সেলফি-সভ্যতা: আয়নায় আটকে পড়া মানুষ
হঠাৎ করেই যেন চির চেনা পৃথিবীটা চোখের সামনে বদলে গেল। সময়ের স্রোতে নতুন নতুন প্রযুক্তি যেমন মানুষের জীবনকে করেছে সহজ ঠিক তেমনি নিঃশব্দে বদলে দিয়েছে মানুষের অনুভূতির প্রকৃতি। আজ আমরা এমন এক সভ্যতার বাসিন্দা, যেখানে বাস্তবতার চেয়ে ‘লোক দেখানো’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া যেন বেঁচে থাকার আর অন্য কোনো উপায় নেই। মানুষের চেহারা বদলে গেছে। কথা-বার্তায় এসেছে পরিবর্তন। চলনে-বলনে-চাহনিতে এসেছে এক দিশেহারা ভাব।
এই সমাজের লোকগুলো এখন জীবনের আনন্দ উপভোগ করে না, বরং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে রেকর্ড করে রাখে। যেখানেই যাই না কেন, হোক সেটা পূজা মন্ডব, বুদ্ধিজীবী কনফারেন্স, সভা-সেমিনার, বই মেলা, আন্ডারগ্রাউন্ড, বাস কিংবা ক্লাস রুম সবজায়গাই শুধু সেলফি, মোবাইল স্ক্রিন, নানা ভঙ্গিতে পোজ আর ছবি তোলার হিড়িক। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম যেন হয়ে উঠেছে এক নতুন ধর্ম, যার দেবতা ফলোয়ার, প্রার্থনা লাইক, আর পূজার মন্ত্র হ্যাশট্যাগ।
একসময় আয়না ছিল আত্মপরিচয়ের প্রতীক। আজ সেটাই হয়ে উঠেছে আত্ম প্রদর্শনের প্রতীক। আজকের এই লেখাটি সেই নতুন সভ্যতার আড়ালে আটকে পড়া মানুষের গল্প, যে সব মানুষেরা নিজের মুখটিকে ভালো করে চেনে, কিন্তু নিজের মনটিকে হারিয়ে ফেলেছে। যারা ভেসে চলে প্রযুক্তির তালে কিন্তু ভুলে যায় আত্মপরিচয়কে।
কোভিডের পরের সমাজ কিছুটা হলেও বদলে গেছে। পরিবর্তন এসেছে আমাদের কাজের ধরনে, অফিস-আদালতের নিয়মে, এমনকি জীবনের ছন্দেও। আগে প্রতিদিনই অফিসে যেতে হতো। সকাল-বিকেল ছুটোছুটি ছিল নিত্যকার ব্যাপার। এখন সেই অভ্যাসে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা বাড়ি থেকে কাজ করার ধারণাটি এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পশ্চিমা বিশ্বে। ফলে প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অন্তত লন্ডনের অনেক বাসিন্দাই এই সুযোগের সুফল পাচ্ছেন। তবু নানা প্রয়োজনেই এখনো রাস্তায় বের হতে হয়। জীবন তো থেমে থাকে না।
আজকাল রাস্তায় বেরুলেই দেখি, মানুষ হেঁটে যাচ্ছে না, মানুষ পোজ দিচ্ছে। কফির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কাপ হাতে ‘মর্নিং ভাইবস’ লিখে খিলখিল করে হাসছে, পাশের লোকটার দিকে না তাকিয়েই। একজন দমফাটা রোদে ঘামছে, তবু বলে উঠছে, ‘এই আলোতে একটা সেলফি না নিলে জীবনটাই বৃথা!’ কেউ আবার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে বসে ঠোঁট বেঁকিয়ে এমনভাবে মুখ বানাচ্ছে, যেন কোন বাসন্তী রাতের চাঁদের আলোও হিংসায় পুড়বে তার ফিল্টারের সামনে। চারপাশে মানুষের কোলাহল, ট্রেনের গর্জন, অথচ সে নির্বিকার, চোখে হালকা ঝিলিক আর হাতে ফোনের পর্দায় নিজের মুখের মায়াবী মহড়া। লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডের দেয়ালের পাশে, যেখানে এক কোণে জবুথবু হয়ে বসে আছে এক বৃদ্ধ, সামনে একটা ছোট্ট বোর্ডে লেখা ‘আমি ক্ষুধার্ত’ সেই মানুষটিও এখন বোঝে, এই বিশাল শহরে যত মুখ, তার চেয়েও বেশি ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল। একটা শহর, যেখানে ক্ষুধার্ত মানুষ নিজের মুখ লুকায়, আর তৃপ্ত মানুষ মুখ দেখায় ফিল্টার লাগিয়ে, সেখানেই সভ্যতার আয়না এখন উল্টো হয়ে গেছে।
এ যেন নতুন এক আজব কলি যুগের সভ্যতার দৃশ্য, যেখানে মানুষ নিজের প্রতিচ্ছবির দাস হয়ে গেছে। রাস্তায়, পার্কে, শপিং মলে, ট্রেনে-বাসে, এমনকি টয়লেটে পর্যন্ত দেখা যায়, একটা মোবাইল, একটা মুখ, আর একগুচ্ছ ইমোশনাল ক্যাপশন। কেউ ভাঙা সম্পর্কের পর পোস্ট দিচ্ছে ‘আবার এক নতুন জীবন শুরু করলাম।’ কেউ বৃষ্টিতে ভিজে লেখে ‘আমার ভাবনাগুলো হারিয়ে গেছে’, আর কেউ কেবল হাসিমুখে লেখে ‘কোন ক্যাপশনের প্রয়োজন নেই’। যেন ক্যাপশন না থাকাটাই এখন ক্যাপশন। মানুষ এখন হেঁটে চলে না, সে চলে রিলের ছন্দে। খাওয়ার আগে কেউ আর প্রার্থনা করে না, বরং প্লেটের সামনে মোবাইল রাখে, আলো ঠিক করে, আর বলে ‘একটা ভিডিও কর’, হ্যাশট্যাগটা হবে ‘দারুনফুড’। একজন কফি খায়, কিন্তু আসলে খাচ্ছে না। সে কফির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছে তার অনলাইন অডিয়েন্সের জন্য।
আমরা এখন এমন এক সময়ের নাগরিক, যেখানে সুখের সংজ্ঞা নির্ভর করছে লাইক আর হার্ট রিঅ্যাকশনের সংখ্যার ওপর। একদিন হয়তো আমাদের বংশধরেরা জিজ্ঞেস করবে ‘তোমরা কীভাবে বাঁচতে?’ আমরা হয়তো বলব, ‘আমরা প্রতিদিন নিজেকে সাজিয়ে তুলতাম, কিন্তু অন্যের চোখে সুন্দর দেখানোর জন্য।’ এই সমাজে এক ধরনের মানুষ আছে যারা প্রতিদিন নিজেদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে, ফিল্টার আর ফলোয়ারের গোলকধাঁধায়। একটু ভালো করে এই সমাজের চকচকে আয়নার ওপারে একটু তাকিয়ে দেখুন, দেখবেন এই সমাজে এখনো কিছু বাস্তব মানুষ নিঃশব্দে নিঃস্ব হয়ে বসে আছে, যারা একদিন সত্যি করে হাসত, কিন্তু আজকাল কেবল ‘সেলফি’-তে হাসে।
জীবনটাই যেন এক অদ্ভুত সিনেমা। পরিচালক কে, তা কেউ জানে না, কিন্তু সবাই অভিনয়ে ব্যস্ত। চোখের পর্দায় দৃশ্য পাল্টায় একের পর এক। কখনো ট্র্যাজেডি, কখনো কমেডি, আর মাঝখানে একটু রোমান্সের ছোঁয়া, যাতে দর্শক ঘুমিয়ে না পড়ে। এই শহরটাও যেন সেই সিনেমার বিশাল সেট। রাস্তায় প্রতিদিনই নতুন দৃশ্যের শুটিং চলে। কেউ ব্যস্ত ট্রাফিকে, কেউ ব্যস্ত ট্র্যাফিক নিয়ে অভিযোগ করতে। কেউ হর্ন বাজায়, কেউ কানে হেডফোন। সবাই যেন নিজের ডায়লগে এত মগ্ন যে অন্যের সংলাপ শুনতে সময়ই নেই। সূর্যও এখন ফিল্টার অন করে ওঠে, চাঁদও বুঝি আজকাল ইনস্টাগ্রামে বল হতে চায়। আর এই নাট্যমঞ্চের এক কোণায় আমার ক্লাসরুম।
দীর্ঘদিনের শিক্ষকতা জীবনে অনেক দৃশ্য দেখেছি, কিন্তু সাম্প্রতিক কালের ক্লাসরুম, এ যেন রিয়েলিটি শোর লাইভ সেট। একসময় ছাত্ররা ক্লাসে নোট নিত, এখন তারা নোট নয়, শটস নেয়। আমি একদিন গম্ভীর মুখে বোঝাচ্ছি, ‘ব্যবসায়িক নৈতিকতার মূল কথা হচ্ছে সততা’। ঠিক তখনই পেছনের বেঞ্চ থেকে ফিসফিসানি। ‘স্যার, একটু হাসুন না, একটা সেলফি দিই! ইনস্টায় দেব, #নৈতিকতার_ভাইবস।’ আমি ভেবেছিলাম হয়তো ভুল শুনেছি। না, ছেলেটা সত্যিই ফোনটা উঁচিয়ে ধরেছে। চোখে আত্মতৃপ্তি, ঠোঁটে আত্মবিশ্বাস, যেন এই মুহূর্তটাই ওর ক্যারিয়ারের ব্রেকথ্রু। আমি রেগে বললাম, ‘ফোনটা নামাও। ক্লাসে মনোযোগ দাও।’ সে এক মুহূর্ত থামল, তারপর আবার সেই চেনা হাসি, যেন আমি-ই রসিকতাটা ধরতে পারিনি। বাকিরা হেসে গড়াগড়ি। কেউ বলে, ‘স্যার, নিচে লিখে দেব, #সততার_লক্ষ্য!’ আরেকজন যোগ করে, ‘স্যার, মুখটা একটু গম্ভীর রাখুন না, তাতে ছবিটা বেশি প্রফেশনাল লাগবে।’ আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাবলাম, এই যে এত হাসি, এত অভিনয়, এত ছবির আয়োজন, তার মধ্যে জ্ঞানের কোন আলো আছে কি? একসময় ছাত্ররা বই খুলে নিজের ভবিষ্যৎ খুঁজত, এখন তারা মোবাইল খুলে নিজের মুখ খোঁজে। ক্লাসের শেষে এসে বলে, ‘স্যার, আজকের ক্লাসটা দারুণ ছিল! আপনি একেবারে অনুপ্রেরণাদায়ী শিক্ষক।’
আমি চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়ি। মনেমনে ভাবি, জ্ঞান যদি এখন ছবিতে বন্দি হয়, তাহলে শেখার গভীরতাও বুঝি ক্যামেরার ফ্রেমেই আটকে গেছে। এই প্রজন্মের আলো এখন স্ক্রিন থেকে আসে, আর ছায়া পড়ে বইয়ের পাতায়। শেষমেশ মনে হয়, এই পৃথিবী আসলে একটা চলমান দৃশ্য। আমরা সবাই তাতে অভিনয় করি, কেউ ক্যামেরার সামনে, কেউ পেছনে। তফাৎ শুধু এই। আগে মানুষ শিক্ষা নিয়ে মানুষ হত, এখন মানুষ কনটেন্ট নিয়ে জনপ্রিয় হয়।
একদিন রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে দেখি, এক স্কুলছাত্রী রাস্তা পার হতে হতে সেলফি তুলছে। তার মুখে খুশির হাসি, পেছনে গাড়ির হর্ন বাজছে বিকটভাবে, আর মুহূর্তের মধ্যে ফটাস। মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ। মেয়েটি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, ‘ওহ মাই গড, আমার ফোন!’ নিজের শরীরটা ঠিক আছে কিনা তা নয়, মোবাইলের জন্য কান্না। আমি তখন ভাবলাম, এই যুগে মানুষ নয়, ফোনই মানুষ। আরেকদিন এক ছাত্রকে দেখি কলেজ ক্যান্টিনে বসে কফি হাতে হা করে হাসছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম, ‘এত খুশি?’ সে বলল, স্যার, হাসিটা নকল। আমি তিন মিনিট ধরে হাসছি, এখন ঠিকমতো আসছে। রিল বানাচ্ছি ‘ক্যাম্পাসে হ্যাপি লাইফ’। আমি চুপ করে রইলাম। যে হাসিটা জীবনের জন্য ছিল, সেটাও এখন কনটেন্টের জন্য। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া বাস স্টেশনের কাছে একদিন দেখি দু’জন তরুণ-তরুণী পরস্পরের সামনে বসে, কিন্তু কথা নয়, দুজনেই ব্যস্ত নিজেদের ফোনে। মেয়েটি বলছে, ‘তুমি তো আমার ইনস্টা স্টোরি লাইক করনি!’ ছেলেটা হাসল, কিন্তু চোখ স্ক্রিনে। ভালোবাসার ভাষা এখন ইমোজি, চোখের ভাষা হারিয়ে গেছে। সেন্ট্রাল লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে এক বৃদ্ধ পায়রা খাওয়াতে খাওয়াতে হঠাৎ পাশে থাকা এক তরুণীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এই মুহূর্তটা ক্যামেরায় না ধরলে, কেমন লাগে?’ মেয়েটি হাসল, বলল, ‘স্যার, ছবি না তুললে তো মুহূর্তটাই হয় না!’ বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, ‘আমাদের সময়ে মুহূর্ত থাকত, ছবিটা না থাকলেও।’
আর একদিন হাইড পার্কে দেখি কয়েকজন দৌড়বিদ একসঙ্গে দৌড় শুরু করেছে, কিন্তু সবাই ঘড়ি বা ফিটনেস ব্যান্ডের দিকে তাকিয়ে। একজন অন্যজনকে বলছে, আজ ইনস্টাতে পোস্ট করব, ‘মর্নিং রান, হেলদি মাইন্ড’। আমি ভাবলাম, সুস্থ দেহের থেকেও এখন বেশি দরকার ‘সুস্থ ফিড’। জীবনের স্বতঃস্ফূর্তটা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন বেঁচে থাকে না—প্রদর্শন করে যে সে বেঁচে আছে।
এই বছরের শুরুর দিকে আমি ও আমার পরিবার গিয়েছিলাম কলকাতায়। আমার ভাগ্নের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। বিয়েবাড়িতে গিয়ে দেখি, বর-কনের পাশে ফটোগ্রাফারের দল নয়, মোবাইল ধারী আত্মীয়ের এক বিরাট সেনাবাহিনী। সবার একটাই লক্ষ্য, কে আগে ‘#PerfectCouple’ লিখে পোস্ট দেবে। কেউ খাবার খায় না, আগে ছবি তোলে। একজন তো পাঁঠার মাংসের সামনে বসে লিখেছে, ‘Feeling blessed’-মাংসের রঙে ফিল্টার, আর আশীর্বাদেও ইমোজি! মনে হলো, এখন আশীর্বাদও ফটো-এডিট করে নিতে হয়। সেই রাতেই দেখি, এক কাকিমা কাঁদছেন, খুশিতে নয়, নেটওয়ার্ক না থাকায়। ‘লাইভে যেতে পারছি না!’ তিনি বলে উঠলেন এমন এক উদ্বেগে, যেন বরপক্ষই পালিয়েছে। বিয়ের গের দিন রাতে ফটোগ্রাফার ড্রোন ক্যামেরা চালাচ্ছে, কিন্তু পিসিমার মাথার সিঁথির ফুল উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। মুহূর্তের সৌন্দর্য, হাসি-ঠাট্টা, সবকিছুই এখন ক্যামেরার ফ্রেমে বাঁধা। বিয়ের কয়েকদিন পর এক বন্ধুর মায়ের অসুখের খবর পাই। তিনি হাসপাতালে কাঁদছেন, তবু মাঝেমাঝে সেলফি তুলে লিখছেন, ‘Stay strong!’ আমি বললাম, ‘তুমি এখন ফোনটা নামাও।’ সে হেসে বলে, ‘না রে, মানুষ যেন জানে আমি কষ্টে আছি। সহানুভূতি পাবে।’ বুঝলাম, সহানুভূতি এখন নতুন মুদ্রা, আর সোশ্যাল মিডিয়া তার ব্যাংক। তারও কিছুদিন পর গ্রামের দিকে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখি, এক কৃষক ধানক্ষেতে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে।
আমি ভেবেছিলাম, হয়তো ভালো লাগার মুহূর্ত ধরে রাখছে। কাছে যেতেই শুনি, ‘এই ছবিটা দিলে সরকার লাইক দেবে, সাহায্য পেতে সুবিধা হবে।’ আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হলো, এই যুগে মানুষ শুধু বাঁচছে না, প্রতিদিন নিজেকে প্রমাণ করছে যে সে ‘দেখাতে’ জানে। জীবনের আনন্দ, দুঃখ, ভালোবাসা, সবই এখন ক্যামেরার জন্য।
আমরা এখন এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে মানুষ মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায়, সব জায়গায় প্রার্থনার চেয়ে বেশি পোজ দেয়। কেউ যদি গাছ লাগায়, সঙ্গে সঙ্গে পোস্ট দেয় ‘পৃথিবীটাকে বাঁচাতে হবে’। কেউ যদি বই পড়ে, সেটা বুকমার্ক নয়, বুকপোস্ট হয়ে যায়। সবকিছু যেন অন্যের চোখে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ। একসময় আত্ম প্রেম মানে ছিল নিজেকে বোঝা, নিজের ভুলগুলো মেনে নেওয়া। এখন আত্ম প্রেম মানে, নিজেকে এমনভাবে সাজানো, যেন অন্যরা অবাক হয়। মানুষ নিজের জন্য নয়, ক্যামেরার জন্য বেঁচে আছে। কেউ সকালে ওঠে না আলোর জন্য, ওঠে সেলফির জন্য-“কি সুন্দর সকাল” লিখবে বলে।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আয়না এখন নিশ্চয়ই ক্লান্ত। প্রতিদিন এত মুখ দেখে, যাদের কোন মুখই আসল নয়। চোখে ক্লান্তি, তবু মুখে হাসি, ভেতরে শূন্যতা, তবু বাইরে ‘#শুধু ইতিবাচক ভাবনা’। একদিন হয়তো ইতিহাসের বইতে লেখা থাকবে, মানুষ সভ্যতা গড়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজ মুখের ছবি তুলতে তুলতে হারিয়ে ফেলেছিল নিজের মুখটাই। তখন কেউ হয়তো খুঁজবে, সেই মানুষগুলো কোথায় গেল? কেউ উত্তর দেবে, তারা এখনো আছে, শুধু আয়নায় আটকে। তবু আমাদের জন্য একটা আশা রইল। যেদিন আমরা আয়নায় নয়, একে অপরের চোখে নিজেদের দেখতে শিখব, সেদিন হয়তো সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে উঠব। আমরা এখন এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে মানুষ মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায়, সব জায়গায় প্রার্থনার চেয়ে বেশি পোজ দেয়।
আমরা এক অদ্ভুত সময়ে বেঁচে আছি, যেখানে মানুষ তার মুখ চেনে, কিন্তু আত্মাকে ভুলে গেছে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ এখন সত্যের আলোকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, আর ফিল্টারের উজ্জ্বলতা ঢাকা দিচ্ছে হৃদয়ের গভীরতাকে। তবু, আশার আলো এখনো নিভে যায়নি। যতদিন মানুষের মধ্যে একফোঁটা সততা, একটুখানি সহানুভূতি, আর সামান্য ‘অদেখা সৌন্দর্য’ খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকবে—ততদিন এই সভ্যতা সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে না। হয়তো একদিন আমরা আবার ফিরে যাব সেই সহজতায়, যেখানে ছবি নয়, মানুষই হবে মুখ্য; যেখানে লাইক নয়, ভালোবাসাই হবে মাপকাঠি। আর সেই দিন, আমরা আবার আয়না নয়—একে অপরের চোখে নিজেদের দেখতে শিখব। তখনই মানুষ সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে উঠবে, ফিল্টারের নয়, বাস্তবের আলোয়।
লেখক- শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিস্ট।
