আমি গর্বিত, আমি সেকুলার নই


বিশ্বায়নের বর্তমান যুগে এসে এই পৃথিবীটাকে কেন জানি বেশ অচেনা বলে মনে হচ্ছে। কেমন যেন উল্টোপাল্টা জায়গা হয়ে গেছে। আর সমাজের কিছু মানুষ, যারা আমাদের চোখের সামনেই ঘুরে বেড়ায় দম্ভ ভরে, তাদের চিন্তা-ভাবনা দেখে মনে হয়, যুক্তি-বুদ্ধি নয়, আজকাল ভুতই যেন মস্তিষ্ক দখল করে বসেছে। কথাগুলো শুনে নিশ্চয়ই আপনাদের বেশ অবাক লাগছে? লাগারই কথা। সত্যি বলতে কি, আজকাল একটা শব্দ শুনলে আমার মাথাটা কেমন যেন বিগড়ে যায়। শব্দটা হলো “সেকুলার”। ইংরেজি শব্দ বলে শুনতে খুব ভালো লাগে, তাই না? বেশ খানদানী-খানদানী ভাব। কানে লাগে আধুনিক, আন্তর্জাতিক, প্রগতিশীল! মানব সমাজের সবচেয়ে বেশী উঁচু স্তরের মন-মানসিকতায় পূর্ণ সুশীল সমাজে অংশ বলে মনে হয়। যেন এই শব্দটা মুখে নিলেই মানুষ হঠাৎ করে অতিরিক্ত সভ্য হয়ে যায়, চিন্তার দরজা খুলে যায় ঠাস করে, মানবতা ঝরে পড়ে তার চোখ থেকে। আপনারা অনেকেই হয়তো দেখছেন যে ইদানীং সমাজের আনাচে–কানাচে, ডানে–বাঁয়ে এক নতুন অভিনব প্রজাতির আত্মপরিচয় জন্ম নিয়েছে, “আমি সেকুলার!” যেন এই শব্দটি উচ্চারণ করলেই এই সব উদ্ভট মানুষগুলি স্বর্গীয় গুণে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। চুলে হাওয়া লাগে, মুখে মৃদু হাসি, কণ্ঠে একরাশ গাম্ভীর্য। বাংলায় গদ গদ হয়ে বলে“আমি ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ।” শুনে মনে হয়, এরা যেন মানবজাতির নবীন বিবর্তিত রূপ। অথচ বাস্তবে তারা কেবল ইতিহাসহীন, মূল্য-বোধহীন ও আত্মপরিচয়হীন এক গোষ্ঠী, যারা নিজের শিকড় কাটাকে প্রগতিশীলতার চূড়ান্ত রূপ মনে করে। কিন্তু আমি বলি, ভাই, আমি গর্বিত যে আমি ‘সেকুলার’ নই। কারণ এই শব্দটা যতটা বাহারি, ভেতরে ততটাই পচনধরা। বরং আমি শুধু একজন মানুষ হিসেবেই থাকতে চাই, যে হবে মানবতায় পূর্ণ, যার কাছে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই হবে পরম শ্রদ্ধেয়, যে বেড়ে উঠবে নিজের সত্যিকারের আত্মপরিচয়ে।
তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় কি জানেন? বিষয়টা হলো, শব্দটার আসল মানে বা উদ্দেশ্যটা আমরা বেশিরভাগই বুঝি না, বরং বুঝতে চাইলেও যেন জাতীয় আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ হয়! আমরা আসলে চিন্তার মানুষ নই, আমরা “হুজুগের দল”। কেউ বাঁশি বাজালেই আনন্দে নাচ শুরু করি, না জেনে যে সুরটা কোন শোকগাথা বাজাচ্ছে। মোদ্দা কথা হলো, সেকুলারিজমের জন্ম ইউরোপের অন্ধকার যুগে, যখন গির্জার প্রভাব চিন্তার শিরায় বিষ ঢালছিল। তখন ভলতেয়ার, জন লক ও রুশোর মতো চিন্তাবিদেরা বলেছিলেন, মানুষকে ঈশ্বরের ভয়ে নয়, যুক্তির আলোয় বাঁচতে হবে। উদ্দেশ্য ছিল মহৎ, কিন্তু ফল হলো এক ধরনের আত্মিক শূন্যতা। ধর্মের শৃঙ্খল ভাঙতে গিয়ে তারা মানবতার মেরুদণ্ডও ভেঙে ফেললো। বিশ্বাসহীন যুক্তিবাদ মানুষকে স্বাধীন করল না। বরং একা করে ফেললো। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ইংরেজ সমাজ সংস্কারক, লেখক ও দার্শনিক জর্জ জেকব হোলিওক, ১৮৫১ সালে। মূলত “religious neutrality” বা ধর্ম থেকে রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবনের বিচ্ছিন্নতার ধারণা বোঝাতে। অর্থাৎ ধর্ম ব্যক্তিগত, রাষ্ট্র নিরপেক্ষ। তবে “secular” শব্দটি এসেছে লাতিন saeculum থেকে, অর্থাৎ “this world” বা “temporal world”। যদিও শব্দটি এর আগেও ব্যবহৃত হতো, “সেকুলারিজম” একটি দার্শনিক ও রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে হোলিওকের হাতেই প্রথম গঠিত হয়।
এরপর এলো ঔপনিবেশিক যুগ। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা “সেকুলার” মুখোশ পরে পুরো পৃথিবী দখলে নামল। ইংরেজরা বলল “আমরা ধর্মের বাইরে, আমরা সভ্য।” অথচ তাদের ধর্মনিরপেক্ষ সভ্যতা ভারত, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে গড়ে উঠল। তৎকালীন সুপ্রিম কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া-র সদস্য লর্ড টমাস বেবিংটন ম্যাকলে ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ভারতীয় শিক্ষা-বিষয়ক প্রস্তাবনা (Minutes on Indian Education) যা তিনি পেশ করেন ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর কাছে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন—“We must create a class of Indians who are Indian in blood and colour, but English in taste and intellect,”—তখন সেই বীজেই সেকুলার শিক্ষার এক দ্বিমুখী বৃক্ষ জন্ম নিল। একদল মানুষ তৈরি হলো, যারা নিজেদের সংস্কৃতিতে লজ্জিত, কিন্তু বিদেশি চিন্তায় মোহিত। ভারতীয় উপমহাদেশে সেকুলারিজম এসে পড়ল রাজনীতির সোনার সিঁড়িতে চড়ে, এক নতুন রাজনীতির পাসওয়ার্ড হয়ে। তখন বলা হলো, “ধর্মের রাজনীতি নয়, আমরা সেকুলার রাষ্ট্র।” স্বাধীনতার পর একদল নেতা ঘোষণা দিলেন, “আমরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই।” কিন্তু বাস্তব হলো একেবারে উল্টো। এই সেকুলার রাজনীতির নামেই সৃষ্টি হলো এমন এক সমাজ, যেখানে নিজের ধর্মে গর্ব করা অপরাধ, অন্যের ধর্মে শ্রদ্ধা দেখানো বাধ্যবাধকতা। কেউ নিজের ঐতিহ্যের কথা বললেই তাকে বলা হয় “ফান্ডামেন্টালিস্ট”; কিন্তু কেউ অন্য ধর্মের প্রশংসা করলে সে হয়ে যায় “উদার, প্রগতিশীল চিন্তক”! যেন নিজের ঘর ভালোবাসা অপরাধ, কিন্তু অন্যের বাড়ির ছাদে গিয়ে দাঁড়ানো মহত্ত্ব। বাস্তবে সেটাই হলো ভোটের রাজনীতি, ধর্মের কারবার। “সেকুলার” নামের তাবিজ পরে তারা একে অপরকে ছুরিকাঘাত করল, সমাজকে ভাগ করল। কেউ হলো সংখ্যাগুরু, কেউ সংখ্যালঘু। একদল বলল, “ধর্ম মানে বিভাজন,” অথচ নির্বাচনের মৌসুমে ধর্মই হয়ে উঠল ভোটের সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র।
ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষায় “সেকুলার” শব্দটি জনপ্রিয় হয় ২০শ শতকের প্রথমভাগে, বিশেষ করে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু ও পরে বি. আর. আম্বেদকর-এর লেখালেখির মাধ্যমে। তবে ভারতের সংবিধানে “সেকুলার” বা ধর্ম-নিরপেক্ষ” শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ হয় ১৯৭৬ সালে, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে, ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে। বাংলা ভাষায় “সেকুলারিজম” শব্দটি সরাসরি ইংরেজি “secularism” থেকে গৃহীত। এর প্রথম বাংলা ব্যবহার দেখা যায় ১৯৪০-এর দশকের শেষ থেকে ১৯৫০-এর দশকে, মূলত রাজনৈতিক ও সাংবাদিক লেখায়। বাংলা ভাষায় প্রথম যারা এই শব্দটি অনুবাদ ও ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন হুমায়ুন আজাদ, আবুল ফজল, অমর্ত্য সেন এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর বক্তৃতায়ও “ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র” ধারণাটি দেখা যায়।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধানেই “ধর্মনিরপেক্ষতা” (সেকুলারিজম) শব্দটি চারটি রাষ্ট্রনীতির একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়, যেখানে ইংরেজি “Secularism”-এর বাংলা রূপ “ধর্মনিরপেক্ষতা” ব্যবহার করা হয়। ব্রিটিশরা ভারতে প্রবেশ করেছিল ব্যবসার নামে, কিন্তু চলে গেল রাজনীতি ও বিভাজনের এক অদ্ভুত খেলা খেলে। তারা খুব দ্রুত বুঝে ফেলেছিল, ভারতবর্ষকে দখলে রাখতে হলে শক্তি নয়, কৌশল দরকার। সেই কৌশল ছিল “Divide and Rule”—অর্থাৎ মানুষকে একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখো, তাহলেই রাজত্ব সহজ। কিন্তু খালি হাতে তো বিভাজন করা যায় না, তার জন্য প্রয়োজন একটা “মার্জিত দর্শন” বা বুদ্ধিবৃত্তিক মুখোশ। সেই মুখোশের নামই ছিল “সেকুলারিজম”। ব্রিটিশরা বলত, “আমরা ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ, আমরা সেকুলার প্রশাসক, আমরা কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করি না।”
কিন্তু বাস্তবে তারা ধর্মকেই ব্যবহার করেছিল শাসনের অস্ত্র হিসেবে। একদিকে তারা হিন্দু আইন সংরক্ষণ করল, অন্যদিকে মুসলমানদের জন্য আলাদা শরিয়াহ আদালত রাখল। এক ধর্মকে অন্য ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিল। ফলাফল, ধর্মের নামে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা, অবিশ্বাস আর শেষমেশ সংঘর্ষ! দেখে মনে হয়, হিন্দি সিরিয়ালের সেই চেনা ভিলেনই যেন পর্দার আড়াল থেকে সুতো টানছে। যার কাজই হলো ঝগড়া বাঁধানো, মন কাদা করা। আর মুখের দিকে তাকালে? আহা! যেন সরলতার প্রতিমূর্তি। দেখে মনে হয়, ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানে না! কিন্তু মুখে যে কথা বেরোয় সেটা তো একেবারে অলকানন্দার জল, মিষ্টি আর পবিত্রতার ছদ্মবেশে বিষ ঢালা বাক্য!
এই ধর্মভিত্তিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা (যেমন—“ইংরেজ-মুসলিম আইন, ইংরেজ-হিন্দু আইন) আসলে ছিল ব্রিটিশ কূটবুদ্ধির এক অদ্ভুত সৃষ্টি। তারা একদিকে বলত, “আমরা ধর্মনিরপেক্ষ,” কিন্তু অন্যদিকে প্রতিটি সম্প্রদায়কে বলত, “তোমার ধর্ম তোমার পরিচয়, আমরা সেটার রক্ষা করছি।” ফলত, মানুষ নিজে মানুষ না থেকে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান এইসব ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। ব্রিটিশরা ভালোভাবেই জানত, যদি ভারতীয় সমাজ একত্র হয়, তবে তাদের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়বে। তাই তারা “সেকুলার নিরপেক্ষতা”-র নামে এক দ্বিমুখী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলল, যেখানে রাষ্ট্রের আইন ধর্ম থেকে আলাদা নয়, বরং প্রতিটি ধর্মের মধ্যে “আইনগত আলাদা পরিচয়” তৈরি করা হলো। তারা বলল, “ধর্ম রাষ্ট্রের বিষয় নয়”। কিন্তু ১৯০৯ সালের ভারত সরকার আইনে যা মর্লে–মিন্টো (জন মর্লে এবং লর্ড মিন্টু) সংস্কার হিসেবে পরিচিত, প্রথমবার ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনী এলাকা চালু করল। এটাই ছিল “Divide and Rule”-এর আসল রাজনৈতিক রূপ। এখানে সেকুলারিজম মানে হলো, রাষ্ট্র নিজের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলল, বলল “ধর্ম তোমার নিজের ব্যাপার,” কিন্তু পিছন থেকে সেই ধর্মকেই ভোট ও ক্ষমতার খেলার উপাদান বানাল। ব্রিটিশরা সেকুলারিজমকে এক ধরনের প্রশাসনিক দর্শন হিসেবে প্রচার করেছিল, কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের নিরপেক্ষ দেখিয়ে শাসন টিকিয়ে রাখা। তারা বলত, “আমরা সবাইকে সমান দেখি,” অথচ সমতার নামে অসমতা স্থায়ী করেছিল। একটা উদাহরণই যথেষ্ট, যখন তারা “হিন্দু কলেজ”(বর্তমানে প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়) খুলল, তখন পাশেই “মোহামেডান কলেজ” বা “ক্যালকাটা মাদ্রাসা” (বর্তমানে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) খুলল। যখন এক সম্প্রদায়ে শিক্ষার জোয়ার এলো, অন্য সম্প্রদায়কে রেখে দিল পিছনে। অর্থাৎ, “সেকুলার নিরপেক্ষতা”-র আড়ালে তারা চালিয়ে গেল নিখুঁত ভারসাম্যহীনতা। আর সেই বিভাজনের চূড়ান্ত ফল আমরা দেখেছি ১৯৪৭ সালে, যখন উপমহাদেশ রক্তে ভেসে গেল। ব্রিটিশরা তখনও বলেছিল—“আমরা কেবলমাত্র সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে শান্তি বজায় রাখছি।” কিন্তু ইতিহাস জানে, সেই “শান্তি” মানে ছিল রাজনীতির সবচেয়ে ধূর্ত নীরবতা।
এমন অনেক সেকুলার রাজনীতিবিদ আছেন, যারা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, “ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করে,” অথচ ভোটের সময় ধর্মকেই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার বানান। যারা বলেন, “আমরা ধর্মের ঊর্ধ্বে,” অথচ গোপনে ধর্মীয় সংগঠনের দানেই তাদের রাজনীতি চলে। এমন এক দ্বিচারী দল তৈরি হয়েছে, যারা মুখে বলে “ধর্মনিরপেক্ষতা,” কিন্তু কাজ করে ধর্ম-নির্ভর। তাদের এই সেকুলারিজম আসলে কূটবুদ্ধির এক অভিনব খেলা। আর এই সেকুলার বুদ্ধিজীবীরা, তাদের কথাই বা কি বলা যায়? তারা বই লেখে, বক্তৃতা দেয়, টেলিভিশনে এসে বলেন, “ধর্ম মানে অন্ধবিশ্বাস।” অথচ যখন কেউ তাদের প্রিয় ধর্মের সমালোচনা করে, তখন তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষেপে যান। এ যেন এমন এক রোগ, যেখানে নিজের ধর্মে লজ্জা, কিন্তু অন্যের ধর্মে মুগ্ধতা! তারা বলে, “সব ধর্ম সমান”, কিন্তু নিজেরটা ছাড়া বাকিগুলোর প্রতি অসম্ভব সহনশীল। এই সেকুলারিজমই সমাজে এনে দিয়েছে এক অদ্ভুত মানসিক বিভাজন। যেখানে বিশ্বাস মানেই পশ্চাদপদতা, আর মূল্যবোধ মানেই সাম্প্রদায়িকতা।
কিন্তু আমরা ভুলে যাই, সমাজ তখনই টিকে থাকে, যখন সেখানে থাকে একটি সাধারণ ন্যায়বিচারব্যবস্থা। যা ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান। ন্যায়বিচার কোনো সেকুলার বা নন–সেকুলার হতে পারে না, সেটা কেবল ন্যায়বিচারই। কিন্তু আজকের তথাকথিত সেকুলার সমাজে ন্যায়বিচারও মতাদর্শে ভাগ হয়ে গেছে। এক দল বলে, “আমরা উদার,” অন্য দল বলে, “আমরা রক্ষণশীল,” আর ন্যায়বিচার দাঁড়িয়ে থাকে আদালতের বারান্দায়। অপেক্ষা করে কে কাকে সমর্থন করবে। নেহরু থেকে শুরু করে বহু “আধুনিক” চিন্তাবিদ পর্যন্ত, তাদের এক বড় অংশ ধর্মকে দেখেছে কুসংস্কার হিসেবে, অথচ পশ্চিমা রাজনৈতিক দর্শনকে প্রায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থের মতো মান্য করেছে। তারা বলেছে, “সব ধর্ম সমান।” শুনতে সুন্দর, কিন্তু বাস্তবে এই দর্শন মানে, “তোমার কোনো ধর্মের প্রয়োজন নেই।” ফলাফল? মানুষ তার আত্মপরিচয় হারাল, তার বিশ্বাসে লজ্জা পেল, নিজের ঐতিহ্যকে অপমান করল।
আজ আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে নিজের ধর্মে বিশ্বাস রাখলে আপনি ‘ফান্ডামেন্টালিস্ট’, কিন্তু অন্যের ধর্মের প্রশংসা করলে আপনি ‘সেকুলার’। যেন নিজের ঘর পরিষ্কার রাখলে আপনি সন্দেহজনক, কিন্তু অন্যের ঘর মোছার সময় আপনি মহাপুরুষ! এই বিপরীতমুখী যুক্তি আসলে আধুনিক উদারতার নয়, এক আত্মপরিচয়–বিভ্রান্ত সমাজের প্রতিচ্ছবি। যারা নিজেদের সেকুলার বলে দাবি করেন, তাদের কাজের মধ্যে এক অদ্ভুত ভণ্ডামি আছে। তারা ধর্মের কথা উঠলেই বলেন, “ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার।” অথচ নিজেদের সুবিধামতো সেই ব্যক্তিগত ব্যাপারেই তারা মন্তব্য করেন, কটাক্ষ করেন, উপহাস করেন। টেলিভিশনে আলোচনা, পত্রিকার কলাম, সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট, সব জায়গায় তাদের একটাই মন্ত্র: “ধর্ম মানেই পিছিয়ে পড়া।” এই সেকুলারিজমের পরিণতি হলো এক অবিশ্বাসের সমাজ, যেখানে মূল্যবোধকে বলা হয় পুরনো, নৈতিকতাকে বলা হয় রক্ষণশীল, আর বিশ্বাসকে বলা হয় পশ্চাদপদতা। তারা মনে করে, ধর্মহীনতা মানেই মানবতা। অথচ ধর্মহীনতা মানেই মানবহীনতা। কারণ যেখানে বিশ্বাসের আলো নিভে যায়, সেখানে করুণার প্রদীপ জ্বলে না। আমাদের দরকার সেকুলারিজম নয়, মানবতাবাদ। মানবতাবাদ মানে, নিজের বিশ্বাসে দৃঢ় থাকা, অন্যের বিশ্বাসে শ্রদ্ধা রাখা। মানবতাবাদ মানে, ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য করা, কিন্তু তা কারও জাত, ধর্ম বা ভাষার ভিত্তিতে নয়। সেকুলারিজম মানুষকে বলে, “সব ধর্ম বাদ দাও”; কিন্তু মানবতাবাদ বলে, “সব ধর্মের মানবিক দিককে বাঁচিয়ে রাখো।” একজন প্রকৃত মানুষ কখনো অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করে না, আবার নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে আপসও করে না। সে জানে, ন্যায়বিচার একটিই, যা ধর্ম, বর্ণ বা মতাদর্শের ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু আজকের সেকুলারিজম সেই একতার ভিত্তিই ভেঙে দিয়েছে।
তাই আমি বলি কি “সেকুলারিজম”-এর মুখোশ খুলে ফেলে আমাদের হওয়া উচিত প্রকৃত মানুষ। আর দর্শন হোক “মানবতাবাদ”। মানবতাবাদ মানে অন্যের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করা, কিন্তু নিজের আদর্শ ত্যাগ না করা। সেকুলারিজম যেখানে সবকিছুকে সমান করতে চায়, মানবতাবাদ সেখানে প্রতিটি বিশ্বাসকে তার নিজস্ব মর্যাদা দেয়। কারণ মানুষ কখনো শূন্যতায় বাস করতে পারে না, তার বিশ্বাসই তাকে মানুষ করে তোলে। আমি গর্বিত যে আমি সেকুলার নই, কারণ আমি জানি ধর্ম মানে বিভাজন নয়, ন্যায় ও মূল্যবোধের শিক্ষা। আমি গর্বিত যে আমি সেকুলার নই, কারণ আমি এখনো বিশ্বাস করি, সমাজের জন্য প্রয়োজন একটিমাত্র ন্যায়বিচার ব্যবস্থা, যা সবার জন্য সমান। আমি গর্বিত যে আমি সেকুলার নই, কারণ আমি জানি, মানুষ তার ধর্ম দিয়ে নয়, তার মানবতা দিয়ে মহৎ। আর সেই মানবতাকে সেকুলারিজমের নামে মুছে ফেলা যায় না। আমি গর্বিত যে আমি এখনো বুঝি, নিজের ধর্মে বিশ্বাস রাখা মানে অন্যের ধর্মকে তুচ্ছ করা নয়।
আজকের তথাকথিত সেকুলাররা ইতিহাস পড়ে না, তারা শুধু স্লোগান মুখস্থ করে। তারা ভাবে, সেকুলার মানেই আধুনিক। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, যখনই কোনো সমাজ তার বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও নৈতিকতার ভিত্তি হারিয়েছে, তখনই তার পতন হয়েছে। রোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিনগুলোতেও একদল মানুষ ছিল যারা বলত, “আমরা দেবতাদের দরকার নেই।” ফল কি হয়েছিল, ইতিহাস জানে। তাই আমি বলি, সেকুলারিজম সমাজের মুক্তি নয়, আত্মবিস্মরণের আরেক নাম। আমি সেকুলার নই, আমি মানুষ। আমি জানি আমার শিকড় কোথায়, আমি জানি আমার বিশ্বাসের শক্তি কতটা, আমি জানি, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা মানেই নিজের আদর্শ ত্যাগ নয়। আমি গর্বিত, কারণ আমি সেকুলার নই। আমি এখনো মানবতায় বিশ্বাস করি। যে সমাজ নিজের ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করতে জানে না, সে কখনো অন্যের প্রতি সহনশীল হতে পারে না। আর যারা নিজেদের পরিচয় হারিয়ে সেকুলার বলে গর্ব করে, তারা এক প্রকার মানসিক দেউলিয়া। তারা জানে না, সভ্যতা ধর্ম থেকে নয়, নৈতিকতা থেকে জন্ম নেয়। কিন্তু নৈতিকতার বীজও ধর্মের মাটিতেই জন্মে। তাই আমি গর্বিত যে আমি সেকুলার নই। আমি গর্বিত যে আমি এখনো মানুষ। যে নিজের বিশ্বাসে দৃঢ়, অন্যের বিশ্বাসে শ্রদ্ধাশীল এবং সর্বোপরি মানবতার প্রতি দায়বদ্ধ। সেকুলারিজম সমাজকে মুক্তি দিতে পারেনি, বরং মুক্তির নামেই তাকে আরও শৃঙ্খলিত করেছে। একদিন এই সেকুলাররা বুঝবে, মানুষকে এক করতে হলে ধর্ম মুছে ফেলা নয়, ধর্মের মধ্যকার মানবতাকে জাগিয়ে তোলা দরকার।
আমরা ভুলে গেছি, মানুষ হওয়াটাই সবচেয়ে বড় অর্জন। সেকুলার বা প্রগ্রেসিভ নামের চকচকে ট্যাগ গায়ে লাগিয়ে কেউ মানুষ হয় না। মানুষ হয় তার আচরণে, সহমর্মিতায়, ন্যায়ের প্রতি আনুগত্যে। আজকাল কেউ নিজের স্বার্থে, কেউ রাজনীতির তাড়নায়, কেউ ক্ষমতার লোভে “সেকুলার” নামের পতাকা ওড়ায়। আর তার নিচে লুকিয়ে রাখে নিজের কুটিল উদ্দেশ্য। তারা বলে, “আমরা প্রগতিশীল,” কিন্তু প্রগতি মানে তাদের কাছে পুরনো বিশ্বাসকে গালাগালি দেওয়া, আর অন্যের বিশ্বাসে তেল দেওয়া। এ এক নতুন যুগের নীতিহীন ব্যবসা। যেখানে আদর্শ বিক্রি হয় নীতির বাজারে, আর ক্রেতারা তালি দেয় নাম শুনেই। মানুষকে এখন শেখাতে হয়, “তুমি সেকুলার হও।” অথচ আসল শিক্ষা হওয়া উচিত, “তুমি মানুষ হও।” ধর্মের পরিচয় নয়, মানবতার চর্চাই সমাজকে রক্ষা করে। আমরা যদি একটু বেশি ন্যায়পরায়ণ হই, একটু বেশি দয়ালু হই, একটু বেশি সত্যবাদী হই, তাহলেই সব ধর্ম, সব সমাজ নিজেরাই শান্ত হবে। কিন্তু তথাকথিত সেকুলাররা চায় মানুষ নিজের মানবতা ভুলে যাক, কেবল মতাদর্শে মগ্ন থাকুক। তারা মানবতার উপরে রাজনীতি বসিয়েছে, আর রাজনীতির নাম দিয়েছে “অগ্রগতি।”
তাই আজ সময় এসেছে মানুষকে চিনে নেওয়ার। যাঁরা প্রতিদিন সেকুলারিজম বা প্রগ্রেসিভিজমের বুলি আওড়ায়, তাঁদের আসল উদ্দেশ্য বোঝা জরুরি। তারা মানবতাকে ঢেকে রেখেছে ফাঁপা তত্ত্বের পর্দায়। সমাজকে বাঁচাতে হলে আমাদের দরকার মানবতাবাদী মানুষ, ন্যায়বোধসম্পন্ন মানুষ, যারা নিজের বিশ্বাসে দৃঢ়, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক। আমি গর্বিত যে আমি সেকুলার নই, কারণ আমি জানি, আমি মানুষ। আমার ধর্ম মানবতা, আমার রাজনীতি ন্যায়, আর আমার প্রগতি সত্য। সেকুলারিজম বা প্রগ্রেসিভিজমের মুখোশের নিচে নয়, মানবতার মুখে হাসি ফোটাতেই আমার গর্ব।