শ্রীচরণেষু দাদা: ১৮

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:২৫ জুন ২০২৫, ০১:১২ পিএম
শ্রীচরণেষু দাদা: ১৮

অরুণ কখনো কল্পনাও করেনি এমনটি ঘটে যাবে তার জীবনে। এই ধরনের ভাগ্য পরিবর্তনের খেলা তো শুধু সিনেমাতেই দেখা যায়।

পথ চলতে চলতে জীবন এমন এক মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, যেখানে প্রতিটি ধূলিকণাও সোনালি আলোয় ঝিকমিক করে। একদিন যেই জীবন ছিলো শুধুই বেঁচে থাকার লড়াই। একটানা ঘাম আর অভিমানের গন্ধে ভেজা। সেই জীবন আজ যেন ধীরে ধীরে খুলছে এক আশ্চর্য প্রভাতের পর্দা, শান্ত, দীপ্ত, অথচ গভীরভাবে অভাবনীয়।

হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে অরুণ আবার কাজে যোগ দেয়।  চারপাশের গুঞ্জন, ষড়যন্ত্র, ঈর্ষা, সবকিছুকে উপেক্ষা করে সে যেন আবারও নিজের ভিতর থেকে উঠে এসেছিলো ধীরে ধীরে। ভুলে গেলো  সব ষড়যন্ত্রের কথা। আর তাই হয়তো বিধাতা প্রসন্ন হয়ে এবার যে উপহার নিয়ে তার দরজায় দাঁড়ালেন, তা ছিল একেবারে অচেনা, অপ্রত্যাশিত, অমূল্য।

এবারের আলোটা অরুণের জীবনে যেন অন্যদিক থেকেই এলো। এই আলোর প্রবেশটা ছিলো এক পিতৃতুল্য স্নেহময় করুণার হাত ধরে।

এক পড়ন্ত সকালে, কায়সার সাহেব তাকে নিয়ে গেলেন তার বাবার কাছে। রহিম কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রীজ মালিক হাজী রহিম উদ্দিন সাহেবের কাছে। তিনি পুরাণ ঢাকার এক প্রখ্যাত ব্যবসায়ী, একজন অভিভাবক-সুলভ সৌম্য-প্রাণ মানুষ। তিনি অরুণকে দেখামাত্রই, তার চোখে এক গভীর মমতার ছায়া ফুটে উঠলো।

— “তোমার কথা অনেক শুনেছি, বাবা,” কণ্ঠে ছিল পিতৃ-স্নেহের ভার। “এই শহরে খুব কম মানুষই আছে যারা পরিশ্রম করে উঠে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু তোমার মধ্যে যে আগুন আছে, সেটা সহজে নেভার নয়। তোমাকে যারা ক্ষতি করতে চেয়েছিলো আল্লাহতায়ালা তাদেরকে কখনোই ক্ষমা করবেন ন। ওরা শাস্তি পাবেই। বলো, তুমি কেমন আছো এখন?”

-“ভালো, চাচা”-ক্ষীণ স্বরে অরুণ উত্তর দেয়।

তারপর...

কথাগুলো যেন বাতাসে স্থির হয়ে গেল। একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মতো ভরাট কণ্ঠে হাজী রহিম উদ্দিন সাহেব ধীরে ধীরে বললেন— “আমি মিটফোর্ড হাসপাতালের পাশে বাবুবাজারে নতুন তৈরি হওয়া একটি মেডিসিন মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় একটি দোকান কিনেছি... সব কাগজপত্র, দলিল, নামজারি—তোমার নামে। আজ চল, নিজ চোখে দেখবে দোকানটা।“ -তারপর দলিলগুলো অরুণের সামনে রেখে বলেন-“এখানে তোমাকে সাইন করতে হবে।“

মুহূর্তে বসার ঘরটি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শব্দ থেমে গেল। ঘড়ির কাঁটা যেন থমকে দাঁড়াল। অরুণ কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তার বুকের মধ্যে শুধু বাজতে লাগল এক অসমঞ্জস ধুকপুক,  না জানি ভুল শুনেছে কি না। না জানি এই মুহূর্তটা স্বপ্ন কিনা।

সে তাকিয়ে থাকল সেই মানুষটার চোখে, যিনি তার জন্য ঠিক যেন ঈশ্বরের পাঠানো এক দূত হয়ে এসেছেন।

তার ঠোঁট কাঁপছিলো। কোন কথা বেরোল না। সে শুধু ফিসফিস করে বলে উঠল—

“আমি?... আমি তো কিছুই নই... কেন আমাকে...?”

রহিম উদ্দিন সাহেব ধীরে হাতটা অরুণের কাঁধে রাখলেন। সেই স্পর্শে ছিল পিতৃ-স্নেহ, বিশ্বাস আর এক রকমের অদ্ভুত নির্ভরতা। তিনি বললেন—

“আজ থেকে তুমি নিজেই ব্যবসা করবে। তুমি আমার ছেলের মতো। তুমি হারিয়ে যাওয়া ছেলেদের একজন...যার স্বপ্নগুলো রক্ত আর ঘামে ভিজে আছে। আমি চাই না, এমন আরেকটি ছেলে শহরের রাস্তায় মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যাক। এ দোকান, এই উদ্যোগ—তোমার জন্য নয় শুধু, তোমার মতো আরও হাজার অরুণের প্রার্থনার জবাব। তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াবে, এটাই আমার পরম পাওয়া।“

এই কথা শোনার পর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না অরুণ। সে ঝুঁকে পড়ল রহিম সাহেবের পায়ের দিকে। তার চোখ থেকে নেমে এলো অশ্রুর ধারা। এ কান্না কোনো অপমানের নয়, কোনো যন্ত্রণার নয়, এ কান্না—পরিত্রাণের, স্বীকৃতির, ভালোবাসার।

কায়সার সাহেব এগিয়ে এসে বললেন—

“চল, আজ দেখা হোক সেই স্বপ্নের সঙ্গে, যেটা এতদিন তুমি শুধু চোখে দেখেছিলে... আজ ছুঁয়ে দেখবে।”

— “যাও, নতুন সূর্য তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের কারখানা থেকে সব ধরনের ঔষধ, মাল-পত্র নিবে। বিক্রি করে টাকা দেবে। তারপরেও যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয় লজ্জা পাবে না। অন্তত: কায়সারকে বলবে“-প্রশান্তির হাসি হেসে রহিম সাহেব অরুণকে আশীর্বাদ দিলেন।

দুপুর গড়িয়ে আসছিল। রোদটা তখন ঝিমিয়ে পড়েছে, ম্লান আলোয় পুরাণ ঢাকার অলিগলিগুলো আরও রহস্যময়, আরও প্রাচীন মনে হচ্ছিল। তারা পৌঁছায় বাবুবাজারে। এ অঞ্চল যেন শুধু একখণ্ড শহর নয়। এক জাদুকরী মঞ্চ—যেখানে শতাব্দীর গল্পেরা বাতাসে মিশে আছে, পুরনো দেয়ালের ফাটলে জমে আছে স্মৃতি, বেদনা, বিজয় আর বাঁচার আর্তি।

এক প্যাঁচালো, সরু গলি ধরে তারা এগিয়ে চলল। চারদিকে যেন ইতিহাসের শব্দ। ঘণ্টাধ্বনি, নওয়াবদের পদধ্বনি, ঘোড়ার টগবগ, আর দালান-কোঠার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা আজানের সুর। গলির দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানগুলো যেন সময়ের গায়ে দাগ কেটে রেখেছে। চামড়ার ব্যাগ, পুরনো কয়লা-চালিত ফ্যান, হাতে লেখা সাইনবোর্ড, কাঠের তাক ভর্তি রঙচটা ওষুধের শিশি।

এভাবে হাঁটতে হাঁটতে তারা হঠাৎ এসে দাঁড়াল এক ঝকঝকে নতুন মার্কেটের সামনে। যেন পুরাণ ঢাকার বুক চিরে নতুন সময়ের জন্ম হয়েছে। কাঁচঘেরা দোকান, ধাতব ছাউনি, চকচকে সাইনবোর্ড—“মডার্ন ফ্যাশন”, “প্রোগ্রেস ট্রেডার্স”—সব কিছু যেন এক নবযুগের আগমনী বার্তা। এই মার্কেটটি সদ্য গড়ে উঠেছে, আশপাশের কাঠ ও মাটির পুরনো দালানগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে যেন বলছে, “সময় বদলাচ্ছে।”

এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে তারা অনুভব করল, পুরাণ আর নতুনের দ্বন্দ্ব এখানে মুখোমুখি নয়—বরং পাশাপাশি অবস্থান করছে। একদিকে আছে স্মৃতির ধুলোমাখা পথ, অন্যদিকে সময়ের ছোঁয়ায় ঝলমল করে উঠছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অর্থনীতি, রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার ভেতরেও ঢাকার এই অংশে একধরনের জীবনীশক্তি ছিল। যা টিকে ছিল কোলাহল, খেটে খাওয়া মানুষের প্রাণ আর ক্ষুদ্র দোকানিদের বড় স্বপ্নে।

মেডিসিন মার্কেটের ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে দুতলায় এসে পৌঁছালেন। সিঁড়ির বা দিকের ছোট্ট দোকানটি সামনে দাঁড়ালেন।

অরুণের চোখে শুধুই বিস্ময়। হাজী সাহেব নিজ হাতে চাবি তুলে দিলেন অরুণকে,

— “এই দোকান এখন থেকে তোমার। খুলে দেখ, ভিতরটা।”

চাবির ঘূর্ণনে খোলা দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল এক রকম বিস্ময়ের রাজ্য। সব কিছুই নতুন—তাজা কাঠের তাক, গ্লাস কাউন্টার, মসৃণ মেঝে। অরুণ চুপ। ঠোঁট কাঁপছে। এক সময় নতমুখে বলল,

— “আমি কি করে আপনাদের ঋণ শোধ করবো, চাচা?”

রহিম সাহেব ধীরে মাথা নাড়লেন,

— “এই দোকান দিয়ে আমার কোনও ঋণ নেই, অরুণ। এটা হলো এক রকমের দায়িত্ব। যেমন এক তরতাজা গাছকে মাটি দিতে হয়। এখন থেকে তুমি শুধু সামনে এগিয়ে চলবে। তুমি খুব বড় হবে, অনেক বড়, আমি জানি।”

সেদিন থেকেই ‘রহিম কেমিক্যাল’ থেকে ওষুধ আসতে লাগল। বাকি হিসেবে, মাস শেষে বিক্রির টাকা জমা দিয়ে আসে। এই শহরে, যেখানে প্রতারণাই পুঁজি, সেখানে এই বিশ্বাস এক অমূল্য সম্পদ।

অরুণ প্রতিদিন সকালে দোকান খোলে। নিজেই ঝাঁট দেয়, ওষুধ গুছিয়ে রাখে, আর সন্ধ্যায় হিসেব লেখে খাতায়। ব্যবসা ধীরে ধীরে জমে উঠছে। আশেপাশের দোকানদাররা তাকিয়ে দেখে, এই ছেলেটা যেন অন্যরকম।

মাস খানেক পর দোকানের জন্য একজন ছেলে রাখে। দিন দিন ব্যবসা ভালোই চলছে। এখন পর্যন্ত রহিম চাচাদের বাড়ীর পাশের সে ঘরটিতেই আছে। 

“এইবার নিজের একটা ঠিকানা চাই...”- একদিন অরুণ গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। নিঃশব্দে নিজেকে প্রশ্ন করে—এই জীবনের ভার কি শুধু নিজেরই? ছোট ভাইবোনদের মানুষ করতে হবে, এ দায়িত্বও তারই। ধীরে ধীরে, একে একে তাদের ঢাকায় নিয়ে আসবে। শহরের আলো-হাওয়ায় গড়ে তুলবে তাদের ভবিষ্যৎ। যে স্বপ্ন তার নিজের জীবনে অপূর্ণ রয়ে গেছে, তা সে পূর্ণ হতে দেখবে ভাইবোনদের মাঝে।

তবে এই মহানগরের পথে একাকী চলা সহজ নয়। কোনো এক ভরসার আশ্রয় চাই এখন, যেখানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের পথ-রেখা আঁকা যাবে। প্রয়োজন একটি ঘর—নির্ভরতার একটি আশ্রয়, নিজের মতো করে বাঁচার একটি পরিসর।

ঠিক তখনই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু পরামর্শ দেয়, “আজিমপুরে খোঁজ নিস। ওদিকটায় এখনো ভাড়ার হাল কিছুটা সহনীয়, জায়গাটাও সুন্দর আর শান্ত।”

অরুণ খোঁজ নেয়, দেখে কথাটা মিথ্যে না। আজিমপুর জায়গাটাই উত্তম। পাশেই নিউ মার্কেট। সেই সময়কার নিউ মার্কেট একেবারে স্বপ্নের মতো। সন্ধ্যা নামলেই জ্বলে ওঠে লাল আর নীল আলোর শোভা। চারপাশে দোকান, মানুষের ভিড়, গলির ধারে বাদাম-ভাজা, গরম চা আর তরুণ বয়সের উন্মাদনা। নবাবপুর থাকতে ছুটির দিনে আসলাম আর তমালকে নিয়ে দুই তিনবার গিয়েছে। ঘুরে ঘুরে দেখেছিলো। বাদাম ভাঁজা খেতে খেতে কতোই না খুনসুটি করেছিলো তিন বন্ধু মিলে। বিড়িতে গভীর এক টান দিয়ে ধোঁয়াটাকে যেন আকাশে চিঠির মতো ভাসিয়ে দিত অরুণ। লম্বা ধোঁয়ার রেখা উপরের দিকে উঠে মিলিয়ে যেত অলক্ষ্যে। নবাবপুরে থাকতেই তার ধূমপানের অভ্যাসটা গেঁথে গিয়েছিল রক্তে, যেন ধোঁয়ার সাথে সাথে জীবনটাও একটু একটু করে নিঃসৃত হচ্ছিল। নবাবপুরের ভাঙা পাটাতন, হালকা ভেজা দেয়াল আর ব্যস্ত গলির কোণ। সব মিলিয়ে যেন ধোঁয়ার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল তার একান্ত নিঃসঙ্গতা। আসলাম আর তমালের সঙ্গ পেয়ে ধূমপানের এই নেশাটা যেন আরও স্বাভাবিক হয়ে উঠে। একা টান দেওয়ার যে অজানা লজ্জা, সেটা তাদের সঙ্গে থাকলেই কোথায় যেন উধাও হয়ে যেত। ওদের পাল্লায় পড়েই ধোঁয়ার সঙ্গে ভাব হয়ে যায় অরুণের।

তবে আজিমপুরের দুপুরগুলো এক অদ্ভুত নীরবতায় মোড়া। এখান সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। বাতাসে ভেসে থাকে এক নিস্তব্ধ, অথচ ভারী ঘুমঘুম ভাব। কিন্তু রাত নামলেই পরিবেশ বদলে যায়। বাতাসের ঘ্রাণে মিশে যায় ইতিহাসের এক চাপা দীর্ঘশ্বাস। যা কেবল অনুভব করা যায়, ব্যাখ্যা নয়।

এই এলাকাতেই দাঁড়িয়ে আছে দেশের প্রাচীনতম ও কিংবদন্তি-সম কবরস্থান। আজিমপুর গোরস্থান। বিশাল লোহার ফটক, যার গায়ে জমে থাকা সবুজ শ্যাওলায় সময়ের আঙুলের ছাপ। তার ভিতরে সারি সারি কবর, কিছুতে নাম লেখা ঘোলাটে পাথরে, কিছুতে শুধু নম্বর। কেউ ছিলেন সাধারণ দিনমজুর, কেউ হয়তো বয়ে বেড়িয়েছেন সাহেবি পদবী আর সম্মান। কেউ ঘামে ভিজিয়েছেন জীবন, কেউ রেখে গেছেন অস্পষ্ট, অথচ মর্মস্পর্শী গল্প।

রাতের আসল রূপ খুলে যায় যখন কেউ সেই গোরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যান একাকী। গা কেমন ছিম ছিম করে হিমেল হয়ে যায়। বাতাসটা হঠাৎ ভারী হয়ে আসে, চারিদিক ঠাণ্ডা হয়ে ওঠে। ঠিক তখন মন হবে কানের কাছে যেন কে আস্তে আস্তে  ফিসফিস করে কথা বলে। মাটির নিচ থেকে ভেসে আসে হাজারো কণ্ঠস্বর। যারা একদিন মানুষ ছিলো, এখন ইতিহাসের ছায়ায় পরিণত। তাদের কেউ কেউ যেন এখনও হাঁটে কবরের মাঝ দিয়ে, স্লেট-পাথরের নিচ থেকে চুপি চুপি বলেন—"আমরা এখানেই আছি।" বুকটা তখন ছাঁৎ করে উঠে এক অজানা আশংকায়।

গোরস্থানের ঠিক বিপরীতে, তিন নম্বর বিডিআর গেটের পাশ দিয়ে যে রাস্তা নিঃশব্দে গড়িয়ে গেছে পুরাণ ঢাকার বুকের দিকে, তার ডান পাশে এককালে ছিলো একটা অদ্ভুত পুকুর।  দিনের আলোয় তা নিছকই একটি জলাধার, কিন্তু সন্ধ্যার পর যেন জলের গায়ে লেগে থাকত ছায়ার কালি। পুকুরটা পুরোপুরি খোলা ছিল না—কিছু অংশে নিচু ইটের দেয়াল, যা ভেঙে পড়তে পড়তে যেন মাটি ও জলের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য সীমানা তৈরি করেছিল। প্রথমবার শুভ্র যখন ছোটকালে ঢাকায় আসে তখন এই পুকুরের পারেই ভাড়ায় সাইকেল চালিয়েছিলো কতো বার।

সেই পুকুরের সীমানার পাশেই, একটি খোলা মাঠের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল দুটি দীর্ঘ, একতলা দালান। টানা, নিঃশব্দ, ক্লান্ত দালান, যেন বহু পুরনো কথা চেপে বসে আছে দেয়াল-জুড়ে। ঘরগুলো ছোট, একেকটিতে মাত্র দুটো কামরা, টিনের ছাদ থেকে মাঝে মাঝে শোনা যেত টিনে বৃষ্টির মতো ইঁদুরের দৌড়ঝাঁপ। জানালাগুলো সাদামাটা, কাঠের পাল্লায় ছোপছোপ পুরনো রং, কিন্তু তার ফাঁক দিয়ে দেখা যেত একচিলতে নীল। জীবন শুরু করার মতো একটুখানি আকাশ।  

অরুণ এসে ঠাঁই নীল সেই ঘরগুলোর একটিতে। খুব বড় কিছু নয়। কিন্তু এতদিনের অস্থির ভ্রমণের শেষে, এই ঘরটিই হয়ে উঠলো তার প্রথম ঠিকানা, তার নিজস্ব একটি কোণ। এই ঘরটিতেই সে গড়তে শুরু করল নতুন এক স্বপ্নের ভিত্তি প্রস্তর।

বাড়ির মালিক একজন প্রভাবশালী, প্রতিষ্ঠিত মানুষ। একসময় তাঁর ছেলেমেয়েরা আমেরিকায় পড়াশোনা করত। আজ তারা সবাই দেশে ফিরে এসেছে। থাকেন এখানেই, পারিবারিক সেই বিশাল পাঁচতলা বাড়িটিতে। অরুণ শুনেছে মালিকের নাকি চৌদ্দজন ছেলে-মেয়ে। 

প্রতিদিন নিয়ম করে মালিকের গাড়ি এসে ঢোকে দুটি দালানের মাঝখানের সরু রাস্তা দিয়ে। টিনের ঘর আর পুরনো দেয়ালের ছায়া মাড়িয়ে গাড়িটি চলে যায় সোজা পেছনের দিকে—যেখানে ফুলগাছ দিয়ে সাজানো একটি সুন্দর লোহার গেটওয়ালা বাড়ি। বাড়িটি যেন অন্য এক জগতের ঠিকানা। চুপচাপ, ছিমছাম, আর সেই বাড়ির মধ্যেই বাস করে সম্পদের নীরব গর্ব।

আজিমপুরের এই সাদামাটা ভাড়া ঘরটাই  ধীরে ধীরে হয়ে উঠে অরুণের সবচেয়ে আপন।

কারণ এটাই তার “নিজের” প্রথম ঠিকানা।

ঘরের ভেতরটা নিঃসন্দেহে সাদামাটা, কিন্তু সেই সাদামাটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের নরম আশ্রয়। পুরনো কাঠের একটা খাট, খাটের একপাশে হালকা চিড়, তবুও দেহে দিনশেষের শান্তি আনে। পাশেই একটা পুরনো টেবিল—খুব মজবুত না হলেও, তার ওপর রাখা কেরোসিন ল্যাম্পটায় সন্ধ্যার আলো নেমে আসে নিঃশব্দে। পাটের দুটো মোড়া, আর এক কোণে ছোট্ট এক বুকশেলফ। এখনো ফাঁকা, কিন্তু ভবিষ্যতের আশা দিয়ে ভর্তি।

দেয়ালের এক কোণে টানানো ক্যালেন্ডারটা একটু কুঁচকে গেছে। 

এই নীরবতা অনেকের কাছে হয়তো বিষণ্ণতা, কিন্তু অরুণের কাছে তা এক নির্ভার সাহস। তার ভেতরে বেজে ওঠে এক ধরনের শব্দ। প্রত্যয়ের, পুনর্গঠনের, পারিবারিক দায়িত্বের। সে জানে, এই নীরব ঘরের মধ্যেই জন্ম নিচ্ছে এক অনিবার্য ভবিষ্যৎ।

একদিন রাত গভীর হলে সে বসে টেবিলের সামনে। কেরোসিন ল্যাম্পের আলোয় হাতে নেয় কলম, টেনে আনে চিঠির কাগজ। বাবাকে লিখছে—একটা চিঠি নয়, যেন নিজের অবস্থানের ঘোষণা।

“বাবা,

এখন আমি একটু স্থির হতে পেরেছি। প্রতিমাসে কিছু টাকা পাঠাতে পারছি তোমাদের জন্য। যাতে গ্রামে অন্তত ক্ষুধার মুখ কেউ না দেখে। এবার সুবীরকে আনতে চাই। ঢাকায় ভর্তি করাবো। জানি, ও পড়াশোনায় ভালো নয়। কিন্তু আমি ওকে নিয়ে বিশ্বাস হারাইনি। তারপর বোনটিকেও আনবো। একটা মেয়ে যেন নিজের স্বপ্নকে মাটিতে পুঁতে না রাখে। এই শহরের জীবন কঠিন, কাঁটার মতো। কিন্তু আমি ওদের পাশে থাকব। বুক চিতিয়ে। তুমি চিন্তা করো না। মাকে আমার প্রণাম দিও। মাস দুয়েকের মধ্যে গ্রামে আসবো।

তুমি শুধু আশীর্বাদ করো।”

চিঠি লেখার পর অনেকক্ষণ সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল।

কবরস্থানের অন্ধকারের দিকে চেয়ে ভাবল—

“ওই মৃত মানুষেরাও নিশ্চয়ই কোনোদিন বেঁচে থাকাকালে এমনই একটা চিঠি লিখেছিল, কোনো প্রিয়জনকে।”

তার বুকের ভেতরে তখন বেজে উঠছিল কেবল একটাই কথা—

"জীবনকে আর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেবো না। এবার ওকে ভিতরে নিয়ে এসে নতুন করে গড়ে তুলবো। আমার মতো করে, নিজের করে।"

সেই চিঠি যেন বাবার হৃদয়ে আলো জ্বেলে দিল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই অরুণ সুবীরকে নিয়ে এলো ঢাকায়। শহরের কোলাহলে নতুন এক শিশুর চোখের বিস্ময়। অরুণ নিজ হাতে তাকে স্কুলে ভর্তি করাল—একজন অভিভাবক হয়ে। পরের মাসে এলো ছোট বোনও। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ, চোখে ভয়-জড়ানো প্রশ্ন, কিন্তু ভাইয়ের মুখ দেখে সে জানে, এখানে আছে আশ্রয়।

সময়টা ছিলো ইংরেজি ১৯৭৪ সাল। দেশজুড়ে খাদ্যাভাব, রাজনৈতিক টানাপড়েন, মিছিল, শ্লোগান, অনিশ্চয়তার ছায়া। কিন্তু অরুণের ঘরে তার কিছুই ঢোকেনি। সেখানে ছিল শুধু এক সূর্যোদয়, এক নীরব নির্মাণ।

প্রতি সকালে সুবীর আর ছোট বোন স্কুলে যায়, বিকেলে ফিরে পড়ে। রাতে অরুণ দোকানের হিসেব দেখে আর তাদের পাশে বসে অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি শেখায়।

জীবনের এতগুলো অধ্যায় অতিক্রম করে এসে এখন সে বুঝতে পারে—উত্থান শুধু নিজে দাঁড়ানোর নাম নয়, বরং অন্যদের দাঁড় করানোর মধ্যেই লুকানো থাকে আসল জয়।

এক সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরছিল। রাস্তায় হালকা বাতাস, মাথার ওপর চাঁদ। আচমকাই তার পাশে এসে দাঁড়াল কায়সার সাহেব।

— “চল এক কাপ চা খাই, অনেকদিন একসাথে বসা হয় না।”

চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠতে উঠতে কায়সার বললেন,

— “জান, অরুণ বাবা তোমাকে কেন দোকান কিনে দিল?”

অরুণ চুপ।

— “কারণ, তিনি দেখেছিলেন, তোমার স্বপ্নগুলো কেবল সহানুভূতির ভিখারি নয়, দরকার ছিল এক শক্ত ভিত, যেখানে দাঁড়িয়ে তারা ডানা মেলতে পারবে। শুধু স্বপ্ন দেখলেই হয় না, অরুণ। স্বপ্নকে জাগিয়ে রাখার জন্য আশ্রয় লাগে, বিশ্বাস লাগে, আর লাগে এমন কিছু মানুষ যারা নিঃশব্দে আলো জ্বেলে রাখে অন্যের পথের জন্য। এই শহরটা যতই নিষ্ঠুর হোক, এখনো কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজের বুকের ভেতর আলো পুষে রাখেন। তারা জানেন কখন কাকে কতটুকু আলো দেখাতে হয়। আমার বাবা, তিনিও তাদেরই একজন। তিনি হয়তো বেশি কথা বলেন না, কিন্তু তোমার প্রতি তার মায়াটা অগাধ। ভয়ের ছায়া থাকে তার চোখে। পাছে না তোমার কোনো ক্ষতি হয়, পাছে না কোন ঝড় এসে তোমাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ঐ ঘটনাটা হওয়ার পর থেকেই বাবা তোমকে নিয়ে খুব ভাবতেন।

জানো, অরুণ, তিনি তোমাকে খুব ভালোবাসেন—ভেতর থেকে, নির্ভরতায় গড়া এক নিঃশব্দ ভালোবাসা। আর শাকিলা? সে তো ‘ভাইয়া ভাইয়া’বলতে বলতেই যেন তোমার ছায়ায় নিজেকে গড়ে নিচ্ছে। তোমার সাহস দেখে, তোমার লড়াই দেখে ওর চোখে নতুন আলো জ্বলেছে। এবার ওর পরীক্ষার ফল জানোই তো—ফার্স্ট হয়েছে! আর সেটা তোমার কারণেই। তুমি শুধু স্বপ্ন দেখো না, অন্যের স্বপ্নকেও রঙ দিয়ে সাঁজাতে জানো।“

অরুণ কিছু বলল না। কিন্তু তার চোখে ফুটে উঠল এক গভীর, শান্ত দীপ্তি, যেন ভেতরেই কেউ একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই শহরে সে এক নতুন জীবনের সূচনা করল। নিজের স্বপ্নে নয়, বরং পরিবারের অস্তিত্ব আর একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের জন্য। সে জানে, এ পথ এখনও অনেক লম্বা, অনেক বাঁক বাকি। সংগ্রাম থামেনি, থামবেও না। তবু আজকের এই মুহূর্ত, এক মাইলফলক হয়ে রইল তার জীবনের পথচলায়।

দোকানের দরজায় লেখা সেই নাম—

“অরুণ মেডিকেল হল”—

এটা শুধু একটা নাম নয়, এটা তার লড়াইয়ের সই। তার পরিবারের প্রতি প্রতিশ্রুতির ছাপ। আর সেই নামের নিচে গাঁথা হয়েছে এক গল্প, যেটা শুরু হয়েছিল এক হকারের ক্ষুধার্ত, ভাঙা স্যান্ডেল পায়ে হেঁটে চলা পথ থেকে।

আজ তা হয়ে উঠেছে আলোর গল্প—

স্বপ্ন যখন সত্যি হয়, তখন তার গায়ে থাকে ঘাম, থাকে ভালোবাসা আর এক নতুন পৃথিবীকে পাওয়ার অপেক্ষার গন্ধ।

চলবে—

ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট