বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অপরিকল্পিত ও ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে হাসিনা সরকার: উপদেষ্টা ফাওজুল

Bangla Post Desk
মাসউদুল হক
প্রকাশিত:৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:৫৭ পিএম
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অপরিকল্পিত ও ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে হাসিনা সরকার: উপদেষ্টা ফাওজুল

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, শেখ হাসিনার আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসবের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি খরচে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

সম্প্রতি ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।

তিনি আরও বলেন, বিগত সরকারের সময় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মহোৎসব চলেছে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের অর্থ লোপাট করা হয়েছে। যেখানেই হাত দিচ্ছি সেখানেই দুর্নীতি পাচ্ছি।

কিছু মানুষকে সুবিধা দিতে ও স্বজনপ্রীতির জন্য অপ্রয়োজনে বেসরকারি খাতে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। এসব প্রকল্পে ভর্তুকির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হয়েছে।

কারণ হিসেবে উপদেষ্টা বলেন, হাসিনা সরকার বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে, বিদ্যুৎ কোম্পানিকে টাকাও দিতে পারি না, আবার বিদেশি হলে ডলার দিতে পারি না। গ্যাস আমদানির জন্য ডলার দিতে পারছি না। একটা বিদিকিচ্ছিরি (বিব্রতকর) অবস্থার মধ্যে আমরা পড়েছি। বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার জন্য কিন্তু বিদ্যুতের ট্যারিফ বারবার বাড়ানো হয়েছে। যেনতেন চার্জ যোগ হয়েছে। তাতে একদিকে গ্রাহকদের যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনি দেশের অর্থ অপচয় হয়েছে।

খান আরও বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনিয়ম খুঁজে বের করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে একজন বিচারপতিকে প্রধান করে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

ফাওজুল কবির বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির যে সংকট রয়েছে, তা দূর করতে আমরা চেষ্টা করছি, অনিয়মের যে নকশা সেটা ভেঙে দিয়েছি। বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে পুনর্গঠন করছি।

উপদেষ্টা বলেন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় গভীর সমুদ্রবন্দর, অর্থনৈতিক জোন, রেললাইন ও সড়ক প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে এর থেকে প্রকৃত সুবিধা পাওয়া সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এখন থেকে বড় প্রকল্পের সঙ্গে ছোট ছোট প্রকল্পের মাধ্যমে স্বল্প খরচে দ্রুত তা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হবে।

দায়িত্ব গ্রহণের পর নেওয়া পদক্ষেপগুলো
উপদেষ্টা বলেন, ‘২০১০ সালের বিশেষ আইন স্থগিত ও বিআরসি আইনের ৩৪ (ক) ধারা বাতিল, তেলের দাম কমানো, কোম্পানির চেয়ারম্যান থেকে সচিবদের অপসারণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লুটপাটের কাঠামো ভেঙে দেওয়া, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধের জন্য বদলি ও নিয়োগের নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যাতে কাজ পায় সেটা নিশ্চিত করারও নির্দেশনা দিয়েছি। উন্মুক্ত দরপত্রে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।’

বিদ্যুতের লোডশেডিং 
                     
উপদেষ্টা বলেন, ‘বিদ্যুতের লোডশেডিং থাকার কারণ হচ্ছে আমাদের ক্যাপাসিটির বাইরে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেবে যে রাজৈনিত সিদ্ধান্ত ছিল, সবই ছিল লোক দেখানো। আমার যা সক্ষমতা আছে তার চেয়ে বেশি সংযোগ দিয়েছি, এখানে তো বিদ্যুতের লোডশেডিং হবেই।’

সাম্প্রতিক বিদ্যুতের লোডশেডিং সম্পর্কে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, বড়পুকুরিয়ায় কারিগরি সমস্যা হয়েছিল যা দ্রুত মেরামত করা হয়েছে। রামপাল পুনরায় চালু হয়েছে, আদানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে ও দ্রুত গ্যাস আমদানির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফলে বর্তমানে বিদ্যুতের অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি

উপদেষ্টা বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। প্রতিটি প্রকল্প আমরা যাচাই করে দেখব, অনিয়ম-দুর্নীতি হলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তথ্য চেয়ে সহযোগিতা কামনা করেন উপদেষ্টা।

প্রকল্পসহ সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত

প্রকল্পসহ সব ক্ষেত্রে এখন থেকে সবার জন্য প্রতিযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যাতে কাজ পায় সেটা নিশ্চিত করা হবে। উন্মুক্ত দরপত্রে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। এই সরকার কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গ্রুপকে প্রমোট করবে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের ব্যাপারে উদ্যোগ

সব অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছন্ন করা হবে। বেআইনি সংযোগ বিচ্ছিন্নের ব্যাপারে তথ্য নেব আগে। তারপর এ বিষয়ে খুব শিগগিরই অভিযান চালানো হবে। বাসা-বাড়ি ও শিল্প কারখানায় যদি অবৈধ গ্যাস সংযোগ থাকে, তাহলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, তিতাস গ্যাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়েছে। এসবের সঙ্গে কারা জড়িত সেটিও বের করব।

নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ

তিনি বলেন, নতুন করে আর কোনো গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে না। অনেক জায়গায় মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। যার এক বা একাধিক গ্যাস লাইন আছে, এরমকম কোনো জায়গায়ও গ্যাস লাইন বাড়াতে নতুন করে সংযোগ দেওয়া হবে না।

জ্বালানি খাতের অনিয়ম

জ্বালানি খাতের অনিয়ম বিষয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে জ্বালানি খাতে যে অনিয়ম হয়েছে, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ ব্যাপারে চুক্তি আইনের প্রশ্ন জড়িত। তাই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। ইতোমধ্যে জ্বালানি খাতের অনিয়ম বিষয়ে প্রয়োজনে সাবেক বিচারপতির সমন্বয়ে কমিটি করে বিদ্যমান চুক্তির শর্তগুলো রিভিউ করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তিনি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর পুনর্গঠন এবং বিদ্যমান অনিয়মের কাঠামো ভেঙে ফেলার বিষয়ে সরকারের অভিপ্রায় পুনর্ব্যক্ত করেন।

উপদেষ্টা বাংলাদেশে সবার জন্য সমান সুযোগের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, চলমান চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সমাধান খোঁজা হচ্ছে।

তীব্র জ্বালানি সংকটের মধ্যে গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করার উদ্যোগ নিয়ে তিনি বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে গ্যাসের ঘাটতি কমানো যেতে পারে এবং চলমান প্রকল্পের জন্য কঠোর সময়সীমা এবং নির্ধারিত বাজেটের মধ্যে রাখতেক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।