বাড়ছে ভূমিকম্পের তেজ, কেন এই পরিবর্তন

Staff Reporter
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:০০ পিএম
বাড়ছে ভূমিকম্পের তেজ, কেন এই পরিবর্তন
ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের জুলাই মাসে চিলির উত্তরাঞ্চলীয় শহর কালামায় আঘাত হানা ৭.৪ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পটি বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। চিলিতে ভূমিকম্প নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই কম্পনটি অন্য যেকোনো গভীর ভূকম্পন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ করেছে—যা এর শক্তি সঞ্চয়ের পদ্ধতি নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে।

ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল মাটির প্রায় ১২৫ কিলোমিটার গভীরে। সাধারণত, এত গভীর থেকে উৎপন্ন ভূমিকম্পের তীব্রতা ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু কালামার ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক তার উল্টো। ভূপৃষ্ঠেও এর কম্পন ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী, যার ফলে এলাকায় ফাটল দেখা দেয় এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।

ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অস্টিন-এর একদল বিজ্ঞানী এই অস্বাভাবিক ঘটনার রহস্য ভেদ করতে গবেষণা শুরু করেন, যা সম্প্রতি বিখ্যাত জার্নাল ‘নেচার কমিউনিকেশনস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। তাদের গবেষণা বলছে, মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা একটি বিশেষ প্রক্রিয়া বা মেকানিজম এই ভূমিকম্পটিকে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী বা ‘সুপারচার্জ’ করে তুলেছে।

দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, মাঝারি বা বেশি গভীরতার ভূমিকম্পগুলো ঘটে মূলত 'ডিহাইড্রেশন এমব্রিটেলমেন্ট’ প্রক্রিয়ায়। এই প্রক্রিয়ায় মাটির গভীরে উচ্চ তাপ ও চাপে পাথরের খনিজ থেকে পানি বেরিয়ে গেলে পাথর দুর্বল হয়ে ভেঙে যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার একটি তাপমাত্রার সীমা আছে—৬৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বেশি হলে এটি কাজ করে না।

কালামার ভূমিকম্প এই প্রচলিত নিয়ম মানেনি। গবেষকরা দেখেছেন, এই ভূমিকম্পের ফাটলটি ৬৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নির্ধারিত সীমা পার করে আরও প্রায় ৫০ কিলোমিটার গভীরে, অর্থাৎ অনেক বেশি উত্তপ্ত এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।

বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়াকে ‘থার্মাল রানওয়ে’ নামে অভিহিত করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় ভূমিকম্প শুরু হওয়ার পর পাথরের ঘর্ষণে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। এই তাপ আশেপাশের পাথরকে আরও দুর্বল করে দেয়, যা ফাটলটিকে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে সাহায্য করে এবং ভূমিকম্পটিকে অতিরিক্ত শক্তিশালী করে তোলে।

গবেষণার প্রধান লেখক ঝে জিয়া বলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো দেখলাম যে, মাটির মাঝারি গভীরতার ভূমিকম্প আমাদের পুরনো ধারণা ভেঙে দিচ্ছে। এটি তুলনামূলক ঠান্ডা এলাকা থেকে শুরু হয়ে অত্যন্ত দ্রুত গরম এলাকার দিকে ছড়িয়ে পড়েছে—যা ভূমিকম্পের শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি নতুন চিত্র দেখাচ্ছে।’

টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলটি চিলি ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মিলে ভূকম্পন তরঙ্গের গতি এবং গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেমের (GNSS) ডেটা বিশ্লেষণ করে এই আবিষ্কার করেছেন। কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে তারা নিশ্চিত করেছেন যে, ফাটলটি কীভাবে ছড়িয়েছে এবং কোন স্তরে সবচেয়ে বেশি বিকৃতি ঘটেছে।

গবেষক থর্স্টেন বেকার জানান, চিলির মতো এলাকায় ভবিষ্যতে আরও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। মাটির গভীরের এই নতুন আচরণ সম্পর্কে জানার ফলে এখন বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও পূর্বাভাস আরও নির্ভুলভাবে পরিমাপ করতে পারবেন। এই গবেষণা দুর্যোগ মোকাবিলা ও ঘরবাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।