স্টেডিয়ামের মাটি চুরি
তদন্তে কী বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল না কেঁচো খুঁড়তে বের হবে সাপ?
‘পুকুর চুরি’ কথাটার সাথে আমরা সকলেই বেশ পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বাঘা বাঘা সব পরিচালকদের নাকের ডগা দিয়ে ‘পুকুর চুরি’ করতে করতেই যে ‘স্টেডিয়ামের মাটিও চুরি’ হয়ে গেল সেটি সাম্প্রতিক সময়ে আলোরণ তুলেছে বেশ।
২০৩১ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে তৈরি হতে যাওয়া স্টেডিয়ামের এখনও বসেনি একটি ইটও। স্টেডিয়ামের চারদিকেই রয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনি, চতুর্দিকেই বিদ্যমান কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সার্বক্ষণিক নজরদারি তো চলছেই।
কিন্তু এতো কিছুর ভেতরও পূর্বাচল স্টেডিয়ামের প্রায় ১৩ হাজার বর্গফুট মাটি চুরি হওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্যের। ২০ হাজার বর্গফুট মাটি যেখানে থাকার কথা সেখানে পাওয়া গেছে ৭ হাজার ৭১০ বর্গফুট মাটি। রীতিমত বোর্ডের কর্তাদের নাকের ডগা দিয়েই হয়েছে বিশাল এই চুরি।
চাহিদার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মাটির কোনো হদিসই নেই বিসিবির কাছে। যদিও কাগজ কলম বলছে ২০ হাজার বর্গফুট মাটি বুঝে নিয়েছে বেশ আগেই। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ডেলিভারি চালান ও সেগুলোতে মাঠ কিউরেটরের স্বাক্ষর সেই প্রমাণই দেয়। সেই মাটির অর্থ পুরোটাই দিয়ে দেয়া হয়েছে বলে দেখানো হয়েছিল আর্থিক বিবরণিতে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে প্রায় ২৩ লাখ টাকার মাটির নেই কোনো হদিস।
শুধু মাটি চুরিতেই থেমে থাকেনি চুরির এই মহাযজ্ঞ। চুরির পর যেটুকু মাটি রয়েছে অবশিষ্ট, সেগুলোও অতি নিম্নমানের। ক্রিকেট পিচের জন্য দরকারি নির্দিষ্ট মানের ‘ক্লে’ সেখানে নেই। বিসিবির অস্ট্রেলিয়ান কিউরেটর টনি হেমিংও এই অভিযোগ করেছেন।
বোর্ডের কাছে একেবারেই অজানা এই বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসায় হুঁশ ফিরেছে বোর্ডের। ইতোমধ্যেই পূর্বাচলে স্টেডিয়ামের জন্য নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করেছেন বিসিবির গ্রাউন্ডস কমিটির চেয়ারম্যান খালেদ মাসুদ পাইলট, ক্রিকেট অপারেশন্স ম্যানেজার শাহরিয়ার নাফিস ও বয়সভিত্তিক বিভাগের প্রধান আসিফ আকবর।
পরিদর্শন শেষে অনেকটা পূর্বনির্ধারিতভাবেই গৎবাঁধা সেই পুরোনো উত্তরেই দিলেন বোর্ড কর্তারা। তদন্ত কমিটি গঠন করে দিলেন থলের বেড়াল বের করে আনার ঘোষণা।
পাইলট বলেন, ‘নিরপেক্ষ একটা তদন্ত কমিটি করব, ওই কমিটিতে হয়তো দুয়েকজন আমাদের ডিরেক্টর থাকবেন, আর বাইরের দুয়েকজন থাকবেন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে। আমি মনে করি, এমন মানুষ রাখব যারা এসব কাজ করতে অভ্যস্ত। তিন সদস্যের একটা কমিটি করার পরিকল্পনা। আমি প্রেসিডেন্টকে (আমিনুল ইসলাম বুলবুল) তা দেব এবং জানাব যেন তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করে বিষয়টির তদন্ত করা হয়।’
একই সাথে সাবেক এই ক্রিকেটার সকল দায় অকপটেই চাপিয়ে দিলেন পূর্ববর্তী কমিটির ওপর। এমনকি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেনও যে মাটি ডেলিভারিই দেয় নি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।
বোর্ডের এই পরিচালক বলেন, ‘প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট মাটি এখানে আসার কথা। কিন্তু মাটি মেপে দেখা গেছে, সাড়ে ৭ হাজার বর্গফুটের মতো মাটি আছে এখানে। মাটি হয়তো এখানে আসেই নি।'
পাইলট অ্টআরও জানান, 'আমি শুনেছি এবং আমাদের একটা টিম আসছিল। আমি যখন দায়িত্ব পাই তার আগ থেকেই আমি এমন একটা ঘটনার কথা শুনেছি। খুব দ্রুত তদন্ত করতে চাই।’
কিন্তু এখানেই জাগে বড় একটি প্রশ্নের। দায়িত্ব নিয়েছেন বোর্ডের নতুন এই সভাপতি দু মাস হতে চললো। তিনি যদি আগেই শুনে থাকেন মাটি গায়েবের কথা, তাহলে শুরুতেই কেন সেটির বিষয়ে নিলেন না কোনো পদক্ষেপ? তাহলে কি তিনি সব জেনেও ছিলেন না জানার ভান করে? মিডিয়াতে খবরটি না আসলে বেমালুম চেপে যেত বোর্ড পুরো বিষয়টি? প্রশ্নটি তোলাই রইলো।
২০১৭ সালে এই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ শুরুর কথা ছিল। প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্প স্থগিত হওয়ার আগেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পপুলাসকে প্রায় ৩.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৩৫ কোটি টাকা) দিয়েছে বিসিবি। ভিত্তিপ্রস্তর না বসালেও এই বিপুল অর্থ পরিশোধ করা হয়েছিল।
৮ বছর পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান কোনো কাজই হয়নি পূর্বাচল স্টেডিয়ামের। কাজ না হলেও অর্থ লোপাট হয়েছে যে মহাসমারোহে, সেটি কিন্তু বলার অপেক্ষাই রাখছে না। এখন দেখার বিষয়, তদন্ত রিপোর্টে কী বেড়িয়ে আসে? থলের বেড়াল না কেঁচো খুঁড়তে বের হবে সাপ?
