অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষমতা হারালে কোন প্রান্তে দাঁড়ায় মানবজীবন?
রাস্তার মোড়ের ফার্মেসিগুলো আজ যেন এক অঘোষিত আদালত—যেখানে রোগ নিরাময়ের রায় লেখেন চিকিৎসক নয়, বরং কাউন্টারের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা বিক্রেতা। শহরের অলিগলির ভেজা বাতাস থেকে শুরু করে গ্রামের হাট-বাজারের কোলাহল—সবখানেই অ্যান্টিবায়োটিক এখন এক অবাধ্য দ্রব্য; প্রেসক্রিপশনের শৃঙ্খল ভেঙে তা ঘুরে বেড়ায় মানুষের হাতে হাতে। আইনের ফাঁকফোকরের সেই অন্ধকারে জনস্বাস্থ্য ক্রমেই প্রবেশ করছে এক গোপন অন্ধকূপে। আর এই লাগামহীন ব্যবহারের মাটিতে নিঃশব্দে অঙ্কুরিত হচ্ছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR)—এক নীরব ঘাতক, যে আমাদের পরিচিত সাধারণ রোগগুলোকেই পরিণত করছে আক্রমণাত্মক, দুরারোগ্য ছায়ায়।
যখন একজন অসহায় মা তার সন্তানের সাধারণ জ্বর বা কাশির চিকিৎসায় উচ্চ ক্ষমতার অ্যান্টিবায়োটিক যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেন, তখন সেই ওষুধটির কার্যকারিতা হারিয়ে যায়, আর অসহায় রোগী শেষ পর্যন্ত সাধারণ রোগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই "নীরব ঘাতক AMR" আজ এক জাতীয় মহামারির পদধ্বনি শোনাচ্ছে, যা পুরো সমাজকে অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে।
ফার্মেসিতে কেন প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয় এবং কেনই বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, এর পেছনে ৪০টিরও বেশি গভীর আইনি, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে। এই কারণগুলো যেন এক বিষাক্ত জাল, যা আমাদের জনস্বাস্থ্যকে নীরবে গ্রাস করছে।

প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি নিয়ন্ত্রণে আইনের দুর্বলতা ও প্রয়োগের অভাব। ড্রাগ আইন (Drug Act) এবং এর বিধিমালায় পর্যাপ্ত কঠোর শাস্তির বিধান না থাকা এই সমস্যার মূল কারণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (DGHS) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৬০% ফার্মেসি চলছে লাইসেন্স নবায়ন বা যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই। ফার্মেসিতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির উপর সরকারি তদারকি এবং পরিদর্শন দলের স্বল্পতা রয়েছে। অবৈধভাবে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির জন্য জরিমানা বা শাস্তির মাত্রা খুবই কম। জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (CDC) গবেষণা অনুসারে, ফার্মেসিগুলো প্রায় ৫০% ক্ষেত্রে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রিতে নিয়ন্ত্রণের মাত্রা সবচেয়ে দুর্বল।
অন্যদিকে, জনস্বাস্থ্যের ওপর AMR এর প্রভাব আজ আমাদের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। সাধারণ রোগের চিকিৎসায়ও অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করা সবচেয়ে বড় বিপদ। রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (IEDCR) তথ্য অনুসারে, গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি ব্যাকটেরিয়ার রেজিস্ট্যান্সের হার গত ৫ বছরে ১৫% থেকে ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর অর্থ হলো, যে ওষুধ একসময় জীবন বাঁচাত, আজ তা নিছক জলের মতো। দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন হওয়া এবং রোগীর ওপর চিকিৎসার আর্থিক বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের (World Bank) অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, AMR এর কারণে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে বার্ষিক ব্যয় প্রায় ৫% বৃদ্ধি পাচ্ছে। সদ্যোজাত শিশুদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের জীবন দুরূহ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (BMRC) এর গবেষণা অনুসারে, ঢাকা শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যা পরিবেশ দূষণকেও চিহ্নিত করে।
আইন প্রয়োগের দুর্বলতার পাশাপাশি সামাজিক কারণগুলোও সমানভাবে দায়ী। রোগী কর্তৃক সম্পূর্ণ কোর্স শেষ না করে মাঝপথে অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দেওয়া একটি সাধারণ প্রবণতা। চিকিৎসকদের মধ্যে ভুল অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করার প্রবণতা রয়েছে। জাতিসংঘের (UN) রিপোর্ট অনুযায়ী, কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে, যার একটি বড় অংশ হবে এশিয়াতে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (ADB) একটি রিপোর্ট বলছে, AMR নিয়ন্ত্রিত না হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বছরে ১% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
ফার্মেসিতে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির এই অনিয়ম এবং এর ফলে সৃষ্ট AMR কেবল আজকের বিপদ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে আনছে।
|
বছর |
প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি (DGHS, গড় %) |
গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স হার (IEDCR, %) |
AMR জনিত কারণে স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি (বিশ্বব্যাংক, %) |
|
২০১৫ |
৫০% |
১০% |
২% |
|
২০২০ |
৬০% |
২০% |
৪% |
|
২০২৫ |
৭০% |
৩০% |
৬% |
|
২০৩০ (অনুমান) |
৮০% |
৪৫% |
৯% |
|
২০৩৫ (অনুমান) |
৯০% |
৬০% |
১২% |
|
২০৪০ (অনুমান) |
৯৫% |
৭৫% |
১৫% |
এই পরিসংখ্যানগুলি এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরে। অর্থনৈতিক মডেলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, যদি এই অনিয়ম চলতে থাকে, তবে ২০৪০ সাল নাগাদ প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির হার ৯৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। একই সাথে, অর্থনৈতিক মডেলের পূর্বাভাস বলছে, গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্সের হার ২০৪০ সাল নাগাদ ৭৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা চিকিৎসাকে প্রায় অকার্যকর করে দেবে। বিশ্বব্যাংকের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অনুসারে, AMR জনিত কারণে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বৃদ্ধি ২০৪০ সাল নাগাদ ১৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
ভবিষ্যতের প্রহরে যে অন্ধকার অপেক্ষা করছে, তা নিছক আশঙ্কা নয়—বৈজ্ঞানিক অনিবার্যতা। চিকিৎসা ধীরে ধীরে হারাবে তার কার্যকারিতা; মৃত্যু পরিণত হবে প্রতিদিনের সমীকরণে এক অবশ্যম্ভাবী যোগফল। স্বাস্থ্যব্যয়ের বোঝা এতটাই ফুলে উঠবে যে সাধারণ মানুষের নাগালের আঙুল তা ছুঁতেও পারবে না। রাষ্ট্রজুড়ে জন্ম নেবে এক গভীর স্বাস্থ্য-দুর্যোগ, যেখানে সামান্য অস্ত্রোপচারও হবে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া এক বিপজ্জনক জুয়া, আর আইসিইউ বেড হবে কল্পনার মতো দুর্লভ।
আজ যদি আমরা এই নীরব ঘাতক—অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ—রোধে কঠোর না হই, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধিকার পাবে এক নিষ্ঠুর পৃথিবী, যেখানে সাধারণ জ্বর, সর্দি, ক্ষত—সবই মৃত্যুর পরোক্ষ রায়।তাই এখনই বলতেই হয়, দৃপ্ত কণ্ঠে—
“প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ করো। অবহেলা বন্ধ করো।”
কারণ অ্যান্টিবায়োটিকের শক্তি হারানো মানে মানবজাতির আত্মসমর্পণ নয়—মানবজাতির পরাজয়ের ইতিহাস লেখা শুরু হয়ে যাওয়া।
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
