মা ও পরিবার

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:২৭ আগস্ট ২০২৫, ০৩:২২ পিএম
মা ও পরিবার
পৃথিবীর সবচেয়ে মধুময় দুটি শব্দ—মা এবং পরিবার। কিছুদিন আগে আমার ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ কি? প্রায় নব্বই শতাংশ উত্তর দিয়েছিল: “মা” ও “পরিবার”। সত্যি বলতে, আমি একটুও অবাক হইনি। কারণ এই দুটি শব্দের ভেতরেই নিহিত আছে আমাদের অস্তিত্ব, ভালোবাসা আর ভবিষ্যতের সমস্ত সম্ভাবনা। ভাবুন তো, একবার যদি এই দুটি শব্দকে আমাদের জীবন থেকে মুছে দেওয়া হয়, তবে পৃথিবী আর কেমন থাকবে? এক অন্ধকার, শূন্য ও নির্জন মরুভূমির মতো, যেখানে থাকবে না আশ্রয়, থাকবে না সান্ত্বনা, থাকবে না নিরাপত্তা। “মা” শব্দের স্পর্শেই তো আমরা প্রথম পৃথিবীকে চিনেছি, প্রথম ভাষা শিখেছি, প্রথম ভালোবাসা পেয়েছি। আর “পরিবার”—এই একটি ছাতার নিচেই আমরা পেয়ে থাকি শক্তি, ঐক্য, দুঃখে ভরসা আর সুখে আনন্দের সমবায়। তাই আজকের ভাঙা-ঢ্যাঙা সমাজে, প্রতিযোগিতা আর যান্ত্রিক জীবনের ভিড়ে, মানুষ যত দূরেই চলে যাক না কেন, শেষ পর্যন্ত ফিরে আসে এই দুটি শব্দের কাছেই—মা ও পরিবার, কারণ এদের ভেতরেই লুকিয়ে আছে মানবতার চিরন্তন সুর ও জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য।
 
এই উপলব্ধি আরও গভীর হয়ে উঠেছিল যখন আমি বেঙ্গর, নর্থ ওয়েলসে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানেই থাকে আমার এক কাকাতো বোন, স্বামী ও সন্তান নিয়ে। স্বামী–স্ত্রী দু’জনেই চিকিৎসা পেশার সঙ্গে যুক্ত এবং কনসাল্টেন্ট হিসেবে বেঙ্গরের একটি হাসপাতালে কর্মরত। সেই বোনের বাড়িতে এটাই ছিল আমার প্রথম যাওয়া। সেখানে গিয়ে তাঁর শাশুড়ির সঙ্গেও পরিচয় হলো, যা আমার ভ্রমণ-অভিজ্ঞতাকে আরও স্মরণীয় করে তুলেছিল। প্রথম দেখাতেই যেন মনে হলো, এ তো সেই মা, যার কথা আমার শিক্ষার্থীরা বলেছিল। তাঁর ভেতরে এমন এক মাতৃত্ব-বোধ, এমন এক উষ্ণতা যে মনে হলো তিনি কেবল তাঁর পরিবারের জন্য নন, আমাদের সকলের জন্যই মা। তাঁর হাসি ছিল এক অদৃশ্য আশ্রয়ের মতো, যেখানে ক্লান্ত মন মুহূর্তেই প্রশান্তি খুঁজে পায়। তাঁর কথাবার্তায় ছিল অভিজ্ঞতার মাধুর্য, জীবনের অগণিত শিক্ষার অনাবিল ধ্বনি। রান্নাঘরে তাঁর হাতের যাদুতে যেমন ভেসে উঠত সুগন্ধময় খাবারের সৌরভ, তেমনি বসার ঘরে তাঁর কণ্ঠে শোনা যেত কবিতা, গান, আবৃত্তির সুধা। শুধু গৃহিণী নন, তিনি যেন শিল্পী, দার্শনিক, শিক্ষক—সব মিলিয়ে এক জীবন্ত মহাকাব্য। তাঁর চোখে ছিল মমতার দীপ্তি, আর আচরণে ছিল এমন এক সৌন্দর্য, যা কাউকে অচেনা থাকতে দেয় না। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন মায়ের আদর্শ প্রতিমূর্তি—যিনি পরিবারের সীমানা ছাড়িয়ে আশেপাশের প্রতিটি মানুষকেই নিজের সন্তান ভেবে আগলে রাখেন। প্রথম দেখাতেই তিনি যেন আপনজনের মতো কাছে টেনে নিলেন।
 
এই লেখাটি লিখতে গিয়ে অনিবার্যভাবেই মনে পড়ে যায় ম্যাক্সিম গোর্কির অমর উপন্যাস “মা”–র কথা। মস্কোর প্রগতি প্রকাশনী থেকে বাংলায় অনূদিত বইটি একদিন চোখে পড়েছিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই কিনে এনেছিলাম। বইটি পড়ার পর আমি গভীরভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম; তার প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছিল আমাকে। নিলোভনা চরিত্রটি আমার মনে আজও অমলিন। তিনি ছিলেন এক সাধারণ মা। যার কথা মনে হলে পৃথিবীর সব মায়েদের সুন্দর অবয়ব চোখে ভেসে উঠে। নিলোভনা প্রথম জীবনে রাজনীতি কিংবা আন্দোলনের কিছুই জানতেন না। কিন্তু সন্তানের প্রতি অগাধ ভালোবাসা তাঁকে এমন এক সাহসী রূপে জাগিয়ে তুলল, যা শুধু মাতৃত্বের শক্তিতেই সম্ভব। সন্তানকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে গিয়ে তিনিও হয়ে উঠলেন এক বিপ্লবী, এক পরিবর্তনের অগ্রদূত। এই চরিত্রের মধ্য দিয়েই গোর্কি দেখাতে চেয়েছেন যে, মা কেবল ঘরের ভেতরের সীমাবদ্ধ পরিচয় নয়—তিনি সমাজ পরিবর্তনেরও এক অদৃশ্য শক্তি। গোর্কির সেই বিখ্যাত উক্তি—“Only mothers can think of the future, because they give birth to it in their children”—আজও সমানভাবে সত্য। মা-ই তো আসলে ভবিষ্যৎকে জন্ম দেন, তাঁর কোলে ভর করেই মানুষ শেখে কিভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়, কিভাবে সংগ্রাম করতে হয়, আর কিভাবে পৃথিবীকে আরও সুন্দর করার পথে হাঁটতে হয়। তবে গোর্কির উপন্যাস শুধু রাজনৈতিক চেতনা নয়, মানব জীবনের গভীর সত্যও তুলে ধরে। তিনি লিখেছিলেন: “সুখ হাতে ধরে রাখলে সবসময়ই ছোট মনে হয়, কিন্তু একবার তা হাতছাড়া হলে তখনই বোঝা যায় কত বড় আর অমূল্য ছিল সেটি” (Happiness always looks small while you hold it in your hands, but let it go, and you learn at once how big and precious it is)। আমরা প্রায়ই মা ও পরিবারকে এতটাই স্বাভাবিক ধরে নিই যে তাদের প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে পারি না। প্রতিদিনের ব্যস্ততা, নিজের সাফল্যের পিছনে দৌড়, কিংবা আধুনিক সমাজের প্রতিযোগিতা—সবই আমাদের ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দেয় এই সত্য থেকে। অথচ যখন আমরা তাঁদের হারাই, তখনই টের পাই, তাদের উপস্থিতিই ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। মা ও পরিবার কেবল আবেগের আশ্রয় নয়, তারা আমাদের অস্তিত্বের শিকড়, আমাদের মানবিকতার কেন্দ্রবিন্দু। তাই আজকের অস্থির, ভাঙা-ঢ্যাঙা পৃথিবীতে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে এই মৌলিক সত্যের কাছে—যতক্ষণ মা ও পরিবার আছে, ততক্ষণ জীবন কখনোই শূন্য নয়, বরং তা পূর্ণতা ও শক্তিতে ভরা। আর এই দৃঢ় সত্যটিই আক্ষেপের সুরে আমাকে শোনাচ্ছিলেন আমার ভগ্নীপতি। তাঁর মতে, ইউরোপে আজ আর “পরিবার” বলে কোনো কিছু নেই—সেই শূন্যতার প্রভাবই ধীরে ধীরে আমাদের সমাজেও পড়ছে। পরিবার শব্দটির কাঠামো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছেদের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনক-ভাবে, প্রতিটি সংসারে বইছে অশান্তির হাওয়া। আধুনিক সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে বেড়ে ওঠা টিকটক-প্রজন্মের অনেকেই “মা” আর “পরিবার” শব্দের গভীর তাৎপর্য বুঝতেই পারছেন না। আর এরই পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ—এক অসংলগ্ন, ছিন্নমূল সমাজের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
 
ইতিহাসে অসংখ্য মানুষ মা-কে ঈশ্বরের সমার্থক বলেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি এবং সভ্যতায় মাতৃত্বের এই মহিমা সমানভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। রুডইয়ার্ড কিপলিং লিখেছিলেন, “God could not be everywhere, and therefore he made mothers।” এই একটিমাত্র বাক্যেই ধরা পড়ে মায়ের সর্বজনীন রূপ, যেখানে ঈশ্বরের অদৃশ্য শক্তি বাস্তবে মায়ের ভালোবাসা ও স্নেহের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ উপন্যাসিক উইলিয়াম থ্যাকেরি আরও গভীরভাবে বলেছেন, “Mother is the name for God in the lips and hearts of little children।” সত্যিই তো, এক শিশুর কাছে ঈশ্বর কোনো দার্শনিক ধারণা নয়, বরং মায়ের কোল, মায়ের ছোঁয়া, মায়ের হাসি—এসবই তার কাছে ঈশ্বরের রূপ। এই উক্তিগুলো কোনো কল্পনা বা আবেগ নয়; এগুলো সেই সত্য যা প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ পরিবারে নতুন করে জন্ম নেয়, নতুন করে জীবনের ভিত্তি গড়ে তোলে। ইতিহাস, সাহিত্য, ধর্ম—সবখানেই মায়ের এই মহিমা স্বীকৃত হয়েছে।
 
মাদার টেরেসার কথাই ধরা যাক। তিনি বলেছিলেন, “If you want to bring happiness to the whole world, go home and love your family।” আজকের বিভক্ত, অস্থির এবং প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে এই সত্য আরও প্রাসঙ্গিক। আমরা বিশ্বশান্তির নানান বড় বড় তত্ত্ব খুঁজি, সভা-সম্মেলনে বক্তৃতা দিই, প্রযুক্তি আর উন্নতির ছক আঁকি, কিন্তু মূলত শান্তির আসল শুরু হয় পরিবার থেকেই। যখন একটি পরিবার ভালোবাসায় ভরে ওঠে, তখন সেই ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে, সমাজে, দেশে, এমনকি সমগ্র পৃথিবীতে। মা হচ্ছেন সেই পরিবারের হৃদয়, যেখানে ভালোবাসার উৎস স্থায়ীভাবে প্রবাহিত হয়। তাঁর ছায়ায় আমরা শিখি সহমর্মিতা, ত্যাগ আর ক্ষমার মতো মৌলিক মূল্যবোধ। তাই মা ও পরিবারকে ভালোবাসা মানে শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, বরং মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার অপরিহার্য শর্ত। এই কারণেই মা-কে কেবল ব্যক্তিগত পরিসরে নয়, সার্বজনীন পরিসরেও ঈশ্বরের সমার্থক বলা হয়।
 
আজকের অশান্ত-উদ্ভট ব্যস্ত ও আত্মকেন্দ্রিক সমাজে আমরা অনেক সময় পরিবার ও মায়ের মূল্য ভুলে যাই। অথচ তাঁরা ছাড়া আমাদের মানবতা টিকে থাকতে পারে না। মা আমাদের প্রথম শিক্ষক, পরিবার আমাদের প্রথম বিদ্যালয়। একসময় পরিবার ছিল ভালোবাসা, সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ এবং ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু। সন্তানরা মায়ের কোলে শিখত সততা, মমতা, ত্যাগ, আর বাবা-মা একসাথে শেখাতেন জীবনের মূল মূল্যবোধ। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, এই শিকড়গুলো ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আধুনিক সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে সম্পর্কগুলো ভেঙে পড়ছে, পরিবার হয়ে উঠছে কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক কাঠামো। অনেক পরিবারেই আর একসাথে বসে খাওয়ার প্রথা নেই, নেই গল্প শোনার বা গান শোনার উষ্ণ সন্ধ্যা। এক ছাদের নিচে থেকেও সবাই আলাদা হয়ে গেছে নিজ নিজ মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ আর সামাজিক মাধ্যমে। আজকের আধুনিক মায়েদের অনেকেই সামাজিক মাধ্যমের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় উড়ে বেড়ান। তাঁদের মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠছে ‘নিজেকে প্রদর্শন’, যেখানে সন্তান বা পরিবারের জায়গা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। পরিবারকে ঘিরে যে আত্মত্যাগ, যে নিবেদন ছিল, তা অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থ-কেন্দ্রিক জীবনযাপনের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, পৃথিবীর বহু সমাজেই পরিবার নামক প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধনকে আর প্রাধান্য দেওয়া হয় না; সেখানে সম্পর্কগুলো ভেঙে গেছে ক্ষুদ্র স্বার্থ, অহংকার, কিংবা অ-সহিষ্ণুতার কারণে। এর ফলেই আজকের পৃথিবী এত অশান্ত, এত ভঙ্গুর। সন্তানরা বড় হচ্ছে প্রযুক্তির ছায়ায়, কিন্তু পাচ্ছে না মায়ের আদরের উষ্ণতা কিংবা পরিবারের নিরাপদ আশ্রয়। ফলে আমরা এক প্রজন্মকে হারাচ্ছি, যারা জানে না ত্যাগের মানে, জানে না একে অপরের জন্য বাঁচার সুখ। এ এক মর্মান্তিক বাস্তবতা, যেখানে মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে, ততই হারাচ্ছে তার মানবিকতার মূল শিকড়—মা আর পরিবার।
 
যে ভারতীয় মায়ের সঙ্গে বেঙ্গরে দেখা হলো, তিনি যেন এই সত্যগুলোর জীবন্ত প্রতীক। তাঁর ভেতরে যেন সমগ্র মাতৃত্বের এক সুষমা, যা প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্ত থেকেই অনুভব করা যায়। তাঁর হাতে রন্ধনশিল্প এমন এক মায়াবী ক্ষমতা রাখে, যা সবাইকে এক টেবিলে এনে বসায়, আর সেই টেবিলে বসে শুধু আহার নয়, যেন ভালবাসা, প্রীতি আর ঐক্যের ভোজে অংশ নেওয়া যায়। তাঁর সেলাই শুধু কাপড়কে জোড়া লাগায় না, বরং ভাঙা সম্পর্ককেও এক অদৃশ্য সুতোয় গেঁথে ফেলে। কবিতা, গান, আবৃত্তি—প্রতিটি শিল্পরূপ তাঁর ভেতরে এমনভাবে মিশে আছে যে তাঁর কণ্ঠস্বরেই মানুষ প্রশান্তি খুঁজে পায়। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, বিশ্ব-রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি—সব বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ বসলে মনে হয়, তিনি যেন এক জীবন্ত পাঠশালা—যেখানে বইয়ের বাইরে থেকেও জীবনের পাঠ শেখা যায়, যে পাঠে থাকে মানবিকতার সারমর্ম। তিনদিন কেমন করে যে উড়ে গেল, টেরই পেলাম না। আমার বোনের দুটি ছেলে, কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, তিনদিনে কারও হাতে ছিল না মোবাইলের যন্ত্রণা, টিভি চলেনি এক ঘণ্টার বেশি। আধুনিক যন্ত্রের টান থেকে মুক্ত থেকে, আমরা যেন ফিরে গিয়েছিলাম পুরনো দিনের পারিবারিক জীবনে—যেখানে সময় কাটে একসাথে গল্পে, গানে, কবিতায়, হাসি-ঠাট্টায়। বোনের মায়ের রান্নায় যেমন ছিল প্রশান্তির ছোঁয়া, তেমনি তাঁর পরিবেশনে ছিল এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। রান্না শেষ হলে গান, কবিতা, গল্প। সব কিছুই চলত তাঁরই নেতৃত্বে, আর আমরা সবাই যেন আবার ছোটবেলার সেই পারিবারিক আসরে ফিরে গিয়েছিলাম। কি আশ্চর্য, কেমন করে তিনি আমাদের সবাইকে নিজের সন্তান আর পরিবারের মতো আগলে রেখেছিলেন—এ যেন এক অদৃশ্য জাদু, যা হয়তো তিনিও নিজে টের পাননি। বিদায়ের দিন তাই চোখ ছল ছল করছিলো নিজর অজান্তেই, হৃদয়ে জমল এক মধুর ব্যথা। মনে হচ্ছিল, আমরা শুধু একজন মানুষের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি না, বরং এক মাতৃত্বময় আশ্রয় থেকে সরে আসছি, যে আশ্রয় আমাদের তিনদিনের জন্য হলেও ভুলিয়ে দিয়েছিল আধুনিক জীবনের সমস্ত কোলাহল আর একাকীত্ব। কলকাতার হাওড়ার ঘরোয়া আঙিনায় বেড়ে ওঠা সেই মেয়েটি একদিন বিয়ে করে পাড়ি জমালেন দিল্লির অচেনা পথে। নিজের প্রিয় সংগীত আর উচ্চশিক্ষার স্বপ্নকে আড়াল করে তিনি বেছে নিলেন এক নতুন স্বপ্ন—একটি পরিবার গড়ে তোলার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিবার হয়ে উঠল তাঁর জীবনসাধনার কেন্দ্রবিন্দু। আর ধীরে ধীরে, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের বুননে তিনি নিজেকে রূপ দিলেন সেই পরিবারের মধ্যমণি—মা কার্ত্যায়নী।
 
তাঁর গান, তাঁর গল্প, তাঁর প্রজ্ঞা—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, এটাই তো সেই মা, যাকে আমরা সবাই খুঁজি। তাঁর প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি স্নেহাস্পর্শ যেন একেকটি আলো, যা ভেতরের অন্ধকার মুছে দিয়ে নতুন প্রাণ জাগায়। তাঁর উপস্থিতি আমাকে যেন গভীরভাবে মনে করিয়ে দিল যে মা কেবল একটি সম্পর্ক নয়; তিনি এক শক্তি, এক শক্তিশালী সত্তা, যা পরিবারকে এক-সূত্রে বাঁধে, ভাঙা সমাজকে টিকিয়ে রাখে, আর ভবিষ্যতের পথে আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়ায়। সেই শক্তি নীরব, অদৃশ্য, অথচ তার প্রভাব এত গভীর যে তার ছায়াতেই মানুষ শিখে নেয় ভালোবাসা, ত্যাগ আর ঐক্যের আসল অর্থ। মা মানে শুধু জন্মদাত্রী নন, তিনি মানে অদম্য প্রেরণা, ভরসার অবলম্বন, জীবনের প্রতিটি বিপদে দাঁড়িয়ে থাকা নির্ভরতার প্রতীক।
 
মা এবং পরিবার—এই দুটি শব্দই পারে পৃথিবীর সমস্ত অস্থিরতা, বিভাজন আর ভাঙন কাটিয়ে মানুষকে আবার টেনে নিয়ে যেতে শান্তি ও আশ্রয়ের চিরন্তন ছায়ায়। আজকের দিনে, যখন মানুষ সাফল্যের মোহে হারিয়ে যাচ্ছে, প্রতিযোগিতায় একে অপরকে ঠেলে দিচ্ছে পেছনে, আর সম্পর্কগুলো কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, তখন এই সত্যটিই আমাদের নতুন করে উপলব্ধি করতে হবে। কারণ প্রযুক্তি, অর্থ, খ্যাতি—এসব কিছুই শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারে না মানুষের হৃদয়ের প্রশান্তি। সেটি টিকিয়ে রাখে কেবল মা ও পরিবার। তাই আমাদের প্রত্যেকের জীবনে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে এই দুটি চিরন্তন সম্পদের মর্যাদা। পৃথিবী যত ভেঙেই যাক, যত অচলই হয়ে পড়ুক, আমরা যদি মা ও পরিবারকে আঁকড়ে ধরতে পারি, তবে নিশ্চয়ই মানবসভ্যতা আবারও আলোর পথে এগিয়ে যাবে। মা ও পরিবারই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, এবং এই সম্পদ হারানো মানেই মানবতার আলো হারানো।
 
পরিশেষে আমার মনের সমস্ত আবেগ এক বিন্দুতে এসে থামে—মা-ই হলেন আমার জীবনের আলো, আমার সাহস, আমার অস্তিত্বের মূলে দাঁড়িয়ে থাকা অবিনশ্বর শক্তি। যত দুঃখই আসুক, যত ঝড়ই বয়ে যাক, তাঁর স্নেহের ছায়া আমাকে আগলে রাখে, আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস যোগায়। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সাফল্য, সমস্ত সম্মান মিলেও মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সঙ্গে তুলনা হয় না। তাই তাঁকে ঘিরেই আমি লিখেছিলাম কয়েকটি পঙক্তি, যা আজও আমার হৃদয়ের গভীরে প্রতিধ্বনিত হয়, আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে মা-ই আসলে জীবনের চিরন্তন কবিতা—
 
“শূন্যের ভেতর যে বিশালতা
সহজ শব্দের মধ্যে যে এক মহাকাব্য
ছোট্ট উচ্চারণে যার চোখে শোভিত পৃথিবীর রূপ
সে আমার মা।”
এই কয়েকটি পঙ্‌ক্তিই আমার বিনম্র স্বীকৃতি—মা শুধু একজন মানুষ নন, তিনি হলেন জীবনের অন্তর্নিহিত কবিতার প্রতিমূর্তি, যাঁর ছায়াতেই আমরা খুঁজে পাই শান্তি, শক্তি আর ভবিষ্যতের পথচলার অনন্ত প্রেরণা।
 
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট