1. হোম
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

বিদেশে বসেই মিরপুর ‘শাসন’ চার শীর্ষ সন্ত্রাসীর

Staff Reporter
কাজী নাহিয়ান আরেফীন
ঢাকা
প্রকাশিত: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:২৮ পিএম
বিদেশে বসেই মিরপুর ‘শাসন’ চার শীর্ষ সন্ত্রাসীর
ছবি: বাংলাপোস্ট

বাংলাদেশ থেকে শত মাইল দূরে ভিন্ন ভিন্ন দেশে অবস্থান করলেও রাজধানী ঢাকার মিরপুর অঞ্চলের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছেন চার শীর্ষ সন্ত্রাসী। চার শীর্ষ সন্ত্রাসী ‘ঐক্যমতের ভিত্তিতে’ পুরো মিরপুরকে ভাগ করে নিয়েছেন চারটি ভাগে। আর চার শীর্ষ সন্ত্রাসী তাদের তৈরি করা সেই চক্রের নাম দিয়েছেন ‘ফোর স্টার গ্রুপ’।

মিরপুর অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে ত্রাস সৃষ্টি করছে এই ‘ফোর স্টার গ্রুপ’এর ক্যাডাররা। চারটি ভিন্ন দেশে অবস্থানরত শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান মামুন, শাহাদাত হোসেন ওরফে শাহাদাত, কিলার ইব্রাহীম ও মোক্তার এই গ্রুপের মূল নিয়ন্ত্রক। তাদের নির্দেশেই মিরপুরে আবাসন ব্যবসা, মাদক কারবার, পরিবহন খাতসহ অন্তত ১২ ধরনের গুরুতর অপরাধমূলক কার্যক্রম সংঘটির হয়।

পলাতক চার শীর্ষ সন্ত্রাসী মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি ও ভারতের নিরাপদ অবস্থানে থেকে ভিওআইপি ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে 'ফোর স্টার গ্রুপ'-এর নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছে। বিদেশ থেকে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে টাকা তোলা হয়, সংঘটিত হয় খুন, অপহরণ, অস্ত্র ও মাদক কারবারের মতো অপরাধ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্লবীর একজন আবাসন ব্যবসায়ী জানান, ‘স্থানীয় প্রভাবশালী সন্ত্রাসীদের প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়েই ব্যবসা চালাতে হয়। ক্ষমতা পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে চাঁদাও তখন ভিন্ন নেতার নামে দিতে হয়।’

বেশ কয়েকটি সূত্র মারফত নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, এই চাঁদা আদায়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই পল্লবীতে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি পল্লবী থানা যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের পেছনেও চাঁদার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের যোগসূত্র রয়েছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মিরপুরকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ভূমি দখল, ভাড়ায় হত্যাকাণ্ড, মাদক ও অস্ত্র কারবার এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে চাঁদাবাজিসহ অন্তত ১২ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই চক্রের নেটওয়ার্ক শনাক্তের কাজ চলছে এবং এর মাঠ পর্যায়ে প্রায় অর্ধশত সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের এ বিষয়ে জানান, ‘কার নির্দেশে অপরাধচক্র চলছে এবং কারা এতে যুক্ত হচ্ছে, সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছে পুলিশ। শুধু ফোর স্টার গ্রুপ নয়, যেকোনো দল বা ব্যক্তি অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।’

মিরপুরকে চারটি ভাগে ভাগ করে ‘ফোর স্টার’ গ্রুপ বিস্তার করেছে তাদের অপরাধের সাম্রাজ্য।

মালয়েশিয়ায় থাকা মামুন নিয়ন্ত্রণ করেন মিরপুর ১২, পল্লবী, সাগুফতা এলাকা

শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান মামুন এই গ্রুপের এক নম্বরে রয়েছেন এবং মালয়েশিয়া থেকে মিরপুর ১২, পল্লবী, সাগুফতা ও বাউনিয়াবাঁধ এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছেন। পল্লবী যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডে মামুনের নাম উঠে এসেছে।

পল্লবী থানায় খুন, চাঁদাবাজি, মাদক, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ডাকাতির অভিযোগে মামুনের বিরুদ্ধে অন্তত ২৭টি মামলা রয়েছে। তিনি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি।

বিদেশে পলাতক তাঁর ছোট ভাই মশিউর রহমান তাঁকে সহযোগিতা করেন। তাদের বড় ভাই জামিলুর রহমান মাঠ পর্যায়ে শতাধিক চিহ্নিত সন্ত্রাসী নিয়ে এই বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেন। জামিলুরের দলে রয়েছে দেলোয়ার হোসেন রুবেল, রফিকুল, নাটা আলমগীর, কালা মোতালেব, 'ল্যাংড়া রুবেল'সহ অনেকে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ‘ল্যাংড়া রুবেল’ একসময় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত থাকলেও গত বছর অস্ত্র লুটের ঘটনার পর থেকে সে মাদক ব্যবসার পাশাপাশি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে।

ইতালিতে থেকে শাহাদাতের নিয়ন্ত্রণ মিরপুর ১, ২, ৬ ও ৭ নম্বর এলাকা

ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামি শাহাদাত হোসেন ওরফে শাহাদাত বর্তমানে ইতালিতে পলাতক। সেখান থেকে তিনি মিরপুর ১, ২, ৬ ও ৭ নম্বর এলাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের সহযোগী ছিলেন। শাহাদাতের মাঠ পর্যায়ের সক্রিয় সদস্যরা হলেন টিপু সুমন, ফিটিং শিশির, বিহারী নীলা।

ফ্রান্স থেকে কিলার ইব্রাহীম চালান ভাসানটেক ও কালশী এলাকার অপরাধ কার্যক্রম

‘ফোর স্টার গ্রুপের’ অন্যতম খুঁটি, ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামি কিলার ইব্রাহীম বর্তমানে ফ্রান্স থেকে মিরপুর ১৩, ১৪, ভাসানটেক ও কালশী এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ভাসানটেকের বাসিন্দা একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘গত বছর বাড়ি তৈরির সময় বিদেশ থেকে সন্ত্রাসী ইব্রাহিমের নাম করে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা চায়। চাঁদা না পেয়ে তার অনুসারীরা আমার নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ভেঙে দেয়।

জানা গেছে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অন্তত চারটি হত্যাকাণ্ডের মামলায় নাম রয়েছে এই কিলার ইব্রাহিমের।

যুবরাজ, সাবু, শাকিল, পাতা সোহেল, জনি তার সক্রিয় ক্যাডার। এর ভেতর যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে পাতা সোহেল ও জনিসহ কয়েকজন বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।

ভারতে থাকা মোক্তারের নিয়ন্ত্রণে মিরপুর ১০ ও ১১ এলাকা

‘ফোর স্টার গ্রুপের’ আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোক্তার ভারত থেকে মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন।

হাড্ডি সোহাগ, নওশাদ, আশিক, এলেক্স জুয়েল, ‘শুটার জাকির’ তার প্রধান সহযোগী। সন্ত্রাসী মোক্তারের মদদপুষ্ট আশিক নিজেও কিশোর-যুবকদের নিয়ে একটি আলাদা সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছে।