ফুটপাতে মানবিকতা নেই, আছে ‌কেবল উচ্ছেদ-বাণিজ্য

Bangla Post Desk
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান ঢাকা
প্রকাশিত:০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:২৬ পিএম
ফুটপাতে মানবিকতা নেই, আছে ‌কেবল উচ্ছেদ-বাণিজ্য
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা নগরী—কোটি মানুষের স্বপ্ন আর সংগ্রামের ক্যানভাস। এই ক্যানভাসের একটি অপরিহার্য অংশ হলো ফুটপাতের হকার, যারা নিজেদের শ্রম আর স্বল্প পুঁজি দিয়ে গড়ে তোলেন একটি ক্ষুদ্র অর্থনীতি। ভাবুন তো, একজন রিকশাচালক দিনশেষে তার সন্তানের জন্য একটি সস্তা জামা খুঁজছেন, অথবা একজন দিনমজুর তার ক্ষিদে মেটানোর জন্য ফুটপাতের একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নিচ্ছেন। এই ফুটপাত শুধু হাঁটার জায়গা নয়, এটি এই শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের একটি সামাজিক আশ্রয়স্থল। অথচ, এই হকারদের বারবার উচ্ছেদ করা হয় শুধু ক্ষমতা আর এক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার্থে।

এই উচ্ছেদ-প্রক্রিয়া কোনো মানবিক সমাধান দেয় না; বরং এই উচ্ছেদ পরিণত হয় এক ধরনের বাণিজ্যে, যেখানে হকাররা হারান জীবিকা, আর নগর প্রশাসন হারায় বিরাট অঙ্কের রাজস্ব আয়ের সুযোগ। এই "ফুটপাতের কান্না" কেবল কিছু মানুষের কষ্ট নয়, এটি অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির একটি বৃহৎ অংশকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার করুণ গাথা। আমরা একটি সম্ভাবনাকে পায়ে মাড়িয়ে চলছি, আর সেই অবহেলার ফল ভুগতে হচ্ছে পুরো সমাজকে।

ফুটপাতে হকার উচ্ছেদের মানবিক সমাধান কেন খুঁজে পাওয়া যায় না এবং কেনই বা নগর প্রশাসন এই খাত থেকে রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ, এর পেছনে ৪০টিরও বেশি গভীর প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে। এই কারণগুলো একটি চক্রের মতো, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো হকারদের পুনর্বাসনের জন্য সমন্বিত নীতি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। হকারদেরকে নাগরিকের বদলে শুধু 'বাধা' হিসেবে দেখার সংকীর্ণ প্রশাসনিক মানসিকতা আমাদের। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (DSCC) এর একটি জরিপ (২০২৩) অনুসারে, প্রায় ৮৫% হকার পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় আসতে পারেনি। এই বিশাল সংখ্যক মানুষকে মানবিক দৃষ্টিতে না দেখে শুধু উচ্ছেদ করা হয়। এই উচ্ছেদ অভিযানে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব প্রকট, যেখানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (TIB) সমীক্ষা অনুসারে, হকাররা দৈনিক গড়ে ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত অবৈধ চাঁদা দিতে বাধ্য হন, যা সরকারি রাজস্বে যুক্ত না হয়ে স্থানীয় মাস্তান ও এক শ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ/কর্মকর্তার পকেটে যায়। এই অবৈধ চাঁদা আদায়ের চক্রই প্রমাণ করে, উচ্ছেদ আসলে একটি 'অর্থ উপার্জনের চক্রে' পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির তথ্য অনুযায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে নিয়োজিত প্রায় ৭২% শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষা নেই। এই বিশাল জনশক্তি, যার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ (৪ মিলিয়ন), তাদের পুনর্বাসনের জন্য 'হকার্স মার্কেট' বা 'নাইট মার্কেট' তৈরির উদ্যোগ বারবার ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BIDS) এর গবেষণা অনুসারে, ঢাকা শহরের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৪-৬% অবদান রাখে। এই বিশাল অর্থনীতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় সরকার বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) এর রিপোর্ট অনুসারে, হকার্স অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলে নগর প্রশাসন বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব পেতে পারে। স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে পণ্য ক্রয়ের সহজলভ্যতা কমে যাওয়া এবং উচ্ছেদের ফলে হকারদের পুঁজি হারানো—এই দুটি বিষয়ই অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) এর শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ৬০%, এবং উচ্ছেদ তাদের জীবনকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

হকারদের জন্য লাইসেন্স বা পরিচয়পত্র প্রদানের প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল হওয়া, সরকারের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) নীতিতে হকারদের অন্তর্ভুক্তির দুর্বলতা, এবং উচ্ছেদের পর হকারদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি—এই সবগুলো কারণ একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে। পরিকল্পনা কমিশনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পুনর্বাসন না হলে হকারদের চরম দারিদ্র্যের হার ২৫% পর্যন্ত বাড়তে পারে। এই মানুষগুলো কেবল একটি কর্মক্ষেত্র নয়, সম্মানজনক একটি জীবন চাইছে।

এই মানবিক অবহেলা আর প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা কীভাবে আমাদের ভবিষ্যৎকে গ্রাস করছে, তা প্রতিটি পরিসংখ্যানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে। যদি আমরা এই সমস্যার মানবিক ও অর্থনৈতিক সমাধান না খুঁজি, তবে ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে ২০৪০ সাল পর্যন্ত এর পরিণতি কেবল অন্ধকার থেকে অন্ধকারে যাত্রা করবে। ২০১৫ সালে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি থেকে সরকারি রাজস্ব আদায়ের হার ছিল যেখানে মাত্র ০.৫%, সেখানে অবৈধ চাঁদা আদায়ের বার্ষিক বৃদ্ধি ছিল ৫% এবং হকারদের চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ১৫%। এরপর ২০২০ সাল আসতে আসতে এই চিত্র আরও বিষণ্ন হয়েছে; রাজস্ব আদায় সামান্য বেড়ে ০.৮% হলেও অবৈধ চাঁদা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮% এবং চরম দারিদ্র্য ছুঁয়েছে ২০%। বর্তমানে, ২০২৫ সালে এসে সরকারি রাজস্ব আদায় আটকে আছে ১.০% এ, অথচ অবৈধ চাঁদার বৃদ্ধি ১২% এ পৌঁছে হকারদের ২৫% চরম দারিদ্র্যের কবলে ফেলেছে। অর্থনৈতিক মডেলের পূর্বাভাস আমাদের হৃদয়ে আঘাত করে জানায়, যদি এই ধারা চলতে থাকে, তবে ২০৪০ সাল নাগাদ অবৈধ চাঁদা আদায়ের হার ৩০% এ পৌঁছাবে, আর হকারদের চরম দারিদ্র্যের হার ৪০% ছুঁয়ে যাবে। এদিকে সরকারি রাজস্ব আদায় ২.৫% এর বেশি উঠবে না। এই পরিসংখ্যানগুলি কেবল সংখ্যা নয়—এগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন, একটি শহরের ভেঙে পড়া অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড এবং আমাদের মানবিক ব্যর্থতার করুণ দলিল। এই মানুষগুলোর জীবনকে উপেক্ষা করা মানে আমাদের নিজেদেরই ভবিষ্যৎকে অস্বীকার করা।

এই ফুটপাতের কান্না থামাতে হলে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের অবশ্যই একটি মানবিক ও দূরদর্শী পুনর্বিন্যাসের পথে হাঁটতে হবে।

প্রথমত, হকারদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও লাইসেন্স প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মুম্বাই বা ভুবনেশ্বরের মতো শহরগুলোতে 'ভেন্ডিং জোন' তৈরি করা হয়েছে। ঢাকা শহরেও প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্দিষ্ট সময়ে (যেমন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত) কিছু ফুটপাতকে 'নাইট হকার্স জোন' হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। জাতিসংঘের নগর উন্নয়ন মডেল অনুসারে, হকারদের নির্দিষ্ট লাইসেন্স বা পরিচয়পত্র দেওয়া হলে তারা রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাশীল হবে এবং অবৈধ চাঁদাবাজি ৯০% পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা চালু করতে হবে। হকারদের জন্য স্বল্প মূল্যে দৈনিক বা মাসিক ফি নির্ধারণ করে কিউআর কোড (QR Code) ভিত্তিক পেমেন্ট বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি সিটি কর্পোরেশনের কোষাগারে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে নগর প্রশাসন বছরে প্রায় ১০০০ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে পারবে, যা শহরের পরিচ্ছন্নতা ও হকার পুনর্বাসনে ব্যবহার করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, হকার্স মার্কেটের আধুনিকায়ন ও সহজ ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যেমন, সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডের মতো দেশে ছোট হকারদের জন্য পরিষ্কার, স্বাস্থ্যসম্মত 'হকার্স সেন্টার' তৈরি করা হয়েছে। আমাদের দেশেও হকারদের জন্য সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের পুঁজি বাড়াতে পারে এবং ফুটপাত ছাড়িয়ে ছোট দোকান বা স্টলে ব্যবসা করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (MRA) যৌথ উদ্যোগে এই ঋণ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব।

এই সম্মিলিত উদ্যোগগুলো কেবল হকারদের চরম দারিদ্র্যের হার কমাবে না, বরং সামাজিক অস্থিরতা রোধ করে ঢাকা শহরকে একটি সহনশীল, মানবিক এবং অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল মহানগরী হিসেবে গড়ে তুলবে। এই মানুষগুলো আমাদেরই প্রতিবেশী, তাদের শ্রমকে সম্মান করা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব।

লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।