কবে আসবে আমার যাত্রীবাহী বাস?
ঢাকার ব্যস্ততম ভলভার কাছে বাসস্ট্যান্ডে বসে আছেন শান্তি নামের এক তরুণী, যার চোখে ভেসে ওঠে অদৃশ্য এক প্রশ্ন: ‘কবে আসবে আমার যাত্রীবাহী বাস?’ বাতাসে ঝুলছে সূর্যের শেষে সোনালি এক নিঃশব্দ আবেদন, আর হৃদয়ে জাগে এক উত্তপ্ত অস্থিরতা। ২০২২ সালে জাহাঙ্গীর এবং তার কিছু কলিক্স মিলে এক সমীক্ষা চালিয়েছিলেন সেখানে তারা খেয়াল করেন, বাংলাদেশের গণপরিবহনে যাত্রীদের গড় অপেক্ষা সময় ঘণ্টা আঙিনার সমান প্রায় ২.৪ ঘণ্টা। শুধু শারীরিক ক্লান্তি নয়, এ সময়ে বয়ে যায় অজস্র মানসিক টানাপোড়েন, যা জীবনের গতিকে থমকে দেয়।
এখানে জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’ থেকে এমন এক অংশ তুলে ধরা হলো, যেখানে নিঃসঙ্গতা, অতীতচারণা, সুদীর্ঘ অপেক্ষা আর একধরনের নীরব দ্বন্দ্বের সুরহীন সিম্ফনি শোনা যায়:
‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন…..’
বাস না আসা মানে লম্বা অপেক্ষার মধ্য দিয়ে অজ্ঞাত ভবিষ্যতের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন। অভিজ্ঞ যাত্রীদের কথায়, ‘অচেনা অস্থিরতা’ শব্দটি শুধু আবুড়ো নয়, এটি সেই মনস্তাত্ত্বিক ঝলক যা প্রত্যেক সেকেন্ডে অভিপ্রায়হীন হয়ে ওঠে। ২০২২ সালে জেনেরোলজিস্টে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বয়স্কদের অনুবীক্ষণে দেখা গেছে, পরিবহন বিলম্বের ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় আর উদ্বেগের মাত্রা প্রকট হয় যা জাহাঙ্গীর এবং আরো কয়েকজন বিজ্ঞ স্কলারদের গবেষণায় উঠে এসেছে । এই অস্থিরতা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি বিঘ্নিত করে, অফিসকর্মীদের মিটিংয়ে দেরি করে দেয়, গৃহিণীদের বাজার সময়সূচি এলোমেলো করে দেয়—সবখানেই বরাবরের মতোই অদৃশ্য এক প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে।
প্রতিটি অপেক্ষা কেবল সময়ের উৎসর্গ নয়; তা স্থানান্তরিত হয় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায়। ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা আবেগজনিত ব্যাধির ঝুঁকি ৩০% বাড়িয়ে দেয়। ঢাকার রাস্তা-ঘাটে নিয়মিত জ্যামের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন এই ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছেন—নিরাপদ যাপনের অধিকার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা ও সামাজিক সুস্থতা এই বিপজ্জনক ধাঁধার সাথেই জড়িয়ে পড়ে।
ঢাকা শহরের রোজকার গণপরিবহন যাত্রা কষ্টস্তর ও সময়বহুল — একাধিক গবেষণা ও প্রতিবেদনে এটি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। এক বিশ্লেষণে হায়দার ও পাপড়ি উদ্ধৃত হয়েছে যে ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী গড় কমিউটার প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে হারায়, যা বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হিসেবে উল্লেখযোগ্য ( JICA রিপোর্ট)। অন্য রিপোর্টে প্রতিদিন প্রায় ৩.২ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা ডাকা-খাওয়া হচ্ছে শহরের সড়কে—অর্থাৎ ট্রাফিক জ্যাম একক দিনে লক্ষ লাখ কাজের ঘন্টা নষ্ট করছে। অভিজ্ঞ যাত্রীদের দৃষ্টিতে একটি ২০ কিমি বাস ভ্রমণ প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় নেয় (গড় গতি ~৯–১০ কিমি/ঘণ্টা), ফলে সাধারণ শহর-বসতি দৈনিক ভ্রমণে বিশাল সময়লাঘব অনুভব করে।
আরও খারাপ দিকটি হলো ভোগান্তি ও নিরাপত্তার সমস্যা — ঢাকায় বাসগুলো প্রায়ই অতিভরত, ঠাসাঠাসি এবং অনিয়মিত চালক-অবস্থা নিয়ে চলাচল করে, যা আরামহীনতার পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়; গবেষণা ও প্রতিবেদনগুলো এই দুরবস্থা দেখায়।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ তথ্যমতে ২০২৩ পর্যন্ত নিবন্ধিত প্রাইভেট বাসের সংখ্যা বোঝায় যে বৃহৎ অংশই রাস্তায় চলাচল করে এবং বহু বাসে নিরাপত্তা মান—যেমন সিসিটিভি—অপ্রতুল; ২০২৫ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায় মাত্র মর্মে একটি ক্ষুদ্র অংশে সিসিটিভি কার্যকর আছে বলে ধার্য করা হয়েছিল, যা নারী ও শিশুদের ভ্রমণ নিরাপত্তায় উদ্বেগ বাড়ায়।সংক্ষেপে, বছরভিত্তিক আলাদা আলাদা সূত্রে ভিন্ন সংখ্যা থাকলেও যৌথ চিত্র স্পষ্ট: ঢাকার পাবলিক বাসভ্রমণে দৈনিকভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে, যাত্রা বহুলাংশে ঠাসাঠাসি ও অস্থির — ফলে যাত্রীরা শারীরিক-মানসিক ক্লান্তি, নিরাপত্তাহীনতা ও বড় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
যদি পরিবহনের নীরব বিলম্ব অব্যাহত থাকে, তবে অস্থিরতা শুধু ব্যক্তিগত মাত্রাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; তা ছড়িয়ে পড়বে শ্রমশক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সহায়তার প্রতিটি খাতে। ভবিষ্যতে ঝড় ওঠবে ‘আলোচনার অপেক্ষা’ নামে—যেখানে সরকারি নীতি, শহরতলির পরিকল্পনা এবং নাগরিক অধিকার সবই ঠেলাঠেলি করবে এক অচেনা স্থানে। ২০২৩ সালে ট্রান্সপোর্ট ইকোনমিক জার্নালে প্রকাশিত হয় যে, গৃহপরিবারের অর্থনীতিতে বিলম্বিত যাত্রা মানে আত্মবিশ্বাসে ফাটল, আর সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা হারাবে দিক; যা আগামী দশকে জাতীয় জিডিপি’র বেশি ভাগকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে।ছবি ভেসে ওঠে একজন গর্বিত শিক্ষক, যিনি ক্লাসে দেরি করতে করতে বিষয়বস্তুকে সময় মতো পরিবেশন করতে পারেন না; এক বৃদ্ধ মহিলা, যিনি ঔষধ নেওয়ার সময়সূচি মিস করে স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন; আর একজন তরুণ উদ্যোক্তা, যিনি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মিটিংয়ে দেরি করে প্রস্তাব হারান। প্রত্যেক ছবিতেই লুকিয়ে আছে একটি অনস্বীকার্য সত্য—অস্থিরতা ভাঙে মানুষের জীবনের মাধুর্য।
২০০৭ সালে ড. ইউনূসের ‘সোশ্যাল বিজনেস’ ধারণায় আর্থিক নয়, মানবিক মূল্যবোধ প্রথম সারিতে রাখা হয়। গ্রামীণ ফোন প্রজেক্টে নারীদের যাত্রাবাহিতায় নিরাপত্তা ও আস্থা ফিরিয়ে দিয়ে, অনলাইনে রাইড-শেয়ারিং সেবা শুরু করেছিলেন তারা। এই মডেল ঢাকার জন্য মানিয়ে নিলে—কমিউনিটি বাস পরিষেবা, অ্যাপ ভিত্তিক আসন সংরক্ষণ ও জরুরি ডাক সেবা—তবে অস্থিরতা আর ভাবতে বাধ্য হবে না। সামাজিক ব্যবসার এই উদ্ভাবনী সমাধান দেখিয়েছে, যেখানে মানুষের কল্যাণ নীতি আয়ত্তে নেয়, সেখানেই কাঠামোগত বিঘ্ন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ‘অচেনা অস্থিরতা’ শুধুই সময়ের পাইকার নয়; এটি আমাদের মানসিক সুস্থতা, জনশক্তির যোগ্যতা ও জাতীয় অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। তবে ডঃ ইউনূসের মানবিক উদ্যোগ প্রমাণ করে, সঠিক নীতি, প্রযুক্তি ও সহমর্মিতার সমন্বয়ে আমরা এই নীরব যুদ্ধকে পরাজিত করতে পারি।
‘যখন প্রতিটি যাত্রী বুঝবে, তার সময়ের মর্যাদা আমাদের প্রথম শক্তি; তখনই ‘অচেনা অস্থিরতা’র অন্ধকার ভেঙে যাবে।’