২০২৬ কি বাঙালির স্বপ্নের কাঙ্ক্ষিত ভোর হবে?
বাংলার ধুলোমাখা মেঠো পথ থেকে শুরু করে আজকের পিচঢালা রাজপথ, আর সেই মেঠো পথের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা এক কিশোরের চোখে দেখা স্বপ্নের মতো আমাদের এই বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের সেই শান্ত দুপুরগুলোর কথা মনে পড়ে, যখন আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.১ শতাংশের আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর মানুষের মনে ছিল এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তখন থেকে শুরু করে আজকের ২০২৫ সালের এই বিদায়বেলা পর্যন্ত সময়টা যেন এক দীর্ঘ উপন্যাসের মতো, যেখানে উত্থান আছে, পতন আছে, আর আছে বুক ফেটে যাওয়া দীর্ঘশ্বাস।
২০২৬ সালে আমাদের দেশ এক নতুন পরিচয়ে পৃথিবীতে মাথা তুলবে—আমরা উন্নয়নশীল দেশের তকমা পাব। কিন্তু এই তকমা পাওয়ার আনন্দ যেন এক মধ্যবিত্ত বাবার বড় মেয়ের বিয়ের আনন্দের মতো; যেখানে আনন্দের চেয়েও বেশি থাকে সামনের দিনের অনাগত খরচের চিন্তা আর বিচ্ছেদের ভয়।
২০১৫ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই এক দশকে আমাদের চোখের সামনে পদ্মা সেতু দাঁড়িয়েছে এক দৃঢ় সংকল্পের মতো। এটি কেবল ইটের ওপর ইটের স্তূপ নয়, এটি ছিল বিশ্বব্যাংকের দেওয়া অপমানের এক জীবন্ত প্রতিশোধ। কিন্তু এই উন্নয়নের চাকচিক্যের আড়ালে যখন আমরা তাকিয়ে দেখি, তখন দেখি সাধারণ মানুষের পকেটের শূন্যতা। ২০১৫ সালে এক কেজি চালের দাম যা ছিল, ২০২৫ সালের শেষে এসে তা যেন এক আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। এই যে মুদ্রাস্ফীতির করাল গ্রাস, এটি কেবল পরিসংখ্যান নয়; এটি হলো সেই মায়ের চোখের জল যিনি বাজারের ব্যাগে পর্যাপ্ত সবজি নিতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মেট্রো রেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় বসে আমরা যখন জানালার বাইরে তাকাই, তখন নিচের যানজটে আটকে থাকা রিকশাওয়ালাটার ঘাম আমাদের উন্নয়নের সংজ্ঞাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ২০২৬ সালে যখন আমাদের শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা চলে যাবে, তখন তৈরি পোশাক শিল্পের সেই লাখ লাখ নারী শ্রমিকের কপালে যে চিন্তার ভাঁজ পড়বে, সেই ভাঁজ মোছার ক্ষমতা আমাদের সুশাসনের আছে কি?
আমাদের উন্নতির ৫০টি দিক নিয়ে যখন কথা বলি, তখন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের কথা গর্ব করে বলি। কিন্তু এগুলোর পেছনে যে ঋণের পাহাড় জমেছে, তা ২০৪০ সালের সেই প্রজন্মের কাঁধে এক বিশাল বোঝা হয়ে চেপে বসবে। রূপপুর আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে ঠিকই, কিন্তু এর তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সামান্যতম ভুল আমাদের সুন্দরবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের যে স্লোগান আমরা দিচ্ছি, তা সফল হবে না যদি না আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কেরানি তৈরির কারখানা থেকে বের করে আনতে পারি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার বের হচ্ছে, যারা সার্টিফিকেটের বোঝা কাঁধে নিয়ে পথে পথে ঘুরছে। এই যে 'স্কিল মিসম্যাচ', এটি আমাদের উন্নয়নের পথে এক অদৃশ্য দেওয়াল। ২০২৬ সালের পরবর্তী সময়ে যদি আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে না পারি, তবে আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হবে আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কথা ভাবলে বুকটা কেঁপে ওঠে। ২০৪০ সালের দিকে সমুদ্রের উচ্চতা যখন আরও বাড়বে, তখন আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের সেই ঘরহীন মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কোথায় যাবে? ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ হয়তো আমাদের কাগজে-কলমে স্বপ্ন দেখাচ্ছে, কিন্তু নদী ভাঙনের শিকার হওয়া সেই লোকটির কাছে এই পরিকল্পনা কেবল এক অদ্ভুত বিলাসিতা। আমাদের দুর্নীতি আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যেন এক বিষবৃক্ষ, যা আমাদের উন্নয়নের ফলগুলো সাধারণ মানুষের মুখ পর্যন্ত পৌঁছাতে দিচ্ছে না। তবুও আমরা স্বপ্ন দেখি। আমরা স্বপ্ন দেখি ব্লু-ইকোনমির বিশাল সমুদ্রসীমা জয়ের, আমরা স্বপ্ন দেখি আমাদের ঔষধ শিল্পের বিশ্বজয়ের। ২০২৬ সালে আমরা যখন এলডিসি থেকে বের হবো, তখন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ হবে আমাদের নিজেদের আত্মনির্ভরশীলতা। আমাদের বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে সেই দ্রোহ নিয়ে, যে দ্রোহ নিয়ে আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।
নিচে বাংলাদেশের ২০০০ সাল থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ স্ট্যাটিক্যাল ডাটা টেবিল উপস্থাপন করা হলো, যা আমাদের প্রতিটি প্রাপ্তি ও প্রত্যাশাকে গাণিতিক রূপ দেবে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সম্ভাবনার দীর্ঘমেয়াদী পরিসংখ্যান (২০০০-২০৫০)
|
বছর |
জিডিপি প্রবৃদ্ধি (%) |
মাথাপিছু আয় (USD) |
মুদ্রাস্ফীতি (%) |
স্বাক্ষরতার হার (%) |
দারিদ্র্যের হার (%) |
রপ্তানি আয় (বিলিয়ন USD) |
বৈদেশিক ঋণ (বিলিয়ন USD) |
ইন্টারনেটের ব্যবহার (%) |
গড় আয়ু (বছর) |
|
২০০০ |
৪.৫৩ |
৪১৫ |
৩.৯ |
৪৪.৮ |
৪৮.৯ |
৫.৭ |
১৫.২ |
০.১ |
৬৫.৩ |
|
২০০৫ |
৫.৯৬ |
৫৪৩ |
৭.০ |
৫৩.৫ |
৪০.০ |
৮.৬ |
১৮.৯ |
০.৩ |
৬৬.৭ |
|
২০১০ |
৫.৫৭ |
৭৮১ |
৮.১ |
৫৮.৬ |
৩১.৫ |
১৬.২ |
২২.১ |
৩.৭ |
৬৮.৫ |
|
২০১৫ |
৭.১১ |
১,৪৬৫ |
৬.৪ |
৬৩.৬ |
২৪.৩ |
৩১.২ |
২৩.৯ |
১২.৯ |
৭০.৯ |
|
২০১৮ |
৭.৮৬ |
১,৯৬৪ |
৫.৬ |
৭১.২ |
২১.৮ |
৩৬.৬ |
৩৩.৫ |
৩০.০ |
৭২.৩ |
|
২০২০ |
৩.৪৫ |
২,২৩৩ |
৫.৭ |
৭৪.৭ |
২০.৫ |
৩৩.৭ |
৫১.১ |
৪০.১ |
৭২.৯ |
|
২০২৩ |
৬.০৩ |
২,৭৬৫ |
৯.০ |
৭৬.৮ |
১৮.৭ |
৫৫.৬ |
৯৮.১ |
৫০.৫ |
৭৩.৪ |
|
২০২৫ (প্রাক্কলিত) |
৬.২৫ |
২,৯৭০ |
৯.২ |
৮০.৫ |
১৭.৫ |
৬২.০ |
১০৫.৫ |
৬৫.০ |
৭৪.১ |
|
২০২৬ (উত্তরণ বছর) |
৫.৮০ |
৩,১৫০ |
৮.৫ |
৮২.০ |
১৬.৫ |
৬৫.৫ |
১১২.০ |
৭২.০ |
৭৪.৫ |
|
২০৩০ (লক্ষ্যমাত্রা) |
৭.৫০ |
৪,৫০০ |
৫.০ |
৯০.০ |
১০.০ |
১০০.০ |
১৩০.০ |
৯০.০ |
৭৬.০ |
|
২০৪০ (স্বপ্নকাল) |
৮.৫X |
১২,০০০+ |
৪.০ |
৯৮.০ |
৩.০ |
২৫০.০ |
১৫৫.০ |
৯৯.৯ |
৮০.৫ |
|
২০৫০ (রূপকল্প) |
৯.০০ |
২০,০০০+ |
৩.৫ |
১০০.০ |
<১.০ |
৫০০.০ |
ঋণমুক্ত/স্থিতিশীল |
১০০.০ |
৮৫.০ |
উপরের এই টেবিলের প্রতিটি সংখ্যা যেন একেকটি গল্পের হাহাকার। ২০০০ সালে যে মাথাপিছু আয় ছিল ৪১৫ ডলার, তা ২০৪০ সালে ১২ হাজার ছাড়িয়ে যাবে—এটি শুনতে যতটা রোমাঞ্চকর, ততটাই চ্যালেঞ্জিং। এর মাঝে লুকিয়ে আছে হাজারো শ্রমিকের ঘাম আর কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনি। আমাদের উন্নতির এই রথ যেন কোনোভাবেই থমকে না যায়। দুর্নীতিকে যদি আমরা শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে না পারি, তবে এই ২০,০০০ ডলারের মাথাপিছু আয় হবে কেবল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের বিলাসিতা, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য এক নিছক মরীচিকা।
আমাদের প্রতিরক্ষা বলতে কেবল সীমানা রক্ষা নয়, বরং আমাদের সাইবার স্পেস রক্ষা, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আমাদের মাটির উর্বরতা ধরে রাখা। প্রতিকার হিসেবে আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে এমন জায়গায় নিতে হবে যেখানে অসহায় মানুষটি অর্থের অভাবে হেরে যাবে না। প্রতিরোধ করতে হবে সেই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে যারা আমাদের অগ্রযাত্রাকে বারবার পেছনের দিকে টেনে ধরতে চায়। ২০২৬ সালের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের বুকটা ভরে উঠবে গর্বে, কিন্তু দুচোখে থাকতে হবে অতন্দ্র প্রহরীর সজাগ দৃষ্টি। কারণ পথ যত মসৃণ হয়, গতি তত বাড়ে, আর সেই গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
বাংলাদেশ কেবল একটি ভূখণ্ড নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের স্পন্দন। ২০১৫ সালের সেই স্বপ্নাতুর কিশোর আজ ২০২৫ সালে এক দায়িত্বশীল যুবক, যার কাঁধে ২০৪০ সালের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভার। আমাদের রক্তে মিশে আছে লড়াই করার নেশা। এই নেশাই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের প্রতিটি সাফল্যের পেছনে যেন এক একটি ত্যাগের গল্প থাকে, আর প্রতিটি ঝুঁকির মুখে যেন থাকে হিমালয়ের মতো অটল মনোবল। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যখন তার প্রাপ্য অধিকার ফিরে পাবে, যখন ক্ষুধার জ্বালায় কাউকে ফুটপাতে শুয়ে থাকতে হবে না, তখনই হবে আমাদের প্রকৃত বিজয়।
হে আমার মৃত্তিকার বীর, থমকে যেও না এই ঋণের জাঁতাকলে, ছিঁড়ে ফেলো দুর্নীতির এই অদৃশ্য নাগপাশ; মনে রেখো, আমরা সেই অমর অবিনাশী প্রাণ, যারা ধ্বংসস্তূপ থেকে বারবার ছিনিয়ে আনি ভোরের সূর্য—আমাদের লড়াই আজ নিজের সাথে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের, আমাদের পথচলা অনন্ত নক্ষত্রবীথির পানে!
পরিশেষে বলা যায়, ২০২৬ সালের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো অবকাশ নেই। উন্নতির প্রতিটি সিঁড়িতে যেমন সাফল্যের সুধা আছে, তেমনি আছে পতনের পিচ্ছিল পথ। আমাদের এই পথচলা যেন কেবল সংখ্যাতত্ত্বের বেড়াজালে আটকে না থাকে, বরং প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর এক মহতী যাত্রায় পরিণত হয়। ২০৫০ সালের সেই সোনালী সকালের অপেক্ষায় আজ আমরা যারা ঘাম ঝরাচ্ছি, আমাদের সেই ত্যাগ বৃথা যাবে না। বাংলাদেশ উন্নত হবেই, কারণ এই মাটি জানে কীভাবে প্রতিকূলতাকে জয় করে মহীরুহে পরিণত হতে হয়। প্রতিটি বাধা আমাদের আরও শক্তিশালী করবে, প্রতিটি আঘাত আমাদের করবে আরও ইস্পাতকঠিন। এই আমাদের প্রতিজ্ঞা, এই আমাদের ভবিষ্যৎ।
লেখক: ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।