1. হোম
  2. মতামত

বিজয়ীর রক্তে ভেজা স্বপ্নে এত অন্ধকার কেন?

Bangla Post Desk
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান
প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫২ পিএম
বিজয়ীর রক্তে ভেজা স্বপ্নে এত অন্ধকার কেন?
ছবি: সংগৃহীত

১৬ই ডিসেম্বর, এই দিনটি কেবল একটি তারিখ নয়; এ হলো একটি জাতির সহস্র বছরের আকাঙ্ক্ষা, রক্ত আর ত্যাগের মহাকাব্য। যখন আমরা ২০২৫ সালের এই বিজয় দিবসটি পালন করতে যাচ্ছি, তখন স্বভাবতই আমাদের চোখ ফেরে পেছনের পানে। কী পেলাম আর কী হারালাম সেই হিসাবে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তার অসামান্য অর্জনের জন্য।

১৯৯০ সালে যেখানে মানব উন্নয়ন সূচক বা HDI মান ছিল মাত্র ০.৩৭১, তা ২০২৪ সালের মধ্যে বেড়ে ০.৬৬১ হয়েছে UNDP রিপোর্ট অনুসারে। এই ঈর্ষণীয় অগ্রগতি প্রমাণ করে যে গত তিন দশকে কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মান ও সুযোগ বেড়েছে, বিশেষত স্বাস্থ্য ও শিক্ষায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েদের স্কুলগামী হওয়ার হার দ্রুত বেড়েছে। ১৯৯১ সালে চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৩.৫ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৮.৭ শতাংশে বিশ্বব্যাংক ও বিবিএস ডেটা অনুযায়ী। এই হার হ্রাস সমাজের প্রান্তিক মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি মডেল তৈরি করেছে। যেমন, উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত এলাকায় এখন আর খাদ্যের জন্য হাহাকার দেখা যায় না।

২০২৫ সাল নাগাদ তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে BGMEA ও WTO ডেটা। যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মূল চালিকাশক্তি এবং লাখ লাখ নারীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, সাভারের কোনো পোশাক কারখানার একজন নারী শ্রমিক এখন নিজের উপার্জনে পরিবার চালান। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় জেন্ডার সমতা অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম UNESCO রিপোর্ট, ২০২৩, এবং ২০২৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্রী ভর্তির হার ছাত্রদের চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি, যা সমাজে নারীর ক্ষমতায়নকে দৃঢ় করেছে এবং বাল্যবিবাহ রোধে সহায়ক হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সেনা ও পুলিশ সদস্য প্রেরণে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে অবস্থান করছে UN Peacekeeping Data, যা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকারকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে FAO রিপোর্ট, যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত করেছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়েও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে। দেশের জনগণের গড় আয়ু বেড়ে প্রায় ৭৩ বছর হয়েছে WHO রিপোর্ট, যা স্বাস্থ্যখাতে আমাদের প্রাথমিক সাফল্যের ইঙ্গিত দেয়; শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। ২০২৫ সালের বাজেট অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে জাতীয় বাজেট ডকুমেন্ট। এই কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা বা বিধবা ভাতা অসহায় পরিবারগুলোকে ন্যূনতম সহায়তা দিচ্ছে। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৪ কোটির মাইলফলক অতিক্রম করেছে BTRC রিপোর্ট, যা ডিজিটাল সেবার দুয়ার খুলে দিয়েছে; প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও এখন অনলাইনে সরকারি ফরম পূরণ করা যায়। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পগুলো দেশের প্রকৌশল সক্ষমতা প্রমাণ করেছে এবং জিডিপি বৃদ্ধিতে ১.২ শতাংশ অতিরিক্ত অবদান রাখছে অর্থনৈতিক সমীক্ষা, যা যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব এনেছে; ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের দূরত্ব কমেছে বহুলাংশে।

কিন্তু এই অর্জনের শিখরে দাঁড়িয়েও আমাদের হৃদয়ে এক গভীর ক্রন্দন বাজে—কেন আমরা আরও বেশি অর্জন করতে পারলাম না? Transparency International-এর সূচকে দেশের দুর্বল অবস্থান আন্তর্জাতিক বিনিয়োগে প্রত্যাশিত গতি আনতে পারেনি। অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট; দেশের মোট সম্পদের ৫০ শতাংশের বেশি মাত্র ১০ শতাংশ ধনী মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত Oxfam রিপোর্ট, যা সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। ২০২৫ সাল নাগাদ উচ্চশিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের বেশি ILO ও BBS ডেটা, যা কোটি তরুণদের স্বপ্নকে অনিশ্চিত করে তুলেছে এবং বাধ্য করছে বিদেশে পাড়ি দিতে।

ঢাকার বায়ুমান নিয়মিতভাবে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপের তালিকায় থাকে IQAir রিপোর্ট, যা জনস্বাস্থ্যের উপর চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে; শীতকালে হাসপাতালে শ্বাসতন্ত্রের রোগী বেড়ে যাওয়া এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের FDI প্রবাহ তুলনামূলকভাবে কম, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা দিচ্ছে এবং নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের গতি কমিয়ে দিয়েছে। প্রধান নদীগুলোর ৮০ শতাংশ দূষণের শিকার পরিবেশ অধিদপ্তর রিপোর্ট, যা পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে এনেছে; বুড়িগঙ্গার কালো জল দেখলে এই ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়। ২০২৫ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা পুরো আর্থিক ভিত্তিকে দুর্বল করেছে এবং ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। উচ্চ প্রযুক্তি ও গবেষণা খাতে জিডিপির মাত্র ০.৩ শতাংশের কম ব্যয় করা হয় UNESCO ডেটা, যা উদ্ভাবনকে বাধাগ্রস্ত করছে; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্মত গবেষণা প্রায় হয়ই না। ঢাকার ট্র্যাফিক জ্যামে বছরে জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ ক্ষতি হয় বিশ্বব্যাংক, যা নাগরিক জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে এবং অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেও অনেক শিক্ষার্থী রিডিং ও ম্যাথ স্কিলে পিছিয়ে থাকে প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা, যা ভবিষ্যতের ভিত দুর্বল করেছে; ৮ম শ্রেণিতে উঠার পরও সহজ পাঠ পড়তে না পারা এর প্রমাণ।

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল আকাশছোঁয়া, কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি। দেশের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৪ শতাংশ কারিগরি শিক্ষায় যুক্ত কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, যা শিল্প খাতের বিশাল চাহিদা মেটাতে পারছে না; ফলে বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ করতে হচ্ছে। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্বল অবস্থান গবেষণায় বরাদ্দ জিডিপির ০.২ শতাংশের নিচে থাকার ইঙ্গিত দেয়, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষক আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাননি শিক্ষা মন্ত্রণালয় রিপোর্ট, যা পাঠদানের গুণগত মান কমিয়েছে; ক্লাসরুমে পুরাতন পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি হয়। মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার এখনও ২০ শতাংশের বেশি শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো, যা বহু শিশুর শৈশব ও শিক্ষাজীবন কেড়ে নিচ্ছে; বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলে। শিক্ষায় লিঙ্গভিত্তিক ও আঞ্চলিক বৈষম্য এখনও বিদ্যমান; হাওর বা চর অঞ্চলের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় মেয়েদের স্কুল শেষ করার হার জাতীয় গড়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম। শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়মের কারণে শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী সমস্যা সমাধানে সমালোচনামূলক চিন্তার প্রয়োগ করতে পারে না।

১৬ ডিসেম্বর আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো ঐক্য আর সততার। ১৯৭১ সালের মতো দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে ২০৪০ সালের উচ্চ আয়ের দেশের লক্ষ্য পূরণ ৫০ শতাংশ দ্রুত হবে। দুর্নীতি ০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে সরকারি প্রকল্পের খরচ ২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব টিআইবি বিশ্লেষণ। ২০৪০ সালের মধ্যে দেশের ৪০ শতাংশ তরুণকে উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরি করতে হবে, যা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য অপরিহার্য। সমালোচনামূলক চিন্তাধারা ও প্রশ্ন করার সংস্কৃতি তৈরি হলে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী সক্ষমতা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ২০৪০ সালের মধ্যে প্রতি ১০ জনে ১ জন তরুণকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করার লক্ষ্য থাকতে হবে, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।

দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাকে স্থিতিশীল করতে ২০২৫ সাল থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত একটি বাস্তবসম্মত পথরেখা তৈরি করা অপরিহার্য। ২০২৫ সালে মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ২,৭০০ মার্কিন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক হলেও, ২০৩০ সালের মধ্যে তা $৪,৫০০ ডলারে উন্নীত করার এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৮,০০০ ডলারে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা পরিকল্পনা কমিশন নির্ধারণ করেছে। এই সময়ে, বায়ুদূষণের হার ১৯০ একিউআই থেকে কমিয়ে ২০৪০ সালের মধ্যে ১৫০-এ নামিয়ে আনতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তরের লক্ষ্য। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার ২০২৫ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশে উন্নীত করা জাতীয় শক্তি পরিকল্পনা ২০৪০ এর অঙ্গীকার, যা পরিবেশ সুরক্ষায় একটি মাইলফলক হবে।

এই সময়ে চরম দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০৪০ সালের মধ্যে ২ শতাংশে নামিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ রয়েছে বিবিএস ডেটা দ্বারা নির্দেশিত। এই কঠোর প্রচেষ্টা ছাড়া, অর্জনের শিখর থেকে নেমে আসা অসমাপ্ত স্বপ্নের ক্রন্দন থামবে না। যেথায় আলো ফিরে আসে, সেখানেই অন্ধকারের বিষণ্নতা নীরবে ছিন্ন হয়। রক্তের ঋণ শোধ হবে, যেদিন দুর্নীতি ভাঙবে বাঁধ; সোনার বাংলা গড়তে, শপথ নাও তারুণ্য!