তারা যেন বাঁচে- এক শিক্ষিকার অমর পাঠ


২১শে জুলাই ২০২৫। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস। রবিবার সূর্যের প্রতীক, এক আলোকিত দিন। স্পষ্টতা, নান্দনিক ভাবনার, আত্মজাগরন, আত্ম জিজ্ঞাসা, আর জীবনের মূলে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত দিন। সূর্য তখন মাথার উপর থকে কিছুটা নুইয়ে পড়ছিলো। আর ঢাকার ব্যস্ততম উত্তরা তখন দুপুরের আলোকের নিস্তব্ধতায় ডুবে। শহরের হালকা কোলাহল আর সূর্যতাপে চকচকে রাস্তা পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিয়া বাড়ী সংলগ্ন একটি স্বপ্নবোনা ভবন, মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ। প্রতিটি ক্লাসরুমে তখন চলছে শিশুমনের জগত গড়ে তোলার নিষ্ঠায় ভরা পাঠদান। কারও হাতে রঙ-তুলি—সে রঙের ছোঁয়ায় সাজাচ্ছে ছোট্ট কল্পনার রাজ্য, কেউ কবিতা মুখস্থ করছে ধীরে ধীরে, ছন্দের ভেতর খুঁজে নিচ্ছে অনুভবের রূপ, কেউ খাতায় টেনে দিচ্ছে সায়েন্স প্রজেক্টের ছক—যেন ভবিষ্যতের আবিষ্কারের প্রথম রেখা। আর কেউবা নিটোল হাসিতে, সহপাঠীর সঙ্গে হাততালি দিয়ে, মাথা ঘুরিয়ে ক্লাসের শেষ মুহূর্তের আনন্দে মশগুল—সবকিছু যেন এক নিঃশব্দ, সুরেলা সঙ্গীতে গাঁথা ছিল। যেন একটি সাধারণ দুপুর, কিন্তু তাতে ছিল শিশুমনের নির্ভরতা, নির্মলতা আর আনন্দের অদৃশ্য সুর, যেখানে প্রতিটি দৃষ্টি ভবিষ্যতের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, শান্তিতে। বারান্দা দিয়ে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে ধীরে, যেন প্রতিটি বইয়ের পাতার ওপর দিয়ে ভালোবাসার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শিশুরা তখনও জানে না, তাদের নির্ভরতার পৃথিবীতে ঠিক কতটা ক্ষিপ্রতা নিয়ে ধেয়ে আসছে এক বিভীষিকা।
তখন মাঠজুড়ে খেলায় মত্ত ছিল অনেকেই। বেশ কিছু ক্লাসের ছুটি হয়ে গেছে, শিশুরা বসে ছিল বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। কেউ কেউ বারান্দায় ছুটোছুটি করছিলো, যেন একটি শান্ত দুপুরের আনন্দধ্বনি ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারদিকে। হঠাৎ, প্রশিক্ষণে থাকা একটি যুদ্ধবিমান, যার উড়ার কথা ছিল সীমান্তের আকাশে, বিদ্যুৎ-বেগে ধেয়ে আসে এই নিরীহ শিক্ষাঙ্গনের বুকে। মুহূর্তেই ছন্দপতন ঘটে। কলম থেমে যায়, স্বপ্নের পাতা ছিঁড়ে পড়ে মাটিতে। বিস্ফোরণের ভয়াল শব্দ যেন শহরের বুক চিরে শান্তির কবিতাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সারা স্কুল থমকে দাঁড়ায়। ভবনের ভিতর আলো আর অন্ধকারের এক নীরব অথচ ভয়ানক লড়াই শুরু হয়। এক মুহূর্তেই আলোকিত শান্ত দুপুরটি রূপ নেয় এক অজানা দুঃস্বপ্নে। শিশুদের বোঝার মতো ভাষা নেই সেই মুহূর্তকে ব্যাখ্যা করার—তারা শুধু অনুভব করে এক অজানা ভয়, এক নিঃশব্দ কষ্ট, যা গিলে ফেলে তাদের ছোট ছোট বুকের সমস্ত নিষ্কলুষতা। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঢেকে ফেলে জানালা, ছড়িয়ে পড়ে পোড়া গন্ধ, আতঙ্কের ঘন ছায়া। কাঁচ ভেঙে পড়ে মেঝেতে, দেয়ালে ফুটে ওঠে আগুনের দাগ, আর ক্লাসরুমের নির্ভরতার পৃথিবী যেন এক নিমেষে হারিয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা কেউ দেয়ালের পাশে গা চেপে ধরে বসে, কেউ ব্যাগের ভেতর লুকোতে চায়, আর কেউ চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে মায়ের ডাক। শিশুরা দিশেহারা কান্না আর আতঙ্কে রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তগুলো কেবল জিজ্ঞাসা করে—“মা কোথায়?” ঠিক সেই মুহূর্তে, সেই ধোঁয়া-ছাওয়া বিভীষিকার ভিতরেই এগিয়ে আসেন এক নারী—মাহেরিন চৌধুরী। তিনি ছিলেন না কোনো সশস্ত্র রক্ষক, তাঁর হাতে ছিল না কোনো ঢাল, কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল সাহসে পূর্ণ, ভালোবাসায় সমৃদ্ধ। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিকা, একজন মা, একজন পথপ্রদর্শক, আর সেই ভয়াল দুপুরে তিনি ছিলেন সেই দিনটির একমাত্র আলোর উৎস। আগুনের মধ্যে থেকেও তাঁর চোখে ছিল শান্ত আভা, কণ্ঠে ছিল ভরসার প্রতিধ্বনি। তিনি বলেছিলেন, “ভয় পেয়ো না, আমি আছি”—এই বাক্য যেন শিশুরা মনে রেখেছে শেষ পর্যন্ত। পোড়া গায়ে, আঁচলে আগুন নিয়েই তিনি ফিরেছেন বারবার, একেকটা শিশুকে ধরে বের করে এনেছেন আগুনের কুয়ো থেকে। ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসা শরীর নিয়েও তিনি থামেননি। তাঁর নিজের প্রাণের বিনিময়ে বাঁচিয়ে গেছেন অন্তত বিশটি শিশুর প্রাণ। সেদিন তাঁর মুখে কোনো আহাজারি ছিল না, ছিল কেবল একটাই অনুরোধ—“তারা যেন বাঁচে।” সেই এক বাক্যে যেন তিনি লিখে গেছেন শিক্ষকতা মানে কি, আর ভালোবাসা কতটা নির্ভীক হতে পারে। মহেরিন চৌধুরী সেই দিন যে ইতিহাস রচনা করলেন, তা কোনো পাঠ্যবইয়ের পাতায় ধরা যাবে না, তা থাকবে আমাদের হৃদয়ে, সময়ের প্রহরে, মানবতার শিখরে।
এই ভয়াবহতার মধ্যেও তিনি ছিলেন স্থির, অটল, তাঁর মুখে ছিল ভরসার এক অদ্ভুত আভা, যেন মৃত্যুর মুখেও দাঁড়িয়ে তিনি আশ্বাস দিতে পারেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। কণ্ঠে ছিল স্নেহের প্রতিধ্বনি, এমন এক কোমল দৃঢ়তা, যা শিশুমনের ভয়ে কাঁপা হৃদয়ে এনে দেয় সাহসের আশ্রয়। আগুন তখন তাঁর কাপড়ে লেগে গেছে, চুল ঝলসে যাচ্ছে, দগ্ধ হচ্ছে শরীরের একের পর এক অংশ, কিন্তু থামার কোনো ইচ্ছা ছিল না তাঁর। প্রথমে একজন, তারপর আরেকজন, এমন করে করে একে একে বিশজনের অধিক শিশুকে তিনি বের করে আনলেন ধোঁয়া আর আগুনের জ্বলন্ত কুণ্ডলী পেরিয়ে। যাদের অনেকেই হতভম্ব হয়ে বসে ছিল বেঞ্চের নিচে, কেউ দেয়ালে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল—তাদের টেনে তুললেন, কাঁধে করে নিয়ে বের করলেন আগুনের ভেতর থেকে। ধীরে ধীরে তাঁর গতি কমতে লাগল, দেহ ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, শ্বাস ধরা পড়ছে, তবু তিনি ফিরছেন বারবার, কারণ তাঁর কাছে ছাত্রদের প্রাণই ছিল নিজের প্রাণের চেয়েও দামী। প্রতিটি পুড়ে যাওয়া কোষে যেন তিনি লিখে যাচ্ছিলেন ভালোবাসা আর কর্তব্যের অক্ষয় সংজ্ঞা—"আমি আছি তোমাদের জন্য।" শেষ মুহূর্তে, যখন তাঁর দেহ আর সাড়া দিচ্ছিল না, যখন চিকিৎসকেরা তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তখনও তাঁর ঠোঁটে একটিই বাক্য—“তারা যেন বাঁচে।” এই ছোট্ট অথচ অসীম বাক্যে তাঁর সমস্ত জীবনবোধ ফুটে ওঠে। এটি শুধু একজন শিক্ষকের শেষ কথা নয়, এটি এক জাতির বিবেককে জাগিয়ে তোলার মতো একটি ঘোষণা। একটি কণ্ঠ, একটি হৃদয়, একটি আত্মা, যা আগুনে পুড়েও নিভে যায়নি, বরং জ্বলে উঠেছে আরও উজ্জ্বল হয়ে। মহেরিন চৌধুরীর গল্প কোনো কিংবদন্তি নয়, এটি কোনো অলৌকিক গল্প নয়, বরং এক নির্জন দুপুরে বাস্তবতার মাটিতে লেখা এক জীবন্ত ইতিহাস, যা মানুষকে শেখায়, কীভাবে ভালোবাসা মানুষকে অমর করে তোলে। তিনি কোনো ভাষণে নন, কোনো জাতীয় পুরস্কারের ঘোষণায় নন, বরং সন্তান-সম শিশুদের মুখে, তাদের বেঁচে থাকায়, তাদের শ্বাসে-প্রশ্বাসে আজ ও চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তাঁর আত্মত্যাগ একদিনের সংবাদের শিরোনাম নয়, এটি সময়ের গায়ে খোদাই করে রাখা এক মানবিক প্রতিমা, যার ছায়া আজ আমাদের সকলকে ছুঁয়ে যায়।
আমার এক বন্ধু আমার এক পোস্টে মন্তব্য করেছেন—“দাদা, আমি আর পারছি না পড়তে… চোখে জল চলে আসে। এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য আর সহ্য হয় না। সৃষ্টি কর্তা আমাদের সহায় হোন।” সত্যিই তাই—এই যে এক ভয়াল, নিষ্ঠুর, মর্মান্তিক ঘটনা, যা ভাষাকে অক্ষম করে দেয়, হৃদয়কে নিঃশেষ করে দেয়। এক মা চোখে জল নিয়ে ছুটছেন, কান্না আর প্রার্থনার মাঝখানে তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেছে। সন্তানের সন্ধানে তিনি বারবার তাকান চারপাশে, যেন ধুলো আর ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উঠে আসবে তার প্রিয় মুখ। এক পিতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, বুকের ভেতর জ্বলছে অসহ্য এক দাবদাহ, যেন শোকে পাথর হয়ে যাওয়া মানুষটিই এখন আগুনে পুড়ছেন। এক ভাই, যার চোখের সামনে আগুনে দগ্ধ হচ্ছে তার বোন, তা দেখে বুকফাটা চিৎকারে আকাশ কেঁপে ওঠে। তার আর্তনাদ যেন বাতাস ছিঁড়ে ফেলে, যেন পুরো সৃষ্টিই থমকে দাঁড়ায় এক মুহূর্তে।
এই দৃশ্য কোনো কল্পকাহিনী নয়, এ এক বাস্তবের দুঃস্বপ্ন, যা কোনো মা-বাবার, কোনো ভাই-বোনের ভাগ্যে আসুক, সেটি কল্পনা করাও পাষাণ হৃদয়ের পক্ষে দুঃসাধ্য। এই বিভীষিকার মধ্যেও, নিজের জীবনের পরোয়া না করে, যেন দেবীর অবতারে উদ্ভাসিত হয়ে, এক মায়ের দৃঢ়তা ও সাহসে ছুটে এলেন এই মহীয়সী নারী।
মহেরিন চৌধুরী শুধু একজন ইংরেজি শিক্ষিকা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক অসীম মমতার প্রতীক, ছিলেন মা, ছিলেন বন্ধু, অভিভাবক, পথপ্রদর্শক। তিনি শুধুমাত্র তাঁর সাবজেক্ট পড়াননি, পড়িয়েছেন জীবনকে, বুঝিয়েছেন ভালোবাসার মানে, দায়িত্বের গভীরতা। তাঁর হৃদয়ের সীমা ছিল না কেবল তাঁর ক্লাসের ছাত্রছাত্রী পর্যন্ত, স্কুলের প্রতিটি শিশুই ছিল তাঁর সন্তানের মতোই প্রিয়। তাঁর স্বামী এক শোকাবেগ ভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, “ও বলত, ওর ছাত্রছাত্রীরাও আমার সন্তান”। এই একটি বাক্যেই ধরা পড়ে যায় একজন প্রকৃত শিক্ষকের সত্তা। এই হৃদয়-ভরা উচ্চারণ তাঁকে সাধারণ শিক্ষকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে নিয়ে যায় এক বিশাল মানবিক অবস্থানে, যেখানে মমতা, দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগ একাকার হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যু শুধু এক দুঃখজনক সংবাদ নয়, বরং এক জাতির বিবেকের দরজায় ধাক্কা দেওয়া বাস্তবতা। যে বাস্তবতা প্রশ্ন তোলে, আমাদের সমাজ কি এমন শিক্ষককে যথোচিত সম্মান দিতে পেরেছে?
পরিবার, সহকর্মী, শিক্ষার্থী, সবার কণ্ঠেই আজ একটাই কথা: এমন মানুষ কেউ দেখেনি। কেউ বলছে, তাঁর ক্লাসে কখনো ভয় পায়নি, বরং শ্রদ্ধায় জড়িয়ে থাকত, কেউ বলছে, জীবনের প্রতিকূলতায় তাঁর একটুখানি কথা ছিল বেঁচে থাকার সাহস। আর যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছে, তারা জানে—তিনি কখনো শুধু পেশাদার নন, ছিলেন নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষাকে ভালোবাসার এক অবিচল প্রতিমা। আজ নীলফামারীর সেই ছোট্ট গ্রাম গর্বে মাথা উঁচু করে আছে, কারণ সেই গ্রামের মেয়ে হয়েছেন অমর। শুধু জাতীয় শোক নয়, এটি হয়েছে এক গৌরবময় অধ্যায়—যেখানে মানবতা হারায়নি, বরং পেয়েছে এক প্রজ্বলিত চেহারা। তাঁর ব্যাগে পাওয়া গেছে অর্ধেক জ্বলে যাওয়া একটি খাতা, যেখানে লেখা ছিল এক ছাত্রীর কাঁচা হাতে আঁকা কবিতা—“ভবিষ্যতের জন্য লিখছি।” সেই কবিতা আর পূর্ণ হলো না, কিন্তু মাহেরিনের আত্মত্যাগ সেই অসমাপ্ত লাইনের শেষে এক দীপ্ত আলোর দাগ রেখে গেল। সেই আলোতে আজ ভবিষ্যৎ পথ খোঁজে, সাহস খোঁজে, ভালোবাসা খোঁজে। এই তো প্রকৃত শিক্ষক—যিনি শুধু পাঠ দেন না, নিজের জীবন দিয়েই শেখান বাঁচার পাঠ, ভালোবাসার পাঠ, মানুষ হওয়ার পাঠ। মহেরিন চৌধুরীর নাম তাই শুধু স্মৃতিতে নয়, আমাদের চেতনায়, আমাদের শিক্ষা দর্শনে চিরজাগরুক এক অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবেন।
এই একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে খুলে যায় এমন এক সত্য, যা আমরা আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায়, ভোগের নেশায়, প্রযুক্তির গর্জনে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম—শিক্ষক মানেই কেবল একজন পেশাদার নন, শিক্ষক হলেন এক জীবন্ত মূল্যবোধের প্রতীক। পাঠ্যবই শেখানো তাঁদের দায়িত্বের একটি অংশমাত্র। প্রকৃত শিক্ষা আসে তাঁদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, নিষ্কলুষ ভালোবাসা এবং নিঃস্বার্থ উৎসর্গের মধ্য দিয়ে। মহেরিন চৌধুরী সেই শিক্ষা দিয়েছিলেন—কলম রেখে, হাত দিয়ে নয়, জীবন দিয়ে। যখন আগুনে চারপাশ পুড়ছিল, মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দৌড়চ্ছিল, তখন তিনি নিজের শ্বাস দিয়ে শিশুদের ফুসফুসে ফিরিয়ে আনছিলেন বাতাস। এমন ত্যাগ আর মানবিকতা এই সময়ে বিরল, যেখানে মানুষ মানুষকে ভুলে গেছে, যেখানে সম্পর্কগুলো হয়ে উঠেছে স্বার্থপরতার লেনদেন। এই পৃথিবীতে, যেখানে শিক্ষকদের সম্মান এখন গৌণ, যেখানে তাঁদের বলা হয় ‘সার্ভিস প্রোভাইডার’, সেখানে মহেরিন চৌধুরী দাঁড়িয়ে গেলেন এক জীবন্ত উত্তরাধিকার হয়ে, প্রমাণ করে দিলেন, শিক্ষক মানে শুধুই ক্লাসরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বোর্ডে লেখা নয়, শিক্ষক মানে নিজের হৃদয়কে আগুনে সঁপে দিয়ে অন্যের ভবিষ্যৎ বাঁচানো।
তাঁর এই আত্মত্যাগ এক দিনের শোক হতে পারে না। এটি একটি জীবন্ত পাঠ, যা আগামী প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে সাহস কি, দায়িত্ব কি, ভালোবাসা কতটা গভীর হতে পারে। শিক্ষকতা কোনো চাকরি নয়, এটি আত্মার এক প্রতিজ্ঞা, যে প্রতিজ্ঞায় লেখা থাকে—“তোমাদের আমি কখনো একা ছাড়ব না।” এই মর্মস্পর্শী সত্যটিই মহেরিন চৌধুরী নতুন করে আমাদের সামনে উন্মোচন করলেন, এক জ্বলন্ত আলোয়। তিনি দেখিয়ে দিলেন, শিক্ষক মানেই এক অবিচল প্রতিরক্ষা, এক বিশ্বস্ত আশ্রয়, এক মানবিক আলো, যা বিপদের মধ্যেও নিভে যায় না। তাঁর নাম থাকবে শুধু পাঠ্যবইয়ে নয়, প্রতিটি শ্রদ্ধার জায়গায়, প্রতিটি মননশীল হৃদয়ে, এবং প্রতিটি শিক্ষকের প্রেরণার অন্তর্গত স্তম্ভ হয়ে। মহেরিন চৌধুরী আমাদের চোখে জল এনে শিখিয়ে গেছেন। শিক্ষক মানে একজন প্রাণদাতা, শিক্ষক মানে জীবন রক্ষারও প্রতিশ্রুতি। আজকের এই বিভ্রান্ত, ক্লান্ত ও অবিশ্বাসে ভরা সমাজে যদি কিছু জাগিয়ে তোলে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, তবে তা এক মহীয়সী শিক্ষকের আগুনে পোড়া কণ্ঠেই পাওয়া যাবে। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তাঁর নিঃশেষ কণ্ঠে ফুটে ওঠে একটিমাত্র আর্তি—"শিশুরা যেন বেঁচে থাকে”। এই একটি বাক্যই আজ আমাদের দিগভ্রান্ত মানবতাকে নতুন করে পথ দেখাতে পারে, যদি আমরা আবার মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা জানাতে শিখি—সেই মহান মানুষদের, যাঁরা একদিন chalk আর duster হাতে ভবিষ্যৎ গড়তে এসেছিলেন।
মহেরিন চৌধুরীর এই আত্মদানের কাহিনী আমাদের চেতনায় শুধু শোক নয়, এক অনির্বাণ আগুন জ্বেলে দিয়ে গেল, যে আগুনে আমরা যেন নতুন করে উপলব্ধি করতে পারি, শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি এক মহান ব্রত, মানবতার নিঃস্বার্থ সেবা। আজকের বিভ্রান্ত, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর সময়ের প্রেক্ষাপটে যখন সমাজ ক্রমশই শিক্ষকদের সম্মান ভুলে যাচ্ছে, তখন তাঁর মতো একজন নারীর আত্মত্যাগ আবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কারা সত্যিকার অর্থে আমাদের সভ্যতা রচনা করে যান। স্কুলের নিষ্পাপ শিশুদের বাঁচাতে তিনি যেভাবে নিজেকে উৎসর্গ করলেন, তা শুধু সাহস নয়, মানবিকতার শিখর। আমরা যে সময়টায় বসবাস করছি, যেখানে ভালোবাসা মাপা হয় সুযোগ আর সুবিধার পাল্লায়, যেখানে কর্তব্য মানে কেবল দায়িত্ব শেষ করে ফেলা, সেখানে একজন শিক্ষিকা তাঁর প্রতিটি পুড়ে যাওয়া কোষে লিখে গেলেন ভালোবাসার শুদ্ধতম ব্যাখ্যা—“আমি আছি তোমাদের জন্য।” সেই উপস্থিতি আজ নেই, কিন্তু সেই অস্তিত্ব আজ আমাদের বিবেকের অদৃশ্য আয়নায় গভীরভাবে প্রতিফলিত। সত্যিকারের শিক্ষক তো সেই, যিনি শিশুদের কেবল পঠন-পাঠন শেখান না—যিনি তাঁদের জীবনের প্রতিটি বিপদের সামনে হয়ে ওঠেন এক বুক ভরসা, এক ছায়াময় নিরাপত্তা, এক নির্ভীক আশ্বাস।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক কালে লিখেছিলেন:
“যাহারা তোমার বিষাদ ঘন সাঁঝে
নিশীথে নিঃশব্দে জাগে,
তাহাদের তুমি চেন না।”
হ্যাঁ, আমরা মহেরিন চৌধুরীর মতো শিক্ষককে চিনিনি, হয়তো চিনতেও পারতাম না, যদি না আগুন তাঁর আত্মাকে অমর করে তুলত। আজ, আমাদের দায়িত্ব, তাঁকে মনে রাখা, কণ্ঠে নয়, কাজে; চোখে জল নয়, শিক্ষকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায়। যদি এক মহীয়সীর আত্মত্যাগ সমাজকে নাড়িয়ে দিতে পারে, তবে সেটাই হোক আমাদের নতুন দিগন্ত, যেখানে প্রত্যেক শিক্ষককে দেখা হবে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে, ভালোবাসার সুরে। ভবিষ্যতের প্রতিটি শিশুর নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত হবে, যখন আমরা শিক্ষকতার আদর্শকে শুধু পাঠশালায় নয়, নিজেদের জীবন-চর্চার অংশ করে তুলতে পারব। মহেরিন চৌধুরী আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়ে গেলেন—একজন শিক্ষক কোনোদিন হারিয়ে যান না, যদি আমরা তাঁকে মনে রাখতে শিখি।
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট