পরিবার হোক মানুষ হওয়ার পাঠশালা


আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আরও বিচ্ছিন্ন, আরও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। একদিকে বৈশ্বিক সংযোগ বেড়েছে, অন্যদিকে হৃদয়ের সংযোগ যেন কমে যাচ্ছে দিন দিন। আমরা অনেকেই বলে থাকি, একটা সময় ছিলো যখন সব কিছুই ছিলো একটু অন্যরকম, আনন্দময়, মানুষের মধ্যে মানবতার ছোঁয়া ছিলো গভীর। আর এখনকার সময় নাকি খুবই খারাপ। সব কিছুই এলো-মেলো, এবড়ো-থেবড়ো, নিরানন্দময়, বিষাদগ্রস্ত। কিন্তু সত্যিই কি সময় খারাপ, না আমরা নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলেছি? পরিবার, সমাজ ও সন্তান গঠনের কথা আমরা যতটা বলি, ততটা কি চিন্তা করি? আমরা যেভাবে অন্যকে বিশেষজ্ঞের মতো শলা-পরামর্শ ও উপদেশ দিই, কখনও কি আয়নায় নিজেকে দেখে ভেবেছি—আমাদের নিজের মধ্যেই কি সেই যোগ্যতা বা প্রজ্ঞা আছে? এই লেখাটির মাধ্যমে আমি আত্ম-সমালোচনার এক অন্তর্মুখী আহ্বান জানাতে চাই। আমরা যারা বয়সে বা অভিজ্ঞতায় কিছুটা অগ্রসর, তাদের প্রতি একটি অনুরোধ, চলুন, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্ববোধকে একটু নতুন করে ভেবে দেখি। এটি কেবল অভিভাবকদের উদ্দেশে করা কোনো একপাক্ষিক সমালোচনা নয়, বরং আমাদের সবার সামনে একটি অন্তরদর্শী আয়না তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস, যেখানে আমরা নিজের চোখে নিজের মুখোমুখি হই। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের আগে নিজেদের মানসিক পরিপক্বতা, নৈতিক বোধ ও আত্মসচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাই এই আলোচনার কেন্দ্রে।
ছোটবেলায় বড়োদের কথা না শুনলেই এই কথাগুলো শুনতাম। আগে নাকি পৃথিবীটা ছিলো অনেক ভালো, মানুষগুলো ছিলো অনেক বেশি ভদ্র, বিনয়ী, আর সহানুভূতিশীল। এখন সময় খারাপ, মানুষ অসভ্য হয়ে গেছে, ছেলে-মেয়েরা কারো কথা শোনে না। আশ্চর্যের বিষয়, এই কথাগুলো আমরা আজ যারা মা-বাবা, তারাও বলছি—যা এক সময় আমাদের বড়োরা আমাদের উদ্দেশ্যে বলতেন। কিন্তু আসলেই কি মানুষ বদলে গেছে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি এসেছে, জীবনধারা বদলেছে, কিন্তু মানুষের স্বভাব ও চরিত্রে সেই পুরনো বৈচিত্র্যটাই রয়ে গেছে। আজও কিছু মানুষ রয়েছে যারা সবসময় অন্যের ভুল খোঁজে, কুৎসা রটায়, সাফল্যে হিংসা করে, নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকে। আজকের দিনে সোশ্যাল মিডিয়ার সহজলভ্যতার কারণে মানুষ নিজের ঢোল পেটাতে আরও বেশি উৎসাহী হয়েছে। আমরা ভাবি, এসব তো শুধু তরুণ প্রজন্মের সমস্যা। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এই প্রবণতা সমাজের সব স্তরেই রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “যে সমাজে শ্রদ্ধা নেই, সে সমাজ কখনো উন্নত হতে পারে না।” আজকের সমাজে সবচেয়ে বড় অভাব বোধহয় এই শ্রদ্ধার। শ্রদ্ধা একে অপরের প্রতি, সন্তানদের প্রতি, এমনকি নিজের প্রতিও।
সম্প্রতি একজন তরুণের সঙ্গে আলাপচারিতায় কিছু অজানা ভাবনার মুখোমুখি হলাম। সে পড়ছে অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স, কিন্তু তার ইতিহাস ও সমাজ-চেতনা আমাকে মুগ্ধ করলো। সে বললো, “ইতিহাস না জানলে মানুষ বোকার মতো সিদ্ধান্ত নেয়। শিক্ষা মানে শুধু ডিগ্রি নয়, প্রেক্ষাপট বোঝা। প্রেক্ষাপট ছাড়া জ্ঞান অসম্পূর্ণ।” আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এমন গভীর উপলব্ধি এই বয়সে সত্যিই বিরল। সে যেভাবে চিন্তা করে, সেটা অনেক বড়দের চিন্তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। অথচ এমন চিন্তাশীল তরুণ খুব বেশি নেই। বেশিরভাগই নম্বর, রেজাল্ট, স্কোর আর ভবিষ্যতের চাকরির চিন্তায় সীমাবদ্ধ। কে দায়ী? আমি বলবো, আমরা, বাবা-মায়েরাই দায়ী। তাদের মধ্যে মানবিক ও মূল্যবোধ-ভিত্তিক শিক্ষা গড়ে তোলার জন্য যে সময় ও আন্তরিকতা প্রয়োজন, তা অনেক সময় বাবা-মায়েরা দিচ্ছেন না।
আজকের বাবা-মায়েদের অনেকেই নিজেদের "সোশ্যাল প্রেজেন্স", অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ায় কেমন দেখাচ্ছে, কে কি বলছে, কে কতটা সাফল্য পেয়েছে, এসব নিয়েই অধিক ব্যস্ত। সন্তানদের সঙ্গে কয়েকটা নির্ভেজাল মুহূর্ত কাটানোর সময় হয় না বললেই চলে। অথচ, একটা শিশুকে প্রকৃত অর্থে সুশিক্ষিত, সদগুণে গঠিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি জীবনে আর কিছুই হতে পারে না। একজন মা নিয়মিত ইনস্টাগ্রামে নিজের ছবি, ট্র্যাভেল ভ্লগ, ফাস্ট ফোর্ড রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ছবি বা নতুন শাড়ির ভিডিও দিচ্ছেন। অথচ, তার ছয় বছরের মেয়েটি স্কুল থেকে ফিরে প্রশ্ন করে, "মা, তুমি আমাকে গল্প বলো না কেন?" সে প্রশ্নের উত্তর হয়ত সাড়া পাওয়া ‘লাইক’-এর চেয়ে মূল্যবান, কিন্তু সেটা কেউ ভাবেন না। অনেক পরিবারে দেখা যায়, সন্তান কিছু করতে পারলে, তাকে নিয়ে বাহবা, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট। আর কিছু না পারলে, "তোমার বন্ধুরা কত্ত ভালো করছে!" এই তুলনা। গসিপ, বাহ্যিক সাফল্যের প্রদর্শনী, এবং অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড় করে দেখানোর এই সংস্কৃতি শিশুদের চোখে জীবনের আসল মানে হয়ে ওঠে। তারা শেখে, ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার চেয়ে ‘দেখাতে পারা’টাই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানদের কাঁধে যদি সবসময় "তুমি সেরা হও", "তোমাকে প্রমাণ করতে হবে"এই চাপ চাপিয়ে দিই, তাহলে তারা কখনো "আমি কে?" এই প্রশ্নটার উত্তর পাবে না। বরং যদি আমরা বলি, "তুমি চেষ্টা করেছ, সেটাই বড়ো কথা। তুমি মানুষ হিসেবে কেমন, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।" তাহলে তারা শুধু সফল নয়, আত্মবিশ্বাসী, আত্মসম্মানবোধে ভরপুর, পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে। আজ দরকার এমন একটা পারিবারিক সংস্কৃতি, যেখানে সন্তানের সাথে বাবা-মায়েরা খোলামেলা ভাবে কথা বলবে, তাকে ভালোবাসবে, সহানুভূতি আর মূল্যবোধ শেখাবে। তবেই সে শুধু ‘বড়ো’ নয়, ‘ভালো’ মানুষ হয়ে উঠবে।
একবার ব্রিটেনের জল হাওয়ায় বেড়ে উঠা এক কিশোর গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে খুব সহজ, কিন্তু অনুরণিত এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল, যা একটু ভালো করে গুছিয়ে লিখলে এমনটি দাড়ায়—"আপনারা বড়োরা সব সময় নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। নিজেদের মধ্যেই কথা বলেন, এমন এক জগতে চলাফেরা করেন যেখানে আমাদের মতো ছেলেমেয়েদের যেন কোনো জায়গা নেই। আপনারা নিজেদের সাফল্যের গল্প বলেন, কিন্তু যখন কাউকে পাশে দাঁড় করানোর সময় আসে, তখন কোথায় হারিয়ে যান? আর এত গসিপ, এত নিজস্ব বলয়—আমাদের সঙ্গে মেলামেশার পথে এত বাধা কেন?" প্রশ্নটা ছিল সরল, স্বচ্ছ, নিঃশব্দ এক তিরের মতো। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। কি বলব তাকে? সত্যি কথা বলতে গেলে, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হলে আমাদেরকে আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। নিজেদের ভেতরের অন্ধকারের দিকে একটু ভালো করে তাকাতে হবে। আর সেই আয়নায় যা দেখা যায়, সেটা অনেক সময়ই স্বস্তি-দায়ক নয়। সেই কিশোরের চোখে ছিল একরাশ কৌতূহল, আর আমার চোখে তখন ধরা পড়ছিল অপরাধ-বোধের ছায়া। আমরা বড়োরা যে কেবল নিজের অর্জন নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকি, প্রতিযোগিতায় জেতার গল্প বলি, আর অন্যের পিছনে গল্প করি, সেটা হয়তো তারা চুপচাপ দেখে, গিলে ফেলে, আর একদিন সেই প্রশ্নের রূপ নেয়। প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে সে আমাদের সামনে যে আয়নাটা ধরে দিয়েছিল, সেখানে আমাদের মুখ স্পষ্ট নয়, তাতে লেগে থাকে সমাজের অভ্যাসে গাঁথা নিষ্ক্রিয়তা, আত্মকেন্দ্রিকতা আর এক ধরনের অস্বীকার। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানে শুধু কথার উত্তর দেওয়া নয়, বরং নিজেদের বিবেকের সামনে দাঁড়িয়ে সাহসিকতার সঙ্গে বলার মতো কিছু খোঁজার চেষ্টা। আর সেই সাহস, দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের অনেকের কাছেই আজ বিলুপ্তপ্রায়।
আসলে সমাজের শিকড় গাঁথা থাকে পরিবারেই। পরিবারই প্রথম পাঠশালা, আর বাবা-মা হন সেই পাঠশালার প্রধান শিক্ষক। যদি তারা সন্তানদের সঙ্গে হৃদয়ের গভীর থেকে কথা না বলেন, জীবনের আসল শিক্ষা—ভালোবাসা, সহানুভূতি, সততা আর মানবিকতা না শেখান, তবে একদিন মানবতা কেবল বইয়ের পাতায় পড়ে থাকা শব্দ হয়ে যাবে, অনুভবের নয়, মুখস্থের বিষয় হয়ে উঠবে। শিশুরা কথা দিয়ে নয়, চোখ দিয়ে শেখে। তাদের সামনে যদি সবসময় দেখা যায় চিন্তায় ক্লান্ত, কথায় গসিপময়, ব্যবহারে অহংকারী আর আত্মপ্রশংসায় ডুবে থাকা বড়োদের, তাহলে তারা কোন পথ বেছে নেবে? তারা কেমন করে বুঝবে নরম হওয়াটাই সাহস, নম্রতাই শক্তি? লালন ফকির তাই নিখুঁতভাবে বলেছিলেন “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, না ভজলে রে থাকবি গুমরে।” এই ‘মানুষ ভজা’ মানে নিজের ভেতরের সত্যকে দেখা, নিজের আত্মাটাকে শ্রদ্ধা করা। যদি সেই আত্মার আলো সন্তানদের চোখে না পৌঁছে, তবে বাহ্যিক সাফল্য যতই থাকুক, জীবনের পূর্ণতা কোথাও হারিয়ে যাবে।
গত বছর ঢাকায় এক সন্ধ্যায় আমি সময় কাটিয়েছিলাম এক প্রিয় বন্ধু, যিনি পেশায় সাংবাদিক, হৃদয়ে সমাজকর্মী, তার বাসায়। চারটি সন্তান তাঁর, ছোটজন এখনো স্কুলের পথে পা রাখেনি। ঘরে ঢুকেই আমি যেন ঢুকে পড়েছিলাম এক আলোকময়, প্রাণবন্ত, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ জগতে। ওদের হাসি, ওদের চোখে ঝলকে ওঠা কৌতূহল, আর কথার ভিতর যে মাধুর্য—তা আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলো, স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। পিতা-মাতা দুজনেই চাকরিজীবী, সময়ের সঙ্গে প্রতিনিয়ত এক অসম লড়াই তাদের। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, ‘পরিবার’ শব্দটি তাঁদের জীবনে কেবল এক সম্পর্কের বন্ধন নয়, বরং এক শক্তিশালী নৈতিক দর্শন, যা ভালোবাসা, সহযোগিতা, এবং মূল্যবোধে গড়ে ওঠা এক আশ্রয়। দরজা খুলে যে আতিথেয়তায় তারা আমাকে গ্রহণ করলো, শিশুগুলোর ব্যবহার, নম্রতা, চোখের ভাষা, মৃদু হাসি আর শব্দ চয়নে ফুটে ওঠা সৌজন্য আমাকে আবেগে অভিভূত করে দিলো। একজন শিশু তার ছোট ছোট হাতে রান্নাঘরে মাকে সাহায্য করছে, কেউ টেবিল সাজাচ্ছে, আর কেউ আমার পাশে এসে অতুলনীয় ভদ্রতায় কথা বলছে, এসব দেখে যেন চোখ ভিজে উঠলো আনন্দ আর বিস্ময়ে। এই ডিজিটাল ব্যস্ততার সময়ে, যখন পরিবারগুলো ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে একে অপর থেকে, তখন এই পরিবারটিকে দেখে মনে হলো, আছে এখনো এমন আলো, এমন শান্তির দ্বীপ, যেখানে ভালোবাসা এখনো নিঃশর্ত, মানবিকতা এখনো বেঁচে আছে নিঃশব্দে। মনে মনে আমি তাদের জন্য হৃদয়ের গভীর থেকে আশীর্বাদ পাঠালাম। ভাবলাম, যদি প্রতিটি ঘর এমন হতো, যদি প্রতিটি শিশু এমন মায়ায় বেড়ে উঠতো, তাহলে সমাজ কতটা সুন্দর, কতটা মানবিক হতে পারতো!
তাই আজ সময় এসেছে আত্মসমালোচনার। আমাদের সন্তানেরা কেমন হচ্ছে সেটা দেখার আগে আমাদের নিজেদের দিকে তাকানো প্রয়োজন। আমরা কি প্রকৃত মানুষ হচ্ছি? আমরা কি আমাদের সন্তানদের সামনে এমন এক আদর্শ তুলে ধরছি, যা দেখে তারা শ্রদ্ধা করতে পারে? পরিবর্তন একদিনে হয় না। কিন্তু প্রতিদিন একটু করে চেষ্টা করলেই, পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের রূপ বদলে যেতে পারে। সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটান, তাদের কথা শুনুন, কেবল নির্দেশ দেবেন না। তাদের সঙ্গে হাঁটুন জীবনের পথে। শেখান নম্রতা মানে দুর্বলতা নয়, বরং প্রকৃত শক্তি। আজকের দুনিয়ায় যতটা প্রয়োজন মেধার, তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন মননের। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেমন হবে, তা নির্ভর করে আমরা কেমন মানুষ হতে পারি তার ওপর। এখনই সময়, আমাদের নিজস্ব আয়নাটা একটু মুছে ঝকঝকে করে তোলার। তারপর সেই আয়নাতেই যেন আমাদের সন্তানরা তাদের ভবিষ্যতের পথ খুঁজে নিতে পারে।
আমাদের সমাজে আজকাল বাবা-মায়েরা নিজেরাই হয়ে উঠছেন খুব বেশি কৃত্রিম। সন্তানের মধ্যে বিনয়, সহানুভূতি, চরিত্র, মূল্যবোধ তৈরি করে তোলার থেকে বেশি তারা ব্যস্ত কাগজে-কলমে প্রমাণযোগ্য সাফল্যের পেছনে। নিজেদের সন্তানকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে, অন্যদের বদনাম করে বা নিজের অর্জন গর্বভরে প্রচার করে তারা অজান্তেই শিশুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, অহংকার আর হীনমন্যতার বীজ বপন করছেন। যদি আমরা সত্যিই চাই আমাদের সন্তানেরা ভালো মানুষ হয়ে উঠুক, তাহলে আমাদের আগে নিজেদের ভাবনা ও অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো, তাদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের দুঃখ-কষ্ট বোঝা, এবং ছোটবেলা থেকেই নম্রতা, সহানুভূতি ও নৈতিকতা শেখানো। এসবের কোনো বিকল্প নেই। শুধু নাম, নম্বর বা চাকরি দিয়ে একজন মানুষ সম্পূর্ণ হয় না। তার ভিতরটা গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের।
সন্তানদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, কারণ তারা আমাদের থেকেই শেখে। আমরা যেমন হবো, তারা তেমনই হয়ে উঠবে। তাই সমাজ বদলাতে হলে, আমাদের বদলাতে হবে আগে। যদি আমরা চাই ভবিষ্যতের আমাদের সমাজ আরও সংহত, আন্তরিক ও মানবিক হোক, তবে আমাদের নিজেদের সন্তানদের মধ্যে সেই বীজ রোপণ করতে হবে আজ থেকেই। আর এই বীজ রোপণের কাজ শুরু হবে বাড়ির ডাইনিং টেবিলে, প্রতিদিনের আন্তরিক কথোপকথনের মাধ্যমে। মানুষ হতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হয়। আর ভালোবাসা শুরু হয় পরিবার থেকেই। এই বাক্যটা যদি আমরা অন্তরে ধারণ করতে পারি, তাহলে বদল আসবেই। বদল আসবে আমাদের চিন্তায়, বদল আসবে আমাদের আচরণে, এবং ধীরে ধীরে বদলে যাবে গোটা সমাজের কাঠামো। একটি সহানুভূতিশীল, সহনশীল ও মানবিক প্রজন্ম গড়ে উঠবে, যারা কেবল নিজের নয়, অপরের দুঃখকষ্টও হৃদয়ে ধারণ করবে। তারা জানবে শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধের অর্থ। আমাদের ছোট ছোট প্রতিদিনের অভ্যাস, কথা, এবং আচরণই তৈরি করে আগামী দিনের নেতৃত্ব। তাই আজই সময়, নিজেকে প্রশ্ন করার—"আমি কি এমন একজন মানুষ, যাকে দেখে আমার সন্তান অনুপ্রাণিত হবে?" যদি উত্তর হয় 'না', তাহলে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে এখনই। নিজেকে গড়ার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ার পথে। কারণ, আমরা যেমন হবো, আগামীকালও তেমনই হবে।"
মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা শুধু স্কুল-কলেজে হয় না, হয় পরিবারে, প্রতিদিনের আচরণে, কথায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে। সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আর কিছুই হতে পারে না। তারা কেমন হবে, তা নির্ভর করে আমরা তাদের সামনে কী দৃষ্টান্ত রাখি তার ওপর। আজ প্রয়োজন এক নতুন অভ্যাস গড়ার, যেখানে বাবা-মা হবেন শুধু অভিভাবক নয়, বন্ধু, শ্রোতা ও দিকনির্দেশক। সন্তানদের শুধু সাফল্যের পথে নয়, মানবিকতার পথেও চালিত করতে হবে। যদি আমরা আজ এই দায়িত্বটি গ্রহণ করি, তাহলে আগামী দিনের সমাজ হবে আরও সহানুভূতিশীল, দায়িত্ববান এবং হৃদয়ের গভীর থেকে আলোকিত এক প্রজন্মের হাতে গড়া। এই লেখাটি যদি একজন বাবা বা মা, শিক্ষক বা অভিভাবকের হৃদয়ে একটু হলেও অনুরণন তোলে, যদি কেউ এক মুহূর্ত থেমে নিজের আয়নায় তাকায়, তাহলেই এর সার্থকতা। মনে রাখুন—বদল শুরু হয় নিজেকে বদলানোর মধ্য দিয়ে। কারণ আমরা যেমন হবো, ভবিষ্যৎ ঠিক তেমনই হবে।
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট