প্রশাসনিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাস হতে চললেও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে বর্তমান সরকার। এরইমধ্যে কয়েকজন সচিবকে ওএসডি করা এবং কাউকে কাউকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। বাতিল হয়েছে ১১ সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। এতে কয়েকটি মন্ত্রণালয় এখন সচিব শূন্য। আবার বেশকিছু মন্ত্রণালয়ে থেকে গেছেন বিগত সময়ের সুবিধাভোগীরা।
অন্যদিকে মাঠ প্রশাসনে চরম হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। বিশেষ করে ডিসি নিয়োগ নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি; নিয়োগের পরপরই আবার বাতিল ও রদবদল; প্রত্যাহারের এক মাসের বেশি সময় পরও আট জেলায় এখনও ডিসি নিয়োগ দিতে পারেনি অন্তবর্তী সরকার।
নিয়োগের দুই দিনের মাথায় দুই সচিবের চুক্তি বাতিল:
অতিরিক্ত সচিব মতিউর রহমান বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছিলেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতির পর তাকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়।
আবার নিয়োগ দেওয়ার দুদিন পর (২ অক্টোবর) তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
ঠিক তেমনই গত সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) খাদ্য ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইলাহী দাদ খানকে দুই বছরের চুক্তিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। পরদিন মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) রাতে তার এ নিয়োগ বাতিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
নৌ পরিবহন ও খাদ্য সচিবকে নিয়োগ দিয়ে দু-এক দিনের মধ্যে বাতিল করা হলো কেন- জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান ইউএনবিকে বলেন, কী কারণ সেটি বলা যায় না। তবে প্রশাসনিক কারণে তাদের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব নিয়োগ পেয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিব মো. মাসুদুল হাসান। সচিব পদে পদোন্নতির পর তাকে এই নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেনকে গত সোমবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে বদলি করা হয়। ওইদিনই দুই বছরের চুক্তিতে খাদ্য সচিব নিয়োগ পান অবসরে যাওয়া বিসিএস খাদ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা ইলাহী দাদ খান। তবে তার নামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা রয়েছে, এটা জানার পরদিনই গত মঙ্গলবার তার এ নিয়োগ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিতকির্ত দুই কর্মকর্তার নিয়োগ দেওয়ার ঘটনায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নতুন করে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে কঠোর নিদেশনা দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৫৯ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়।
ডিসি পদে নিয়োগপ্রত্যাশী উপসচিব পদমর্যাদার ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা গত ১০ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে প্রায় হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। ওই দিন দুপুরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব কে এম আলী আযমের কক্ষে হট্টগোল করেন তারা।
অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মাঠ প্রশাসন সাজাতে গিয়ে ৫৯টি জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) প্রত্যাহার করা হয়। এরপর এসব জেলায় নতুন ডিসি পদায়ন নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। তিন দফায় ৫১ জেলায় যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেছেন নতুনরা। অভিযোগ থাকায় নিয়োগের পরদিনই বাতিল হয় ৮ জেলার নতুন ডিসির নিয়োগ। তাই ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে এসব জেলা। আবার উপসচিব পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার ক্ষোভ ও অভিযোগ আছে নতুন ডিসি নিয়োগ নিয়ে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান ইউএনবিকে বলেন, নতুন ডিসিদের কেউ সক্ষমতা প্রমাণ করতে না পারলে প্রত্যাহার হতে পারেন। শূন্য থাকা ৮ জেলার ডিসি নিয়োগও হবে দ্রুত। রদবদল হতে পারে এডিসি ও ইউএনও পদেও।
তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে কঠোর সরকার। গতকাল থেকে শুরু হচ্ছে প্রশাসন সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমও।
জেলা প্রশাসক ডিসি নিয়োগ নিয়ে হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা করায় ১৭ জন উপসচিবকে শাস্তির সুপারিশ করেছে এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় এক সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ। তার রিপোর্ট পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, সাক্ষী-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান।
তিনি বলেন, '১৭ জনকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তিনটি পর্যায়ে তিনি সাজেস্ট করেছেন কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আটজনের বিষয় বলা হয়েছে, তদন্ত সাপেক্ষে কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে গুরুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। চারজনের বিষয় বলা হয়েছে তদন্ত সাপেক্ষে বিধি-বিধান অনুযায়ী লঘুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। আর পাঁচজনের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তাদের শাস্তি তিরস্কার দেওয়া যেতে পারে। তাদের সাবধান করা, যাতে ভবিষ্যতে এটা না করে।
জেলা প্রশাসক প্রত্যাশী উপসচিবদের সমন্বয়ক নূরুল করিম ভূইয়া জানান, ৫৯ জন ডিসিকে যে পদায়ন করা হলো, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ রয়েছে। আপত্তি রয়েছে। যেহেতু বিগত সরকারের সময়ে এসব কর্মকর্তা বিভিন্নভাবে সুবিধা নিয়েছেন এবং আশীর্বাদপুষ্ট হয়েছেন। তারা যে খুন-হত্যা ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত, সে তথ্য আপনারা মিডিয়ার মাধ্যমেই দিয়েছেন। যেহেতু এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া সেহেতু যত দ্রুত সম্ভব প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলে এ দুটি প্রজ্ঞাপন বাতিল করবেন বলে জনপ্রশাসন সচিব আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবি ছিল প্রশাসনের সর্বস্তরে বিগত দিনের সুবিধাভোগী, ছাত্র-জনতা হত্যার সঙ্গে জড়িত, খুন, লুটপাট ও রাষ্ট্র সংস্কারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এখনও পর্যন্ত ছাত্র জনতার এই বিপ্লবের মূল আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করছেন, সেসব কর্মকর্তাদের বিদায় দিতে হবে। এটা ছিল আমাদের প্রধান দাবি।’
ডিসি নিয়োগ নিয়ে ৩ কোটি টাকা চেক পাওয়া গেছে বলে একটি দৈনিক পত্রিকায় নিউজের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ২৪ সেপ্টেম্বরই অতিরিক্ত সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটিকে চেকের সত্যতা যাচাই করে তিন দিনের মধ্যে সুস্পষ্ট মতামতসহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছিল।
তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘৩ কোটি টাকার চেক দিয়ে ডিসির পদায়নের খবরটি ভুয়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। পত্রিকাটি বড় ধরনের গুজব ছড়িয়েছে। ছবি দিয়ে একেবারে ভাইরাল নিউজ করেছে। এমন কিছুই ছিল না। একটা ভুয়া খবর এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই ধরনের একটা খবর ছাপলে আপনাদের সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে।’
প্রশাসনে সচিব পদে আরও পরিবর্তন আসছে:
প্রশাসনে সচিব পদে আরও পরিবর্তন আসছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া বড় বড় কর্মকর্তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে রয়েছেন তাদের প্রত্যাহার ও নতুন সচিব নিয়োগ দিয়ে পদায়ন করতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় কাঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ করে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সচিব মো. নূরুল আলমসহ আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগ পাওয়া সচিবদের প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তবে দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ সচিবদের প্রথমে ওএসডি করে পরে মামলা দায়ের এবং গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হতে পারে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।