শ্রীচরণেষু দাদা: ২০

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৪৩ পিএম
শ্রীচরণেষু দাদা: ২০

ঢাকা শহরের গলি-ঘুপচিতে কত না দুঃখ, কত না ঝঞ্ঝার মুখোমুখি সে হয়েছে। যুদ্ধোত্তর দুর্ভিক্ষ, অভাব, ভাঙাচোরা সংসারের হাহাকার, এসবই যেন তাকে শিখিয়েছে জীবনের কঠিনতম পাঠ। সে জানে, জীবনের পাত্রে দুঃখ আর কষ্টের জল সবসময় উপচে পড়ে। তবু সেই জল গিলে নিতে হয়। দুঃখকে সহাস্যে বরন করে সামনে এগিয়ে চলাই সংসারের নিয়ম।

তাই ভালোবাসার আপনজনকে হারানোর ব্যথা অরুণকে কাবু করতে পারেনি। সে জানে, শোককে বুকে নিয়ে থেমে থাকলে সংসারের চাকা ঘুরবে না। দাঁতে দাঁত চেপে, ভেতরের আগুনকে শান্ত করে, তাকে এগিয়ে যেতেই হবে। তাই একদিন বাবা-মায়ের কথায় অরুণ অবশেষে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।

অরুণের বয়স তখন বিয়ের উপযুক্ত। গ্রামে-শহরে আত্মীয়রা কতদিন ধরেই চাইছিলেন, সে সংসার পাতুক। মানুষের চোখে চোখে কথা, সমাজের অদৃশ্য চাপ, সব মিলিয়ে মনে হলো, এ বিয়ে কেবল অরুণের জন্য নয়, পুরো পরিবারের সম্মান, ভবিষ্যৎ আর আশার প্রতীক। ছোট-ছোট ভাই-বোনদের মানুষ করতে হলে অরুণকে আগে সংসারী হতে হবে। অরুণ নিজে যদিও মন থেকে কিছু বলেনি, কিন্তু বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারল না। জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতার মাঝেও বাবা-মা তাকে আঁকড়ে বেঁচেছেন। আজ তারা চায় তার সংসার হোক, তার পাশে কেউ থাকুক। অরুণ বুঝল, এটাই হয়তো দায়িত্ব পালনের সময়।

একদিন অরুণের ডাক পড়ল গ্রামে। বাবা-মায়ের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা যেন সেদিন আরও গম্ভীর রূপ নিলো। সকালের কুয়াশায় মোড়া আঙিনায় গ্রামের পরিচিত এক ঘটক এলেন। চোখেমুখে কপট গাম্ভীর্য, হাতে সযত্নে কাগজে মোড়ানো একটি ছোট্ট ছবি। ভাঁজ খুলতেই ভেসে উঠল মেয়েটির মুখ। নাম—লক্ষ্মী। কুমিল্লা থেকে চল্লিশ কিলোমিটার উত্তরের এক থানার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে। স্বভাব শান্ত, লাজুক, কিন্তু লেখাপড়া তেমন হয়নি। তবে বংশ পরিচয় খারাপ নয়, পরিবার ধনী, জমিজমা ও ভিটে-বাড়ির অভাব নেই।

অরুণ ছবিটি হাতে নিয়েই এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করল। কতদিন ধরে তার ভেতরে যে অস্থিরতা, একাকীত্ব, অপূর্ণতার দীর্ঘ ছায়া, হঠাৎ যেন ছবির মেয়েটি সেই আঁধারে আলো ফেলে দিল। যেন ঝড়-ঝঞ্ঝার বুকের ভেতর দিয়ে একটুখানি নীরব আলো এসে জানাল, অরুণের জীবনেও হয়তো এবার শান্তি, স্থিতি, সংসারের সুর বেজে উঠতে পারে।

এরপর শুরু হলো প্রচলিত আচার অনুসারে আয়োজন। দিনক্ষণ স্থির হলো মেয়েকে দেখার।

হিন্দু সমাজে তখনকার দিনে মেয়ে দেখা মানেই যেন এক পরম্পরার নাটকীয় আয়োজন। সম্ভাব্য বরকে কখনো একা পাঠানো হয় না। সাথে থাকেন কাকার দল, আত্মীয়-স্বজন, আর গ্রামের এক-দুইজন মর্যাদাসম্পন্ন প্রবীণ ব্যক্তি। যেন বর শুধু একজন নয়, পুরো পরিবার, এমনকি গ্রাম-সমাজের প্রতিনিধি হয়ে যাচ্ছেন সেখানে।

সেদিন তাই অরুণের সাথেও রওনা হলেন তার ছোটকাকা ও গ্রামের দুইজন মর্যাদাবান প্রবীণ। থানার বাজার থেকে কুমিল্লা-গামী পুরনো বাসে চেপে বসলেন সবাই। কুমিল্লা থেকে আবারো অন্য একটি বাসে যেতে হয়। সেখান থেকে দুটি রিক্সা নিয়ে রওনা দেয় মেয়ের গ্রামের উদ্দেশ্যে। 

অরুণ রিক্সায়। সে তাকিয়ে রইল। পথের ধারে তালগাছ, খেজুর-গাছ, ফসলের ক্ষেত, আর ছোট ছোট নদী। তার বুকের ভেতর কেমন এক অচেনা ধুকপুকানি।

মেয়ের বাড়িতে পৌঁছাতেই যেন এক আলাদা পরিবেশ। মেয়ের আত্মীয়রা সাদরে বর পক্ষকে বরণ করে নিলেন। পেতলের থালায় রাখা হলো পান-সুপারি, মিষ্টি, আর আতিথেয়তার ভঙ্গি।

তারপর এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্ত।

মেয়েকে আনার সময় বাড়ির ভেতরে যেন এক অদৃশ্য শিহরণ বয়ে গেল। উঠোনের বাইরে ছোট ছোট মেয়েরা গুনগুন করে হাসছিল, ভেতরে বউঝিরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো শাঁখের শব্দ, সঙ্গে ধূপের হালকা গন্ধ।

একটু পরেই দরজার আড়াল থেকে ভেসে উঠল নূপুরের টুংটাং শব্দ। ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করল মেয়েটি। লাজে-লজ্জায় মাথা নত, আঁচল টেনে পুরো মুখ ঢেকে রেখেছে, কেবল কপালের একটু অংশ আর ঠোঁটের কোণে মৃদু কম্পন চোখে পড়ছিল।

তার পায়ের মৃদু শব্দ, অচেনা সৌন্দর্যের নীরব আভা যেন উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ঘরের বাতাস তখন নিস্তব্ধ, কেবল বাতাসার মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠছে চারপাশ।

প্রথা-মাফিক একপাশে পেতলের থালায় রাখা হলো পান-সুপারি, নারকেলের খণ্ড, মিষ্টান্ন। বরপক্ষ বসে আছে গাম্ভীর্য বজায় রেখে। কাকা ও গ্রাম্য প্রবীণরা মেয়ের দিকে তাকালেন এক দৃষ্টিতে, যেন চোখেই লিখে নিতে চাইছেন ভবিষ্যতের ভরসা। কাকা হালকা কাশি দিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রশ্ন শুরু করলেন।
— “পড়াশুনা কতদূর করেছো, মা?”

মেয়েটি মাথা নিচু করে ধীরে উত্তর দিল—“সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত।”

— “ঘরকন্নার কাজ জানো তো?”

মেয়েটি এবার শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

ঘরে বসা প্রবীণরা সমস্বরে বললেন—“ভালো, ভালো।”

- সেলাই-ফোঁড়াই কিছু পারো, মা?”-আরেক প্রবীন জিজ্ঞেস করেন।

-মাথ নেড়ে সন্মতি জানায়।

- চুলোর কাজে কেমন? ভাত-ডাল, তরকারি এসব বানাতে পারো তো?”

-পারি-আস্তে করে মেয়েটি উত্তর দেয়।

বরের কাকা হেসে মিষ্টি এগিয়ে দিয়ে বললেন— “এই নাও, একটা মিষ্টি খেয়ে মুখ মিষ্টি করো।”

অরুণ তখন নীরবে তাকিয়ে ছিল। সে কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারল না। কেবল চোখ মেলে দেখছিল মেয়েটির ভঙ্গি, লাজুক দৃষ্টি, আর আড়ালে রাখা মুখমণ্ডলের রেখাগুলো। যতটুকু চোখে পড়ল, তাতে তার মনে হলো, এই মেয়েটিই হয়তো সংসারের সাথী হওয়ার মতো উপযুক্ত।

মুহূর্তটি যেন অরুণের ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তি নামিয়ে আনল। দীর্ঘদিনের শূন্যতা, একাকীত্ব আর ভাঙাচোরা স্মৃতির ভেতরে হঠাৎ মনে হলো, হ্যাঁ, এই মেয়েটির হাত ধরে হয়তো গড়া যাবে সংসারের রূপকথা।

কেন জানি অরুণের মনে হয়েছিল মেয়েটিকে সে যেন বহুদিন থেকেই চেনে। প্রথম দেখাতেই তার ভেতরে এক অদ্ভুত টান জেগে উঠেছিল। কথায়, আচরণে, চাহনিতে মেয়েটির সরলতা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। পরিবারের সবার সম্মতিতে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। পুরোহিত পঞ্জিকা দেখে নির্দিষ্ট করলেন শুভ-লগ্ন, আর অরুণের জীবনে যেন এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল।

শুভ্রের সে দিনটার কথা এখনো বুকের ভেতর রোদ্দুরের মতো ঝলমল করে। যেদিন গোটা পাড়া খবরটা জানলো, অরুণের বিয়া ঠিক হইছে! সেদিন খুশিতে শুভ্র যেন পাখির মতো ডানা মেলল। সারা পাড়া ঢ্যাং-ঢ্যাং-ঢ্যাং করে খালি ঘুরে বেড়াইছে। যারে সামনে পাইছে, দৌড়াই গিয়া হাঁপাইয়া বলছে—“শুনছস? দাদার বিয়া অইবো! নতুন বউ আইবো! কি মজা! কি খুশি!” ওর চোখে মুখে তখন এমন আলো জ্বলতেছিল, যহন মনে হইত—পুরা গ্রামটাই ওর আনন্দে নাইচা উঠছে। বউ আসলে কেমন হইব, কেমন কথা কইব, আর দাদা-বৌয়ের ঘরে হাসির আওয়াজ কেমন বাজবো—এইসব ভেবে শুভ্রর বুকের ভেতরটা কেমন যেন কাঁপ কাঁপ করতেছিল।

প্রথামতো বিয়ের আয়োজন হবে কনের বাড়িতেই। শুভ্রর আনন্দ যেন আর সামলানোই যায় না। তার চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক। প্রথমবার সে যাচ্ছে বিয়ে বাড়ি, তাও আবার পুরো বরযাত্রীদের ভরা বাসে। বাস ছাড়তেই হইচই, হাসি, তালি, আর বাস চলার শব্দ যেন সবার বুকের ভেতরেই বাজতে থাকে। শুভ্রর বুক ধুকপুক করছে। এত লোক নিয়ে, এমন আনন্দ-যাত্রায় সে আগে কখনো ওঠেনি। জানলার বাইরে গ্রামবাংলার সবুজ মাঠ, গাছের সারি, পথের ধুলো আর মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি যেন উৎসবের অংশ হয়ে উঠল।

মেয়েদের গ্রামটি থানা শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়, মাত্র মাইল দু’এক। কিন্তু পথ যেন সে দূরত্বকে দীর্ঘ করে তোলে। থানা শহর থেকে ইটের রাস্তা যতদূর গিয়েছে, তার পর শুরু হয়েছে কাঁচা পথ, অসংলগ্ন, উঁচু-নিচু আর সরু। গরুর গাড়ি যেন কষ্টেসৃষ্টে চলতে পারে এমনই অবস্থা। তাই গ্রামের দিকে আসতে হলে যাত্রীদের অনেকটা পথ পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিতে হয়। পথের ধারে ঘন ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকে গ্রামের কুকুরেরা। হঠাৎ করে তারা ঘেউঘেউ করে উঠলে শুভ্র চমকে যেত। ভয় পেয়ে সে দৌড়ে গিয়ে অরুণ দাদার হাত আঁকড়ে ধরত। অথচ ভয়ের ভেতরেও ছিল এক অদ্ভুত আনন্দ। অচেনা পথ, গ্রামের নিস্তব্ধতা, অজানার ডাক। সব মিলিয়ে শুভ্রর মনে হচ্ছিল যেন এক রোমাঞ্চকর অভিযানে এসেছে সে।

এক সময় বর যাত্রীরা কনের বাড়ী এসে পৌঁছায়। কনের বাড়ি যেন এক আলোকময় মঞ্চ। কারো মুখে শুনেছে, আগের দিন থেকেই সেখানে শুরু হয়েছে অদ্ভুত এক ব্যস্ততা। উঠোনের বাঁশের বেড়ায় ঝুলছে রঙিন কাগজ, কাগজের ফুল, কখনোবা ঝকঝকে ফিতা। মাটির উপর চালের গুঁড়ো দিয়ে আঁকা হয়েছে নকশা করা আলপনা, যেন চাঁদের আলোয় উঠোনে ঝলমল করছে। ফুলের গন্ধে ভরে উঠেছে আঙিনা। টগর, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা মিলেমিশে যেন বাতাসে ঢেউ তোলে।

উঠোনের এক পাশে মেয়েরা কণ্ঠ মেলেছে গানের সুরে। কিছু বয়স্ক মহিলারাও আছেন। কখনো বিয়ের গীত, আবার কখনো হাসি-ঠাট্টায় ভরা ছড়াগান। সেই সুর যেন ভেসে বেড়াচ্ছে পুরো পাড়া-মহল্লায়। শুনলেই মনে হয় আনন্দ যেন নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। উঠোনে কিশোরদের হুল্লোড়, কে দৌড়ে বেশি, কে নাচে বেশি, এই প্রতিযোগিতাতেই মেতে আছে সবাই। গায়ে হলুদের আসরে চারপাশে শুধু হাসি, খুনসুটি আর হলুদে রঙিন মুখ। সেই হলুদে যেন লুকিয়ে আছে অগাধ আবেগ, মিষ্টি লজ্জা আর সীমাহীন উচ্ছ্বাস। শুভ্র সবকিছু দেখে অবাক। এই উৎসব শুধু একটা বিয়ে নয়, এটা যেন সবার প্রাণের মিলন-মেলা।

সন্ধ্যা নামতেই বাড়িটা যেন আনন্দে গমগম কইরা উঠলো। চারিদিক ভরে গেল মানুষে মানুষে, হাসি-গল্পে উঠোন কাঁপিতেছে। উঠোনে টাঙানো হ্যাজাকের আলো ঝলমল কইরা জ্বলে উঠলো। সারা বাড়িটা তখন এমন ফকফকে আলোয় ভইরা গেল, মনে হইলো—আনন্দের নীড় জেগে উঠছে রূপকথার মতো। বরযাত্রী এলো বাদ্য-বাজনা, উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনির ভেতর দিয়ে। অরুণকে দেখে সবাই হর্ষ-ধ্বনি তুলল। কনে তখন লাজে-শরমে আড়ষ্ট, অথচ চোখেমুখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। মালাবদলের মুহূর্তে মনে হলো যেন দুটো পৃথক জগত একে অপরকে গ্রহণ করছে। অগ্নিকে সাক্ষী রেখে সাত পাক ঘুরল তারা, উচ্চারিত হলো মন্ত্রপাঠ, আর প্রতিটি পাকের সঙ্গে প্রতিশ্রুত হলো জীবনের নতুন শপথ।

সিঁদুর পরানোর সময় নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল চারপাশ। সবার চোখে ছিল এক ধরনের আলো, আশীর্বাদ আর আবেগের মিশ্রণ। কন্যাদানের মুহূর্তে কনের বাবার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, অথচ সেই কণ্ঠেই ছিল পরম বিশ্বাস যে তার কন্যা এখন নিরাপদ হাতে। 

বিদায়ের ক্ষণে মেয়েটির চোখ ভিজে উঠল অশ্রুজলে। সে যে কতটা অসহায়, তা বোঝা যাচ্ছিল তার কাঁপা ঠোঁট আর ভিজে ওঠা মুখে। বাড়ির আঙিনা ভরে উঠল বুকফাটা কান্নায়। মায়ের হাত ধরে ঝুঁকে পড়েছে সে, মায়ের চোখেও ঝড়ের মতো অশ্রুধারা। বাবার দৃঢ় বুকটাও হঠাৎ যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। চোখের পানি আর দীর্ঘশ্বাস মিলেমিশে বেরিয়ে এলো চাপা কান্নায়।

কেউ মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বুক ভাসিয়ে কাঁদছে, কেউ আবার লুকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে আঁচলের আড়ালে, কিন্তু আঁচল ভিজে যাচ্ছে নোনতা জলে। দিদি, বোন, কাকী, পিসি—প্রতিটি মুখে একই আকুলতা, একই যন্ত্রণার আর্তনাদ। উঠোনের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীরাও চোখ মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, মনে হচ্ছে এই বিদায়ের বেদনা যেন সবার ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

পাড়া-প্রতিবেশীদের বুকেও জমে উঠল এক অদ্ভুত শূন্যতা, যেন এই মুহূর্তে পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। তবে সেই শূন্যতার বুকফাটা কান্নার ভেতর দিয়েই জন্ম নিলো এক নতুন সম্পর্ক, নতুন সংসারের অচেনা গল্প। তবু যে শূন্যতা রয়ে গেল, তা কোনো সম্পর্কের বাঁধন দিয়েও পূর্ণ হওয়ার নয়।

পরদিন বউ ভাতে কনে নতুন ঘরে প্রবেশ করল, হাসি আর স্নেহে ভরা এক পরিবারের অঙ্গ হয়ে উঠল। অরুণের মনে হলো, এই রঙিন কাগজ, আলপনা, গান, হাসি আর চোখের জল মিলিয়েই তৈরি হয়েছে জীবনের সবচেয়ে পবিত্র চিত্রকাব্য। বিবাহ কেবল দুজন মানুষের মিলন নয়, এটি এক নবজীবনের সূচনা, এক সেতুবন্ধন, যেখানে ভালোবাসা, আস্থা আর আশীর্বাদ মিলেমিশে যায় চিরন্তন ঐতিহ্যের স্রোতে।

নিয়তি যে কেমন অদ্ভুত খেলায় মাতে, তা অরুণ সেদিন নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করল। চারদিক আলোয় ভরে গেছে, হাসি-গান, উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনির গর্জনে আকাশ-বাতাস যেন মেতে উঠেছে আনন্দে। অথচ সেই উৎসবের ভেতরেই কোথাও যেন লুকিয়ে ছিল এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার।

বাসর ঘরের শূন্যতায় বসে ছিল অরুণ, অদ্ভুত এক কাঁপুনি তার ভেতরে ভর করেছে। চোখে বারবার ভেসে উঠছিল মেয়েটির মুখ। সেই কুমারী, যাকে দেখে সে মুগ্ধ হয়েছিল, যার সরল হাসিতে সে খুঁজে পেয়েছিল জীবনের অর্থ। মন ভরে উঠেছিল অদ্ভুত আশায়। অরুণের বুক ধকধক করছে, প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক অনন্ত প্রতীক্ষা।

অবশেষে এলো সেই ক্ষণ। দরজার আড়াল থেকে ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করল নববধূ। লাজ-শরমে ঢেকে আছে সারা দেহ, রাঙা শাড়ি, অলংকার আর রক্তিম আলতায় ভেজা পা। ঘোমটার নিচে ঢাকা মুখ যেন এক অদ্ভুত রহস্য। অরুণের বুক ভরে উঠল অনাবিল আনন্দে। এখন শুধু সেই পরিচিত মুখটি দেখবার অপেক্ষা।

কিন্তু মুহূর্তেই সব পাল্টে গেল।

অরুণ কাঁপা হাতে সরাল ঘোমটা। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার ভেতরে যেন বজ্রপাত হলো।

এ কি! এ মুখ তো নয়!

চোখ দুটি অন্যরকম। কোনো কোমল মায়া নেই সেখানে, বরং কঠিন শীতলতা। গায়ের রং ভিন্ন, মুখাবয়ব, এমনকি চাহনি, কোনো কিছুর সঙ্গেই মিলছে না সেই ছবির মেয়েটির। দেখা মেয়েটির গায়ের রং ছিলো ফর্সা। কিন্তু এতো একেবারে কালো…

অরুণের বুকের ভেতরটা যেন ছিন্ন-ভিন্ন হতে লাগলো।

এ তো প্রতারণা! এক ভয়ঙ্কর প্রতারণা!

যে মায়ার ছবি তার চোখে এঁকে দেওয়া হয়েছিল, সেটি নিছক এক অভিনব ছলনা। আজ তার সামনে বসে আছে অন্য এক নারী, সম্পূর্ণ ভিন্ন, সম্পূর্ণ অচেনা। চারদিক হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। বাইরে তখনো মানুষে গুঞ্জন, আত্মীয়রা উৎসবে মেতে উঠছে। অথচ এই ছোট্ট ঘরটিতে জমাট বাঁধল এক নীরব মৃত্যু।

অরুণের চোখে জল এলো না, মুখ থেকে কোনো কথা বেরোল না। শুধু বুকের ভেতর এক ঝড় বইতে লাগল। এ কেমন খেলা, এ কেমন ছল?

বিবাহ তো ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। মন্ত্রপাঠ, সাত পাক, সিঁদুর-দান, সবই হয়েছে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে। শুভদৃষ্টির লগ্নেও সত্য গোপন থেকেছে। এখন সে আর কিছুই করতে পারবে না।

অরুণ যেন হঠাৎ আবিষ্কার করল, নিয়তি মানুষকে কেবল বেছে নেয় না, তাকে খেলা দেখায়। আর সেই খেলায় কোনো নিয়ম নেই, নেই কোনো ন্যায়-অন্যায়। শুধু আছে বিস্ময়কর নির্মমতা।

ঢাকায় ফিরে আজিমপুরের ছোট্ট ঘরেই শুরু হলো অরুণের নতুন জীবনের অধ্যায়। বধূর নাম লক্ষ্মী। একদমই সেই মুখ নয়, যাকে প্রথম দেখায় মনে ধরেছিল, যে রূপের স্বপ্নে সে বুঁদ হয়ে ছিল। কালো রঙ, ভিন্ন অবয়ব, কঠিন চাহনি, প্রথম রাতে যেটুকু বিস্ময়, ক্রোধ আর হতাশা তাকে ঝাঁকুনি দিয়েছিল, সেটাই ধীরে ধীরে জমে রইল এক দীর্ঘশ্বাসের মতো।

তবুও অরুণ জানত, জীবনের এই দীর্ঘ যুদ্ধে প্রতারণার ক্ষত বয়ে চলাই মানুষের নিয়তি। ছোট্ট ঘর, ভঙ্গুর স্বপ্ন, সম্পর্কের নাজুক পরিসর, সবই তার অজানা ছিল না। তবু দায়িত্বের পথ থেকে কখনো পিছিয়ে আসেনি সে।

লক্ষ্মীও ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে সত্যিকারের লক্ষ্মী। অরুণের জীবনের আশ্রয়। রান্না করে, সংসার সামলায়, পাশে বসে থাকে নীরবে। তার মমতায় অরুণের বুকের গভীর শূন্যতা ধীরে ধীরে ভরে উঠতে থাকে। অরুণের ভাইবোনদেরও নিজের সন্তান মনে করে আগলে রাখে সে। সংসারের টুকরো টুকরো সুখ-দুঃখে তারা একে অপরের পরিপূর্ণ সঙ্গী হয়ে ওঠে।

অরুণের নতুন সংসার, নতুন দায়িত্ব। দিন কাটছে ভিন্ন ছন্দে, ভিন্ন ব্যস্ততায়। তবু একদিন, এক নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায়, গোরস্থানের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেল সে। নিশ্চুপ কবরগুলোর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল। যেন প্রতিটি কবরের ভেতরে লুকিয়ে আছে মানুষের হারিয়ে যাওয়া হাসি, দুঃখ, ভালোবাসা আর অসমাপ্ত গল্প।

সেই নীরবতার ভেতর অরুণের মনে হলো, এই শহর আসলে এক অদ্ভুত দানব। প্রতিদিন একটু একটু করে মানুষকে গিলে খায়, আবার সেই ক্ষতবিক্ষত বুকেই আশ্চর্যরকম করে বুনে দেয় টুকরো টুকরো সান্ত্বনা। চোখের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস যেন হঠাৎ ভাষা পেল।

অরুণ খুব আস্তে বলল—

“এই শহর যত কিছু কেড়ে নেয়, তবু শেষমেশ কিছু ফিরিয়েও দেয়। হয়তো এ ঘর, এ নারী, এ সংসারই আমার নতুন আশ্রয়। আমার কাজ কেবল চুপচাপ আয়নাটা ধরে রাখা, যতদিন পারি।”

কথাগুলো উচ্চারণ করতেই বুকের ভেতর অজানা হালকা ভাব নেমে এলো। সে বুঝল, আয়নার ভেতর যে মুখই থাকুক, তার দায়িত্ব, তার সঙ্গ, তার সংসার চালিয়ে নেওয়ার শপথই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

জীবন যদি নিয়তির খেলায় ভাসিয়েও দেয়, তবু অরুণ ভাঙবে না। সে দাঁড়িয়ে থাকবে নিঃশব্দে, নীরবে, অবিচল—যতদিন পারে।

চলবে—

ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট