শ্রীচরণেষু দাদা: ১৭

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:১৪ জুন ২০২৫, ০৭:৪৪ পিএম
শ্রীচরণেষু দাদা: ১৭

অরুণ এগিয়ে চলেছে। অদম্য দৃঢ়তায়, অনন্ত পথের অভিযাত্রী হয়ে।

 

সে যেন এক দুর্বিনীত সৈনিক। সমস্ত ঝড়-ঝঞ্জা, বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে সাহসিকতায় পা ফেলে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। তার চলার পথটি যেন এক বহতা নদীর মতো। অবিরাম, অবিচল, অপরিকল্পিত নয়। বরং সুসংবদ্ধ ও শক্তিশালী।

আজ অরুণের কাজের উন্নতি আর কেবল চোখে পড়ার মতো নয়। এই কারখানার অনেকের কাছে এখন সে হয়ে উঠেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, বিস্ময়ের অনুপ্রেরণা।

 

প্রায় ছয় মাস ধরে এখানে সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। অনেকেই প্রথম দিকে অরুণকে কোন গুরুত্ব দিতো না। এখন সময় পাল্টিয়েছে। এখন অরুণ হয়ে উঠেছে কারখানার প্রতিটি শাখায় এক নির্ভরতার প্রতিচ্ছবি। সকলের মধ্যমণি, ভালোবাসার পাত্র। তার চলাফেরা নীরব, ছায়ার মতো। কারও চোখে পড়ে না কখন সে কারখানায় আসে, কখন আবার কাজ শেষে চলে যায়। কিন্তু কারখানার প্রতিটি ইউনিটে, প্রতিটি কাজের মধ্যে রয়েছে তার  নিখুঁত দৃষ্টিভঙ্গি, শৃঙ্খলা আর মমতার ছোঁয়া। আর তাই সব কিছু চলছে এক ছন্দের তালে, বেশ পরিপাটি।

 

খুব শান্ত স্বভাবের অরুণ। রাগ যেন তার মধ্যে নেই। কেউ ভুল করলেও অরুণ তাদের ওপর চড়াও হয় না। শুধু তার উপস্থিতি অনুভব করা যায় যখন যন্ত্রের শব্দ থেমে যায়। বোতলের সারি যখন সোজা হয়ে যায়, বা কোনো জটলা হঠাৎ যখন থেমে যায়।

অরুণ কারো কাছে উচ্চকণ্ঠে কিছু দাবি করে না। তার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন এক অদৃশ্য ভার—দায়িত্ব, নিষ্ঠা, আর নিজেকে প্রমাণ করার এক অন্তরাল যুদ্ধ।

 

এই কারখানায় আসার পর থেকেই তার কাজ আর কায়সার সাহেবের মানবিক আন্তরিকতা, ভালোবাসা তাকে শুধু বদলেই দেয়নি, বরং তার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে এক নীরব দীপ্তি। অরুণের চোখে এখন শুধুই বাঁচার আকুতি নয়, বরং সে এখন দেখে এক নির্মাণশীল ভবিষ্যতের স্বপ্ন,। এই স্বপ্নকে সে গড়ে তুলছে প্রতিটি দিন, প্রতিটি দায়িত্বের মধ্য দিয়ে।

 

এক সকালে, কারখানায় আসার আগে শাকিলাকে নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দেয় অরুণ। যদিও গাড়ীতে করেই সব সময় যায়। তবে ইদানীং কেউ না কেউ বাড়ন্ত মেয়ে শাকিলার সাথে যায়। মাঝে মধ্যে অরুণ নিয়ে যায়। পথ চলতে চলতে হঠাৎ তার চোখে পড়ে—মেয়েটির চোখে জমে আছে একরাশ অন্যমনস্কতা, যেন ছোট্ট কপালের কোণে চিন্তার নিঃশব্দ ভাঁজ। চুপ চাপ গাড়ীতে অরুণের পাশে বসে আছে। জানালা দিয়ে বাইরে স্থির তাকিয়ে আছে। এক মনে যেন কিছু ভাবছে।

অরুণ চোখ তুলে তাকাল। কিশোরীর মুখে অস্বাভাবিক এক গাম্ভীর্য।

— “কিছু বলবেন না, শাকিলা? আজ আপনার মুখে এতটা থমথমে ভাব কেন? কিছু ভাবছেন?”

শাকিলা ধীরে মুখ সরিয়ে অরুণের দিকে তাকায়। তারপর মুখ নামিয়ে নরম কণ্ঠে বলে,

— “ভাইয়া... কাল থেকে আমার পরীক্ষা শুরু। গতকাল বিকেলে টিউটর পাটিগণিত পড়িয়েছেন, কিন্তু কিছুই ঠিকঠাক বুঝিনি। মনটা খারাপ লাগছে।”

অরুণ হেসে বললেন,

— “একবার খাতাটা দেখাবেন?”

শাকিলা ,পাশে রাখা ব্যাগটি খুলে খাতাটি এগিয়ে দিলেন। অরুণ তা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। এরপর হালকা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,

— “এখানে টিউটর ভুলটা করেছেন। এই অঙ্কটা গুণের নিয়মে হবে, ভাগে নয়।”

তারপর পকেট থেকে কলম বের করে কোলের উপর খাতাটি রেখে সহজ ভাষায় অঙ্কটা ধাপে ধাপে বুঝিয়ে দিলেন—যেন তিনি কোনো অভিজ্ঞ শিক্ষক, শাকিলা তাঁর প্রিয় ছাত্রী।

শাকিলা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। এমন সহজভাবে আগে তাকে কেউ পাটিগণিত বুঝিয়ে দেয়নি। তার পর আরো দুটি অঙ্ক বুঝিয়ে দেয় অরুণ।

 

 শাকিলা বাকরুদ্ধ। কি করে এটা সম্ভব? এক সময় শাকিলা চুপচাপ বললেন,

— “ভাইয়া... আপনি তো কারখানায় কাজ করেন... আপনি এই সব জানেন কীভাবে? আমিতো জানতাম, আপনি কোন লেখা পড়া জানেন না।”

তার কণ্ঠে ছিল অবাক হওয়া শ্রদ্ধা, আর চোখে—এক নতুন উপলব্ধির জন্ম।

অরুণ শুধু মৃদু হেসে বললেন,

— “এক সময় জানতাম… সবই জানতাম। আজও ভুলিনি কিছু। কেবল হারিয়ে ফেলেছিলাম… মানুষ যেমন হারায়। এমন এক সময় জীবনে আসে যখন হারানোর চেয়ে বেঁচে থাকাটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়।”

শাকিলা কিছু বললেন না। তবু তাঁর চোখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত প্রশ্নচিহ্ন। এক তরুণ, যাকে এতদিন শুধু কারখানার কর্মী ভেবেছেন, তাঁর ভিতরে এমন কি আছে, যা এত সহজে অঙ্কের নিয়মের ভুল ধরতে পারে? কথার মধ্যেও কি সুন্দরতা! কি গুছিয়ে কথাগুলো বলে।

বাড়ীতে ফিরেই ব্যাপারটা মাকে বলে। বাবাও ছিলো বসার ঘরে। শাকিলা পুরো ঘটনাটাই কোনোরকম বাড়াবাড়ি ছাড়াই বলে যায়। তবে কণ্ঠ ছিলো এক নিঃশব্দ বিস্ময়। এ বিস্ময় হয়তো শাকিলার মনের ভেতর জন্ম নিয়েছে অরুণের মধ্যে হঠাৎ নতুন কিছু দেখতে পেয়ে।

মা ও বাবা দুজনেই বেশ মনোযোগ দিয়ে ঘটনাটা শুনলেন। তারপর বাবা আলতো করে বললেন,

— “কি অদ্ভুত ব্যাপারতো! শুনেছিলাম ছেলেটা কোন পড়াশুনা করেনি।“

কথা প্রসঙ্গে একদিন ছেলে কায়সারকে এই ব্যাপারটি বললেন শাকিলার বাবা। সব শুনে কায়সার অবাক হয়ে গেলেন কিছুক্ষণ। চোখে যেন জমে উঠল অভিজ্ঞতা আর সংশয়ের কুয়াশা।অবশেষে ধীরে, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

— “ছেলেটা কে, তা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি, আব্বা। তবে ছেলেটির মধ্যে যে কিছু একটা আছে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।  কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, কোন কারনে সে লুকিয়ে রেখেছে নিজের একটা পৃথিবী। এমন কিছু, যা সে প্রকাশ করতে চায়না... হয়তো সাহস পায়নি।”

কায়সারের কণ্ঠে এক ধরনের ভরসা মিশে ছিল। যা কোনো কর্মীর জন্য নয়, একজন মানুষের ভেতরের সম্ভাবনার জন্য।

তার কিছুদিন পরের আরেকটি ঘটনা।

দিনটি ছিল কারখানার ছুটি। বিকেলটা নীরব। কারখানার ধুলোমাখা চাতালে তখন আর কোনো শব্দ নেই—নেই মেশিনের গর্জন, শ্রমিকদের হাঁকডাক কিংবা বোতলের কাঁচের ঝংকার।

অরুণ নিজের ঘরে একা। এই একটা দিন অরুণ ঘরেই থাকার চেষ্টা করে। সেইদিন জানালার পাশে বসে ভাবছিল অনেক কিছু। এক সময় বসা থেকে উঠে চকির নীচে রাখা টিনের বাক্সটা  ধীরে ধীরে বের করে আনলো। একটি পুরনো বড়ো এনভেলাপ থেকে মেট্রিক আর কলেজের সার্টিফিকেটগুলো বেড় করলো। সাথে পলিটেকনিকের প্রথম বর্ষের মার্কশিটগুলোও ছিলো। ভালো করে কাগজগুলো দুহাতে দেখছিলো। প্রতিটি কাগজের ভাঁজে যেন ছিল তার অতীতের পায়ের শব্দ। টিনের বাক্সে  এগুলো বহু বছর চাপা পড়ে আছে রাস্তাঘাট, পরিত্যক্ত স্বপ্ন আর জীবনের দায়ে।

অনেকক্ষণ ধরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কাগজগুলোর দিকে। সেই সব স্বপ্ন, যেগুলো এক সময় অরুণের বুক থেকে উঠে এসেছিল কাঁপা কাঁপা হাতের ছোঁয়ায়। তারপর হঠাৎ যেন সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো…

চোখের সামনে বাস্তব আর স্মৃতির সীমা মিলেমিশে এক কুয়াশার পর্দা টেনে দিল।

নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। কোনো শব্দ ছিল না, শুধু ভারী হয়ে উঠছিল বাতাস…একটি একটি করে কাগজ ছিঁড়ে ফেলতে লাগলো অরুণ, যেন নিজের বুকের পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলছে—প্রত্যেকটি ছেঁড়া টুকরো যেন এক একটি অসমাপ্ত আহ্বান।

জানালার বাইরে ছুঁড়ে দিল কাগজগুলো, যেন পৃথিবীকে জানিয়ে দিচ্ছে: "আমি আর স্বপ্ন দেখবো না।" তারপর সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। এই কান্না কোনো লজ্জার নয়, নয় কোনো আত্মদোহী দুর্বলতার প্রকাশ। এ কান্না এক দীর্ঘশ্বাসের মতো—যেন হারিয়ে যাওয়া সময়ের সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ। যার জীবন, কেবল সময়ের অভাবে, অসমাপ্ত থেকে গেল…একটি উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠার মতো, যেখানে আর কখনো শব্দ লেখা হবে না।

দরজাটা তখন খানিকটা খোলা ছিল।

সন্ধ্যার নরম আলোয় করিডোরে ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন কায়সার সাহেব। হঠাৎই তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল সেই ঘরের ভিতর।

অরুণের কান্নার ক্ষীণ শব্দ যেন বাতাস কেঁপে এনে দিল তাঁর কানে। চোখ রাখলেন জানালার দিকে। দেখলেন, একের পর এক কাগজের টুকরো অরুণ ছুঁড়ে দিচ্ছে বাইরে, যেন কোনো অতল যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা। কায়সার সাহেব চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনো প্রশ্ন করলেন না, কোনো সান্ত্বনার ভাষাও খুঁজলেন না। শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ।

সে দৃষ্টিতে ছিল না কোনো কৌতূহল বা বিস্ময়—ছিল এক গভীর উপলব্ধি, এক নিঃশব্দ স্বীকৃতি। এতদিন যাকে নিজের ছায়ার নিচে রেখে ভেবেছিলেন শুধুই এক সহজ-সরল তরুণ, আজ বুঝলেন—সে এক জ্বলন্ত সম্ভাবনার শিখা, যার দহন একান্তই নিজের ভেতরের, একা... নিঃশব্দে।

সেই সন্ধ্যার আলোয় অরুণ জানত না, কেউ তার অতীত দেখে ফেলেছে। কিন্তু সময় ঠিক নিজের পথ বেছে নেয়। কারণ পরদিন সকালেই, কায়সার সাহেব অফিসে ডেকে পাঠালেন অরুণকে।

অরুণ ধীর পায়ে উঠলেন সিঁড়ি বেয়ে। বুকের ভেতরে ধুকপুক শব্দ, মনে হচ্ছিল, যেন কেউ ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে কোনো বহু পুরনো তালা। হয়তো ভুল কিছু হয়েছে, হয়তো কোনো অনিচ্ছাকৃত অসাবধানতা।

অফিস ঘরের ভেতর ঢোকার পর অরুণ দেখল, কায়সার সাহেব চুপচাপ বসে আছেন জানালার পাশে। তার পেছনে ঝুলছে সূর্যের আলোয় ধুয়ে যাওয়া এক পুরনো মানচিত্র, যা হয়তো এই প্রতিষ্ঠানের সীমানা নির্ধারণ করে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সে মানচিত্রে এখন অরুণের জীবনের রেখাও আঁকা হতে চলেছে।

কায়সার সাহেব ধীরে মুখ তুললেন। চোখে কোনও রাগ নেই, কিন্তু এমন এক গভীরতা, যা চোখের ভিতর ডুবে যেতে বাধ্য করে।

একটি সাদা খাম টেবিলের উপর রাখা ছিল।

— “বসো অরুণ।”

অরুণ চুপচাপ বসল।

কায়সার সাহেব কিছুক্ষণ খামটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর কণ্ঠে আশ্চর্য প্রশান্তি এনে বললেন—

— “এই কাগজগুলো যদি গতকাল না দেখতাম, হয়তো আমি কখনো জানতে পারতাম না তুমি আসলে কে।”

তিনি খামের ভেতর থেকে অরুণের ছেড়া সার্টিফিকেট আর মার্কশিটগুলো বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন।

 

“তুমি কেন বলেছিলে তুমি লেখাপড়া করো নি?”

অরুণ কিছুই বলছে না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে।

কায়সার সাহেব আবার মুখখুললেন— “তুমি তো কারখানার সুপারভাইজার, কিন্তু এই কাগজগুলো বলছে, তুমি শুধু শ্রমিক নও। তুমি একদিন ছিলে একজন শিক্ষার্থী, একজন স্বপ্ন দেখার মানুষ। এমন কেউ, যার ভিতর থেকে উঠে আসা আলোর প্রবাহ সময়ের কাছে থেমে যায়নি—শুধু চাপা পড়ে গিয়েছিল।”

অরুণ কিছু বলতে পারল না। তার ঠোঁট কাঁপছিল। বুকের ভেতরে ঝড়—কিন্তু বাইরে সম্পূর্ণ স্তব্ধতা।

— “তুমি নিশ্চয়ই জানতে না, আমি বহুদিন অ্যাকাউন্টস বিভাগের জন্য এমন কাউকে খুঁজছিলাম যে শুধু অঙ্ক জানে না, দায়িত্বও বোঝে। আজ বুঝলাম, তোমার চেয়ে যোগ্য কেউ এই অফিসে নেই।”

তিনি হাত বাড়িয়ে খামের ভেতর থেকে একটি নিয়োগপত্র টেনে বের করলেন।

— “আজ থেকে তুমি শুধু ফ্যাক্টরির সুপারভাইজার নও, অরুণ। তুমি কোম্পানির অ্যাকাউন্ট সেকশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।”

অরুণ এবারো কিছু বলল না। শুধু তার চোখের কোণে ধীরে ধীরে জমে উঠল অনাবিল জল। দীর্ঘদিনের চেপে রাখা অভিমান, পরাজয় আর নীরব সংগ্রামের নীরব স্বীকৃতি যেন এই কণ্ঠস্বরে বাঁধ ভাঙল।

অরুণ ফিসফিস করে কিছু বালর চেষ্টা করলো,

— “স্যার... আমি... এই যোগ্যতা হয়তো... আমি—”

কায়সার সাহেব থামিয়ে দিয়ে বললেন,

— “ভয় পেয়ো না, অরুণ। ভয় মানুষকে থামিয়ে দেয়। আর তুমি তো চলতে শিখেছ... তোমার হাঁটা আমি দেখেছি। শুধু গন্তব্য বদলালাম, গতি নয়।”

এই প্রথম অরুণ কাঁদল—স্পষ্ট, নিঃশব্দ, প্রশান্ত কান্না। সেই কান্নায় ছিল না কোন আত্মদহন। ছিল কেবল এক সত্যিকার মানুষের মতো বাঁচার অনুভব।

“আরেকটা কথা”-কায়সার সাহেব বলতে লাগলেন-“এখন থেকে সপ্তাহে তিনদিন সন্ধ্যায় আমার ছোটবোন শাকিলাকে পড়াবে। কি পারবে না?”

“পারবো স্যার। আমি পারবো। আপনি শুধু আমাকে আশীর্বাদ করবেন।“

নতুন দায়িত্বের শুরুটা ছিল আবেগময়। নতুন পোশাক, নতুন ডেস্ক, ফাইলের গন্ধ, এবং সাদা কাগজে ছাপানো তার নাম—"অরুণ চন্দ্র, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (অ্যাকাউন্টস)"।

কিন্তু অরুণের এই সাফল্য যেন অনেকের সহ্য হলো না অফিসের চারিপাশে শুরু হলো গুঞ্জন।

— “এক হকার ছেলে এত দূর উঠলো কেমনে?”

— “আমরা তো দশ বছর ধরে কাজ করছি, আমাদের নাম তো কেউ নেয় না।”

— “ও কি এখন আমাদের উপর বসবে?”

কেউ মুখের সামনে হাসে, আবার পেছনে রুচিহীন ফিসফাসে বিষ ছড়ায়।

চায়ের কাপ হাতে টেবিলের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েকজন। তাদের মুখে যত না কথা, তার চেয়ে বেশি অভিমান আর ঈর্ষার সুর।

একদিন কুদ্দুস সাহেব, অ্যাকাউন্ট বিভাগের পুরনো কেরানি, ফাইল জমা দিতে গিয়ে উচ্চস্বরে বলেই ফেলল,

— “এই জায়গাটা বরাদ্দ ছিল একজন অভিজ্ঞ লোকের জন্য। হঠাৎ কইরা কি হইয়া গেল। কায়সার সাহেব এক উঠতি শ্রমিককে বসাইয়া দিলেন এই জায়গায়। এটা কি প্রতিষ্ঠানকে হেয় করা নয়?”

অরুণ মাথা নিচু করল না। চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,

— “আপনার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে বেশি, সেটা আমি জানি। কিন্তু আমি এই জায়গা কাজ দিয়ে অর্জন করেছি। কোন  অনুগ্রহ নয়। আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাই তাকে সম্মান জানিয়ে আমি আমার সাধ্যমতো কাজ করে যাবো। আর যদি কোথাও ভুল করি, সেটাও মাথা পেতে নেবো।”

এই নির্লিপ্তি, এই সংযত আত্মবিশ্বাস যেন আরও বেশি জ্বালিয়ে দিলো সেদিন কুদ্দুস সহেবের মতো আরো অনেক অরুণ বিরোধীদের মন।

ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল ষড়যন্ত্রের এক সূক্ষ্ম জাল।

চায়ের কাপে ফিসফাস, ঘাড় ঘুরিয়ে হালকা ঠোঁট বাঁকানো হাসি, আর নোটবুকে অপ্রাসঙ্গিক খোঁচা।

অরুণ বুঝত, কেউ কেউ সহজে মানতে পারছে না তার এই উঠে আসা। একজন “হকার” থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হওয়া যেন তাদের দীর্ঘ অপেক্ষার অপমান।

অরুণ প্রতিদিন সময়মতো আসতো। কখনো মাথা নিচু করতো না। কাজের মধ্যে মিশে যেতো দাগ কাটা অভিজ্ঞতায়। তার নীরবতা ছিল উত্তর, আর নিষ্ঠা ছিল প্রতিবাদ।

হঠাৎ একদিন, দুপুরে কাজ শেষে কারখানার গেট পেরিয়ে গলির মোড় ঘুরতেই, ঝড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল দুই অচেনা মানুষ।

মুখ ঢাকা, চোখে হিংসার আগুন। একজন গলা চেপে ধরল, আরেকজন লাথি চালিয়ে বলল—

— “বেশি বাড় বেড়েছিস, নামবি এখন নিচে!”

অরুণ কিছু বোঝার আগেই মুখে ঘুষি, পাঁজরে লাথি।  রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে গেলো অরুণ। তার জামার বুক রঙিন হয়ে উঠল রক্তে। পাশ দিয়ে লোক হেঁটে যাচ্ছিলো কিন্তু কে থামলো না। শহরের গলিগুলো ব্যস্ত থাকে, কিন্তু হৃদয়গুলো নয়।

সে পড়ে রইল ধুলোতে। মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখে ছিল শুধু একরকম স্থির আগুন— “আমি আবার দাঁড়াবো। যদি পড়ে যাই, তাও উঠবো।” এক সময় অরুনকে কারখানার শ্রমিকরা নিয়ে আসে হাসপাতালে।

হাসপাতালের নীল আলোয় ঢেকে রাখা বেডে অরুণ তখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মুখে ব্যান্ডেজ, ঠোঁটের কোণে শুকনো রক্ত। আর পাশে বসে আছেন কায়সার সাহেব—দুটি হাতের ভাঁজে মুখ রেখে বসে থাকা একজন অভিভাবকের মতো।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর তাঁর কণ্ঠে ফেটে এলো আবেগ।

— “তুমি আমার জন্য শুধুই একজন কর্মচারী নও, অরুণ। তুমি আমার বিশ্বাসের আরেক নাম। যারা তোমার ক্ষতি চেয়েছে তাদেরকে আমি  দেখিয়ে ছাড়বো তুমি কেমন মানুষ। এই শহরে এখনো কিছু গল্প শুধু চাকা ঘুরিয়ে লেখা যায় না, কিছু গল্প মানুষ লিখে—ঘাম দিয়ে, রক্ত দিয়ে, সত্য দিয়ে। তোমাকে শক্ত হতে হবে অরুণ।”

অরুণ চোখ মেললো। কষ্টের মধ্যেও তার মুখে ফুটে উঠল কৃতজ্ঞতার আভা—কোনো শব্দ ছাড়া বলা “ধন্যবাদ”, যা হয়ত হাজারটা বাক্যের চেয়েও বেশি।

প্রায় সপ্তাহ খানেক পর অরুণ অফিসে ফিরে আসে। কাজের ব্যস্ততায় কখন বিকেল গড়িয়ে যে সন্ধ্যা নামে টেরও পায়নি।

অফিসের নতুন কক্ষে একলা বসে ছিলো  অরুণ। টেবিলের ওপর খোলা খাতা, পাশে রাখা ক্যালকুলেটর—আর জানালার ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করছে সূর্যাস্তের সোনালি আভা। ছায়া পড়ে যাচ্ছে কাঁধে, তবু মন আজ আলোয় ভরা।

এই সেই অরুণ। গ্রামে সে ছেলেটি। ঢাকায় এসে হকারি করতে করতে এক সময় এ জায়গায় এসে পৌঁছে নিজের গড়া  আত্মশক্তির ভিতর থেকে। তার বুকে এখনো কষ্টের দাগ, তবু মাথা উঁচু। তার চোখে এখনো শোক, তবু পেছনে ফেরার কোনও ইচ্ছা নেই।

বুঝতে পারছে, বাইরে এখনও ঝড় বইছে। ষড়যন্ত্রের ঝড়, পতনের খেলা। কিন্তু ভিতরে? ভিতরে বইছে এক নিঃশব্দ অথচ অটল আত্মবিশ্বাসের নদী। যার উৎস খুঁজতে গেলে পৌঁছাতে হয় একদিন ঢাকার গুলিস্তানের রাস্তায় হাঁটা এক তরুণের কাছে। যার চোখে ছিল আগুন, আর বুকজুড়ে ছিল স্বপ্নের মানচিত্র। তার সেই স্বপ্ন আজও জেগে আছে, শুধুই নিজে গড়া এক মোহনার দিকে এগিয়ে চলেছে।

সে জানে, আজ নয়তো কাল, পৌঁছাবে ঠিক সেখানেই। কারণ জীবন যতবার তাকে ভেঙেছে, সে প্রতিবার নিজের ভিতর থেকে তুলে এনেছে এক নতুন শক্তি, নতুন গঠন। তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি কোনো দিন, কোনো ষড়যন্ত্রে, কোনো ভাঙনে। সে জানে, নিজেকে হারায় না যে, তাকেই একদিন পুরো পৃথিবী খুঁজে পায়।

চলবে—

ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট