অস্থির ঢাকা, বিপন্ন নাগরিক জীবন
আকাশের বুক চিরে একসময় যে শহর সূর্যোদয়ের সোনালি আলো দেখত, আজ সেই ঢাকা এক ধূসর ক্যানভাসে পরিণত হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের পর স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটলেও, এ শহরের ফুসফুস যেন নতুন এক সংকটের শ্বাসকষ্টে ভুগছে। এই ঢাকা কি কখনো তার স্বাভাবিক শান্ত রূপ ফিরে পাবে, নাকি প্রতিবাদের নামে চলছে এক নতুন ধরনের নৈরাজ্য, তা বলা সত্যিই কঠিন। নাগরিকের জীবন এখানে প্রতিদিন এক নতুন অধ্যায়ের গল্প লেখে, যেখানে শান্তি নয়, বরং অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার চিত্রই মুখ্য হয়ে ওঠে।
৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর, জনমনে যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল, তা এখন ক্রমশই হতাশায় পরিণত হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে যে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হওয়ার কথা ছিল, সেখানে দেখা যাচ্ছে এক নতুন ধরনের স্বৈরাচার, যা জনগণের জিম্মি করে নিজেদের দাবি আদায় করতে চাইছে। কোনো একটি ইস্যু উঠলেই মানুষ দলবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে আসে, যা এক প্রকার জিম্মি ও অপরাধমূলক কাজ। সাধারণ মানুষকে আটকে রেখে, অ্যাম্বুলেন্সকে পথ না দিয়ে, তারা নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। এটি এক ধরনের সামাজিক অস্থিরতা, যা কেবল রাজনৈতিক অস্থিরতা নয়, বরং একটি ভঙ্গুর সমাজের প্রতিচ্ছবি।
“তুমি যদি বলো
ভোরের বেলার কাক
শব্দ করা একলা স্টিমার
ফেরিওয়ালার হাঁক
লাঠি হাতে ডাকাত সর্দার
রাত জাগা হাইওয়ের ঘুমিয়ে পড়া কোনো এক ড্রাইভার
এই শহর আমার
এই মানুষ আমার
এই শহর আমার
এই মানুষ আমার”
পুলিশ প্রশাসন, যারা একসময় শৃঙ্খলা রক্ষার প্রতীক ছিল, তারাও এখন যেন অনেকটাই অসহায়। তাদের ক্ষমতা প্রয়োগে এক ধরনের ভয় কাজ করছে, যা প্রমাণ করে দিচ্ছে যে একটি প্রশাসন কীভাবে ভেঙে পড়ছে। সচিবালয়, যা দেশের নীতি নির্ধারণের কেন্দ্র, তা বারবার ঘেরাও করার মতো ঘটনা ঘটছে। এমনকি ছোট ছোট স্কুল ছাত্ররাও, কিছু অসাধু মানুষের প্ররোচনায়, তুচ্ছ কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও করার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এই ঘটনাগুলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সমাজের নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়কে স্পষ্ট করে তোলে। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং ঢাকা শহরকে প্রতিনিয়ত এক অনিরাপদ স্থানে পরিণত করছে।
যদি এই সমস্যার সমাধান না হয়, তবে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী এবং ভয়াবহ। ঢাকা শহর তার প্রাণোচ্ছলতা হারাবে, পরিণত হবে একটি জরাগ্রস্ত শহরে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে, কারণ রাস্তাঘাটে জ্যাম, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের দূরে সরিয়ে দেবে। সাধারণ মানুষ, যারা তাদের দৈনন্দিন জীবিকার জন্য কাজ করে, তারা অসহায়ত্বের শিকার হবে। অ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগীরা সময় মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারবে না, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হবে, এবং ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য সরবরাহ করতে পারবে না। এই পরিস্থিতিতে সমাজের প্রতিটি স্তরে অবিশ্বাস, হতাশা এবং ক্ষোভ বাড়তে থাকবে, যা একসময় সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।
শিক্ষা ব্যবস্থা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়বে, কারণ শিক্ষার্থীরা শিখবে যে দাবি আদায়ের জন্য সহিংস পথই একমাত্র উপায়। পুলিশ প্রশাসন আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙে যাবে। দুর্নীতি বাড়বে, এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তি হবে আরও কঠিন। ঢাকা শহর তার সৌন্দর্য হারাবে, এবং বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হবে। এটি কেবল একটি শহরের সমস্যা নয়, বরং পুরো দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে দেওয়ার মতো একটি চিত্র। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সব স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সাধারণ দায়িত্বশীল নাগরিক, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, বিভিন্ন সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা—সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। ঢাকা শহরকে একটি সুশৃঙ্খল নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দরকার একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা। রাজনৈতিক কার্যকলাপের নামে যে নৈরাজ্য চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। জনভোগান্তি সৃষ্টি করে এমন সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
পাশাপাশি, জনগণকে সচেতন করতে হবে যে জিম্মি প্রথার মাধ্যমে দাবি আদায় এক প্রকার স্বৈরাচারী অনুশীলন। তাদের জন্য এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যেখানে তারা তাদের অভাব-অভিযোগ এবং সমস্যার কথা জানাতে পারে, যেন রাস্তায় নেমে আসতে না হয়। সমাজের প্রতিটি স্তরে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আয়োজন করা যেতে পারে। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো রোগের প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে মানুষ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত থাকে।
ঢাকার মতো একটি প্রাণের শহরকে বাঁচাতে হলে, নাগরিকদের সচেতনতার প্রতিফলন পথে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে দেখাতে হবে। প্রত্যেকটি নাগরিককে তার মৌলিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে। প্রতি মাসে দেশের সংস্কারের হার এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে, বিশেষ করে ঢাকার উন্নয়নের বিষয়টি সবার সামনে প্রমাণ করতে হবে।
আজকের ঢাকা এক ক্রান্তিলগ্ন পার করছে। যে শহর একদিন তার প্রাণের স্পন্দনে উচ্ছল ছিল, আজ তা যেন এক নীরব আর্তনাদ করছে। তবে, এটি একটি সমাধানযোগ্য সমস্যা। প্রয়োজন কেবল দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে আমরা অবশ্যই একটি সুন্দর ও সুস্থ ঢাকা শহর বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে পারব। ‘জীর্ণ নয়, ঢাকা আমার জাগো, হাজার বছরের ঘুম ভেঙে আলোতে ভাগো।’
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
