পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়


ছোটকাল থেকেই কানে বাজছে। কখনো ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের বাঁক, কখনো মুখভরা হাসির চকচকে প্রলেপ, আবার কখনো অক্র-বক্র ভঙ্গির খোঁচা, এই একটাই বাক্য-"পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়।" এ যেন আমাদের লোকজ সংস্কৃতির অনানুষ্ঠানিক মূলমন্ত্র। স্কুলের মাঠ থেকে চায়ের দোকান, অফিসের করিডর থেকে ফেসবুকের কমেন্ট। যেখানে যুক্তি থেমে যায়, সেখানেই এই বাণী বিজয়ী হয়ে ঢুকে পড়ে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রবাদটা শুধু শোনা নয়, আমি নিজেও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করি। যেন কথার তূণে এক বিশেষ তীর, যা ছুঁড়লেই সামনের মানুষ আর কোনো জবাব খুঁজে পায় না। শঙ্কাহীন, দ্বিধাহীন, প্রায় খেলাচ্ছলে। কেউ যদি একটু আলাদা কিছু ভাবে, সেই পাগল। কেউ যদি প্রচলিত নিয়ম মানতে না চায়, সেও পাগল। আর যদি সে ব্যতিক্রমী ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কিছু করে বসে, ওহ, সেটাও নাকি ছাগলের কাজ। আসলে আমরা বোধহয় ভুলে গেছি, ইতিহাসে বড় পরিবর্তন এনেছে তারাই, যাদের প্রথমে বলা হয়েছিল পাগল। তবে হ্যাঁ, তাদের সাফল্যের আগে পর্যন্ত, আমাদের প্রিয় সংস্কৃতিতে "ছাগলে খায়" বলে বিদ্রুপ করারই বিধান আছে। এ যেন এক অদ্ভুত সামাজিক সংবিধান, যেখানে সৃজনশীলতার আগে বিদ্রুপ, আর বিদ্রুপের আগে "পাগল-ছাগল" সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক। তবে আমি ভাবি, যেদিন সমাজের সব পাগল আর ছাগল একসঙ্গে কাজ শুরু করবে, সেদিন হয়তো ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লেখা হবে। আর আমরা তখন দাঁড়িয়ে বলব, "আরে, আমরা তো জানতামই, ওরা গরুর মতো শান্ত!"
গ্রামে যখন ছিলাম তখন এই প্রবাদটি ছিল স্কুলে যাওয়ার পথে পুকুর পাড়ে গড়ে উঠা গ্রামের চায়ের দোকানে হাসির ঝাঁপি। কেউ একটু অদ্ভুত আচরণ করলেই কেউ এক গাল হেসে বলে উঠত, “পাগলে কিনা বলে!” চারপাশে তখন টুকটুকে কৌতুক,হাতে ধরে রাখা চায়ের কাপ চায়ের প্লেটে ঠুক ঠুক করে নেচে উঠতো। আর ছাগল চুপচাপ গম চিবিয়ে ভাবত, ‘মানুষের রসিকতার কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে, এমন দুর্ভাগ্য কে চায়?’ আজ সেই কথাটি আর কেবল প্রবাদ নয়, হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবন্ত সমাজ-দর্পণ। মানুষ তার প্রতিদিনের ভার্চুয়াল জীবন দেখে নিজের অজান্তেই কুঁকড়ে যায়—‘এ তো আমারই মুখ।’ আজকাল কেউ হঠাৎ কুমিরের মতো হাঁ করে কথা বললেই ভাইরাল। কেউ রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে গান গাইছে, শ্রুতি ঠিক আছে কি নেই, তাতে কারও মাথাব্যথা নেই—তার ইনস্টাগ্রামে একদিনেই লাখ লাখ ফলোয়ার। আরেক জন ঘুম থেকে উঠে, চোখে এখনো ঘুমের কচি নীল আলো, মুখ ধোয়া শেষ করে বলে, “সুপ্রভাত বন্ধুরা!” আর আমরা হা করে তা দেখে ভাবছি, “আহা, কী সুন্দর ঘুমিয়েছে!” যেন ঘুমের চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক পেয়েছে। তারপর আসে খাবার সেনাবাহিনী। বিশাল গামলায় নানা পদের খাবার নিয়ে দু’হাতে গপাগপ খাওয়া, মুখ থেকে ছিটকে পড়ছে ভাত, ঝোল, কাবাব, গায়ে, চুলে, মেঝেতে, সবখানেই ছড়িয়ে পড়ছে খাদ্যের বর্ষা। আমরা তা দেখে উল্লাসে লাইক দিচ্ছি, কমেন্টে লিখছি না বাক্যে। দেখতে দেখতে মিলিয়ন ভিউ। এদিকে, যে ছেলে সারাদিন নিজের ঘরে বসে বই পড়ে, কিংবা কোনো মেয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করে নতুন কিছু বানাচ্ছে, তাদের নিয়ে কোনো মাতামাতি নেই। কারণ ভাইরাল হওয়ার যোগ্যতা নেই। তারা তো পাগল বা ছাগলও নয়—তারা কেবল সাধারণ মানুষ। তাই মনে হয়, পাগল আর ছাগল—এই দুই জাতের শাসনেই চলছে পৃথিবী। পাগলরা তৈরি করছে অদ্ভুত কনটেন্ট, আর ছাগলরা হা করে তা খাচ্ছে, স্ক্রল, লাইক, শেয়ারের মশলা দিয়ে। আর আমরা? আমরা গর্বের সঙ্গে প্রবাদ আওড়াচ্ছি, "পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়।" শুধু একটু যোগ করা দরকার, "আর বাকি সবাই দাঁড়িয়ে তালি দেয়।"
এই যে সবকিছু দেখার আর জানানোর মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কারের এই আগুনে, আমাদের স্বাভাবিকতা এমনভাবে পুড়ে যাচ্ছে, যা দেখে এক সময়ের সত্যিকারের পাগলেরাও হয়তো বলে উঠবে এক সময়, “আরে ভাই, আমাদের নামে এই অপমান কেন!” যে পাগল এককালে গ্রীষ্মের দুপুরে শীতের চাদর জড়িয়ে হাঁটত, আজ সেই চাদর বিছিয়ে লাইভে আসে, আর বলে, “এই যে বন্ধুরা, আজকের মোটিভেশনাল কথা: নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, হোক সেটা গরমে চাদর জড়ানোই হোক না কেন।” আর আমরা সে কথায় উদ্বেলিত হয়ে বলি, “সত্যিই! পাগলের মাঝেই তো সত্য লুকিয়ে থাকে!”আসলে আজকালকার পাগলদের আর কোনও মানসিক হাসপাতাল দরকার পড়ে না। এদের হাসপাতাল এখন স্মার্টফোন, বিছানায় শুয়ে ফেসবুক, হাঁটতে হাঁটতে ইউটিউব, আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে টিকটক। সত্যিকারের পাগলরা যেখানে বিভ্রান্তিতে ভুগে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, সেখানে আধুনিক পাগলরা নিজেকে খুঁজতে খুঁজতেই হারিয়ে যায় অন্য কারও মতামতে, অন্যের জীবনে, অন্যের ফিল্টারে। আগে মানুষ পাগল হয়ে পাহাড়ে গিয়ে বসত, চিন্তা করত জীবন ও মৃত্যুর রহস্য নিয়ে। আর এখন? কেউ যদি সকাল আটটায় ফেসবুকে সক্রিয় না থাকে, তাহলে বন্ধুরা চিন্তায় পড়ে যায়, “ও কি সুস্থ আছে?” কেমন যেন এক উল্টো দুনিয়া। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এই পাগলামির রুচি নিয়েও আজ প্রশ্ন ওঠে। আগে পাগলের বোকামি ছিল নিরীহ, আজকের পাগলরা রুচির দেউলিয়াতেও বিশ্ব রেকর্ড গড়তে চায়। একজন টিকটক ভিডিওতে হঠাৎ বলে বসলো, “মানুষ যদি মাছ হতো, তবে প্রেম অনেক সহজ হতো।” এই কথা শুনে চারদিক থেকে বাহবা“কী গভীর দর্শন!” কেউ বোঝার চেষ্টা করল না, মানুষ মাছ হলে তো প্রেমের আগে অক্সিজেন দরকার হতো। সবচেয়ে বিপজ্জনক হল এই হীনমন্যতার পাগলামি। মানুষ এখন নিজের সংস্কৃতি, নিজের ভাষা, এমনকি নিজের নাম নিয়েও লজ্জিত। সাবিনা আজ হয়ে গেছে “স্যাবি”, আর মতি ভাই হয়ে গেছে “ম্যাথিউ”। ড্যান্ডি, ড্যান্ডি করতে করতে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে বন্ধুর আসল নাম দিব্যেন্দু সেটা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছি। একদিন তো সত্যি আকাশ থেকে পড়া ঘটনা। ইংরেজ ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে গর্বভরে নিজের নাম বলছে, “হাগু”! ভেবে দেখুন, হরপ্রসাদ গাঙ্গুলি বললে ওই সাহেব হয়তো নাকে রুমাল দিয়ে পালাবে, তাই আগে থেকেই নিরাপদে নিজেকে “হাগু” বলে পরিচয় দিচ্ছে। নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে যখন মানুষ অন্যের জীবনে নিজেকে ফিট করাতে চায়, তখনই পাগলামির উচ্চতম স্তর ছোঁয়া যায়।
বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কি একবার লিখেছিলেন-“আমরা সবাই পাগল, কেউ একটু বেশি, কেউ একটু কম”। যদিও এই কথাটি হালকা রসিকতার মতো শোনায়, এর পেছনে ছিল এক গভীর দার্শনিক উপলব্ধি, যা তিনি বিশেষভাবে তুলে ধরেছিলেন তাঁর উপন্যাস "দা ইডিয়ট-এ" (১৮৬৯)। দস্তয়েভস্কির চোখে পাগলামি মানে ছিল না কেবল মানসিক ভারসাম্যহীনতা; বরং তা ছিল সমাজের চাপ, দ্বন্দ্ব, এবং অস্তিত্বের সংকটে মানুষের ভেতরে জমে থাকা কুয়াশার প্রকাশ। "দা ইডিয়ট"-এর মূল চরিত্র প্রিন্স মিশকিন, যিনি ছিলেন অতিমাত্রায় নিষ্পাপ ও সংবেদনশীল, তাঁকে সমাজ ‘ইডিয়ট’ বললেও, পাঠক বুঝতে পারে, আসলে তিনিই সবচেয়ে মানবিক ও যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষ। অন্যদিকে সমাজের তথাকথিত "স্বাভাবিক" মানুষগুলোর আচরণই বারবার প্রমাণ করে, যে তারা নিজস্ব ভণ্ডামি, লোভ, হিংসা ও ষড়যন্ত্রে এতটাই নিমজ্জিত যে স্বাভাবিকতার ছদ্মবেশে তাঁরা আসলেই এক ধরনের পাগলামির মধ্যে বাস করছেন। এই কথাটি আজকের দিনে এসে যেন এক ভয়াবহ সত্যে রূপ নিয়েছে। একসময় মানুষ বই পড়ত, চিন্তা করত, তর্ক করত যুক্তি দিয়ে, এবং মত বিনিময় করত বিনয়ের সঙ্গে। ভিন্নমত মানেই ছিল চিন্তার বৈচিত্র্য, তা ছিল সম্মানের বিষয়। এখন মানুষ যা দেখছে, তা-ই বিশ্বাস করছে, যা শুনছে, তা-ই শেয়ার করছে, যা জানে না, তাতেই মত দিচ্ছে। চিন্তার জায়গাটা এখন পরিণত হয়েছে প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্র। যেকোনো পোস্টে, যেকোনো মতামতে সঙ্গে সঙ্গে চটজলদি প্রতিক্রিয়া জানাতে না পারলে যেন আমরা সমাজ থেকে ছিটকে পড়ি। আর এই প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ভাবনার অনুপস্থিতি আমাদের ধীরে ধীরে টেনে নিচ্ছে এক ‘সুশীল পাগলামি’র দিকে, যেখানে আমরা প্রযুক্তির দাস, মতের ভিখারি, এবং স্বতন্ত্রতার শত্রু হয়ে উঠছি। চিন্তার এই সংকোচন, যুক্তির এই নির্বাসন, আর আত্মবিশ্লেষণের এই অনীহা আমাদের একটি ঘোরলাগা বাস্তবতায় ঠেলে দিয়েছে, যেখানে সুস্থতা আর পাগলামির সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কে পাগল, কে বুদ্ধিমান, তা এখন নির্ধারিত হচ্ছে কে কতটা ভাইরাল, কতজন তাকে ‘ফলো’ করছে, অথবা সে কতটা ‘স্মার্টলি’ মতামত দিতে পারে। দস্তয়েভস্কির কথাটি তাই আজ শুধু সাহিত্যিক নয়, বরং সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার এক প্রজ্ঞাময় ব্যাখ্যা।
আমার এক অধ্যাপক সহকর্মীর ভাষাতেও এই যুগের এক নিঃশব্দ হতাশা ধরা পড়েছিল। শিক্ষকতার জীবনে আমি খুব কম মানুষকেই দেখেছি, যিনি এতো বই পড়তে ভালোবাসেন, এত গভীরভাবে ছাত্রদের নিয়ে ভাবেন। দর্শন, ইতিহাস—এই দুই শাখা তার জীবনের প্রতিদিনের চিন্তাভাবনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু একদিন তার মুখে শুনলাম, তার এই পড়াশোনার অভ্যাস, জ্ঞান নিয়ে মগ্ন থাকার স্বভাবকে তার নিজের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অনেকেই “পাগলামী” বলে ঠাট্টা করে। যেন বই পড়া এখন এক ধরনের অদ্ভুত রোগ, আর জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা একটি সামাজিক বিপথগামিতা। আমি ভাবি, সমাজে যদি তার মতো শিক্ষক আরও কিছু থাকত, যারা ছাত্রদের মাথায় কেবল তথ্য নয়, চিন্তা জাগিয়ে তুলতে পারে, তাহলে এই সমাজে এতো কুলাঙ্গার, ছলনাময়, ভণ্ড গুরুর অভ্যুত্থান ঘটত না। বরং আমরা হয়তো এমন এক প্রজন্ম পেতাম, যারা কেবল পরীক্ষা নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশ্ন করতে শিখত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজকের পৃথিবীতে জ্ঞানীকে পাগল বলা সহজ, আর মূর্খকে গুরু বানানো আরও সহজ।
তবে এটা ঠিক যে আমরা সবাই পাগল। কেউ সমাজের নিয়ম ভেঙে পাগল, কেউ আবার সেই নিয়ম মানতে গিয়েই পাগল। কেউ নিজের প্রশ্ন নিয়ে একাকী পথ খুঁজে ফেরে, কেউ আবার অন্যের মতামতের পিছনে দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত। কিন্তু পাগলামি, সেই সূক্ষ্ম অথচ গভীর মানসিক অবস্থান, আজকের সমাজে এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, মানুষ আর বোঝে না সে আদৌ চিন্তা করছে, না শুধু প্রতিধ্বনি করছে অন্যের চিৎকার। আর সেই কারণেই দস্তয়েভস্কির এই কথাটি, শত বছর আগের হলেও, আজকের ‘ডিজিটাল যুগের আয়নায়’ ফিরে তাকিয়ে যেন বলে ওঠে, "তোমরা আসলেই পাগল, এবং এখন পাগলামিই স্বাভাবিকতা!" আধুনিক সমাজে “পাগল” হয়ে ওঠার পথ এখন অনেক বেশি খোলা। তথ্যপ্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মানুষ অনবরত তথ্যের বন্যায় ভাসছে। এই তথ্যের ভারে অনেকেই হারিয়ে ফেলছে নিজের চিন্তা করার ক্ষমতা। আমরা প্রতিদিন অন্যের মত, অন্যের জীবন, অন্যের আদর্শে এমনভাবে ডুবে যাচ্ছি, যে নিজের স্বাতন্ত্র্য খুইয়ে ফেলছি। একদিকে আমরা যতটা সংযুক্ত, বাস্তবে ততটাই বিচ্ছিন্ন। যখন মানুষ নিজের মত প্রকাশ করতে গিয়ে কেবল ‘ট্রেন্ড’ অনুসরণ করে, যখন কেউ একটা বিষয় বুঝে না বুঝে সেটার পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তখন সেটাও একধরনের পাগলামি। এবং এই পাগলামি দিনে দিনে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। কেউ যখন নিজের জীবন ঘেঁটে অন্যের চেহারায়, মতামতে, চাহিদায় নিজেকে মানিয়ে নিতে চায়, তখন সে হয়তো মানসিক ভারসাম্য হারায় না, কিন্তু সে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করে—এবং সেটাই আসলে নিঃশব্দ পাগলামি। আধুনিক পাগলরা হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকে না। তারা ঘোরে টিকটকে, লাইক চায় ইনস্টাগ্রামে, বিতর্কে জড়ায় ফেসবুকে, এবং নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে চিন্তার স্বচ্ছতা, রুচির পরিচয় আর আত্মসম্মান। এই সমাজে 'পাগল' হওয়া আর পাগল দেখার মধ্যকার পার্থক্য প্রতিনিয়ত অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের ফিরতে হবে মননশীলতার কাছে। ফিরতে হবে পাঠের জগতে, সাহিত্য ও দর্শনের আলোয়। প্রযুক্তিকে দোষারোপ না করে তাকে ব্যবহার করতে হবে নিয়ন্ত্রিতভাবে। সোশ্যাল মিডিয়া যদি হতে পারে একটি প্ল্যাটফর্ম, তবে সেটি যেন হয় যুক্তি ও সৌন্দর্য চর্চার মঞ্চ। মানুষ যেন ভাবতে শেখে, প্রশ্ন করতে শেখে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে মতপ্রকাশ করতে শেখে। এই সামষ্টিক উন্মাদনার মধ্যে দাঁড়িয়ে কেউ যদি একটু থামে, একটু চিন্তা করে, তবে হয়তো সেই এক মুহূর্তই হতে পারে পরিবর্তনের সূচনা। আমরা সবাই হয়তো পাগল, কিন্তু পাগলামিরও এক সংহত রূপ থাকে, যেখানে থাকে সৃজন, থাকে প্রতিরোধ, থাকে সত্যের জন্য অটল থাকা। তাই আমাদের বেছে নিতে হবে, আমরা কোন ধরণের পাগল হতে চাই: অন্ধ অনুকরণকারী, না বুদ্ধির আলো হাতে চলা এক নীরব বিপ্লবী?
প্রশ্নটি সহজ, উত্তরটিও হয়তো আমাদের মধ্যেই আছে। শুধু প্রয়োজন একটু থেমে তাকানো, নিজের সঙ্গে নিজের সংলাপ। তাহলেই হয়তো প্রবাদটির পরিপ্রেক্ষিত বদলে যাবে, এবং আমরা বলব—পাগলে বলে না, জ্ঞানীও চুপ করে না। আজও আমরা সেই অবস্থার মাঝেই হাঁটছি। মানুষ এখন যা জানে না, তাতেও মত দেয়, যা বোঝে না, তাও শেয়ার করে। চিন্তার জায়গা এখন প্রতিক্রিয়ার ভিড়ে চাপা পড়ে গেছে। যুক্তির চর্চার জায়গা দখল করেছে রিল, স্ট্যাটাস আর কন্টেন্ট। কে কত ‘ট্রেন্ডি’ বা ভাইরাল, এটাই বিচার হচ্ছে তার জ্ঞান ও অবস্থান। ফলে, কে পাগল আর কে বুদ্ধিমান, সেই সীমারেখা দিনকে দিন অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। তবে পাগলামিও কিন্তু একরকম শিল্প। কেউ হয়ে ওঠে অনুসরণে পাগল, কেউ হয় নিজের চিন্তার তাড়নায়। ইতিহাস বলে, অনেক ‘পাগল’কেই একদিন যুগপ্রবর্তক হিসেবে গ্রহণ করেছে সভ্যতা।
তবে সব পাগলামি যে ক্ষতিকর, তা কিন্তু নয়। রবীন্দ্রনাথকেও কেউ কেউ বলেছিলেন ‘ভাবুক পাগল’। তিনি গানের কথা লিখে চলেছেন, কবিতা লিখে চলেছেন, নাটক মঞ্চস্থ করছেন। তখন অনেকেই বলত, “ও অনেক ভাবুক টাইপ মানুষ, একটু পাগলও বটে।” কিন্তু সেই ভাবুকই আজ জাতির সাংস্কৃতিক আত্মার মূর্ত প্রতীক। তাই পাগল হওয়াই যদি আজকের দিনে অনিবার্য হয়, তাহলে ঠিক করতে হবে আমরা কী ধরনের পাগল হতে চাই। আধুনিক ছাগলের মতো অন্ধ অনুকরণকারী, নাকি নিজের আলোর খোঁজে নির্লিপ্ত যাত্রী? রুচিহীন ট্রেন্ড-ভিত্তিক পাগল, না কি সৃষ্টিশীলতা আর প্রশ্নের তৃষ্ণায় পাগল? আজকের দিনে হয়তো স্বাভাবিক থাকার ভানটাই সবচেয়ে বড় পাগলামি, আর একটু গভীরভাবে ভাবাটাই সবচেয়ে সাহসী কাজ। এই সমাজে যে হেঁটে চলে, দেখে না, ভাবে না, শুধু অনুকরণ করে, সে-ই হয়তো আসল ছাগল। আর যে প্রশ্ন তোলে, ভাবে, আর নিজের রুচির দায়িত্ব নেয়, সে-ই আজকের দিনের সাহসী পাগল। আসুন, আমরা সবাই মিলে ঠিক করি—পাগল হবো, তবে চিন্তার পাগল। ছাগল হবো না, অন্তত অন্ধ অনুসরণে। কারণ, শেষ কথা একটাই, পাগল হওয়া দোষ নয়, কিন্তু ছাগলের মতো খেয়ে ফেললে সব কিছু... তখন তো আর বলার কিছুই থাকে না! তবে মোদ্দা কথা হলো, আমরা যদি নিজের চিন্তা, বোধ, রুচি, ও দায়িত্ববোধ বজায় রাখতে পারি, তবে এই পাগলামির ভিড়ে থেকেও আমরা স্বাভাবিক থাকতে পারি। নইলে হয়তো আসল পাগল আর ভদ্রবেশী পাগলের পার্থক্য করা একদিন অসম্ভব হয়ে যাবে। আর তখনই হয়তো কেউ আবার বলবে—“আমরা সবাই পাগল, কেউ প্রকাশ করে, কেউ লুকিয়ে রাখে।”
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট