রসিদহীন কেনাকাটায় নিজেদের বিপর্যয় ডাকছি?

Bangla Post Desk
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান ঢাকা
প্রকাশিত:২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৬ পিএম
রসিদহীন কেনাকাটায় নিজেদের বিপর্যয় ডাকছি?
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান।ছবি: বাংলাপোস্ট

বাংলাদেশের দৈনিক জীবনের প্রতিটি লেনদেন যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা—সেটি আস্থার সুতো। রাস্তার মোড়ের ছোট দোকান থেকে শুরু করে পাড়ার বড় মুদির দোকান পর্যন্ত প্রতিটি কেনাকাটা এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই চলে। কিন্তু এই আস্থার গভীরে লুকিয়ে আছে এক নীরব প্রতারণা, যা ধীরে ধীরে আমাদের অর্থনৈতিক এবং আইনি কাঠামোকে দুর্বল করছে। সেই প্রতারণা হলো—অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বাইরে স্থানীয় দোকান থেকে পণ্য কিনলে ক্যাশ মেমো বা বিক্রয় রসিদ না দেওয়া।

এই রসিদ না দেওয়ার অভ্যাসটি কেবল একটি কাগজের অনুপস্থিতি নয়; এটি ভোক্তার আইনি দুর্বলতা এবং অধিকারের করুণ মৃত্যু। এটি এমন এক অদৃশ্য জাল, যা গরিব ও সাধারণ মানুষের অধিকারকে অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে, তাদের নিঃশব্দে ঠেলে দিচ্ছে এক গভীর আইনি অনিশ্চয়তার দিকে। স্থানীয় দোকানে বিক্রয় রসিদ না দেওয়ার পেছনে পঞ্চাশটিরও বেশি কারণ রয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, আইনি শৈথিল্য এবং নৈতিকতার অবক্ষয়কে স্পষ্ট করে তোলে।

প্রথমত, কর ফাঁকি একটি প্রধান কারণ। রসিদ না দিলে বিক্রেতা সহজেই সেই বিক্রয়কে হিসেবের বাইরে রেখে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে (২০২৩), বাংলাদেশে মোট ব্যবসার একটি বৃহৎ অংশ (প্রায় চল্লিশ শতাংশ) অপ্রদর্শিত অর্থনীতিতে চলে, যার মূল কারণ ক্যাশ মেমো না দেওয়া। একটি বেসরকারি সংস্থার নিরীক্ষা দেখায়, সরকারি ঔষধ ক্রয়ের প্রায় পনের শতাংশ অপচয় হয়। বিক্রেতার ব্যক্তিগত মুনাফা বাড়ানোর লোভ, মুনাফার সঠিক হিসেব গোপন করে কম আয় দেখানো এবং করের হার কমানো এই অভ্যাসের জন্ম দেয়। অর্থনীতি গবেষকদের মতে, ক্যাশ মেমো না দেওয়ার কারণে বছরে সরকারের পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ক্ষতি হয়। এফবিসিসিআই (FBCCI) পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পঁচাশি শতাংশ অনানুষ্ঠানিক লেনদেন করে, যা পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তোলে। বিশ্বব্যাংকের (World Bank) একটি রিপোর্টে দেখা যায়, কর ফাঁকির কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় দুই শতাংশ ক্ষতি হয়।

দ্বিতীয়ত, ভোক্তার অজ্ঞতা ও আইনি প্রক্রিয়াগত জটিলতা এই দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সাধারণ ভোক্তারা ক্যাশ মেমোর গুরুত্ব বা আইনি ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন নন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (DNCRP) এর তথ্যমতে (২০২৫), ক্ষতিপূরণের জন্য অভিযোগ দায়েরের হার অত্যন্ত কম—মোট লেনদেনের মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশ। অভিযোগ দায়ের প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ও জটিল হওয়ায় ক্রেতার অনীহা সৃষ্টি হয়। সরকারি ভোক্তা সুরক্ষা আইনের প্রচার ও প্রসারের হার গ্রামীণ এলাকায় প্রায় সত্তর শতাংশ কম (এনজিও গবেষণা)। অনেক সময় ক্রেতা নিজেই রসিদ চাইতে ভুলে যান বা তা অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। অল্প দামের পণ্যের ক্ষেত্রে রসিদ না নেওয়ার প্রবণতা থেকেই যায়, যা বিক্রেতাকে আরও বেপরোয়া করে তোলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, দেশের আশি শতাংশের বেশি ক্ষুদ্র দোকান অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, ফলে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা কঠিন হয়। একটি ভোক্তা জরিপ দেখায়, সত্তর শতাংশ ক্রেতা মনে করেন রসিদ চাইলেও তা পাওয়া যায় না।

প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং আইনি শৈথিল্য এই সংকটকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জনবল এবং মাঠ পর্যায়ে তদারকির অভাব রয়েছে। দ্রুত বিচার বা নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালের অভাব এবং আইনি প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য-প্রমাণের গুরুত্ব সম্পর্কে দুর্বলতা এই অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবসম্পদ পর্যবেক্ষণ অনুসারে, যে সংস্থাগুলোতে বহুমুখী মতামত নেওয়া হয়, সেখানে কর্মক্ষেত্রে মানসিক হয়রানির হার পঁয়তাল্লিশ শতাংশ কম থাকে। বিক্রেতাদের লাইসেন্স নবায়নের সময় ক্যাশ মেমোর ব্যবহার বাধ্যতামূলক না করা এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজে রসিদ দেওয়ার ব্যবস্থার অভাবও এর জন্য দায়ী। নকল পণ্য ও ভেজাল বিক্রির ক্ষেত্রে প্রমাণ নষ্ট করার সুযোগ থাকায় বিক্রেতারা জনস্বাস্থ্য নিয়েও উদাসীন হন। আইন বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, ক্যাশ মেমো ছাড়া লেনদেনের জন্য জরিমানার হার অপর্যাপ্ত।

ক্যাশ মেমো না দেওয়ার এই প্রবণতা কেবল আজকের সমস্যা নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ আইনি ও অর্থনৈতিক ফাঁদ তৈরি করছে। এই দুর্বলতা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং ভোক্তার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করছে।

বছর

অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে লেনদেন হার

ভ্যাট/ট্যাক্স ফাঁকির হার (মোট লেনদেনের %)

ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তির হার (সফল %)

২০১৫

৩৫% (অর্থনীতি গবেষণা)

২২% (এনবিআর ভিত্তিতে)

২.০% (DNCRP)

২০২০

৪০% (অর্থনীতি গবেষণা)

২৫% (এনবিআর ভিত্তিতে)

১.৫% (DNCRP)

২০২৫

৪৫% (অর্থনৈতিক পূর্বাভাস)

২৮% (অর্থনৈতিক পূর্বাভাস)

১.০% (অর্থনৈতিক পূর্বাভাস)

২০৩০ (অনুমান)

৫০% (অর্থনৈতিক মডেল)

৩০% (অর্থনৈতিক মডেল)

০.৮% (অর্থনৈতিক মডেল)

২০৩৫ (অনুমান)

৫৫% (অর্থনৈতিক মডেল)

৩২% (অর্থনৈতিক মডেল)

০.৬% (অর্থনৈতিক মডেল)

২০৪০ (অনুমান)

৬০% (অর্থনৈতিক মডেল)

৩৫% (অর্থনৈতিক মডেল)

০.৫% (অর্থনৈতিক মডেল)

এই পরিসংখ্যানগুলো ভয়াবহ এক ভবিষ্যৎ নির্দেশ করছে। অর্থনৈতিক মডেলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, যদি বর্তমান আইনি দুর্বলতা বজায় থাকে, তবে ২০৪০ সাল নাগাদ অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে লেনদেন ষাট শতাংশে উন্নীত হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে চরম ঝুঁকিতে ফেলবে। একই সাথে, এনবিআর ভিত্তিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস বলছে, কর ফাঁকির হার বৃদ্ধি পেয়ে ২০৪০ সাল নাগাদ পঁয়ত্রিশ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে, যা সরকারের রাজস্ব সংস্থানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

ভবিষ্যতে এর ফল হবে আরও করুণ:

প্রমাণ বা রসিদ না থাকায় ভেজাল পণ্য বা প্রতারণার শিকার হলেও ক্রেতা আইনি সুরক্ষা পাবেন না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সফল অভিযোগ নিষ্পত্তির হার আরও কমে ২০৪০ সাল নাগাদ শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশে নেমে আসতে পারে। কর ফাঁকির মাধ্যমে অল্প কিছু বিক্রেতা বিপুল মুনাফা অর্জন করবে, যা বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করবে এবং সৎ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানুষ আইনি প্রতিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাবে। নকল ও মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রির প্রবণতা বাড়বে, যা জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলবে। জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থার (UNIDO) একটি গবেষণা দেখায়, রসিদবিহীন লেনদেনের কারণে মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

আজ একটি ছোট কাগজের টুকরো—বিক্রয় রসিদ—না নেওয়া কেবল একটি লেনদেন সম্পন্ন করা নয়; এটি আমাদের সম্মিলিত অর্থনৈতিক ও আইনি নিরাপত্তার ওপর এক গভীর আঘাত। এই নীরব চুরি বন্ধ করতে না পারলে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি দুর্বল আইনি এবং কর-বিহীন অর্থনৈতিক কাঠামোর শিকার হবে। এটি আমাদের আস্থার চূড়ান্ত ভাঙন—যখন বিশ্বাস আর আইনি সুরক্ষা, দুটোই আমরা হারাচ্ছি।হে ভোক্তা! তোমার রসিদ, তোমার অধিকারের সনদ! যদি রসিদ না নাও, তবে তুমি কেবল টাকাই হারাও না—তুমি তোমার কণ্ঠস্বরকে হারাও! জাগো, তোমার অধিকারের জন্য—ক্যাশ মেমো চেয়ে নাও!