এক লাশের বিনিময়ে মেলে ৩০০ থেকে ৬ হাজার টাকা, ব্যক্তিভেদে বাড়ে-কমে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এবং পেশাদার ‘শার্প শুটার’ বা দক্ষ বন্দুকধারীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। অপরাধ জগতের অন্ধকার অংশে সক্রিয় এসব শুটাররা মাঝেমধ্যেই চাঞ্চল্যকর কায়দায় গুলি চালিয়ে নিজেদের ক্ষমতার জানান দিচ্ছে।
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাস দমনে যুক্ত একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানিয়েছে, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নির্বাচনের আগে কমপক্ষে ২০ জন দুর্ধর্ষ শুটারকে ঘিরে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। এদের কয়েকজন আটক হলেও তাদের সহযোগীরা পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহীতেও শক্তিশালী শুটারদের প্রভাববলয় রয়েছে।
গত দেড় মাসের মধ্যে এই শুটারদের ভয়ংকর কর্মকাণ্ডের অন্তত চারটি উদাহরণ দেখা গেছে:
নভেম্বর, চট্টগ্রাম: বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থীর গণসংযোগে অস্ত্রধারীর গুলি।
নভেম্বর, পল্লবী (ঢাকা): শুটারের নির্ভুল নিশানায় যুবদল নেতার মৃত্যু।
নভেম্বর, পুরান ঢাকা: তালিকাভুক্ত আরেক সন্ত্রাসীর প্রাণহানি।
ডিসেম্বর, পল্টন (ঢাকা): গত শুক্রবার ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন।

এই ঘটনাগুলো দেশের আইনশৃঙ্খলার চ্যালেঞ্জ এবং অস্ত্রধারী শুটারদের ভয়াবহ চিত্রটি স্পষ্ট করে তুলেছে।
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে ভোটের দিন যত এগিয়ে আসবে, এই দক্ষ বন্দুকবাজরা নানা কারণে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া নির্বাচনী প্রচারণাকে কেন্দ্র করে এলাকাভিত্তিক সক্রিয় শুটাররাও উদ্বেগের কারণ।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র, সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন নিশ্চিত করেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় অস্ত্রধারী ও পেশাদার অপরাধীদের হালনাগাদ তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার এবং অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
রাজধানীর পুরান ঢাকায় গত ১০ নভেম্বর ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সামনে ফিল্মি কায়দায় গুলি চালিয়ে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ ওরফে মামুনকে হত্যা করা হয়। এক মিনিটেরও কম সময়ে এই কিলিং মিশনটি সম্পন্ন করে শুটাররা।
মামুন হত্যায় জড়িত গ্রেপ্তার হওয়া শুটারদের জিজ্ঞাসাবাদকারী ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এক কর্মকর্তা জানান, এই বন্দুকধারীরা প্রত্যেকেই শার্প শুটার (অত্যন্ত দক্ষ)। তারা মূলত ভাড়ায় কাজ করে এবং হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিদের হত্যার চুক্তি নেয়। রাজনীতিক বা শক্ত প্রতিপক্ষ গ্যাংস্টারদের হত্যার জন্য তারা মোটা অঙ্কের টাকা বা পারস্পরিক সমঝোতা গ্রহণ করে থাকে।

মিরপুরের ফোর স্টার গ্রুপ: পল্লবীতে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে পয়েন্ট-ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে এলোপাতাড়ি গুলিতে হত্যার ঘটনায় এই গ্রুপের নাম আলোচনায় আসে। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া শুটাররা প্রাথমিকভাবে ৩০ হাজার টাকা পেয়েছিল। এই গ্রুপের আরও অন্তত পাঁচজন দক্ষ শুটারের তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে।
শুটার বাপ্পি: দুর্ধর্ষ এই শুটার (মো. আলী ওরফে ফিরোজ আলম নামেও পরিচিত) ডেমরা-যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু করে সাভার ও আশুলিয়া পর্যন্ত সক্রিয়। চলতি বছরের জুনে ইয়াবার চালান নিয়ে যাওয়ার সময় সে পুলিশের মুখে পড়ে এবং রাতের অন্ধকারে নিখুঁত নিশানায় গুলি চালায়, যাতে ডিবির তিন সদস্য গুলিবিদ্ধ হন। বাপ্পি পরবর্তীতে যশোর থেকে গ্রেপ্তার হলেও ছয় মাস না যেতেই জামিনে মুক্ত হয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। বাপ্পি জবানবন্দিতে জানিয়েছে, সে অবৈধ অস্ত্রের জগতে প্রবেশ করার পর জুন মাস পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীদের কাছে প্রায় ৭০টি অবৈধ অস্ত্র বিক্রি ও সরবরাহ করেছে।
কিশোর গ্যাং ও দলছুট শুটার: শরিফ ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ আলোচনায় এসেছেন, যাকে বর্তমানে 'শার্প শুটার' হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মোহাম্মদপুরের কিশোর গ্যাংসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোতেও অন্তত দশজন সক্রিয় শুটার রয়েছে।

গত সাত মাসে ডিবি শুটারদের দুটি অস্ত্র ভান্ডারের সন্ধান পেয়েছে। কিবরিয়া হত্যার তদন্তে পল্লবীর একটি রিকশা গ্যারেজ থেকে এবং পুলিশকে গুলি করার ঘটনায় বাপ্পির বাসা থেকেও বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব অস্ত্র শুটাররা নিজেরা ব্যবহার করার পাশাপাশি ভাড়াতেও দেয়। অস্ত্র ভাড়া দেওয়া, নেওয়া ও ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনেক সময় কেউই কাউকে চেনে না এবং ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, মাত্র ৬০০ টাকা থেকে ৩,০০০ টাকায়ও শুটার ভাড়া পাওয়া যেতে পারে। তবে শুটারের ‘মজুরি’ নির্ভর করে কাকে গুলি করা হবে, ভয় দেখানো হবে নাকি হত্যা করা হবে—এর ওপর। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ বাড়ে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, নির্বাচনের আগে অস্ত্রধারী ও শুটারদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী মাঠে আমরা সংঘাত, পেশিশক্তির ব্যবহার এবং আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা দেখেছি। এমন পরিস্থিতিতে অস্ত্রবাজদের চাহিদা বাড়ে। আইন প্রয়োগের জায়গা থেকে যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে পারলে তখনই সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’
আরও খবর
অধ্যাদেশ হলেও ৬ মাসে আলাদা হয়নি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’
সচিবালয়ে ফায়ারের গাড়ি প্রবেশে হচ্ছে আলাদা গেট, সব ফ্লোরে বসছে বিশেষ দরজা
নতুন বননীতি চূড়ান্ত, বৃক্ষাচ্ছাদন ২৭ শতাংশে উন্নীতের লক্ষ্যমাত্রা
বাড়ছে ভূমিকম্পের তেজ, কেন এই পরিবর্তন
ভূমিকম্পে ঢাকার বহুতল ভবনের বাসিন্দাদের করণীয়