শ্রীচরণেষু দাদা: ১৪

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:০৯ মে ২০২৫, ০২:২৯ পিএম
শ্রীচরণেষু দাদা: ১৪

দিন কেটে যায় নিঃশব্দে, যেন বাতাসে ভেসে যাওয়া পাখির পালক। অরুণের জীবন থেকেও শহরের কোলাহলে হারিয়ে গেলো অনেকগুলো দিন—অগোচরে, নিঃশব্দে।

অরুণের কাছে মনে হয় এই সময় জাতীয় ব্যাপারটাই একটু অন্যরকম। যেন বাতাসে ভেসে চলা এক অদৃশ্য সুর—শোনা যায়, ধরা যায় না,  ক্লান্তি তার নেই, বিশ্রামু তার অধিকারেই নেই। অরুণের জীবনও যেন সেই সময়েরই অনুগত এক স্রোতস্বিনী নদী—প্রথমে দুরন্ত, বিক্ষুব্ধ, অচেনা ও আনচান। তারপর এক সময় সে নদী হয় শান্ত, ধীর, গভীর—সমঝদার এক প্রজ্ঞার প্রবাহ।

এই কয়েক সপ্তাহে ঢাকা শহরের গুলিস্তান-নবাবপুর এলাকা যেন হয়ে উঠেছে অরুণের জীবনের এক জাগ্রত চিত্রপট। অলিগলির প্রতিটি ইট-পাথরে আছে তার পায়ের স্পর্শ, প্রতিটি দোকানে তার চেনা হাসি। তার কণ্ঠস্বরের উষ্ণতা অনেকের কানে বাজে। পানওয়ালা হলেও সে কেবল একজন বিক্রেতা নয়—সে যেন এক আপনজন, এক মুহূর্তের বন্ধু। পথচলতি মানুষেরা শুধুই পান বা বিড়ি কিনতে আসে না, তাদের অনেকেই আসে একটুখানি হৃদয়ের সঙ্গ, জীবনের একটু উষ্ণ ছোঁয়া নিতে।

খুব বেশি দিন লাগেনি। এই সময়ের মধ্যেই অরুণ যেন দ্রুতই জীবন নামের কঠিন পাঠ্যটি রপ্ত করে ফেলেছে। সে বুঝে গেছে, চলার পথে যা কিছু প্রয়োজন, তাকে আপন করে নিতে হয় নিঃসংকোচে—বেছে নিতে হয় সাহস আর শ্রান্তিহীন পরিশ্রমকে সঙ্গী করে। সে বুঝে ফেলেছে, স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছাতে চাইলে অলসতার কোনো ঠাঁই নেই।

প্রতিদিনের পথচলাকে সহজ ও প্রাণবন্ত করতে হলে, প্রতিটি দিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে নিতে হয় জীবনের পাঠ। আর এই পাঠ অরুণ নেয় সতেজ মনোযোগে। আজ তার আঙুলে লেগে আছে পান-বিড়ি-সিগারেট বিক্রির নিখুঁত কৌশল—কোন সময় কোন পণ্য বেশি চলে, কার মুখে কেমন ভাষা বললে মন খুলে আসে, আর কার চোখে লুকিয়ে থাকে চাহিদার ইশারা—সবই যেন সে এখন অনুভব করতে পারে হৃদয়ের গভীর থেকে।

শহরের ফুটপাথ তাকে শিখিয়েছে, বিক্রির ভাষা কেবল পণ্যের নয়—এটা একধরনের মনস্তত্ত্ব, মানুষের মনের দরজায় কড়া নাড়ার জাদুর লাঠি।

আর তার ফল? আয়ও হচ্ছে ভালোই। যেন লক্ষ্মী স্বয়ং প্রতিদিন সন্ধেবেলা তার খুপরি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়—একগাল মায়াময় হাসি নিয়ে।

মাটির প্রদীপ যেমন আলো দেয় কোমল, নিঃশব্দ, তবু দীপ্ত—অরুণের জীবনেও ঠিক তেমন এক আশাবাদের আলো জ্বলে, নরম অথচ স্থির, নিঃশব্দ অথচ দৃঢ়।

ইদানীং সে বসে গুলিস্তানের এক পুরনো সিনেমা হলের পাশের রেস্টুরেন্টটির সামনে। জায়গাটি সে নিজেই খুঁজে নিয়েছে। এখানে মানুষের আসা-যাওয়া থামে না একটুও। সিনেমা দেখে বেরিয়ে আসা দর্শকদের চোখে-মুখে থাকে গল্পের রেশ, কেউ খাওয়া সেরে খোঁজে একটুকরো পান, কেউবা শুধু একটু দাঁড়ায় ক্লান্ত পায়ে। আশপাশের দোকানিদের মুখও তার চেনা, যেন এ জায়গাটা তার জীবনের এক অনিবার্য পরিসর হয়ে উঠেছে।

এই জায়গায় বসে অরুণ এক নীরব অভিনয় করে চলে। কখনো একটুখানি হাসে, কখনো চোখ রাখে চোখে—সুযোগ বুঝে মৃদু দুঃখে গাঢ় করে কণ্ঠস্বর:

“আজ নতুন মাল এনেছি ভাই, একবার দেখে যান।”

এইভাবেই গড়িয়ে চলে তার দিন। সূর্য নামে, আলো ফিকে হয়। এক সময় সন্ধ্যা হয়ে আসে। হয় বাড়ীমুখো…।

এমনি করে একদিন এক অপ্রত্যাশিত কান্ড ঘটে যায় রুণের জীবনে। অ্রত্যাশিত…

সেদিন গুলিস্তানের আকাশটা ছিল ধূসর সোনার মতো—রোদ ছিল, কিন্তু রঙহীন। গ্রীষ্মের কড়াচাপে দুপুরটা কেমন নির্জীব হয়ে পড়েছিল, যেন কেউ নিঃশব্দে তার প্রাণশক্তি চুষে নিয়েছে। রাস্তার ওপরে গলিত পিচের ঘ্রাণ, মানুষের ক্লান্ত পায়ে ধুলোর ঢেউ, আর আশেপাশের দোকানগুলোর টিনে পড়ে থাকা রোদ যেন ছাইরঙা হয়ে উঠেছিল। এই রকম এক বিষণ্ণ দুপুরে, অরুণ বসে আছে তার প্রতিদিনের ঠিকানা সেই রেস্টুরেন্টের সামনে, দেয়াল-ঘেঁষা এক কোণে।

গলায় পান-বিড়ি-সিগারেটের বাক্স ঝোলানো, পাশে ছেঁড়া চটের ব্যাগে কিছু হেয়ার ক্লিপ, প্লাস্টিকের খেলনা আর কয়েকটি ললিপপ।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এটিই অরুণের নির্দিষ্ট আসন—সিনেমা হলের পাশের সেই ব্যস্ত রেস্টুরেন্টের সামনের কোণ। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সে যেন দেখেছে শহরের মানুষের ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর অভ্যাসের অনবরত পালাবদল। রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে যারা বেরোয়, তাদের অনেকেই খোঁজ করে একখানা পান, কিংবা একটা সিগারেট। যেন খাওয়ার শেষে একটু প্রশান্তির আশ্রয় খোঁজে এই যুবকের হাতে।

এটা শুধু এলাকার সবচেয়ে বড় রেস্টুরেন্টই নয়, এক অর্থে একাধিক স্বপ্নেরও কেন্দ্র। ঢাকার নামজাদা হালিম, মাখা সবজি আর গরম পরোটা, আর সেই বিখ্যাত বিরিয়ানি—যার ঘ্রাণে অরুণের বুকের ভেতর কেমন হালকা কাঁপন ওঠে। কখনো কখনো সে দাঁড়িয়ে থাকে একটু দূরে, শুধু চোখে দেখে মানুষগুলো কেমন আয়েশে খায়, গল্প করে, হাসে।

তারও যে খেতে ইচ্ছে করে না, এমন নয়। ইচ্ছে করে—বড্ড বেশি। ইচ্ছে করে একদিন বিড়ি-সিগারেটের বাক্সটা রেখে আসবে কোণে, তারপর বাবুদের মতো টেবিলে বসে গরম ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানির পাশে ঠোঁট রাখবে ঠাণ্ডা পানির গ্লাসে। জীবনে কোনো দিন, কোনো সন্ধ্যায়ও সে পেটভরে ভাত খায়নি। তার কাছে বিরিয়ানির স্বাদ তো দূরের কথা, সে জানেই না এই ‘বিরিয়ানি’ জিনিসটা দেখতে কেমন।

খাবারের কথা উঠলেই মনটা উড়ে যায় বহু দূরে—তার শিকড়ের কাছে, গ্রামের সেই পুরনো ভাঙাচোরা কুটিরে। যেখানে মা চুলোয় রান্না করতেন, আর ছোট্ট অরুণ ভাতের হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবত, কবে পেটভরে একবেলা খেতে পারবে। এই শহরে এসেও সে অপেক্ষা করে আছে—না খাওয়ার নয়, সেই চিরচেনা আদর আর শান্তির স্বাদের জন্য।

অরুণ জানে, পড়ন্ত দুপুরের এই সময়টা বিক্রির জন্য আশীর্বাদের মতো—সূর্যের কোমল আলো আর মানুষের ক্লান্ত মন, দুটোই যেন তাকে ডাকে। কিন্তু আজ অরুণের চোখে ভিড় নেই, লেনদেন নেই, আছে এক ধরণের নরম অন্যমনস্কতা। ক্লান্ত নয় সে—বরং মুখে ফুটে উঠেছে এক প্রশান্ত আলো, যেন হৃদয়ের গহীনে বয়ে গেছে নীরব কোনো স্মৃতির হাওয়া।

তার চোখ হঠাৎ জীর্ণ পকেটটায় স্থির হয়। 

ডান হাতের দুই আঙুলে সাবধানে টেনে বের করে আনে একখানা চিঠি—পুরনো কাগজ। বহুবার খোলা ও ভাঁজ করা, যেন প্রতিবার খুললে জীবনের একটা অধ্যায় আরেকবার বেঁচে ওঠে।

এই চিঠির ভেতর লুকিয়ে আছে এক মুখ—মায়ের মুখ। যেটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভাঁজ খুললেই। সেই মুখে অশ্রু আছে, ভাষা নেই, ব্যথা আছে, তবু আশীর্বাদের মতো এক নিঃশব্দ মমতা ছড়িয়ে থাকে কাগজের প্রতিটি অক্ষরে।

কালির ছোঁয়া এখনও তাজা—যেন বাবা মায়ের ভাষাতেই লিখে দিয়েছেন সেদিনই। কিন্তু কাগজে জমে আছে সময়ের ধূলি, সংসারের ব্যস্ততা আর শহরের অবহেলার দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

এই একটি চিঠি—অরুণের জীবনের সবচেয়ে দামি সম্পদ। বিক্রির সময় ভুলে গেলেও, এই চিঠির কথা সে কখনো ভুলতে পারে না। কারণ এই কাগজেই সে নিজের শিকড় ছুঁতে পারে, মায়ের চোখে নিজের ছায়া দেখতে পায়। বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয় জীবনের ্রথম চিঠি-

প্রিয় অরুণ,

বাবা আমার,

অনেকদিন পর তোমার ছোঁয়া পেলাম—ডাকপিয়নের হাত থেকে যখন খামটা নিলাম, হাত কাঁপছিল। তুমি টাকা পাঠাইছিস—আমরা পেয়েছি। তোমার মা সেই টাকাগুলো কপালে ছুঁইয়ে একটা বাক্সে তুলে রেখেছে। মুখে বললো—‘এইডা আমার অরুণের পাঠানো প্রথম টেকা। এই টেকাতেই এবার ঘরে ধূপ জ্বালাইমু।’ আমি কিছু বলিনি, শুধু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভালোবাসা যখন মাটির মতো হয়, তখন শব্দ লাগে না—চোখেই পড়ে যায়, বুকে বাজে।

তুমি যা করছ ভালো করছ। মাথা উঁচু করে থাকবে—আমরা তোমার জন্য গর্ব করি। তোমার মা এখন আর কাঁদে না। হয়তো চোখের জল শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিদিন বিকেলে বারান্দার এক পাশে বসে থাকে। সূর্য ডোবে আর তোমার মা চেয়ে থাকে পথের দিকে—মুখে কিছু বলে না, কিন্তু আমি বুঝি—ওর কান অপেক্ষা করে তোমার পায়ের শব্দের জন্য।

মীনাক্ষী এখন বাড়িতে। তোমাদের কাকা নিজের হাতে তাকে গ্রামে নেয়ে এসেছেন। সে আর ওখানে থাকতে চায়নি। বলেছিল—‘আমি দাদার বাড়িতে থাকব। দাদা আমাকে আবার পড়াবে।’ এখন উঠোনে বসে তোমার আঁকা পুরনো ছবিগুলোর পাশে খেলে, আর মাঝে মাঝে মা'কে জিজ্ঞেস করে—‘দাদা কবে আসবে, মা?’ কখনো তোমার নাম ধরে ডাকে—'অরুণ দাদা!' 

সুবীর আর বিকাশ স্কুলে যাচ্ছে। তুমি সবার বড়ো। তুমি আগে শক্ত হও। তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আগের মতো কাজ করতে পারি না, হাত-পা কাঁপে। তবু ভোর হলে মনে হয়—তুমি সামনে এসে দাঁড়ালে সব কষ্ট থেমে যাবে। শুধু একবার তোমাকে দেখতে পারলে...

ঘর এখনও সেই আগের মতো। চাল দিয়ে বৃষ্টি পড়ে, গোলা ফাঁকা। স্বাধীনতা এসেছে দেশজুড়ে, কিন্তু আমাদের উঠোনে এখনও ভাতের গন্ধ খুবই কম। সপ্তাহে এক বলাও ভাত জুটে না। 

আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হয়। মনটা বাড়ীতে পড়ে থাকে। আমাদের জন্য না হোক তোমার মায়ের জন্য হলেও পারলে একবর বাড়ীতে আসবে।

একদিন হঠাৎ করেই উঠোনে তোমার পায়ের শব্দ যেন শুনতে পাই। দেখবে, তোমর মা দৌড়ে ছুটে আসবে, মীনাক্ষী খিলখিল করে উঠবে—‘দাদা এসেছে!’ তুমি ভাইবোনদের জড়িয়ে ধরবে, মা’র কোলের কাছে বসে বলবে—‘আমি ফিরেছি মা।’

আর আমি?

আমি দূরে দাঁড়িয়ে থাকব। কিছু বলব না। শুধু দেখব। হয়তো চোখে জল আসবে, কিন্তু আমি চুপ করে থাকব।

তোমার অপেক্ষায়,

তোমার হতভাগ্য বাবা

অরুণ আস্তে করে চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষনের জন্য চোখ যেন কাগজের ভাঁজে আটকে থাকে। তার মনে পড়ে বাবার মুখ। মায়ের শাড়ির আঁচল—যেটা চিঠি পড়ে ভিজে গেছে হয়তো। আর সেই ছোট উঠোন, যেখানে সাঁঝের বাতাসে শোনা যেত ভাইবোনদের কলরব, সন্ধ্যায় পাশের বাঁশ ঝাড় থেকে ভেসে আসতো খেক শিয়লের ডাক— আজ যেন সব কিছু স্তব্ধ । কেবল সেই চিঠির কাগজে তারা হয়তো বেঁচে আছে। অরুণের গলায় দলা পাকিয়ে উঠে কান্না। 

সেই মুহূর্তে, অরুণ বুঝে যায়—

জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিঠিগুলো আসলে কাগজে নয়, হৃদয়ের দেওয়ালে লেখা হয়। যা কখনো মুছে যায় না…।

পাশের রোদ তখন ফুটপাথে সরে এসেছে, গরম বাতাস আর ক্লান্ত হর্নের শব্দে শহর যেন একটু নড়েচড়ে বসেছে। তবু অরুণের বুকের ভেতর এক শীতল বাতাস বইতে থাকে—মাটির টান, রক্তের ডাক, আর এক অনিশ্চিত প্রতিশ্রুতির ভার। চিঠির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য যেন তার শরীরের ভেতর বেয়ে নামতে থাকে। মায়ের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা মুখ, মীনাক্ষীর কান্না-ভেজা চোখে “দাদা” ডাক, বাবার গলার কাঁপা কাঁপা স্বর— সব মিলে মনে হয়, এই গুলিস্তানের জনারণ্যের মাঝেও কেউ যেন তার নাম ধরে ডেকে উঠছে…।

অরুণ চিঠিটা ধীরে ভাঁজ করে বুক পকেটে রাখে। তারপর একটু সোজা হয়ে বসে পড়ে, যেন একটা অদৃশ্য ভার কাঁধে তুলে নিয়েছে সে। এই মুহূর্তে অরুণ আর শুধু একজন হকার নয়—সে একজন পুত্র, একজন ভাই, একজন ভবিষ্যৎ নির্মাতা।

ঠিক সেই মুহূর্তে হঠৎ করেই যেন দৃশ্যপট পালটে যায়। রেস্টুরেন্টের কাচের দরজা ঠেলে বাইরে আসে এক যুবক—চেহারায় তীক্ষ্ণ স্মার্টনেস, চোখে গাঢ় কালো ফ্রেমের চশমা, গড়নে লম্বা-চওড়া, যেন অনর্গল অনুশাসনের ছাপ। ঘন কালো চুল আর্মি কাটে ছাঁটা, মুখে পরিপাটি ও কঠোর ভাব। রংচাপা ত্বকে এক ধরনের রুক্ষ দীপ্তি, যেন আগুনে পুড়ে বেরিয়ে আসা ইস্পাত।

তাকে দেখামাত্রই মনে হয়—সে একজন সৈনিক, হয়তো গোপন মিশনের একজন যোদ্ধা, যার উপস্থিতিই বাতাসে এনে দেয় একরকম নিঃশব্দ ভয় ও শ্রদ্ধার মিশ্র প্রতিধ্বনি।

তার চোখ ঘোরে আশপাশে—একটু থেমে সে দাঁড়ায় অরুণের সামনে।

— “একটা সিগারেট দাও তো।”

অরুণ বাক্স খুলে এগিয়ে দেয়, তারপর পয়সা হাতে নিতে নিতে কৌতূহলী চোখে তাকায়।

যুবক হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে,

— “তোমার নাম কি?”

অরুণ কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলল,

— “নাম জানার দরকার নেই, ভাই। সিগারেট কেমন লাগছে সেটাই আসল কথা। একদম খাঁটি জিনিস—ফ্রেশ, নিখুঁত, কোনো ভেজাল-টেজাল নাই।"

যুবকটা হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল—একটা টানটান হাসি, যেন সে নিজেই কিছু গোপন মজা উপভোগ করছে।

— “আরে না রে ভাই, এসব কিছুই না।”

এই বলে সে পকেট থেকে একটা কালো রং এর লাইটার বের করল। টিপ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সিগারেটের মাথায় ছুঁইয়ে দিল। একটা দীর্ঘ টান—তারপর ধোঁয়ার একটা মেঘ ছাড়ল আকাশের দিকে, যেন ওড়ানো হল কোনো নীরব সংকেত।

“ভালোই তো… একেবারে খাঁটি মাল, কোনো ভেজাল নাই। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি লেখাপড়া জানা ছেলে, ভদ্র ঘরের। সেটা ধোঁয়ার ভেতর দিয়েও বোঝা যায়।”

নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে অরুণ। চোখেমুখে একরাশ দ্বিধা, কপালে হালকা ভাঁজ ফেলে একবার তাকায় লোকটার দিকে। এই ক'সপ্তাহে ঢাকার ধুলোমাখা রাজপথ, গলির মোড় আর মানুষের মুখোশে ঢাকা হাসি দেখে দেখে কিছুটা বোঝার ক্ষমতা তার হয়েছে। যারা এভাবে হঠাৎ করে কথা বলে, সাহায্যের হাত বাড়ায়, তারা বেশিরভাগ সময়েই চালাক। ধান্দাবাজি করে জীবিকা চালায়। মানুষকে ঠকানো যেন তাদের পেশা।

তবে এই লোকটাকে ঠিক সেরকম মনে হলো না। চোখে যেন একরকম নির্ভরতা আছে, মায়া আছে একধরনের।

— “তুমি কি লেখাপড়া করেছো?”—নরম স্বরে জানতে চায় লোকটা।

— “না ভাই, লেখাপড়ার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু মানুষ চিনতে শিখেছি।” —একটু থেমে জবাব দেয় অরুণ। ইচ্ছে করেই সে তার পেছনের গল্পটা তুলে ধরলো না।

— “তুমি কি কাজ করতে চাও? আমি তোমায় একটা ভালো কাজ দিতে পারি। থাকার ব্যবস্থাও করে দেব। এই পান-সিগারেট বেচা তোমার সঙ্গে যায় না।”

আচমকা এমন প্রস্তাব শুনে হতভম্ব হয়ে যায় অরুণ। কথার জবাব খুঁজে পায় না, চুপচাপ লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে—“এ কি বলছে! সত্যিই কি এসব সম্ভব?”

লোকটি একটু এগিয়ে আসে, যেন বন্ধুত্বের সুরে আরও আত্মীয়তা ছড়ায়।

— “আমি কায়সার। আমার বাবা হাজী রহিম উদ্দিন। মিটফোর্ডে আমাদের একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি আছে—‘রহিম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ’। অনেক লোক কাজ করে সেখানে। যদি সত্যি তুমি চাও, তাহলে কাল সকালেই চলে এসো। কাজ শিখে নিতে পারবে। শুরুতে গুদামে কাজ করবে। বোতল ধোয়ার কাজ, প্যাকিং এর কাজ। তারপর তোমার নিষ্ঠা, সততা আর পরিশ্রম বলে দেবে তুমি কতদূর যেতে পারো।”

অরুণ চুপ করে থাকে। তার মনে ঝড় বইছে।

এতক্ষণে যুবকটি পকেট থেকে একটি কার্ড বের করে অরুণের হাতে দিয়ে বলে—

— “এটা আমার কার্ড। কাল সকাল দশটার মধ্যে চলে এসো। আমি অফিসেই থাকবো।”

সাদা মোটা কাগজে ছাপা কার্ডে লেখা—

"রহিম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, মিটফোর্ড"

নিচে ছোট হরফে—

কায়সার রহমান, ডিরেক্টর (অপারেশন)

শেষে কায়সার কৌতূহলে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে,

— “তোমার নামটা তো এখনো জানা হলো না?”

এক নিঃশ্বাসে জমে থাকা বাতাস যেন হঠাৎ করেই বয়ে যায় অরুণের বুকের ভেতর দিয়ে।

অরুণ হালকা হাসে। এক চিলতে সূর্য যেন মুখে এসে পড়ে।

— “নাম অরুণ। শুধু অরুণ। আমি আসব।”

শব্দগুলো ধীরে ধীরে বাতাসে মিশে যায়, কিন্তু তার ভেতরে রয়ে যায় এক অপূর্ব কাঁপন। লোকটি একবার মাথা নাড়েন। তাঁর চোখে অদ্ভুত এক প্রশ্রয়। তারপর ধীরে ধীরে চলে যান, যেন এই ব্যস্ত শহরের কোলাহলের মধ্যেও কোনো নির্দিষ্ট রোদের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি।

অরুণ দাঁড়িয়ে থাকে। নীরব, স্থির।

চোখে একরাশ বিস্ময় আর বুকে এক ধরনের অচেনা আলো। তার হাতের পান-বিড়ির বাক্সটা আজ হঠাৎ করেই ভারহীন মনে হয়। যেন হাতের ওজন নয়, হৃদয়ের বোঝা হালকা হয়েছে। বিক্রি কেমন হলো, হিসেব মিলল কি না—এসব আজ আর জরুরি নয়। গনগনে শহরের একটানা দিনগুলোর মধ্যে আজ যেন কোথাও এক কোমল বাতাস লেগে গেল।

মনের ভেতর ঢেউ তুলতে শুরু করেছে কিছু নতুন অঙ্ক।

বাবার হাতের লেখা চিঠিগুলো মনে পড়ে—যেখানে প্রতিটি অক্ষরে ছিল প্রত্যাশা, প্রতীক্ষা। জীবনের দায়বদ্ধতা, শহরের রুক্ষ ইট-কাঠের গলি, আর প্রতিদিনের টিকে থাকার সংগ্রাম—

তার মধ্যেই হঠাৎ এক অচেনা উষ্ণতা এসে পড়ে।

সে অনুভব করে—এই বিশাল শহরের বুকেও হয়তো কোথাও তার জন্য একটু জায়গা রাখা আছে। একটি নতুন দিগন্ত তাকে হাতছানি দিচ্ছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা অরুণের মনে হঠাৎ করে যেন একটি কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়—

একটি প্রশ্ন, যেন খুব ধীরে, আত্মার গহিন থেকে উঠে আসে—

“তাহলে কি… সত্যিই আমার নতুন যাত্রা শুরু হতে চলেছে?”

এ প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা।

কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, অরুণ জানে—তার ভেতরে কিছু বদলে গেছে।

এখান থেকে সে আর আগের মানুষটি নয়।

সেই মুহূর্তে গুলিস্তানের আকাশে ধীরে ধীরে নামতে থাকে সন্ধ্যা। ট্রাফিকের গর্জন, মানুষের কণ্ঠস্বর, ভ্যাপসা গরমের হালকা বাতাস—সব একটু আধটু থেমে গিয়ে যেন শুনে নেয় অরুণের নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা।

সে পেছনে ফিরে তাকায় না, শুধুমাত্র সামনে তাকায়।

সামনের দিগন্তে সে দেখে না কোনো কারখানা, কোনো অফিস—সে দেখে ছোট্ট একটি উঠোন, ঘরে-ফেরা পায়ের শব্দ, মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে ফেলা এক ক্লান্ত ছেলে।

এক টুকরো হাওয়া তার গালে এসে লাগে। অরুণ বুঝে যায়—হাওয়া বদলাচ্ছে।

জীবন তাকে ডাকছে—নতুন নামে, নতুন পথে।

সে বাক্সটা হাতে তুলে নেয়, বুক পকেটে রাখা চিঠিটা একবার স্পর্শ করে, এবং এক নিঃশ্বাসে বলে ওঠে—

“আমি আসবো, মা।”

চলবে—

ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট