প্রতিযোগী নয়, সম্ভাবনা: ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজির আলোকযাত্রা
একদিন ভোরে, ফজরের আজানের ধ্বনি আর বাসের হর্ন একসাথে ভেসে এসেছিল পুরান ঢাকার আকাশে। রিকশাচালক তার ক্লান্ত চোখ মুছছিল, ফুটপাথে বসে থাকা এক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা দিনের প্রথম হিসাব কষছিল, আর বহুতল অফিসের কাচের জানালার আড়ালে কেউ একজন ভাবছিল—আজ আবার কীভাবে টিকে থাকা যাবে। সেই ভোরটা আলাদা ছিল না; আলাদা ছিল আমাদের বুকের ভেতরে জমে থাকা অদৃশ্য অস্থিরতা। কারণ আমরা বুঝে গিয়েছিলাম—এই শহর কেবল মানুষে ভরে উঠছে না, ভরে উঠছে প্রশ্নে, দ্বন্দ্বে, আর অমীমাংসিত স্বপ্নে।
হৃদয়ের গভীরে এক তীব্র, অশান্ত ও অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা বহন করে আজ আমরা সময়রেখার এক সংকটপূর্ণ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা কেবল একটি শহরের নয়—গত তেরোটি অস্থির বছরের প্রত্যক্ষ সাক্ষী; এমন এক সময়ের, যখন ঢাকা শহরের কোলাহল কেবল যানজট বা জনঘনত্বেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সেই কোলাহল প্রবেশ করেছে আমাদের অর্থনৈতিক চেতনায়, আমাদের ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে, আমাদের নৈতিক দ্বন্দ্বে। প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধে লাল সিগন্যালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মতোই, আমাদের উদ্যোক্তারা থমকে গেছে—একই বাজারে একই পণ্যের জন্য রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে।এই তেরো বছরে আমরা দেখেছি কীভাবে লাভের হিসাব মানুষের স্বপ্নকে সংকুচিত করেছে, কীভাবে দ্রুত টিকে থাকার তাগিদ দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকে গ্রাস করেছে। ব্যবসা যেন হয়ে উঠেছে এক অন্তহীন যুদ্ধক্ষেত্র—যেখানে জয় মানে অন্যের পরাজয়, আর সাফল্য মানে আরেকটু কম দামে, আরেকটু বেশি চাপ দিয়ে টিকে থাকা। এই বাস্তবতা আমাদের প্রশ্ন করতে বাধ্য করে: আমরা কি কেবল হারানো মুনাফার জন্য লড়াই করতেই জন্মেছি, নাকি এই শহরের কোলাহলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নতুন দিগন্তের ডাক?
এই প্রশ্ন কোনো আবেগী বিলাসিতা নয়; এটি আমাদের সময়ের নৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিবার্যতা। কারণ ইতিহাস বলে, যখন একটি সমাজ একই জলে বারবার রক্ত ঝরায়, তখন মুক্তির পথ আসে নতুন জলরাশি থেকে। আজ সেই উপলব্ধির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে শিখছি—ঢাকার এই অস্থির কোলাহলের ভেতরেই জন্ম নিতে পারে নতুন নীরবতা, নতুন সাহস, এবং নতুন অর্থনৈতিক কল্পনা।এই দীর্ঘ সময়জুড়ে ব্যবসায়িক জগৎ যেন নিজের মধ্যেই ক্রমাগত লড়াই করে চলেছে—একটি আত্মঘাতী প্রতিযোগিতায়, যেখানে প্রতিটি মূল্যছাড়ের পেছনে ঝরে পড়ে আস্থার রক্ত, প্রতিটি বাজার দখলের চেষ্টায় ক্ষয়ে যায় সৃজনশীলতার মেরুদণ্ড।
২০২৫ সালের এই অনিশ্চিত ও উত্তাল বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে যে প্রশ্নটি আমাদের চেতনার গভীরে সবচেয়ে তীব্রভাবে আঘাত হানে, তা হলো—আমরা কি কেবল হারানো মুনাফা পুনরুদ্ধারের জন্যই লড়াই করে যাব, নাকি সাহস করে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পথ বেছে নেব? এই প্রশ্নের উত্তর কোনো সাধারণ ব্যবস্থাপনা কৌশল নয়; এটি এক ধরনের দার্শনিক অবস্থান, এক জাতীয় সাহসিকতার পরীক্ষা। এই সাহসিকতার নামই হলো নীল সাগর অর্থনীতি—একটি চিন্তাধারা, যা আমাদের প্রতিযোগিতার রক্তাক্ত চক্র থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সম্ভাবনার সমুদ্রে যাত্রা করার আহ্বান জানায়।
নীল সাগর অর্থনীতির দর্শন আমাদের শেখায়, জনাকীর্ণ ও রক্তাক্ত জলরাশিতে একই প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে বারবার লড়াই করে শক্তিক্ষয় না করে, বরং সম্পূর্ণ নতুন ও অপ্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন বাজার সৃষ্টি করতে। যেখানে প্রচলিত ব্যবসায়িক বিশ্ব কেবলই দাম কমানো, খরচ ছাঁটাই এবং একই গ্রাহকের মন জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে—সেই পরিসরটি হয়ে ওঠে লাল মহাসাগর: রক্তে রঞ্জিত, ক্লান্তিকর এবং ধ্বংসাত্মক। এখানে প্রতিযোগিতা মানেই ক্ষয়, আর সাফল্য মানেই অন্যের পরাজয়।
কিন্তু এই অবিরাম রক্তক্ষরণের মাঝেই কিছু দূরদর্শী ও স্বপ্নদ্রষ্টা প্রতিষ্ঠান দৃষ্টি ফেরায় দিগন্তের দিকে—যেখানে নীল সাগরের বিস্তৃত, শান্ত ও অনাবিষ্কৃত জলরাশি নীরবে অপেক্ষা করে। এই নীল জলরাশি কোনো অলীক কল্পনা নয়; এটি সেই নতুন বাজারের প্রতীক, যেখানে মূল্য সৃষ্টি হয় নতুনভাবে, চাহিদা জন্ম নেয় উদ্ভাবনের মাধ্যমে, এবং গ্রাহক আর কেবল ক্রেতা থাকে না—সে হয়ে ওঠে সহযাত্রী। এখানে লক্ষ্য প্রতিযোগীদের হারানো নয়, বরং খেলার নিয়মই এমনভাবে পুনর্লিখন করা, যাতে পুরোনো প্রতিযোগিতা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।এই অর্থে, নীল সাগর অর্থনীতি কেবল একটি ব্যবসায়িক কৌশল নয়; এটি এক ধরনের সময়োত্তীর্ণ আহ্বান—যা আমাদের বলে দেয়, টিকে থাকার লড়াই নয়, বরং নতুন পৃথিবী নির্মাণই হতে পারে ভবিষ্যতের একমাত্র টেকসই পথ।
বাংলাদেশ আজ আর কেবল সম্ভাবনার দেশ নয়—এটি ধীরে ধীরে সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক পরিবর্তনশীল রাষ্ট্র। ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যাগত শক্তি, অর্থনৈতিক গতিশীলতা এবং সামাজিক অভিযোজনক্ষমতা—এই চারটি স্তম্ভ একসঙ্গে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদীয়মান অর্থনীতিতে পরিণত করার বাস্তব ভিত্তি তৈরি করেছে।
প্রথমত, জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ (Demographic Dividend) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। দেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ তরুণ, কর্মক্ষম ও প্রযুক্তিতে আগ্রহী। এই তরুণ প্রজন্ম শুধু শ্রমশক্তি নয়, বরং উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা সংস্কৃতি ও ডিজিটাল অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। সঠিক দক্ষতা উন্নয়ন ও শিক্ষায় বিনিয়োগ করা গেলে এই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ভৌগোলিক অবস্থান ও আঞ্চলিক সংযোগ বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশ একটি স্বাভাবিক লজিস্টিক ও বাণিজ্যিক হাবে পরিণত হওয়ার সুযোগ রাখে। সমুদ্রবন্দর, নদীপথ এবং স্থলপথ—এই ত্রিমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আঞ্চলিক বাণিজ্য, ট্রানজিট ও রপ্তানিতে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করছে।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য ও শিল্পায়নের সম্ভাবনা বাংলাদেশের আরেকটি বড় শক্তি। তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফার্মাসিউটিক্যালস, আইসিটি, হালকা প্রকৌশল, চামড়া শিল্প এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে দ্রুত প্রবৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ) ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এই শিল্পায়নকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে।
চতুর্থত, ডিজিটাল রূপান্তর ও উদ্যোক্তা সংস্কৃতি বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং, ফিনটেক, ই-কমার্স ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। “ডিজিটাল বাংলাদেশ” থেকে “স্মার্ট বাংলাদেশ”-এর পথে যাত্রা প্রযুক্তিকে কেবল সুবিধা নয়, বরং ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে।
পঞ্চমত, সামাজিক সহনশীলতা ও অভিযোজন ক্ষমতা বাংলাদেশের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈশ্বিক সংকট কিংবা অর্থনৈতিক ধাক্কা—সবকিছুর মাঝেও বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এই স্থিতিস্থাপকতা (resilience) ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যেও দেশটিকে এগিয়ে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস দেয়।
সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে তার মানুষ, মানসিকতা ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায়। যদি সুশাসন, ন্যায়বিচার, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে রূপ দেওয়া যায়, তবে বাংলাদেশ কেবল উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নয়—একটি নতুন বৈশ্বিক উদাহরণ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
বাংলাদেশের বুকে এই 'নীরব বিদ্রোহের' শক্তি প্রমাণ করেছে আমাদের স্থানীয় কিছু প্রতিষ্ঠান, যারা প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে এবং অর্থনীতির চিত্র পাল্টে দিয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত আমাদের অর্থনীতিতে এই নীতিগুলি এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। এই পরিবর্তনগুলি আমাদের আবেগকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়, কারণ এগুলি কেবল ব্যবসার গল্প নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন পরিবর্তনের গল্প।
- বিকাশ (Bkash) — ব্যাংক ছাড়া ব্যাংকিং: বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল, যা ছিল এক বিশাল, উপেক্ষিত নীল মহাসাগর। বাংলাদেশ ব্যাংক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে যেখানে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের গ্রাহক ছিল মাত্র ৩ কোটির কাছাকাছি, সেখানে ২০২৫ সালে এসে তা ১৮ কোটি অতিক্রম করেছে। এই সংখ্যা প্রমাণ করে, এই উদ্ভাবন কেবল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির এক বিশাল বিপ্লব নয়, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব গতি সঞ্চার করেছে, কিন্তু এর কুফল হিসেবে ফিনটেক প্ল্যাটফর্মে প্রতারণার হার ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ডিএমপি সাইবার ক্রাইম ইউনিট রিপোর্ট করে। অন্যদিকে, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর একটি গবেষণা বলছে, ২০২৪ সালের মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় নারী উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আর্থিক স্বাধীনতার ইতিবাচক ফল।
- পাঠাও (Pathao) — গতির নতুন সংজ্ঞা: ঢাকার ভয়াবহ যানজটে যখন ট্যাক্সি সার্ভিসগুলি হিমশিম খাচ্ছিল, পাঠাও সেই লাল সমুদ্র এড়িয়েছে। তারা স্থানীয় চাহিদা অনুসারে মোটরসাইকেল-ভিত্তিক রাইড-শেয়ারিং সিস্টেম তৈরি করে। ২০১৬ সালে এটির যাত্রা শুরু হওয়ার পর, ২০১৯ সালের মধ্যে এর ব্যবহারকারী ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। **এই উদ্ভাবন প্রমাণ করে, স্থানীয় সমস্যাকে গভীরভাবে বুঝে সমাধান দিলে সেটি দ্রুত মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে, যদিও এর ফলস্বরূপ, সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের অংশগ্রহণ ২০২১-২২ সালে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে বলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন রিপোর্ট করে, যা ব্যবস্থাপনার কুফল। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ৫ লাখ রাইড সম্পন্ন হয় বলে পাঠাওয়ের নিজস্ব ডেটা নির্দেশ করে, যা কর্মসংস্থানের এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে।
- চালডাল (Chaldal) — মুদিখানার কেনাকাটার পুনঃউদ্ভাবন: ঐতিহ্যবাহী মুদিখানার বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকলেও, চালডাল ঢাকা জুড়ে ঘন মাইক্রো-গুদাম তৈরি করে, যা ১-২ ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারি সক্ষম করে। এই কৌশলটি প্রচলিত বাজারের সাথে প্রতিযোগিতা না করে, শহুরে ব্যস্ত জীবনে সময়ের মূল্যকে পুঁজি করেছে, কিন্তু এর কুফল হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন মহল্লার ছোট মুদি দোকানগুলির বিক্রি ১৫ শতাংশ কমেছে বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমিতি রিপোর্ট করে। চালডাল-এর মতো প্ল্যাটফর্মের কারণে ২০২৫ সালের মধ্যে অনলাইন গ্রোসারি মার্কেট শেয়ার ৪ শতাংশে পৌঁছেছে বলে ই-ক্যাব রিপোর্ট নির্দেশ করে, যা দ্রুত প্রবৃদ্ধির ফল।
- ওয়ালটন (Walton) — গণ-বাজার ইলেকট্রনিক্সের বিজয়: বিদেশী ব্র্যান্ডগুলি যখন উচ্চমূল্যের ইলেকট্রনিক্সের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল, তখন ওয়ালটন মধ্যম এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের গ্রাহকদের জন্য মানসম্পন্ন, স্থানীয়ভাবে তৈরি ইলেকট্রনিক্স তৈরি করে একটি নতুন বিভাগ তৈরি করেছে। তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ২০২৫ সালের মধ্যে স্থানীয় বাজারের ৬০ শতাংশেরও বেশি দখল করেছে বলে শিল্প রিপোর্ট নির্দেশ করে, যা দেশের শিল্পায়নে এক নতুন আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় গর্বের সঞ্চার করেছে। অন্যদিকে, এই দ্রুত উৎপাদনের ফলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মান অনুযায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ওয়ালটনের কারখানায় পরিবেশগত ঝুঁকি ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে পরিবেশ সমীক্ষা রিপোর্ট করে, যা কুফল হিসেবে চিহ্নিত।
আজকের এই তীব্র প্রতিযোগিতার সময়ে দাঁড়িয়ে, আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে ২০৪০ সালের নীল সমুদ্রের, যেখানে কেবল সাহসীরাই স্থান পাবে। আমরা যদি এই কৌশল অনুসরণ করি তবে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের জিডিপিতে ডিজিটাল অর্থনীতির অবদান ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে আশা করা হচ্ছে। **এটি অর্জনের জন্য আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে উপেক্ষিত ক্ষেত্রগুলিতে**
অসুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী (স্বাস্থ্য): স্বাস্থ্য খাত বাংলাদেশের নীরব যন্ত্রণার নাম—যেখানে অসংখ্য পরিবার চিকিৎসার ভার বহন করে নিজের কাঁধে। উন্নয়ন অর্থনীতির ভাষায় এটি “financial vulnerability”, আর মানবিক ভাষায় এটি অসহায়তার দীর্ঘশ্বাস। এই প্রেক্ষাপটে কম খরচের, মোবাইলভিত্তিক রোগ নির্ণয় ও দূরবর্তী চিকিৎসা পরামর্শ কেবল একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়; এটি ন্যায়বিচারভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার প্রতিশ্রুতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জনস্বাস্থ্য গবেষকরা দেখিয়েছেন, টেলিমেডিসিন প্রাথমিক সেবার প্রবেশাধিকার বাড়িয়ে স্বাস্থ্য বৈষম্য কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে এই আশার পথে একটি নীরব বাধা আছে—প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্বল ডিজিটাল অবকাঠামো। নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব এখানে দ্বিমুখী: প্রযুক্তি গ্রহণের পাশাপাশি অবকাঠামোগত ন্যায়সংগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা, যাতে প্রযুক্তি সুবিধা নয়, অধিকার হয়ে ওঠে।
টেকসই প্রযুক্তি (পরিবেশ): পরিবেশের প্রশ্নে উন্নয়ন আর প্রকৃতির দ্বন্দ্ব আর গ্রহণযোগ্য নয়। সমকালীন টেকসই উন্নয়ন তত্ত্ব বলছে, ভবিষ্যৎ অর্থনীতি হবে সবুজ—না হলে তা টেকসই হবে না। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিশেষত বিকেন্দ্রীকৃত সৌর শক্তি ও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বাংলাদেশকে একটি নতুন মূল্যসৃষ্টির পথে নিতে পারে। জ্বালানি অর্থনীতিবিদদের মতে, এই রূপান্তর পরিবেশ রক্ষা ও জ্বালানি নিরাপত্তাকে একসূত্রে গাঁথে। তবে প্রযুক্তির প্রতিটি অগ্রগতিরই একটি নৈতিক দায় আছে—ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহারের নীতিগত শূন্যতা ভবিষ্যতের আরেকটি পরিবেশগত সংকট ডেকে আনতে পারে। নীল সাগরের পথে হাঁটতে হলে তাই সবুজ বিবেককে পথনির্দেশক করতে হবে।
দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ (শিক্ষা): শিক্ষা কেবল ডিগ্রির নাম নয়; এটি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়া। মানব পুঁজি তত্ত্বের প্রবক্তারা বহু আগেই দেখিয়েছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রকৃত ইঞ্জিন হলো দক্ষ মানুষ। কিন্তু আমাদের প্রচলিত শিক্ষা কাঠামো এখনও শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী বাস্তবতার সাথে পুরোপুরি সংলাপ গড়ে তুলতে পারেনি। অভিযোজিত অনলাইন শিক্ষণ, আজীবন শেখার সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা উন্নয়ন—এই তিনটি স্তম্ভ ভবিষ্যৎ কর্মবাজারের প্রস্তুতি গড়ে তুলতে পারে। শিক্ষা গবেষণা সতর্ক করে দেয়, ডিজিটাল বিভাজন অবহেলা করলে এই রূপান্তর নতুন বৈষম্যও সৃষ্টি করতে পারে। তাই নীতিগত হস্তক্ষেপের কেন্দ্রে থাকতে হবে সমতা—যাতে গ্রাম ও শহর, সুবিধাভোগী ও বঞ্চিতের মাঝে শেখার দূরত্ব না বাড়ে।
নীল সাগর অর্থনীতি: সাহসের দর্শন: নীল সাগর অর্থনীতি কৌশল নয়, এটি এক ধরনের নৈতিক সাহস—চেনা পথে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে অচেনা জলে পাড়ি জমানোর দৃঢ়তা। কিম ও মউবর্নের ভাষায়, এটি প্রতিযোগিতাকে হারানোর গল্প নয়; বরং প্রতিযোগিতাকেই অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার শিল্প। এই সাহস মানে ঐতিহ্য ভাঙা, নতুন গ্রাহক কল্পনা করা, এবং এমন ধারণায় বিনিয়োগ করা যা শিল্প আগে দেখেনি। আজকের পৃথিবীতে জিততে হলে শুধু দ্রুত দৌড়ালেই হবে না—দৌড়ের ট্র্যাকটিকেই নতুন করে আঁকতে হবে। সমুদ্র বিশাল, সম্ভাবনা বাস্তব, আর নীল জলরাশি—সাহসীদের জন্য—নীরবে অপেক্ষা করছে।
জীবনানন্দ দাশ একবার যেন আমাদেরই উদ্দেশে লিখেছিলেন—
“এই পৃথিবীতে একদিন সব শান্ত হবে—
পাখির নীড়ের মতো, নদীর ঘুমের মতো।”
কিন্তু সেই শান্তি আসে না রক্তক্ষরণের পুনরাবৃত্ত পথ ধরে।তাই আজ প্রশ্নটি অনিবার্য হয়ে ওঠে—ওহে ঘুমন্ত স্বদেশ, আর কতকাল রবে লাল সাগরের রক্তক্ষরণে?যেখানে প্রতিটি বিজয় নতুন ক্ষতের জন্ম দেয়,যেখানে প্রতিযোগিতা মানেই আত্মক্ষয়ের আরেকটি অধ্যায়।ওহে ঘুমন্ত স্বদেশ, আর কতকাল রবে লাল সাগরের রক্তক্ষরণে? সাহসকে সম্বল করে নীল সাগরে পাড়ি দাও, কারণ প্রতিযোগীদের ভিড় ঠেলে নয়, নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেই আসে সত্যিকারের জাতীয় মুক্তি!
লেখক : ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক ও তাকমিলা তাবাসসুম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।