আমরা সবাই রাজা


আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে— নইলে মোদের রাজার সনেমিলব কী স্বত্বে?” বাংলাদেশ জিয়া শিশু একাডেমীর প্রাঙ্গণে প্রায় পাঁচ দশক আগেছোট্ট কণ্ঠে যখন এই গানটি সমবেত সুরে বেজে উঠেছিল, আমার তারুণ্যের প্রাণেযেন এক অদ্ভুত আনন্দের ঝর্ণাধারা বইয়ে দিয়েছিল। ভাতিজি তখন সেখানে গানশিখতে যেত, আর আমি মাঝেমধ্যে তাকে নিয়ে উপস্থিত হতাম। সেই মুহূর্তগুলিরসুর ও স্মৃতি আজও আমার অন্তরে এক অপার্থিব আলো জ্বালিয়ে রাখে। সেইথেকে গানটি বারবার গুনগুন করে গেয়েছি। যেন জীবনের গভীরে নিহিত একঅমলিন বার্তা মনে করিয়ে দিতে: আমরা প্রত্যেকেই রাজা, প্রত্যেকেই সম্ভাবনারঅসীম শক্তির অধিকারী। এই লাইনটা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন প্রায় দেড়শো বছরআগে, তাঁর `সোনার তরী` কাব্যগ্রন্থে। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৮৯৪ সালে। সেইসময় ভারতবর্ষ ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে, চারদিকে রাজনৈতিক দমন, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং সামাজিক অবক্ষয়ের নানা চিহ্ন। সাধারণ মানুষনিজেদের দুর্বল, তুচ্ছ আর পরাধীন মনে করত। রবীন্দ্রনাথ তখন লিখলেন—“আমরা সবাই রাজা, আমাদেরি রাজার রাজত্বে।” তাঁর চোখে মানুষের প্রকৃত শক্তিকেবল বাইরের ক্ষমতায় নয়, আত্মমর্যাদার স্বীকৃতিতে। মানুষ যতই দরিদ্র বাসাধারণ হোক না কেন, তার অন্তরে যে স্বাধীন সত্তা আছে, সেটিই তাকে রাজকীয়মর্যাদা দেয়। এই কবিতা ছিল নিছক অহংকার নয়, বরং মানসিক মুক্তির ঘোষণা।রবীন্দ্রনাথের এই ধারণা মূলত তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসেছে। তিনিবিশ্বাস করতেন, মানুষকে মর্যাদা দিতে হলে তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে হবে।সেই সময়ে কবিতাটি ছিল এক ধরনের মানসিক প্রেরণা। “তুমি তুচ্ছ নও, তুমিনিজের জগতে রাজা।” কিন্তু আজকের সমাজে এসে সেই কবিতার অর্থ যেন একঅদ্ভুত বাঁক নিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় সবাই-ই রাজা। কিন্তু এখানেআত্মমর্যাদা নয়, বরং নিজেকে বড় দেখানোর প্রতিযোগিতা। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নছিল অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতার, আর আজকের বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে বাহ্যিক প্রদর্শনীরওপর।
এখন রাজত্ব চলছে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, এইসব প্ল্যাটফর্মে।তখন মানুষ নিজের ভেতরে রাজা ছিল, এখন মানুষ নিজের প্রোফাইল পিকচারআর ফলোয়ার সংখ্যার রাজা। তখন মর্যাদা মানে ছিল আত্মজ্ঞান, এখন মর্যাদামানে লাইক-শেয়ার কমেন্ট। তখন কবি বলেছিলেন “আমাদেরি রাজার রাজত্বে”, আর এখন শোনা যায়, “আমাদেরি নোটিফিকেশনের রাজত্বে।” এই নতুন রাজত্বেপ্রত্যেকে সবকিছুর বিশেষজ্ঞ। চিকিৎসা থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে বিজ্ঞান।বাস্তবে যে জগতে হাজারো বছরের সাধনা লাগে, সেখানে আজকের ডিজিটালরাজারা ইউটিউবের পাঁচ মিনিটের ভিডিও দেখে হয়ে যান “ডক্টর”, “অ্যনালিস্ট”, বা “বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক।” রবীন্দ্রনাথ যে সময় এই কবিতাটি লিখেছিলেন, তখন তিনি মানুষকে প্রজার আসন থেকে রাজাসনে বসিয়েছিলেন, যা ছিলোএকটা মহৎ মানবতাবাদী আহ্বান। আর আজ আমরা সেই কবিতাকে ব্যঙ্গাত্মকরূপে দেখতে পাচ্ছি। এমন এক ডিজিটাল জগতে, যেখানে সবাই রাজা হতে চায়, কিন্তু রাজত্বটা আসলে নিয়ন্ত্রণ করছে অ্যালগরিদম নামের অদৃশ্য সম্রাট। কিন্তুঠাকুর যদি আজ বেঁচে থাকতেন আর ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ঘুরে দেখতেন, তবে হয়তো চমকে উঠে বলতেন “এ কিসের রাজত্ব গো! এখানে তো রাজার সংখ্যাগুনতে গুনতে হাত ব্যথা হয়ে যাবে, আর প্রজা পাওয়া যাবে না একটিও।”
আজকের রাজত্বে রাজা হওয়ার জন্য রাজমুকুট দরকার নেই, রাজদণ্ড দরকার নেই, শুধু একটা স্মার্ট-ফোন আর ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেই যথেষ্ট। টাইমলাইনেএকটা পোস্ট দিলেন। আপনি রাজা। ইউটিউবে একটা ভিডিও বানালেন, আপনিগুরু। টুইটারে দুই লাইন লিখলেন, আপনি চিন্তাবিদ। ইনস্টাগ্রামে মেকআপ করেবক্রাকারে হাসলেন, আপনি সেলেব্রিটি। এ যেন রাজত্বের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক রূপ—সবাই রাজা, কিন্তু প্রজা নাই। এখানে প্রতিদিন নতুন নতুন রাজাদের জন্ম হয়।সকালে ঘুম থেকে উঠে কেউ লিখলেন “আজ আকাশ মেঘলা, মন খারাপ”। সাথেসাথে লাইক, কমেন্ট, রিঅ্যাকশনের বন্যা। মুহূর্তে তিনি কবি রাজা। দুপুরে অফিসেগিয়ে বিরক্ত হয়ে লিখলেন “দেশটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে” সাথে সাথে বিশ জন সায়দিল। তিনি এখন রাজনৈতিক রাজা। রাতে বিছানায় শুয়ে গুগল থেকে দু’টোওষুধের নাম পড়ে পোস্ট করলেন—“জ্বর হলে এগুলো খেলেই হবে”—সাথে সাথেতিনি চিকিৎসক রাজা। এ যেন কলিযুগে রাজাদের মেলা।
তবে রাজাদের এই মেলায় বিশেষ কিছু বিভাগও আছে। একদল রাজা আছেনযারা ফুডি রাজা। প্রতিদিন কী খেলেন, কোথায় খেলেন, কত টাকার খাওয়াটা ফ্রিপেলেন, কোন রেস্টুরেন্টে আরাম করে বসলেন। সবই ছবিসহ ঘোষণা করেন।তাদের রাজত্বে পেটের খাবারটাই আসল সংবিধান। আরেকদল আছেন ট্রাভেলরাজা। তারা দেশের মধ্যে ঘুরলেও এমন ছবি দেন যেন নেপাল, সুইজারল্যান্ড, হিমালয়ের পাদদেশে, তিব্বতের পাহাড়ের গায়ে কিংবা আর মালদ্বীপ মিলিয়ে একরাজকীয় সফর করেছেন। আরেক দল আছে ফিল্টার রাজা। বাস্তবে হয়তোচেহারায় ক্লান্তি, কিন্তু ছবিতে এমন উজ্জ্বলতা ছড়ান যেন স্বর্গ থেকে আলোনেমেছে। আকাশ থেকে সাদা বলাকারা উড়ে এসে কপোলে চুমু দিয়ে যাচ্ছে।আপনার নিশ্চয়ই আরেক রাজার কথা শুনেন নাই। আমার এক সহকর্মী এইরাজার সংবাদটা দেয়। এদেরকে নাকি `মীম রাজা` বলে। তারা না রাজনীতিবোঝেন, না অর্থনীতি বোঝেন, কিন্তু একটা ছবি আর দুটো ইংরেজি লাইন জুড়েদিয়ে সবার হাসির সিংহাসনে বসে যান। তবে এই সব রাজাদের মধ্যে নাকিসবচেয়ে ভয়ঙ্কর হল কমেন্ট রাজারা। তারা নিজেরা কিছু লেখেন না, কিন্তু সবারপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন এক অদৃশ্য রাজদণ্ড হাতে। কেউ যদি লিখল“আমার মা অসুস্থ”, কমেন্টে হাজির হয়ে যাবে “এই তো আগে বলেছিলাম, দেশনষ্ট হয়ে যাচ্ছে!” কেউ যদি লিখল “আজ খুব খুশি”—কমেন্টে নামবে ধমক, “অন্যরা দুঃখে আছে, আপনি খুশি কিসের?” এরা হলো সেই রাজা যারা আসলেসবার মনের আদালতে বিচারক হয়ে বসে থাকেন।
রাজত্বের আসল মজা দেখা যায় লাইভ ভিডিওতে। আগে মানুষ নাটক দেখতথিয়েটারে, এখন নাটক হয় লাইভে। কেউ ভাত খাচ্ছেন, সেটাও লাইভ। কেউ গানগাইছেন, সেটাও লাইভ। কেউ ঝগড়া করছেন, সেখানেও ভিউয়ার সংখ্যা দেখেইবোঝা যায় তিনি কত বড় রাজা। এই রাজত্বে সবই আছে, শুধু নেই প্রজা। সবাই-ইরাজা, সবাই শাসক, সবাই গুরু। অথচ রাজত্বটা আসলে কাদের হাতে? সত্যিবলতে কী, রাজাদের রাজত্বের সুতোটা ধরা আছে এক অদৃশ্য অ্যালগরিদমসম্রাটের হাতে। ফেসবুকের মাথার ভেতর এক অচেনা প্রোগ্রাম ঠিক করে দেয়। কেরাজা হবে, কে হারিয়ে যাবে।
আজকের এই মহরথিদের রাজত্বের যুগে ডাক্তারদের আর দরকার কী।“হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি” থেকে পাশ করে গেছেন অগণিত মহারাজারা।আপনার জ্বর হয়েছে? সঙ্গে সঙ্গে দশজন রাজা বলবেন। গরম জল খেয়ে নিন।কেউ কেউ আবার বলবেন, লেবুর রস খেলে এক মিনিটে সারবে। আর কেউ যদিসাহস করে বললেন যে ডাক্তারের কাছে যান, তাহলেই শুরু হবে আরেক মহাযুদ্ধ, “ডাক্তাররা সব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির দোসর, টাকা বানানোর ব্যবসা।”এই রাজত্বে আসল ডাক্তার আসলে গুগল সার্চ। একটু কাশি হলেই কেউ বলবে—‘কালোজিরার তেল মাখো, দেখবে সব উধাও।’ আরেকজন ফিসফিস করে দিয়েযাবে মহৌষধের মতো উপদেশ—‘ভাই, রাতে পেঁয়াজ কেটে মোজা পরে শুয়ে পড়ো, সকালে উঠে দেখবে শরীর একেবারে এক্সপ্রেস ট্রেন!’ কোভিডের সময় তো এইস্বঘোষিত ডাক্তারদের কারিশমা সত্যিই দেখার মতো ছিল। বিনা খরচেই এমনঅসংখ্য ‘ডাক্তার’ পাওয়া যাবে, তা কেউ কল্পনাও করেনি।
আরও একদল আছে `ভিডিও-রাজা`, যারা ইউটিউবে দেখা “দশটি অব্যর্থ ঘরোয়াটোটকা” ফরওয়ার্ড করে দিয়ে চিকিৎসকের দায়িত্ব শেষ করে ফেলেন। সবচেয়ে বড়মজাটা হল, যদি কারও মনে হয় সে একটু বেশি বিজ্ঞ, সে বলবে, “এমনকাশি-জ্বরের জন্য ডাক্তার দেখানো আসলে ষড়যন্ত্র। হাসপাতাল তো বানানোইহয়েছে টাকা খাওয়ার জন্য।” কেউ কেউ আবার দুনিয়ার সব রোগের ওষুধ খুঁজেপান হলুদ আর আদার ভেতর। একেবারে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের মতো ঘোষণাকরেন, “এই দুটো খেলেই ক্যান্সার থেকে শুরু করে ব্রহ্মাস্ত্রের আঘাত পর্যন্তসারবে।” এমনকি অপারেশন লাগলেও এসব রাজাদের অদ্ভুত বুদ্ধি। তারা বলবে—“না না, অস্ত্রোপচার করলে শরীর নষ্ট হয়ে যাবে। বরং ভেজা লবণ মেখে রোদেদাঁড়িয়ে থাকো, সব ঠিক হয়ে যাবে।” চোখে সমস্যা হলে চশমা নয়, উপদেশআসবে—“ঘুমানোর আগে দুই ফোঁটা সরষের তেল চোখে দাও।” দাঁতের ব্যথা হলেকেউ বলবে, “রাতারাতি দু’ফোঁটা কেরোসিন মাখো।” এরা বিশ্বাস করে পৃথিবীরসব ওষুধই রান্নাঘরে লুকিয়ে আছে, আর গুগল ডাক্তার হল তাদের রাজকীয়দাওয়াখানা। ফলাফল যা-ই হোক না কেন, তাদের আত্মবিশ্বাসের কাছেহাই-প্রোফাইল সার্জনও হার মানবে। কারণ এই ডিজিটাল রাজত্বে এমবিবিএসডিগ্রির চেয়ে বেশি দামি হল `ফরওয়ার্ড মেসেজ ডিগ্রি`।
এখন রাজনীতির আসরও জমে উঠেছে। আগে যেখানে মিছিলে যেতে হতো, পোস্টার ছাপাতে হতো, এখন শুধু ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলেই আপনি দলীয়নেতা। আর যদি সেই স্ট্যাটাসে একটু ঝাঁঝালো গালি থাকে, তবে তো কথাই নেই।আপনি জাতীয় নেতার কাতারে! এখানে কেউ কারও যুক্তি শোনে না, কিন্তু সবাইচিৎকারে একে অপরকে হারানোর চেষ্টা করে। যেন এক বিশাল ডিজিটাল ময়দান, যেখানে গলা যত ফাটে, ততই আপনি রাজা। আজকের রাজনৈতিক রাজারাএকেকজন এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে পোস্ট দেন যে মনে হয় তারা দেশ রক্ষার চূড়ান্তদায়িত্ব নিয়েছেন। কেউ রাগে কিবোর্ড ভাঙার মতো ভাষায় লিখে ফেলেন, “দেশটারসর্বনাশ হয়ে গেছে”। সাথে সাথে ৩০০ লাইক, ৫০ শেয়ার, আর একশো কমেন্ট।মুহূর্তে তিনি গণআন্দোলনের হিরো। আরেকদল রাজা আছেন লাইভ ভিডিওরাজা। কোনো মিছিল নেই, কোনো মঞ্চ নেই, তবুও তারা কড়া ভ্রূকুটি করেমোবাইল হাতে লাইভে আসেন। “বন্ধুগণ, এই সরকারের কীর্তি আর সহ্য করা যায়না।” পাশে অবশ্য তাদের একমাত্র শ্রোতা হলেন রান্নাঘরে ভাত নামাচ্ছেন এমনবউ বা পাশের ঘরে মোবাইলে গেম খেলছে ছেলেটি। তবুও লাইভ চলতে থাকে, আর শেয়ার বাড়তে থাকলেই তিনি হয়ে যান “জনতার নেতা।” রাজনীতির এইডিজিটাল রাজত্বে আছে “কমেন্ট সেনা। এরা নিজেরা কোনো পোস্ট লেখেন না, কিন্তু ভিন্নমত পেলেই তীব্র আক্রমণ করেন। কেউ যদি বললেন, “দেশে উন্নতিহচ্ছে”, সঙ্গে সঙ্গে কমেন্টে ঝড় শুরু হয়ে যায়। “আপনি কি সরকারের দালাল?” আবার কেউ লিখলেন, “সবই নষ্ট হয়ে গেছে।” সঙ্গে সঙ্গেই আরেক দল ঝাঁপিয়েপড়বে, “দেশ-বিরোধী!” এই কমেন্ট সেনারা দিনরাত লড়াই করে যায়, যেন একঅদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র।
আর আছে হ্যাশট্যাগ রাজারা। এরা একদিনে দশটা হ্যাশট্যাগ চালু করে দেন।#দেশ-বাঁচাও, #সরকার-গড়াও, #জনতার-কণ্ঠ। তাদের বিশ্বাস, এই হ্যাশট্যাগদিয়েই রাতারাতি বদলে যাবে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। সবচেয়ে মজার হলো, এই রাজত্বেআসল রাজনীতি নিয়ে কারও ধৈর্য নেই। কেউ নীতির আলোচনা করে না, শুধুগলার জোর আর কীবোর্ডের গতি দিয়েই নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। ফলেতৈরি হয় এমন এক রাজনৈতিক রাজসভা, যেখানে মুকুট আছে, মন্ত্রীসভা আছে, কিন্তু প্রজাদের স্বার্থ নেই। শুধুই শোরগোল আর শ্লোগানের ঢাকঢোল।
অর্থনীতির রাজত্বেও একই অবস্থা। আন্তর্জাতিক মন্দা, শেয়ার বাজার, মুদ্রাস্ফীতি।সব কিছুর বিশ্লেষণ মিলবে আপনার পাশের ফেসবুক গ্রুপেই। রিকশাচালক থেকেশুরু করে প্রবাসী ছাত্র, সবাই অর্থনীতিবিদ। ইউটিউবের দুই মিনিটের ভিডিওদেখে তারা আই এম এফ-এর রিপোর্ট বাতিল করে দিতে পারে মুহূর্তেই। এখানেঅর্থনীতির সূত্র নয়, “লাইক” আর “শেয়ার”-এর সংখ্যাই আসল তথ্য। কেউলিখলেন, “টাকার দাম কমছে, সবই সরকারের দোষ।” সঙ্গে সঙ্গে শ’খানেকশেয়ার। আরেকজন বললেন, “বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, কারণআন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র”। তারপরেই তিনি হয়ে গেলেন গ্লোবাল ফিনান্স বিশেষজ্ঞ।শেয়ার মার্কেট পড়লেই আরেকদল ঘোষণা করেন, “সব টাকা তুলে সোনায়বিনিয়োগ করুন, না হলে সর্বনাশ।” এরা এমনভাবে কথা বলেন, যেন ওয়ারেনবাফেটও তাদের কাছে শিষ্যত্ব নেবেন। কেউ আবার ডলারের দাম দেখে বলেন, “চলুন সবাই মিলে ক্রিপ্টো কিনি, দেশ বাঁচবে।” অল্পক্ষণের মধ্যেই তার পেজেরফলোয়ার বেড়ে যায় কয়েক হাজার। এ যেন ডিজিটাল ফিনান্সের রাজসভারআসল প্রমাণ।
বুদ্ধিজীবীদের রাজত্বে তো কথাই নেই। প্রত্যেকের কাছেই এমন সব তত্ত্ব আছে যাঅচিরেই বিশ্ব-সভায় পেশ করার মতো। টেবিলে বসে চায়ের কাপ হাতে নেওয়ামানেই তারা তৈরি হয়ে যান সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক হিসেবে। কীভাবে দেশ চলবে, সরকার কেমন হওয়া উচিত, বিশ্ববিদ্যালয় কী পড়ানো উচিত, সব কিছুরই চূড়ান্তসমাধান তারা মুহূর্তে দিয়ে দেন। একজন লিখলেন, “শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়েগেছে”। কমেন্টে আসবে সঙ্গে সঙ্গে একশো সমাধান: কেউ বলবে প্রতিদিন কবিতামুখস্থ করালেই সব বদলাবে, কেউ বলবে ইউটিউব ছাড়া আর কিছু পড়ানোরদরকার নেই। কেউ আবার বলবেন, “আমাদের সময়ে শিক্ষকরা লাঠি নিয়েপড়াতেন, তাই আমরা মানুষ হয়েছিলাম”। এই কথাই হলো শিক্ষানীতির সর্বোচ্চপ্রজ্ঞাপন। রাজনৈতিক সমস্যায় এরা আরও ভয়ঙ্কর। কোনো দাঙ্গা হলে একদলতত্ত্ব দাঁড় করান, “এটা আসলে আন্তর্জাতিক এজেন্ডা।” কেউ বলেন, “এটামিডিয়ার তৈরি নাটক।” আরেকদল বলেন, “এটাই আসলে জনগণের জাগরণ।”প্রত্যেকের বিশ্লেষণ এতটাই গম্ভীর যে মনে হয় জাতিসংঘের পরবর্তী অধিবেশনেইতাদের ডেকে নেওয়া হবে। সবচেয়ে মজার হলো, এই রাজত্বে বাস্তব সমাধান কারওনেই। কিন্তু শব্দ আর যুক্তির ফুলঝুরি ছড়াতে সবাই ওস্তাদ। কেউ লিখলেইশ’খানেক লাইক, দু’শো শেয়ার, তর্কের পাহাড় জমে যায়। এ যেন এক চায়েরদোকানের আড্ডা, যা সোশ্যাল মিডিয়ার রাজসভায় রূপান্তরিত হয়েছে—আরযেখানে প্রত্যেকেই বুদ্ধিজীবী সম্রাট।
কি এক পঙ্গপালের অভূতপূর্ব রাজত্বে বসবাস করছি আমরা। যেখানে রাজাদেরকোনো দায়িত্ব নেই, প্রজাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু শাসনের ঢাক বাজছেসারাক্ষণ। কেউ কারও কথা শোনে না, সবাই শুধু নিজের কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে দিতেব্যস্ত। মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যদি আজ লিখতেন, হয়তো লাইনটা হতো
“আমরা সবাই রাজা, আমাদেরি নিউজ-ফিডের রাজত্বে।
আমরা সবাই মহারথী, আমাদেরি ওয়াই-ফাইয়ের রাজত্বে।
আমরা সবাই সম্রাট, আমাদেরি সেলফির রাজত্বে।”
শেষ পর্যন্ত আসলে কী দাঁড়াল? এই ডিজিটাল রাজত্বে রাজা-রাজাদের ভিড়ে হাসিপাওয়া যায়, রাগও হয়, কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে প্রজাদের হাহাকারটাই বেশিশোনা যায়। একেকজন এতটাই রাজা হয়ে গেছে যে নিজেদের বাইরে অন্য কাউকেজায়গা দেওয়ার জায়গাটুকুই নেই। তবুও স্বীকার করতেই হবে, এই রাজত্ব ভীষণরঙিন, ভীষণ নাটকীয়, আর ভীষণ ব্যঙ্গাত্মক। কারণ শেষ পর্যন্ত আমরা সবাইমিলে রাজা হতে গিয়েই ভুলে যাচ্ছি, রাজত্বটা আসলে আমাদের হাতে নেই, সেটানিয়ন্ত্রণ করছে অ্যালগরিদম নামের এক অদৃশ্য সম্রাট। কিন্তু জীবন কি সত্যিইএই ভুয়া রাজত্বেই আটকে থাকার জন্য? রাজা হওয়ার এই কৃত্রিম খেলা থেকেবেরিয়ে আসা দরকার। আসল রাজত্ব তো অন্য জায়গায়। পাঠ্যবইয়ের পাতায়, চিন্তার গভীরে, পরিবারের আজ এক সহকর্মী গভীর আনন্দে আমাকে দুটি বইহাতে তুলে দেখালেন। চোখে গর্বের আলো, কণ্ঠে আন্তরিকতা। তিনি বললেন—“স্যার, এই দুটি বই-ই এখন পড়ছি। দুটোই আমার কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।অস্তিত্বকে নতুন করে ভাবতে, সমাজের দর্শনকে জানতে, আর নিজের উপলব্ধিকেআরও আলোকিত করতে এগুলো অপরিহার্য। এটাই তো আসল রাজার কাজ—অন্তরে আলো জ্বালানো।” যে রাজত্বে রাজা হবার মানে হচ্ছে নিজেকে গড়ে তোলা, শিখে ওঠা, অন্যকে জায়গা দেওয়া, এবং মানুষ হয়ে ওঠা। আমরা পারি না এইভুয়া ডিজিটাল রাজসভাকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখে মন দিতে পড়াশোনায়, জ্ঞানে, আর প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটাতে? কেননা দিনের শেষে সত্যিকারের রাজত্ব সেইঘরে, যেখানে ভালোবাসা আছে, শিক্ষা আছে, আর আছে মানুষের মতো মানুষহওয়ার সুযোগ।
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট