নথি না থাকলেও কি বিচার পাবো কখনো?
সরকারি নথি বা ফাইলগুলো কেবল কিছু কাগজের স্তুপ নয়—এগুলোই রাষ্ট্রের স্মৃতি, জাতীয় সিদ্ধান্তের নথিপত্র, আর নাগরিক অধিকারের নীরব সাক্ষ্য। অথচ বাংলাদেশে এই অমূল্য দলিলসমূহ আজ যেন চাপা পড়ে আছে কাগজের পাহাড়ের নিচে, অবহেলার ধুলোর খাঁজে। বিশেষ করে শ্রম আদালত কিংবা বিভিন্ন ভূমি অফিসে বছরের পর বছর ধরে নথি ডিজিটাল ডেটাবেজে সংরক্ষণ না করার ফলে, পুরোনো কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া এখন প্রায় হারানো সুতোর খোঁজের মতো—এক দুঃসাধ্য, ক্লান্তিকর অনুসন্ধান, যেখানে সময়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে নাগরিকের অধিকারই। যখন একজন অসহায় নাগরিক তার ন্যায্য অধিকার বা পুরোনো সিদ্ধান্তের প্রমাণ চাইতে আসে, তখন তাকে বছরের পর বছর ধরে সেই অদৃশ্য নথির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই বিলম্ব এবং নথির অনিশ্চয়তা শুধু প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে ধীর করছে না, এটি বিচারপ্রার্থী মানুষের মনে হতাশা এবং রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টি করছে। এই "কাগজের পাহাড়ে চাপা ইতিহাস" আজ এক জাতীয় সংকটে রূপ নিয়েছে, যা সুশাসনের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এই করুণ গাথা শুনতে গেলে কেবল চোখ নয়, হৃদয়ের কানও খোলা রাখতে হয়।
সরকারি অফিসের ফাইল বা নথি কেন দীর্ঘদিন ভার্চুয়াল ডেটাবেজে সংরক্ষণ করা হয় না এবং এর ফলে পুরনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়ায় কেন অসুবিধা হয়, এর পেছনে ৩০টিরও বেশি গভীর প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কারণ রয়েছে। এই কারণগুলো যেন এক অদৃশ্য শেকল, যা আধুনিক শাসন ব্যবস্থার গতিকে আটকে রেখেছে।
প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো প্রযুক্তিনির্ভরতার অভাব এবং সনাতন মানসিকতা। পুরনো নথি ডিজিটাল করার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না থাকা এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করার অনীহা এই সমস্যার মূল কারণ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের (MoP) তথ্য অনুযায়ী, সরকারি দপ্তরগুলোর মাত্র ২০% নথিপত্র ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয় (২০২৪ সাল)। এর মানে হলো ৮০% নথি আজও কাগজের স্তূপে বন্দি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (TIB) একটি সমীক্ষা (২০২৩) অনুসারে, তথ্য খুঁজে না পাওয়ার অজুহাতে সাধারণ মানুষকে প্রায় ৩০% বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। নথি স্ক্যান বা ইনডেক্স করার জন্য পর্যাপ্ত এবং প্রশিক্ষিত জনবলের স্বল্পতা রয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (ICT) এর পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রায় ৬৫% সরকারি কর্মকর্তা পুরনো পদ্ধতিতে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

অন্যদিকে, প্রশাসনিক ও আইনি দুর্বলতা এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বদলি হওয়ায় নথির ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না। আইন ও বিচার বিভাগের (Law and Justice Division) পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শ্রম আদালতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক প্রতিষ্ঠানের পুরনো রেকর্ড খুঁজতে গড়ে ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় লাগে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) প্রশাসনিক জরিপ অনুসারে, সরকারি অফিসের ৪৫% নথি সময়মতো খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরোনো নথি সরিয়ে ফেলার বা ধ্বংস করার কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ভূমি সংক্রান্ত ৫৫% পুরনো নথিপত্র অসংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (ADB) একটি রিপোর্ট দেখায়, দুর্বল নথি ব্যবস্থাপনার কারণে সরকারি প্রকল্পের বাস্তবায়ন খরচ গড়ে ১৫% বেড়ে যায়।
এই সমস্যার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবও কম নয়। পুরনো রেকর্ড খুঁজে না পাওয়ায় আইনি মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হওয়া। পেনশন, ভূমি বিরোধ বা ন্যায্য পাওনা সংক্রান্ত মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকা। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) রিপোর্ট অনুসারে, ডিজিটাল সরকার পরিচালনায় পিছিয়ে থাকার কারণে সুশাসন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের গভর্নেন্স ইনডিকেটর অনুসারে, নথিপত্র সংরক্ষণের দুর্বলতার কারণে সরকারের কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক (BB) এর তথ্য অনুযায়ী, পুরাতন রেকর্ড না পাওয়ায় আর্থিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে গড়ে ৮ মাস অতিরিক্ত সময় লাগে।
ভার্চুয়াল ডেটাবেজে নথি সংরক্ষণ না করার এই প্রবণতা কেবল আজকের সমস্যা নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ প্রশাসনিক ও সামাজিক সংকট তৈরি করছে।
|
বছর |
ডিজিটাল নথি সংরক্ষণের হার (পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, গড় %) |
নথি খুঁজে পেতে গড় সময় (আর্থ-সামাজিক গবেষণা, মাস) |
প্রশাসনিক স্বচ্ছতা সূচক (আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ, ১০০-এর মধ্যে) |
|
২০১৫ |
৫% |
৪ |
৪৫ |
|
২০২০ |
১০% |
৬ |
৪০ |
|
২০২৫ |
১৫% |
৮ |
৩৫ |
|
২০৩০ (অনুমান) |
২০% |
১০ |
৩০ |
|
২০৩৫ (অনুমান) |
২৫% |
১২ |
২৫ |
|
২০৪০ (অনুমান) |
৩০% |
১৫ |
২০ |
এই পরিসংখ্যানগুলো যেন আমাদের সামনে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দরজা খুলে দেয়। অর্থনৈতিক মডেলগুলোর পূর্বাভাস বলছে—যদি এই ডিজিটাল অবহেলা চলতেই থাকে, তবে ২০৪০ সাল নাগাদ একটি সরকারি নথি খুঁজে পেতে গড়ে ১৫ মাস সময় লাগতে পারে; যেন রাষ্ট্রের স্মৃতিই তখন ধুলোয় চাপা পড়ে অদৃশ্য কোনো গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তৈরি আরেক পূর্বাভাস জানাচ্ছে, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা সূচক ২০৪০ সালে ২০-এর ঘরে নেমে আসতে পারে—যা সুশাসনের গভীরতম সংকটের ইঙ্গিত।

জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সও একই হতাশার প্রতিচ্ছবি দেখায়; নথি ডিজিটালাইজেশন না হওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান স্থবির রয়ে গেছে, উন্নতির সিঁড়ি যেন নড়তেই চায় না। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বাড়তি ছায়া—জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, রেকর্ড না পাওয়ার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে, ফলে নাগরিকেরা তাদের মৌলিক অধিকার দাবি করতে গিয়েও বারবার বাধার মুখে পড়ছেন।সব মিলিয়ে এই সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়—এগুলো ভবিষ্যতের সতর্কবার্তা, একটি জাতির প্রশাসনিক স্মৃতিভ্রষ্টতার ট্র্যাজেডির আগাম আভাস।
ভবিষ্যতে এর ফল হবে আরও করুণ: আইনি জটিলতা বৃদ্ধি পাবে। নাগরিক অধিকারের বঞ্চনা ঘটবে। অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়বে। সুশাসনের পতন হবে। এই করুণ গাথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, তথ্য যদি হারিয়ে যায়, তবে ন্যায়বিচারও পথ হারায়। কাগজের কারাগারে বিচার বন্দি কেন? ডিজিটাল হও, স্বচ্ছ হও—কারণ পুরোনো নথিতেই লুকিয়ে আছে আগামীর ন্যায়!
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
