শিক্ষকের লালসায় অন্ধকারের পথে জাতির ভবিষ্যৎ
আজ বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো, আর এর মেরুদণ্ড হলেন শিক্ষকেরা। তারা কেবল শিক্ষক নন, তারা জাতির নির্মাতা, স্বপ্ন দেখানোর কারিগর। কিন্তু আজ সেই পবিত্র স্থান—বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ—এক নীরব বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। শিক্ষকদের ব্যক্তিগত কোচিং ব্যবসার লোভ, তাঁদের নৈতিকতা এবং পেশাগত দায়িত্বের ওপর এক কালো ছায়া ফেলেছে।
শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ কম দেওয়া এই শিক্ষকেরা কেবল তাদের দায়িত্ব থেকে সরে আসছেন না, তাঁরা দেশের লাখ লাখ শিশুর ভবিষ্যতের ওপর এক অশনি সংকেত এঁকে দিচ্ছেন। যখন রাষ্ট্রের সবটুকু ভরসা এই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর, তখন এই "শিক্ষার নীরব বাণিজ্য" এক জাতীয় সংকটে রূপ নিয়েছে। এই করুণ গাথা শুনতে গেলে কেবল চোখ নয়, হৃদয়ের কানও খোলা রাখতে হয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন ব্যক্তিগত কোচিং বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন এবং ক্লাসরুমের পড়ালেখায় মনোযোগ দেন না, এর পেছনে পঞ্চাশটিরও বেশি গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণ রয়েছে। এই কারণগুলো যেন এক অদৃশ্য শৃঙ্খল, যা শিক্ষকদের ক্লাসরুম থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোচিং সেন্টারের দিকে।
প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো শিক্ষকদের স্বল্প বেতন ও আর্থিক অনিশ্চয়তা। একজন শিক্ষক যখন দেখেন তার সরকারি বেতনে সংসার চালানো কঠিন, তখন বাধ্য হয়েই বাড়তি আয়ের পথ খোঁজেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (DPE) তথ্য অনুযায়ী, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার শিক্ষকদের মধ্যে আর্থিক অসন্তোষের হার সত্তর শতাংশের বেশি (২০২৪ সাল)। স্বল্প বেতনের কারণে বাড়তি আয়ের জন্য কোচিং অপরিহার্য হয়ে ওঠে এবং দ্রুত ও নগদ অর্থ উপার্জনের লোভ শিক্ষককে নৈতিকতা বিসর্জন দিতে প্ররোচিত করে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (TIB) একটি রিপোর্টে শিক্ষকদের মধ্যে অবৈধ কোচিং ব্যবসার প্রবণতাকে নৈতিক অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রতিবেদন (২০২৩) অনুসারে, প্রাথমিক শিক্ষকদের গড় বেতনের সাথে একজন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয়ের ফারাক প্রায় পঁচিশ শতাংশ।
অন্যদিকে রয়েছে প্রশাসনিক দুর্বলতা ও সামাজিক চাপ। বিদ্যালয় পরিদর্শকদের দুর্বল এবং অনিয়মিত নজরদারি এই অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (PEDP) পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের (UEO) পক্ষ থেকে বিদ্যালয় পরিদর্শনের হার বছরে গড়ে মাত্র চার বার, যা নজরদারির চরম অভাবকেই তুলে ধরে। কোচিং-এ যুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দীর্ঘসূত্রিতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ব্র্যাক পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় বিরানব্বই শতাংশ অভিভাবক মনে করেন কোচিং ছাড়া তাদের সন্তানেরা পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারবে না, ফলে শিক্ষকের ওপর কোচিং করানোর একটি অলিখিত সামাজিক চাপ তৈরি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষা দেখায়, শহর অঞ্চলে প্রায় ৭৬ শতাংশ শিক্ষক সরাসরি কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
এই নীরব বাণিজ্যের ফলস্বরূপ ক্লাসরুমের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। শিক্ষকের মূল মনোযোগ কোচিং-এর আয়ের দিকে থাকায় ক্লাসরুমে পড়ানোর আগ্রহ হ্রাস পায়। বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ক্লাসে সম্পূর্ণ না করে কোচিং-এর ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়। ইউনিসেফের (UNICEF) একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোচিং বাণিজ্যের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার অপ্রত্যক্ষভাবে বেড়ে যায়। শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর অতিরিক্ত তথ্য অনুসারে, বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে পনের শতাংশেরও বেশি শিক্ষক কোনো না কোনোভাবে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (NCTB) গবেষণা বলছে, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে অতিরিক্ত নোট বা শিট ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে প্রায় চল্লিশ শতাংশ।
শিক্ষকদের এই নীরব বাণিজ্য কেবল আজকের প্রজন্মের ক্ষতি করছে না, এটি বাংলাদেশের শিক্ষার ভিতকে দুর্বল করে ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করছে।
|
বছর |
প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার (শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো ভিত্তিতে) |
কোচিং-নির্ভরতার হার (এনজিও গবেষণা ও অর্থনৈতিক পূর্বাভাস) |
শিক্ষার গুণগত মানের সূচক (ইউনেস্কো ভিত্তিতে) |
|
২০১৫ |
২০.০% |
৫০% |
৫৫ |
|
২০২০ |
১৭.৫% |
৬২% |
৫২ |
|
২০২৫ |
১৫.০% |
৭৫% |
৪৮ |
|
২০৩০ (অনুমান) |
১২.৫% |
৮৫% |
৪৫ |
|
২০৩৫ (অনুমান) |
১০.০% |
৯৫% |
৪০ |
|
২০৪০ (অনুমান) |
৮.০% |
১০০% |
৩৫ |
এই পরিসংখ্যানগুলো ভয়াবহ এক ভবিষ্যৎ নির্দেশ করছে। অর্থনৈতিক মডেলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, যদি এই প্রবণতা চলতে থাকে, তবে ২০৪০ সাল নাগাদ প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার ৮ শতাংশে নেমে এলেও, কোচিং-নির্ভরতার হার প্রায় একশো শতাংশে পৌঁছাবে। অর্থাৎ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গুরুত্ব হারাবে। একই সাথে, ইউনেস্কো ভিত্তিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস বলছে, শিক্ষার গুণগত মানের সূচক ২০৪০ সাল নাগাদ পঁয়ত্রিশে নেমে আসতে পারে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চরম পতনের ইঙ্গিত। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) একটি বিশ্লেষণ দেখায়, শিক্ষার গুণগত মান খারাপ হওয়ায় মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (WEF) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষতার অভাবের কারণে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রায় সাঁইত্রিশ শতাংশ তরুণ কর্মসংস্থান সংকটে ভুগছে।
ভবিষ্যতে এর ফল হবে আরও করুণ:
কোচিং-নির্ভরতা বাড়লে মৌলিক জ্ঞান ও সৃজনশীলতা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়বে, কারণ গরিব শিশুরা যারা কোচিং নিতে পারে না, তারা পিছিয়ে পড়বে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গুরুত্ব হ্রাস পাবে এবং জাতীয় মেধার সঙ্কট তৈরি হবে। বিবিএস (২০২৩) এর তথ্য অনুযায়ী, এএমআরজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেলে দেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর একটি গবেষণা অনুসারে, শিক্ষার ঘাটতি এবং স্বাস্থ্যের অবনতি একটি চক্র তৈরি করে।
আজ এই নীরব বাণিজ্য বন্ধ করতে না পারলে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি দুর্বল মেধা ও অকার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার শিকার হবে। শিক্ষকদের নৈতিক দায়িত্ব এবং সরকারের কঠোর তদারকি ছাড়া এই অন্ধকার দূর করা অসম্ভব। এই করুণ গাথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিক্ষার পবিত্রতা যদি বিকিয়ে যায় টাকার কাছে, তবে কোনো জাতিই সমৃদ্ধ হতে পারে না।
হে শিক্ষক! তোমার ক্লাসরুম, তোমার পবিত্র মন্দির! অর্থের লোভে জ্ঞানের দীপ নিভিয়ে দিও না! জাগো, তোমার দায়িত্বের জন্য—কারণ আজ তুমি যা শেখাবে, সেটাই হবে জাতির ভবিষ্যৎ!
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
