অধ্যাদেশ হলেও ৬ মাসে আলাদা হয়নি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’
‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২’ সংশোধন করে গত ৩ জুন সরকার জারি করে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’। নতুন এই অধ্যাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হলেও ছয় মাসের বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’—এই দুই শ্রেণি আলাদা করা যায়নি। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা ও বিতর্ক কাটেনি।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে রণাঙ্গনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরাই কেবল ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে মর্যাদা পাবেন।
অন্যদিকে, যারা দেশ-বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করা, বিশ্ব জনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন আদায়সহ স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন, তারা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’।
আইন কার্যকর হলেও এখন পর্যন্ত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে কারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং কারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী—সে বিভাজন করতে পারেনি। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি চূড়ান্ত, বিতর্কহীন তালিকা প্রণয়ন আরও বিলম্বিত হচ্ছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, অধ্যাদেশ অনুযায়ী দ্রুত মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের আলাদা করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা জরুরি।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সরকারই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল ও চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই নতুন করে তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।
তালিকার নামে বহু অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সময়ে সুযোগ-সুবিধা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৯ হাজার।
তবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) সদস্যদের দাবি, ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা সর্বোচ্চ এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়। সে হিসাবে বর্তমান তালিকার প্রায় অর্ধেকই ভুয়া বলে মনে করছেন তারা।
জামুকার সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আহমেদ খান জানান, বর্তমানে চারটি টিম যাচাই-বাছাইয়ের কাজে যুক্ত। সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ২৫০টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘যাচাই করতে গিয়ে দেখছি, প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মুক্তিযোদ্ধা ভুয়া। আমরা নোট দিয়ে সেগুলো বাতিলের সুপারিশ করছি।’
এ পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার অভিযোগের মধ্যে ৬–৭ হাজার নিষ্পত্তি করা হয়েছে। পুলিশ থেকে পাঠানো দেড় হাজার আবেদনের মধ্যে ১২০০–১৩০০টিই ভুয়া বলে শনাক্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সাদেক আহমেদ খান বলেন, ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের সময় আমিন আহম্মেদ চৌধুরী (বীর বিক্রম)–এর নেতৃত্বে একটি জাতীয় তালিকা করা হয়েছিল। তখন কোনো ভাতা বা সুযোগ-সুবিধা না থাকায় সেই তালিকায় মূলত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই ছিলেন, যার সংখ্যা ছিল ৯২ হাজার।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বর্তমান সরকারের সময়ের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা করার চেষ্টা করছি। জামুকার বর্তমান কমিটির মেয়াদ তিন বছর। নতুন সরকার এলেও এই কমিটি বাতিল হয়ে যাবে—এমন নয়।’
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংক্রান্ত বহু মামলা-মোকদ্দমা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় কাজটি সময়সাপেক্ষ হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের তালিকা তৈরির কাজও চলমান।
সচিব ইসরাত চৌধুরী বলেন, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, বিদেশে সংগঠক হিসেবে কাজ করা ব্যক্তি, ক্রীড়াবিদসহ নির্দিষ্ট কিছু ক্যাটাগরির মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হবেন।’
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন জানান, নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী তিন ক্যাটাগরিতে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাঁচ ক্যাটাগরিতে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী তালিকাভুক্ত হবেন।
তিনি বলেন, ‘যারা এখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সহযোগী—তাদের আলাদা করা একটি বড় ও জটিল প্রক্রিয়া। জনবল সংকটের কারণে এটি দ্রুত করা সম্ভব হচ্ছে না।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান খান (বীর প্রতীক) বলেন, ‘আইন হয়েছে, এখন দ্রুত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের আলাদা তালিকা করা দরকার। এতে দীর্ঘদিনের বিভ্রান্তি দূর হবে।’
আরও খবর
এক লাশের বিনিময়ে মেলে ৩০০ থেকে ৬ হাজার টাকা, ব্যক্তিভেদে বাড়ে-কমে
সচিবালয়ে ফায়ারের গাড়ি প্রবেশে হচ্ছে আলাদা গেট, সব ফ্লোরে বসছে বিশেষ দরজা
নতুন বননীতি চূড়ান্ত, বৃক্ষাচ্ছাদন ২৭ শতাংশে উন্নীতের লক্ষ্যমাত্রা
বাড়ছে ভূমিকম্পের তেজ, কেন এই পরিবর্তন
ভূমিকম্পে ঢাকার বহুতল ভবনের বাসিন্দাদের করণীয়