঞ্জ। তাদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল বা ডাক্তার নেই বললেই চলে। অনেক প্রবীণই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন, কিন্তু সঠিক চিকিৎসা পান না। গ্রামের দিকে চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল, আর শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যয়বহুল। জমির উদ্দিনের মতো অনেক প্রবীণই তাই নীরবে রোগ ভোগ করে চলেন। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা আরও করুণ। পেনশন বা সরকারি ভাতা সবাই পান না। যারা পান, তা দিয়ে জীবন চালানো অসম্ভব।
ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার একটি গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি হাশেম আলী (৭৫) জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নানা শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত। দীর্ঘদিন ধরে তার ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলেও, এলাকায় কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাঝে মাঝে গিয়ে ওষুধ আনেন, কিন্তু নিয়মিত ফলো-আপের ব্যবস্থা নেই। সন্তানরা ঢাকায় চাকরি করে—তারা মাসে একবার ফোনে খোঁজ নেয়, কিন্তু সময়ের অভাবে প্রায়ই দেখা করতে আসে না।
হাশেম আলী গ্রামের হাটে বসে পুরনো বন্ধুরা মিলে গল্প করতেন, কিন্তু এখন হাঁটাচলার কষ্টে ঘরেই থাকেন।সরকারি বয়স্ক ভাতা পান, মাসে মাত্র ৬০০ টাকা। এই টাকায় তার ওষুধের এক সপ্তাহও চলে না। কোনো বেসরকারি প্রবীণ সেবা কেন্দ্র নেই আশেপাশে, আর শহরে গেলে চিকিৎসা খরচ বহন অসম্ভব। সমাজের তরুণরা তার দিকে তেমন নজর দেয় না—তাদের কাছে তিনি ‘অতীতের মানুষ।’ প্রবীণদের ডে-কেয়ার সেন্টার বা বিনোদনের ব্যবস্থা এখনো কল্পনার জগতে। প্রবীণ নিবাসগুলোতেও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। এই শূন্যতা কি কেবল সরকারের দায়িত্ব? নাকি এটি সমাজের প্রতিটি সদস্যের ব্যর্থতা?
যদি এই সমস্যার সমাধান না হয়, তবে ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হবে। ২০৪০ সাল নাগাদ প্রবীণদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৫% ছাড়িয়ে যাবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে যদি আমরা উপেক্ষা করি, তাহলে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হবে। স্বাস্থ্যসেবা খাত অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রবীণদের চাপ সামলাতে পারবে না। অর্থনৈতিকভাবে, একটি বড় অংশ উৎপাদনশীলতা থেকে দূরে থাকবে, যা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে বাধা দেবে।
এই সমস্যার প্রভাব এখন থেকেই শুরু হয়েছে। আমাদের ছাত্রসমাজ এর বলি হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীকে পড়াশোনা ছেড়ে উপার্জনে নামতে হচ্ছে, কারণ তাদের পরিবারের প্রবীণ সদস্যের চিকিৎসা বা ভরণপোষণ জরুরি। শিশুরাও এর শিকার। দাদা-দাদি বা নানা-নানির স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা, যা তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভবিষ্যতের প্রজন্ম হিসেবে তারা শিখছে যে বৃদ্ধ বয়স এক বোঝা, যা সম্পর্ক ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি তাদের বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে তুলছে।
এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সাধারণ জনগণের ভূমিকা অপরিহার্য। ২০১০ সালে যেখানে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ১৫%, তখন তারা মূলত পরিবারের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখন সেই সংখ্যা ১৮%। এই পরিবর্তনের সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও জরুরি। বেসরকারি উদ্যোগে প্রবীণদের জন্য বিশেষ সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা, যেখানে তারা শুধু চিকিৎসা নয়, বরং বিনোদন ও সামাজিক মেলামেশার সুযোগ পাবেন। ছাত্রসমাজ নিজেদের অবসর সময়কে প্রবীণদের সেবায় ব্যয় করতে পারে। যেমন, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে প্রবীণদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়া বা তাদের গল্প শোনা। আমাদের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিষয়টিকে দেখা উচিত।
প্রবীণদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার এই উদ্যোগ স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকে শুরু করা দরকার। পাঠ্যক্রমে প্রবীণদের গুরুত্ব এবং তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ নিয়ে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ছোট ছোট উদ্যোগ, যেমন প্রতিবেশীর প্রবীণ সদস্যের খোঁজ নেওয়া বা তাদের প্রয়োজনে সাহায্য করা, এক বৃহৎ পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। এই সমস্যার সমাধান শুধু সরকারের উপর ছেড়ে দিলে চলবে না, বরং এটি আমাদের সকলের যৌথ দায়িত্ব।
প্রবীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষা একটি জটিল সমস্যা। কিন্তু এটি সমাধানযোগ্য। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি পেনশন স্কিমকে আরও কার্যকর করা, প্রবীণদের জন্য বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন করা এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আজ যারা যুবক, কাল তারাই প্রবীণ হবে। আমরা আমাদের প্রবীণদের সাথে যে আচরণ করব, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের সাথেও তাই করবে। এটি কেবল মানবিকতা বা নৈতিকতার প্রশ্ন নয়, বরং একটি টেকসই সমাজের ভিত্তি গড়ে তোলার প্রশ্ন।
এই সমস্যার প্রতিরোধে যদি আমরা দ্রুত পদক্ষেপ না নিই, তাহলে এর প্রতিকার করা একসময় অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই আজই আমাদের জেগে উঠতে হবে, নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কারণ, ‘যদি আজ তুমি প্রবীণের কান্না না শোনো, কাল তোমারই অশ্রু ঝরবে’।
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
