Daily Bangla Post
  1. হোম
  2. মতামত

নৈতিকতার অবক্ষয়

অর্থপাচার-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত দেশ, সুশাসন কি ফিরবে?

Bangla Post Desk
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান
ঢাকা
প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৬ পিএম
অর্থপাচার-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত দেশ, সুশাসন কি ফিরবে?
ফাইল ছবি

আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি, বাংলাদেশ। এখানে যখন ভোরের আলো ফোটে, তখনো কি আমরা মুক্তির সম্পূর্ণ স্বাদ পাই? নাকি এক অদৃশ্য জালের বুননে আটকা পড়েছি, যেখানে স্বপ্নগুলো সুতোয় সুতোয় ছিঁড়ে যায়? ‘সুশাসন ও দুর্নীতি দমন’ – এই দুটি শব্দ কেবল প্রশাসনিক পরিভাষাই নয়, এ যেন আমাদের সমাজের এক দীর্ঘশ্বাস, এক অব্যক্ত আর্তনাদ। এক কৃষক যেমন রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে ফসলের স্বপ্ন দেখে, তেমনই আমরাও একটি সুস্থ, স্বচ্ছ সমাজের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু যখন দেখি সেই ফসলের এক বড় অংশ পোকায় খেয়ে ফেলছে, তখন সেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বুকে বাজে। ঠিক তেমনই, যখন আমাদের উন্নয়নের ফসল দুর্নীতির কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন হয়ে যায়, তখন সেই যন্ত্রণা সমগ্র জাতিকে পঙ্গু করে দেয়। এই পরিস্থিতি কেবল কিছু মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না, বরং পুরো সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়, পারস্পরিক বিশ্বাসকে গুঁড়িয়ে দেয় এবং ভবিষ্যতের পথকে অন্ধকার করে তোলে। এই গভীর ক্ষত সমাজের প্রতিটি স্তরে বিষিয়ে উঠেছে, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, কেবল অর্থনৈতিক উন্নতিই যথেষ্ট নয়, নৈতিকতার শক্ত ভিত্তির উপরই একটি জাতি তার প্রকৃত ঠিকানা খুঁজে পায়।

সুশাসন এবং দুর্নীতি দমনের বিষয়টি আমাদের সমাজে এক জটিল বুনট তৈরি করেছে। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করলেও, বাস্তবতার চিত্র ভিন্ন। সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতেই দুর্নীতির ব্যাপকতা জনমনে গভীর হতাশা সৃষ্টি করেছে। আমরা যখন প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখি কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, কীভাবে বড় বড় প্রকল্পগুলো দুর্নীতির কারণে থমকে দাঁড়াচ্ছে, তখন মনে হয় যেন একটি অদৃশ্য শক্তি আমাদের অগ্রগতিকে টেনে ধরছে। ধরা যাক, একটি সেতু নির্মাণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ, যা দিয়ে হয়তো হাজারো গ্রামের মানুষের যাতায়াত সহজ হতে পারতো, তার সিংহভাগই চলে গেল কিছু অসাধু কর্মকর্তার পকেটে। এই অর্থ পাচার শুধু আর্থিক ক্ষতিই করে না, বরং দেশের উন্নয়নের গতিকে মারাত্মকভাবে শ্লথ করে দেয় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনাকেও নস্যাৎ করে। যখন একটি তরুণ উদ্যোক্তা দেখে যে, তার ব্যবসা শুরু করার জন্য পদে পদে ঘুষ দিতে হচ্ছে, তখন তার মেধা ও পরিশ্রমের স্পৃহাটাই মরে যায়। এই শোষণ সমাজের উন্নতির পথে একটি বিরাট বাধা, কারণ এটি মেধা, সততা এবং কঠোর পরিশ্রমের চেয়ে অনৈতিকতাকে প্রাধান্য দেয়। এটি এক চক্রাকার প্রক্রিয়া, যা একবার শুরু হলে তা থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ দুর্নীতির এই শেকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত হয়ে যায়। যখন সরকারি সেবার জন্য একজন সাধারণ মানুষকেও ভোগান্তির শিকার হতে হয়, তখন সুশাসন কেবল একটি কথার কথা মনে হয়, বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না।

এই দুর্নীতি যদি নিরসন না হয়, তাহলে এর ভবিষ্যৎ প্রভাব হবে ভয়াবহ এবং সুদূরপ্রসারী। আজকের এই ছোট ছোট সমস্যাগুলো ভবিষ্যতে এক মহীরুহে পরিণত হবে, যার বিষাক্ত ফল ভোগ করবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। প্রথমেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা ভাবুন। দুর্নীতির কারণে বিনিয়োগের পরিবেশ নষ্ট হয়, ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এর ফলস্বরূপ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না, বেকারত্বের হার বাড়ে, এবং দারিদ্র্য একটি স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ধরা যাক, একজন মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে এলো, কিন্তু চাকরির সুযোগের অভাবে তাকে হতাশ হয়ে বিদেশে পাড়ি দিতে হলো। এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি জাতির মেধা পাচার।

শিক্ষা খাতে দুর্নীতির প্রভাব আরও ভয়াবহ। যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম হয়, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়, তখন শিক্ষার গুণগত মান নিম্নমুখী হয়। এর ফলে আমরা এমন এক প্রজন্ম তৈরি করি, যারা প্রকৃত জ্ঞান ও দক্ষতার পরিবর্তে অনৈতিকতার মাধ্যমে পথ চলতে অভ্যস্ত হয়। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির কারণে সঠিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ, জীবন রক্ষাকারী ঔষধের মূল্য বেড়ে যায় এবং মানহীন ওষুধ বাজারে প্রবেশ করে, যা মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি প্রবেশ করলে মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে আসে। যখন একজন নিরীহ মানুষ কেবল অর্থের অভাবে বিচার পায় না, তখন আইনের শাসন বলে কিছু থাকে না। সমাজের প্রতিটি স্তরে অবিশ্বাস ও হতাশা বাসা বাঁধে, যা সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করে। সামগ্রিকভাবে, এটি একটি ভঙ্গুর সমাজ তৈরি করবে, যেখানে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকবে না, মানবিক মূল্যবোধগুলো বিলীন হয়ে যাবে এবং জাতি হিসেবে আমরা আমাদের গৌরবময় ইতিহাসকে হারাবো। এই ভবিষ্যৎ চিত্র এতটাই ধূসর যে, তা ভাবতে গেলেও গা শিউরে ওঠে।

এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের এক নতুন দিশা হয়ে এসেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তার কার্যক্রম বা প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো এই গভীর সমস্যাগুলোর সমাধানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তার ‘সামাজিক ব্যবসা’ (Social Business) ধারণাটি কেবল পুঁজিবাদের বিকল্প নয়, এটি এমন এক দর্শন যেখানে লাভের উদ্দেশ্য গৌণ, মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের সমস্যার সমাধান করা। ধরা যাক, তিনি যদি সরকারি প্রকল্পে এই সামাজিক ব্যবসার মডেলটি প্রয়োগ করেন, তাহলে সেই প্রকল্পের অর্থ শুধুমাত্র কিছু মানুষের পকেটে না গিয়ে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে ব্যয় হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি স্বাস্থ্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যেখানে গ্রামের দরিদ্র মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হয়, এবং সেই প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত মুনাফা পুনরায় সেই প্রকল্পের উন্নয়নেই ব্যবহার করা হয়, তবে তা দুর্নীতির সুযোগ কমিয়ে দেবে এবং সেবার মান বৃদ্ধি করবে।

তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে কঠোর পদক্ষেপের কথা বলেছেন, যা কেবল আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে সম্ভব। তার প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি হয় এবং দুর্নীতির পথ রুদ্ধ হয়। অর্থ পাচার রোধে তিনি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে পাচারকৃত অর্থ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা যায় এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। তার এই পদক্ষেপগুলো এমনভাবে সাজানো হচ্ছে, যা সমাজের প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করবে। তিনি কেবল আইনের প্রয়োগের কথা বলছেন না, তিনি বলছেন একটি নৈতিক জাগরণের কথা, যেখানে প্রতিটি নাগরিক তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হবে। এই উদ্যোগগুলো হয়তো রাতারাতি ফল দেবে না, কিন্তু এটি একটি নতুন পথের সূচনা করবে, যেখানে সততা ও মেধা মূল্য পাবে, এবং দেশ সত্যিকার অর্থেই উন্নতির শিখরে আরোহণ করবে। তার দূরদর্শী নেতৃত্ব এই অন্ধকার টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর রেখা দেখাচ্ছে, যা আমাদের মনে আশার সঞ্চার করে।

আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি, বাংলাদেশ, এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সুশাসন এবং দুর্নীতি দমনের এই লড়াই কেবল একটি প্রশাসনিক সংস্কার নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। আমরা দেখেছি কীভাবে দুর্নীতির করাল গ্রাস আমাদের স্বপ্নের সৌধকে ভেঙে দিচ্ছে, কীভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের মতো দূরদর্শী নেতৃত্ব আমাদের মনে আশার সঞ্চার করেছে। তাঁর প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো কেবল সমস্যা চিহ্নিতকরণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সমাধানের সুনির্দিষ্ট পথও বাতলে দিচ্ছে। এটি প্রমাণ করে যে, এই সমস্যাগুলো সমাধানযোগ্য, যদি আমরা সঠিক পথে অবিচল থাকি এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করি। আমাদের মনে রাখতে হবে, পরিবর্তনের শুরুটা আমাদের নিজেদের থেকেই। প্রতিটি নাগরিক যখন সততা ও নিষ্ঠার সাথে তার দায়িত্ব পালন করবে, তখনই সুশাসনের ভিত মজবুত হবে।

‘দুর্নীতির কালো মেঘ যতই ঘনীভূত হোক না কেন, সততার ছোট্ট প্রদীপটি জ্বেলে রাখলে একদিন আলোয় ভরে উঠবে পুরো দেশ।’