নতুন বননীতি চূড়ান্ত, বৃক্ষাচ্ছাদন ২৭ শতাংশে উন্নীতের লক্ষ্যমাত্রা

Staff Reporter
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক ঢাকা
প্রকাশিত:০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪৮ এএম
নতুন বননীতি চূড়ান্ত, বৃক্ষাচ্ছাদন ২৭ শতাংশে উন্নীতের লক্ষ্যমাত্রা
ছবি: সংগৃহীত

দেশের পরিবেশ, বনসম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকার 'জাতীয় বননীতি, ২০২৫' জারি করেছে। নীতিতে ২০৩৫ সালের মধ্যে বৃক্ষাচ্ছাদন ২৭ শতাংশে উন্নীত করা, সব ধরনের বনভূমির কঠোর সুরক্ষা এবং বননির্ভর জনগোষ্ঠীর অধিকার স্বীকৃতির মতো বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে বননীতির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এরপর এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, অনুপ্রবেশ, আইনি দুর্বলতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য দ্রুত ক্ষয়—অবক্ষয়ের মুখে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৪ সালের বননীতি হালনাগাদ করে জাতীয় বননীতি, ২০২৫ প্রণয়ন করেছে সরকার। সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার যে দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে, নতুন এই নীতি তার বাস্তব রূপায়ন হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে ভুলে জানিয়েছেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

নীতিতে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন, চরম আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বননির্ভর মানুষের জীবিকা টেকসই রাখতে দেশের বন ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও সংরক্ষণমুখী করতে হবে। পাশাপাশি বন খাতে কার্বন নিঃসরণ কমানো, কার্বন মজুদ বৃদ্ধি, উপকূলীয় বেষ্টনী জোরদার এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়নকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

বনায়ন ও বনভূমি সুরক্ষা

নীতিতে বিদ্যমান সব বনভূমিকে কঠোর সুরক্ষার আওতায় আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় নতুন সবুজ বেষ্টনী তৈরির পাশাপাশি নতুন চর, পতিত জমি ও নদীর চরগুলোতে সরকারি মালিকানায় ব্যাপক বনায়ন গড়ে তোলা হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট ভূমির অন্তত ৪ শতাংশকে রক্ষিত এলাকা ঘোষণার পরিকল্পনাও নীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

স্থানীয় জনগণ, নারী, তরুণ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ‘ফ্রি, প্রাইর অ্যান্ড ইনফর্মড কনসেন্ট (এফপিআইসি)’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সব পক্ষের সম্মতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বনভূমি কোনোভাবেই অ-বন কাজে ব্যবহার করা যাবে না। সরকারি বনভূমি অন্য খাতে নিতে হলে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সরকারপ্রধানের অনুমোদন ছাড়া কিছুই করা যাবে না।

বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ

বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, চলাচল করিডোর, খাদ্যাঞ্চল, জলাভূমি ও অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিলুপ্ত বা বিপন্ন প্রজাতির পুনঃপ্রবর্তন, বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতি নিয়ন্ত্রণ এবং বন্যপ্রাণী পাচার প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মানুষ–বন্যপ্রাণী দ্বন্দ্ব কমাতে প্রযুক্তিভিত্তিক সতর্কতা ব্যবস্থা, ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা ও আলোকপ্রপাতকরণ বাদ দিয়ে বাস্তুসংস্থান-সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

বৃক্ষাচ্ছাদন বৃদ্ধি

নীতিতে ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশব্যাপী বৃক্ষাচ্ছাদন ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে পাহাড়ি বন, শালবন, উপকূলীয় বন, নদীতীর, হাওর, খাল–বিল, রেলপথ, সড়কধারের ভূমি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত জায়গায় বৃহৎ পরিসরে বনায়ন করা হবে। বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলে তালগাছ রোপণকে উৎসাহিত করা হবে। জলাভূমিতে নিচুভূমি–উপযোগী উদ্ভিদের মাধ্যমে পরিবেশসম্মত বনায়ন করা হবে।

সামাজিক ও অংশীজনভিত্তিক বনায়ন

স্থানীয় জনগণ, নারী, ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সামাজিক বনায়ন সম্প্রসারণ করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্রাম বন, প্রথাগত অধিকার এবং সামাজিক বনায়নের আইনি স্বীকৃতি দিতে নীতিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এলাকা অনুযায়ী পৃথক মডেল তৈরি এবং যথাযথ সুবিধাভোগী তালিকা প্রণয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

প্রকৃতি-শিক্ষণ ও পর্যটন

নীতি অনুযায়ী, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে প্রকৃতি শিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। বনাঞ্চলে পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পরিবেশ-সংবেদনশীল এলাকা সীমিত রাখা, বনভূমিতে প্লাস্টিক, উচ্চ শব্দ, দাহ্য পদার্থ বা রাসায়নিক দ্রব্য বহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পর্যটন কর্মকাণ্ড বনাঞ্চলে অনুমোদন দেওয়া হবে না।

 কঠোর শাস্তির সুপারিশ

বন ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, জাতীয় বন জরিপ, ড্রোন নজরদারি, স্পেকট্রাল অ্যানালাইসিসসহ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। জাতীয় কার্বন রেজিস্ট্রি ও কার্বন ট্রেডিং–এর রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হবে। বন আইনের যুগোপযোগী সংশোধন এবং বন অপরাধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে।

সরকার মনে করে, জাতীয় বননীতি ২০২৫ কার্যকর হলে দেশের প্রাকৃতিক বন, জীববৈচিত্র্য, উপকূলীয় সুরক্ষা, জলাভূমি, পাহাড়ি অঞ্চল ও সমগ্র বাস্তুতন্ত্র টেকসইভাবে সংরক্ষিত হবে—যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির দিকে অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।