পিছু ছাড়ছে না ডিসি নিয়োগের বিতর্ক

Bangla Post Desk
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত:১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৩৪ পিএম
পিছু ছাড়ছে না ডিসি নিয়োগের বিতর্ক
ফাইল ছবি

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত সপ্তাহে তিন দফায় মোট ৫২ জনকে জেলা প্রশাসক বা ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বড় পরিসরে ডিসি পদে যতবার পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে দক্ষ মাঠ প্রশাসন তৈরির উদ্দেশ্যে নেওয়া সর্বশেষ ওই পদক্ষেপও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারের নীতি-নির্ধারণী পদগুলোতে থাকা কর্মকর্তাদের অনভিজ্ঞতাই এই বিতর্ক সৃষ্টির মূল কারণ। কারণ তারা যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। 

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকলেও আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রস্তুতিও শেষ করে আনছে নির্বাচন কমিশন। 

ভোটের সময় ডিসিরা সাধারণত রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডিসি পদে রদবদলে হাত দেয় সরকার। গত ৮ নভেম্বর ১৫ জন, ৯ নভেম্বর ১৪ জন এবং ১৩ নভেম্বর ২৩ জন কর্মকর্তাকে ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে কয়েকজনের জেলা বদল করা হয়। যা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। মূলত ৮ নভেম্বর ছুটির দিন (শনিবার) শেষে মধ্যরাতে প্রথম ধাপে ডিসি পদে নিয়োগের পরেই বিতর্ক ওঠে। 

নিয়োগ পাওয়া কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ও দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকা এবং আওয়ামী লীগের সময় বিতর্কিত নির্বাচনে জড়িত থাকা এবং দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কারো কারো বিরুদ্ধে মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতা না থাকারও অভিযোগ ওঠে।

এসব বিতর্কের মধ্যে দুজন কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিলও করা হয়। সিলেট জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উপসচিব সন্দ্বীপ কুমার সিংহ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব লুৎফুন নাহারের ডিসি পদে নিয়োগ বাতিল করা হয়। সন্দ্বীপ কুমারকে বরগুনার এবং লুৎফুন নাহারকে মেহেরপুরের ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। 

এছাড়া ডিসি নিয়োগ পাওয়া আরও চারজনকে আবার বদলি করা হয়। এরমধ্যে নোয়াখালীর ডিসি হিসেবে বদলির আদেশধীন আহমেদ কামরুল হাসানকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গাজীপুরের ডিসি হিসেবে বদলির আদেশাধীন মো. আজাদ জাহানকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ঢাকার ডিসি হিসেবে বদলির আদেশাধীন মো. শফিউল আলমকে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং গাইবান্ধার ডিসি হিসেবে বদলির আদেশাধীন মো. নজরুল ইসলামকে বিদ্যুৎ বিভাগে নতুন করে পদায়ন করা হয়।

ডিসি রদবদলের মধ্যেই নতুন করে ফিটলিস্টের সাক্ষাৎকার আহ্বান করা হয়। বিকালে নোটিশ করে সন্ধ্যায় সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। আর এসব বিষয়কেই অভিজ্ঞতার ঘাটতি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা মনে করছেন- বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার শুরু থেকেই অনভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রাখছেন। প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা যে এক বছরের বেশি সময়ে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে পারেননি, সেই প্রমাণ রাখলেন সর্বশেষ ডিসি নিয়োগেও।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার মুখে মুখে ভালো নির্বাচনের কথা বললেও ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, অতীত ইতিহাস ও সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সুপারিশ অনেক ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গোয়েন্দা প্রতিবেদনকেও আমলে নেওয়া হয়নি। 

নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ প্রাধান্য পেয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তবে নিয়োগ সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ। এই চাপ সামনে রেখে অনেক ক্ষেত্রেই তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেছেন না। এছাড়া গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এমন কাউকে দায়িত্বে না রাখার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হচ্ছে। তাই সব মিলিয়ে কাজটি বেশ জটিল এবং এখানে ভুল থাকার সম্ভাবনা আছে। ভুল সামনে এলে সেটি সংশোধনও করা হচ্ছে। 

তারা আরও বলেন, যেহেতু গত তিনটি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বে না রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত রয়েছে, তাই প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত হওয়া ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা কিছুটা গুরুত্ব পেয়েছেন। কারণ তারা আগের নির্বাচনগুলোতে কোনো দায়িত্বে ছিলেন না।

এ বিষয়ে কথা বলতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এহছানুল হককে ফোন দেওয়া হলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার এসে আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগ পাওয়া ডিসিদের সরিয়ে দেয়। কিছুটা তড়িঘড়ি করে ফিটলিস্ট তৈরি করে ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু এই নিয়োগের পর নানা ধরনের বিতর্ক ও সমালোচনা শুরু হয়। 

নিয়োগ বাতিল চেয়ে নজিরবিহীনভাবে সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেন ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তারা। হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। পরে ডিসি নিয়োগ দেওয়া ৯ কর্মকর্তাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। 

ডিসি নিয়োগ দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভও হয়। অর্থের বিনিময়ে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে। নিয়োগে অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয় জনপ্রশাসনকে।

এছাড়া ডিসি পদে থাকা ১৮ জন উপসচিব যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার দীর্ঘদিন পরেও সরকার সেখানে নতুন ডিসি নিয়োগ দিতে পারেনি।

সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলা পোস্টকে বলেন, ‘সিভিল সার্ভিসের বিশৃঙ্খল অবস্থা এখনো ঘোচেনি। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি দূর, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি- এগুলোতে কোনো দৃশ্যমান কোনো অর্জন নেই। ওনাদের (সরকার) কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, যে কারণেই হোক ওনারা সেটা পূরণ করতে পারেননি।’