ফেলে দেওয়া সম্পদই ভবিষ্যতের অশনি সংকেত?
আমাদের চারপাশের প্রাচুর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নীরব ট্র্যাজেডি—তুচ্ছ ভেবে আমরা যা ফেলে দিচ্ছি, তা-ই আমাদের গ্রহের ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত। প্রতিটি আলুর খোসা, প্রতিটি বাসি রুটির কণা কিংবা একটি ব্যবহৃত চায়ের ব্যাগ—এরা যেন এক একটি সুযোগ, যা আমরা অবহেলায় ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করি।
এই আখ্যান কেবল পরিবেশ সুরক্ষার গতানুগতিক আলোচনা নয়; এটি আমাদের মানবিক বিবেকের কাছে এক সরাসরি আবেদন, যেখানে আমাদের উপেক্ষিত সম্পদের করুণ পরিণতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমরা সেই ১৫টি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের গল্প বলব, যাদেরকে আমরা বারবার প্রত্যাখান করে চলেছি।
২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশের নগর জীবনে যে দ্রুত বর্জ্য বৃদ্ধির ধারা শুরু হয়েছে, তা আজ এক ভয়াবহ বাস্তবতা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে যেখানে একজন নগরবাসী দৈনিক গড়ে প্রায় ৩৬০ গ্রাম কিচেন স্ক্র্যাপস বা খাদ্য বর্জ্য উৎপাদন করত, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ তা প্রায় ৪৮০ গ্রামে পৌঁছানোর পূর্বাভাস রয়েছে। এই অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধি আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে এক চরম সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্যই হলো জৈব উপাদান—যা প্রায় ৬.৬ মিলিয়ন টন। এই বিপুল পরিমাণ জৈব সম্পদকে মাটির নিচে চাপা না দিয়ে, যদি আমরা এই ১৫টি উপকরণের মাধ্যমে পুনঃব্যবহারের পথে চালিত করতে পারি, তবে তা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত স্থায়িত্বের জন্য এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ হবে।
আমরা ভুলে গেছি যে প্রকৃতির দেওয়া উপহারের কোনো বিকল্প নেই। ডিমের খোসা, যা আমরা প্রতিবার রান্নায় ফেলে দেই, তা প্রায় ২.২ গ্রাম খাঁটি ক্যালসিয়াম ধারণ করে—একটি অতি মূল্যবান খনিজ, যা বাণিজ্যিক সারের চেয়ে অনেক বেশি জৈব ও কার্যকর। গবেষণায় প্রমাণিত, ডিমের খোসার গুঁড়ো ব্যবহার করলে টমেটো, ক্যাপসিকামসহ অন্যান্য ফলদায়ী ফসলের উৎপাদনশীলতা ২০ শতাংশেরও বেশি বাড়ানো সম্ভব। এটি কেবল ফলন বৃদ্ধি নয়, গাছের ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত রোগ নিরাময়েও এটি এক জাদুকরী ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, ব্যবহৃত কফি গ্রাউন্ডস, যা প্রায় ২ শতাংশ নাইট্রোজেন এবং ০.৪ শতাংশ পটাসিয়ামের মতো অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বহন করে, তা মাটির গুণাগুণ বাড়ায় এবং তার বায়ু চলাচল ক্ষমতা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নত করে। দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত হাজার হাজার টন কফি গ্রাউন্ডস ফেলে না দিয়ে, আমরা অনায়াসে আমাদের বাগানকে সতেজ করতে পারি।
একইভাবে, সবজির খোসা বা মুরগির হাড়ের করুণ পরিণতি আমাদের সচেতনতার অভাবকেই তুলে ধরে। এই উপাদানগুলো থেকে তৈরি স্টক বা ব্রথ কেবল স্বাদের গভীরতাই বাড়ায় না, এটি বাজারের সোডিয়াম-ভারাক্রান্ত কিউবের চেয়ে ৯০ শতাংশ কম ক্ষতিকর। প্রতিবার সবজির খোসা ফেলে দেওয়া মানে প্রায় ২০০ গ্রামেরও বেশি পুষ্টির অপচয়, যা একটি স্বাস্থ্যকর রান্নার ভিত্তি হতে পারত। লেবু বা কমলার খোসার কথা ভাবুন! তাদের থাকা প্রাকৃতিক সাইট্রিক অ্যাসিডের তেলগুলো শক্তিশালী জীবাণুনাশক—এই উপাদান দিয়ে ভিনেগারে মিশিয়ে তৈরি ক্লিনার বাজারের রাসায়নিক ক্লিনারগুলোর চেয়ে ৪০ শতাংশ কম দূষণকারী এবং প্রস্তুতিতে প্রায় ৭৫ শতাংশ কম ব্যয়বহুল। আর ভাতের মাড়, যা ফেলে দিচ্ছি, তা হলো অ্যামিনো অ্যাসিড ও প্রোটিনে ভরপুর এক প্রাকৃতিক কন্ডিশনার—এটির নিয়মিত ব্যবহারে চুলের ঔজ্জ্বল্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এইগুলো হলো আমাদের সেই হারানো সম্পদ, যা আমাদের হাতের মুঠোয় ছিল।
আমাদের পুরোনো টি-শার্টগুলো যেন গৃহস্থালীর পরিচ্ছন্নতার এক অব্যবহৃত সৈনিক। এদের নরম ফাইবার ও উচ্চ শোষণ ক্ষমতা কাঁচ পরিষ্কারের জন্য এতটাই উপযোগী যে, একজন গৃহস্থ পেপার টাওয়েল কেনা শতভাগ বন্ধ করতে পারেন, যা বছরে কয়েক হাজার টাকা সাশ্রয় করে। এই পুনঃব্যবহার কেবল পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীলতা নয়, এটি আমাদের পকেটের প্রতিও সংবেদনশীলতা দেখায়। একইভাবে, প্লাস্টিকের মুদির ব্যাগগুলো ফেলে দেওয়ার পরিবর্তে যদি ছোট ডাস্টবিনের লাইনার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে এর উপযোগিতা প্রায় তিন থেকে চার গুণ বৃদ্ধি পায়, যা একক-ব্যবহারের প্লাস্টিকের আয়ু বাড়িয়ে তোলে।
ডিমের কার্ডবোর্ডের ট্রে বা বাসি রুটির মতো আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ জিনিসগুলোর বহুমুখী ব্যবহার আমাদের অবাক করে। বাসি রুটি থেকে তৈরি ব্রেড ক্রাম্বস বা ক্রুটনসের মাধ্যমে একটি পরিবার বছরে প্রায় ৬ থেকে ৮ কেজি খাদ্যশস্যের অপচয় কমাতে পারে। আর ডিমের ট্রে—তা হলো ছোট ছোট জিনিস গুছিয়ে রাখার জন্য এক নিখুঁত ও বিনামূল্যে পাওয়া অর্গানাইজার, যেখানে সেলাইয়ের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে ছোট হার্ডওয়্যার স্ক্রু পর্যন্ত সবকিছু গোছানো যায়। এর প্রতিটি সেল আমাদের সাংগঠনিক দক্ষতার প্রতীক। কাঠের চপস্টিক ও আইসক্রিম কাঠিগুলোও কম যায় না। বিশ্বে বছরে ৪০ বিলিয়নেরও বেশি চপস্টিক বাতিল হয়—এইগুলোর কিছু অংশকে যদি আমরা প্ল্যান্ট মার্কার বা চারাগাছের সাপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করি, তবে তা আমাদের বাগান পরিচর্যায় এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। এই ক্ষুদ্র পরিবর্তনগুলোই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
আমাদের এই 'সম্পদ রূপান্তরের' যাত্রা ২০২৫ সালের পর এক নতুন মোড় নেবে। যদি আমরা সম্মিলিতভাবে এই ১৫টি উপকরণের পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি, তবে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ মাথাপিছু অপচয়ের হারকে স্থিতিশীল করা সম্ভব হবে। আমাদের লক্ষ্য হলো, ২০৪০ সালের মধ্যে অপচয়ের হারকে প্রায় ২৫০ গ্রামে নামিয়ে আনা, যা বর্তমান প্রবণতার চেয়ে ৪৫ শতাংশেরও বেশি হ্রাস। এই বিশাল পরিবর্তনটি সম্ভব হবে যদি আমরা এখন থেকেই দৃঢ় পদক্ষেপ নেই। এই সাফল্য অর্জনের জন্য শুধু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই যথেষ্ট নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষকদের প্রতি আমাদের আকুল আবেদন: শ্রেণিকক্ষে এই ১৫টি উপকরণের গুরুত্ব কেবল তথ্য হিসেবে নয়, এটিকে ব্যবহারিক প্রকল্পের মাধ্যমে শেখান। বিজ্ঞান, পরিবেশ, এমনকি অর্থনীতি ক্লাসেও এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করুন। শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখান কিভাবে ডিমের খোসা গুঁড়ো করতে হয়, বাসি রুটি থেকে ক্রুটনস বানাতে হয়, অথবা টি-শার্ট কেটে ডাস্টার তৈরি করতে হয়। প্রতিটি বিদ্যালয়ে 'জিরো-ওয়েস্ট ল্যাব' স্থাপন করা হোক, যেখানে শিক্ষার্থীরা উচ্ছিষ্ট থেকে সার বা ক্লিনার তৈরি করবে।
শিক্ষার্থীদের প্রতি আমাদের আহ্বান: তোমরা ভবিষ্যতের কারিগর। তোমরা শুধু এই জ্ঞান গ্রহণ করবে না, তোমরা হবে পরিবর্তনের দূত। বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে শেখাও কেন আলুর খোসা ফেলা উচিত নয়, কেন প্লাস্টিকের ব্যাগটি আবার ব্যবহার করা জরুরি। তোমাদের উদ্যোগেই এই ৬.৬ মিলিয়ন টন জৈব বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। এই সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে আমরা কেবল পরিবেশ রক্ষা করব না, বরং নতুন এক অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করব যেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হবে সম্পদ সৃষ্টি এবং কর্মসংস্থানের উৎস।
আমাদের এই ১৫টি উপকরণের গল্প প্রমাণ করে—এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই 'আবর্জনা' নয়, সবই হলো 'ভুল জায়গায় থাকা সম্পদ'। আমাদের এই সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ২০৪০ সালের মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে। আমাদের বিবেক আজ জাগ্রত হোক, আমাদের হাত আজ কর্মমুখী হোক। প্রতিটি ফেলে দেওয়া জিনিসকে আমরা যেন একটি দ্বিতীয় জীবন দিতে পারি—এই হোক আমাদের জীবনের একমাত্র ব্রত। "আবর্জনা নয়, সম্পদ! বদলে দাও তোমার অভ্যাস, বদলে যাবে পৃথিবী। শিক্ষা হোক স্থায়িত্বের প্রথম পদক্ষেপ।"
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
