বিনয় অনেক আগেই মারা গেছে

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:০৬ আগস্ট ২০২৫, ০২:৪৭ পিএম
বিনয় অনেক আগেই মারা গেছে

ছোটকাল থেকেই বিনয়ের কথা শুনে এসেছি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বুঝতে পারলাম, এই দুনিয়াটা "বিনয়" নামক এক আজব প্রজাতির পদলেহী দেবতার পূজার আস্তানায় পরিণত হয়েছে। স্কুলের সেই পণ্ডিত স্যার, যিনি নিজে কথা বলতে বলতে থামতেন না, তিনিও বলতেন,"বিনয়ের মতো হও বাছা।" গুরুজন, কবি, সাহিত্যিক, কলমচি, গল্পকার – সবাই মিলে এমন ভাব, যেন বিনয়ের সাথে বন্ধুত্ব না করলে জীবনটাই ব্যর্থ। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে চাটুকার পর্যন্ত সবাই এমন বিনয়বান, যে নিজেদের স্বার্থে দরজায় পড়ে গিয়ে 'স্যরি স্যার' বলে উঠে দাঁড়ায়। ফেসবুকের দেওয়াল থেকে সেমিনারের মঞ্চ, এমনকি টয়লেটের দরজার পেছনেও যেন লেখা "বিনয় মহান, বিনয়ই মানবধর্ম"। এই সব ঢং-ঢাং, নাটক-নাটকী, পাগলামির সার্কাস আর ভাঁওতাবাজির লোক দেখানো ভাব বিনয়ের পছন্দের তালিকায় নেই। অধিকাংশ ভণ্ড মানুষ প্রজাতির অভিনয়ের গন্ধে তার নাকই সোজা সিঁধ কেটে বেরিয়ে যায়। বিনয়ের জন্য ছিল ঘোর অসহনীয়! কারো যেন বিনয় হওয়াটাই আজকালকার দিনে একটা পাবলিক ইভেন্ট। কেউ ক্যামেরা চালু করে অভিনয় করে, কেউ ভদ্রতার আড়ালে চালায় ভাঁওতা।কিন্তু হায়, বিনয়ের সহ্যশক্তিরও তো একটা এক্সপায়ারি ডেট আছে। শেষমেশ যা হওয়ার তাই হলো। বিনয় মারা গেল।

তবে বিনয় আত্মহত্যা করেনি। তার মৃত্যুটা ছিল খুবই "স্বাভাবিক"-অন্তত এই সমাজের চোখে। একদিন সকলেই বলত, "শিক্ষাই মানুষকে বিনয়ী করে।" কিন্তু এখন চারপাশে এত উচ্চশিক্ষিত মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে যে, আমরা কেউ আর কথা বলার সাহসই পাই না। কারণ তারা যেভাবে কথা বলেন, তাতে শব্দের মধ্যে কেবল জ্ঞান নয়, একটা তাচ্ছিল্যও ঢেলে দেওয়া থাকে। মনে হয় যেন বলছেন, “তোমার মতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমি সময় নষ্ট করছি।”অফিসে, ক্লাসরুমে, সেমিনারে যেখানেই যান, “বিনয়” নামক সেই পুরাতন মূল্যবোধটা যেন এখন শুধুই প্রাচীন কোনো পাঠ্যবইয়ের পাতায় পড়ে আছে, ঠিক পাশেই “সততা” আর “মানবিকতা” নামের আরেক যুগপৎ মৃতদের সাথে। আজকাল একজন মানুষ যত বেশি পিএইচডি অর্জন করেন, তার কণ্ঠে ততটা রুক্ষতা এসে পড়ে। যত বেশি পদবি, তত বেশি নাক উঁচু। একটা সময় ছিল যখন শিক্ষিত মানুষ হাঁটতেন মাথা নিচু করে। এখন হাঁটেন এমনভাবে যেন পৃথিবীটা তারই পদতলে থাকার কথা। তাদের কথা শুনলেই বোঝা যায়—শিক্ষা তাদের জ্ঞান দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিনয় কেড়ে নিয়েছে। বিনয়ের শোকসভায় আজ বক্তৃতা দিচ্ছেন পাঁচজন ‘প্রফেসর’, যারা নিজের ছাত্রছাত্রীদের নাম ভুলে যান, কিন্তু নিজের উপাধি ঠিকঠাক উচ্চারণ না করলে রেগে আগুন হয়ে যান।

আজ চারদিকে এত শিক্ষিত মানুষ, এত ডিগ্রি, এত বক্তৃতা, কিন্তু বিনয়ের গন্ধও নেই! ডিগ্রির গায়ে “ড.”, নামের আগে “প্রফেসর.” কথার মাঝে “হার্ভাড”, “অক্সফোর্ড”, “কেমব্রিজ”  শব্দের ম্যারাথন ব্যবহার? যেন বাকিদের মাথায় পা দিয়ে চলাটাই শিক্ষার মূল মন্ত্র! কেউ যদি ভুল করে “স্যার” বলতে না ভুলে যান, তাহলে রেগে গিয়ে বলেন, “তুমি কি জানো, তুমি কার সাথে কথা বলছো? কিন্তু সেই মানুষটিই আবার নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে লিখেছেন—“নানা উপদেশের বানী.” জানি না, এসব ‘মহামানব যদি সত্যিই হত, তাহলে ছাত্রের প্রশ্ন শুনে মুখ বেঁকিয়ে বলতেন না—“এসব তুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সময় নষ্ট করিও না।” বিনয় আজ মারা গেছে, কারণ আজকাল বিনয় শেখানো হয় সিভি তৈরির অংশ হিসেবে। “হিউম্যান স্কিলস”-এ একটু "নম্রতা" দেখাও—চাকরি পেতে সুবিধা হবে। ইন্টারভিউতে মুখে মিষ্টি হাসি, বলা হয়, “আমি সেবামূলক নেতৃত্বে বিশ্বাসী”। তবে কথাগুলি ইংরেজিতেই অনেকে মুখে অহেতুক হাসি এনে গলগল ভাবে বলতে পছন্দ করেন “I believe in servant leadership.” কিন্তু অফিসে ঢুকেই জুনিয়রদের ব্যবহার করেন টিস্যুর মতো। প্রেজেন্টেশন করিয়ে নিজে কৃতিত্ব নিয়ে নেন, আর তাদের বলে দেন, “তোমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখছি”। একেবারেই ফালতু কথা। মানেটা হলো, কিভাবে নিঃশব্দে শোষণ করা যায়, তা শিখছেন। এক বাঙালী যখন আরেক বাঙালীর সাথে চোখ-মুখ-নাক-কান-ঠোঁট-জিহ্বা আঁকিয়ে-বাঁকিয়ে "আই মিন, ইউ নো", "লাইক, অ্যাকচুয়ালি", "ওয়েল, ইউ কান সে দ্যাট..." ইত্যাদি ইংরেজি বাক্য-বিন্যাসে কথার বান ছাড়েন — তখন বিনয়ের অবস্থা এমন হয় যেন, সে গিলে ফেলা চা'য়ের কাপ হাতে নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, বুঝে উঠতে পারে না সে এখন বাংলা শিখছে না ইংরেজি ভুলে যাচ্ছে। আশেপাশের বাতাসেও তখন একটা ভাষা-গত বিভ্রান্তির গন্ধ ছড়ায়, যেটা বুঝে ফেলতেও খুব একটা প্রজ্ঞার দরকার হয় না। মনে হয় যেন দুইজন একসাথে ফরাসি রেস্তোরাঁয় গিয়ে আলু ভাজা অর্ডার দিয়ে ভাব ধরছে তারা এখন ইউরোপীয়।

এই লেখাটা লিখতে গিয়ে অনেক দিন আগের একটা কথা মনে পড়ে গেল। একটা বড় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এক নামকরা প্রফেসর আসেন বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতার শুরুতে বলেন, “I am always learning, I respect all voices.”কিন্তু প্রশ্নোত্তর পর্বে যখন এক তরুণ গবেষক বিনয়ের সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করেন, তখন ওই প্রফেসর চশমা খুলে তাকিয়ে বলেন, “You clearly haven’t read the article.” সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম, বিনয় এখন শুধুই প্রেজেন্টেশনের স্লাইডে থাকে, হৃদয়ে নয়। বিনয় মারা গেছে, কারণ আজকাল তার কোনও বাজারমূল্য নেই। যত বেশি দামি গাড়ি, তত কম নম্রতা। যত বেশি মিডিয়া কভারেজ, তত বেশি ‘আমি কে সেটা বোঝাতে হবে’ ধরনের গলাবাজি। আজ বিনয়ের চেহারা দেখলে হয়তো আপনি তাকে চিনতেই পারবেন না। সে রিকশাওয়ালার ধৈর্য্যে থাকে, যিনি আপনার রুক্ষ কথার পরেও বলে, “ঠিক আছে ভাই, আপনি যা দেন।” সে স্কুলের লাস্ট বেঞ্চে বসা সেই ছাত্রটির মধ্যে থাকে, যে টপারের সাফল্যে সত্যিই খুশি হয়। সে বৃদ্ধ মায়ের কণ্ঠে থাকে, যিনি বলেন, “আমার সন্তান ডাক্তার হয়েছে”—কিন্তু নিজে তার ব্যবহারে কষ্ট পান, কাউকে বলেন না। বিনয় আজ সত্যিই মারা গেছে। আর তার মৃত্যুতে যারা শোক করছে, তারাই তাকে খুন করেছে নিজের অহংকারে, পদবীর দাম্ভিকে, আর সমাজের তথাকথিত “সফলতা”-র মানদণ্ডে।

এই জাতীয় "বিনয়" যেন শুধু ক্যামেরার জন্য পরা একখানা মুখোশ। চ্যারিটি ইভেন্টে গিয়ে বড়লোক বললেন, “আমি তো কাউকে ছোট করি না”। হ্যাঁ, কারণ যাদের ছোট করবেন, তারা তো আমন্ত্রিতই নয়। শুধু বড়লোক নয়, তার মেকআপ আর্টিস্ট থেকে শুরু করে মিডিয়া ম্যানেজার পর্যন্ত নিশ্চিত করে যে "বিনয়ের" ফ্রেম ঠিকঠাক-ভাবে ধরা পড়ে ক্যামেরায়।
কারণ এখানে ভেতরের নয়, ছবি তোলার সময় মুখে হাসি রাখাটাই বিনয়। সম্প্রতি আমাদের এক বন্ধু মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি পোস্ট শেয়ার করলেন। তার লেখাটি পড়েই আমার ইচ্ছে হলো এ লেখাটার।  তিনি এক দাতব্য অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখেছেন সেখানে সবাই কতোটা বিনয়ী। উনি লিখেছেন, “এই অনুষ্ঠান থেকে বেড়িয়ে আসার সময়, শুধু একটি ভালো কাজের অংশ হতে পেরে নয়, বরং অসাধারণ কিছু মানুষকে কাছ থেকে দেখে আমি মনের দিক থেকে আরো সমৃদ্ধ বোধ করছিলাম। শিক্ষার প্রকৃত সৌন্দর্য তখনই ধরা পড়ে, যখন তা নীরব অথচ গভীরভাবে প্রভাব ফেলে - গর্জন নয়, বরং আলোকিত করে। আসুন, আমরা সবাই চেষ্টা করি এই মূল্যবোধগুলো ধারণ করতে, এবং আগামী প্রজন্মকে শেখাই - শিক্ষার প্রকৃত মানে হলো তা কীভাবে আমাদের ব্যবহার ও মনুষ্যত্বে প্রতিফলিত হয়”। খুব ভালো লাগলো কথাগুলো পড়ে। তিনি নিজেও একজন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। বিনয়ের সাথে ধৈর্য ধরে শিক্ষার্থীদেরকে মানুষ করে তোলাই তার কাজ। তার আহ্বানের সাথে আমিও একমত। আমরাও চাই আমরা সকলেই বিনয়ী হই।  কিন্তু সত্যি কি আমরা পারি? 

একবারের কোনো প্রেক্ষাপটে কারো ব্যবহার দেখে কি তার বিনয়ের মাপকাঠি নির্ধারণ করা যায়? যদি কোনো সেলিব্রেটি ক্যামেরার সামনে বৃদ্ধাকে হাত ধরে রাস্তা পার করান, তাহলে সেটাকে কি সত্যিই বিনয় বলব, নাকি সেটা একটা ক্যামেরায় বন্দী সিকুয়েন্স? যেমন দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন, "সব মানুষই পাগল, পার্থক্য হলো কার পাগলামি কতটা লুকানো", তেমনি বলা যায়, সব মানুষই কোন না কোন ভাবে আত্মকেন্দ্রিক, কেউ সেটা 'বিনয়' নামক পর্দায় ঢেকে রাখে। আজকের দিনে সেই পর্দার পেছনে কী আছে, সেটা কেউ দেখে না। কে কাকে সম্মান করল সেটা নয়, বরং কে কবে তা ক্যামেরায় ধরল, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনয়ের প্রমাণ। আসলে বিনয় একটা আপেক্ষিক জিনিস। একজন নামী শিল্পপতি হাই-প্রোফাইল ইভেন্টে গিয়ে যখন গরীব শিশুর মাথায় হাত রাখেন, সবাই বলেন, “কী দারুণ বিনয়।” কিন্তু একই শিল্পপতি যখন কারখানার মজুরদের ছাঁটাই করে দেন, সেটা কেউ দেখে না। একজন রাজনীতিক যখন সাধারণ মানুষের বাড়িতে গিয়ে ভাত খান, সবাই বলে—“এমন নেতা আজকাল পাওয়া যায় না।” কিন্তু সেই ভাতের দাম যে সরকারি ফাইল ঘুরে ঘুরে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প থেকে চুরি হয়ে গেছে, সে খবর কেউ রাখে না। বিনয় আজকাল একরকম বিনিয়োগ। সঠিক সময়ে সঠিক ক্যামেরার সামনে ব্যবহার করলে দারুণ ডিভিডেন্ড মেলে।

বিনয় হয়তো আজ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, কিন্তু তার প্রভাব, তার মহিমা আজও অনেকে বয়ে চলেছেন হৃদয়ে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে জানেন কি, সত্যিকারের বিনয়ীরা কোথায় বাস করেন? তারা থাকেন লাইনের একেবারে শেষে। ঠেলাঠেলি করে নয়, অপেক্ষা করে ধৈর্যের সঙ্গে, অন্যদের আগে যেতে দিয়ে, নিজের সময়ে সামনে এগোতে শিখে। তাদের হাতে কোনো পদক ওঠে না। কারণ তারা যা করেন, তা ক্যামেরাবন্দি হয় না, প্রচারের আলোয় আসে না। তাদের "বিনয়" ধরা পড়ে না কোনো ভাষণে বা মঞ্চে, ধরা পড়ে হয়তো কাউকে নিঃশব্দে জড়িয়ে ধরার মুহূর্তে, কিংবা কারো কাঁধে হাত রেখে বলার ভঙ্গিমায়—"আমি আছি পাশে।"হ্যাঁ, হয়তো বিনয় মৃত। কিন্তু তার আত্মা এখনো বেঁচে আছে। সে ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর সেইসব কোণে, যেখানে আলো পড়ে না, কিন্তু হৃদয় এখনো উষ্ণ থাকে। যেখানে ভালোবাসা শব্দহীন, কিন্তু অনুভব অগাধ। বিনয় বেঁচে আছে সেই ছোট্ট শিশুটির চোখে, যে প্রতিদিন স্কুলে অপমানিত হয়, মোট বলে উপহাস পায়, তবুও কাউকে ঘৃণা করতে শেখে না। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদে, কিন্তু হৃদয়ে এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা রাখে। একদিন এই দুনিয়াকে দেখাবে, সত্যিকারের শক্তি কতটা নীরব হতে পারে।

একজন গরীব লোক যখন বৃদ্ধার জন্য রাস্তা ছাড়ে, সেটাকে আমরা সাধারণ সৌজন্য বলি। কিন্তু যখন একজন নামজাদা সিইও কোনো কর্মচারীর নাম মনে রাখেন, সেটাই হয়ে যায় "মহাবিনয়"! এই তো বিনয়ের মাপকাঠি, পদবী অনুযায়ী পরিবর্তিত। বিনয় এখন এক ধরনের নবাবী মুদ্রা, যা গরীবের কাছে মূল্যহীন, কিন্তু বড়লোকের হাতে থাকলে তা হয়ে যায় মহৎ। একজন দিনমজুর সকালে উঠেই স্ত্রীর জন্য চা বানিয়ে দেন। তিনি চিৎকার করেন না, ফেসবুকে ছবি দেন না।
তিনি জানেন না "লিঙ্গ-সমতা` শব্দদুটি কী। কিন্তু তার ব্যবহারটাই মানবিকতা। আর একদিকে, যিনি "নারীর ক্ষমতায়ন” নিয়ে শত বক্তৃতা দেন, তিনিই আবার অফিসে বসে নারী সহকর্মীর প্রস্তাব এড়াতে বলেন, “তুমি এখনও নতুন, বোঝো না।” শিক্ষা কি মানুষকে বিনয়ী করে? উত্তর—নিশ্চয়ই না। শিক্ষা মানুষকে জানায় কীভাবে বিনয়ী ‘দেখাতে’ হয়। কিন্তু সত্যিকারের বিনয় আসে অভিজ্ঞতা থেকে, কষ্ট থেকে, ভাঙার পর গড়া থেকে। ভবিষ্যতের বিনয় তৈরি হয় যখন কেউ রাতের খাবার খেতে বসে ভাবে, “আজ মা খেল কি না?” বিনয় গড়ে ওঠে যখন কেউ জীবন থেকে শেখে, সবাই যুদ্ধ করছে, কেউ প্রকাশ্যে, কেউ নীরবে। আমরা সবাই চাই অন্যেরা বিনয়ী হোক। ছাত্র চাই শিক্ষক বিনয়ী হোক, কর্মচারী চাই ম্যানেজার বিনয়ী হোক, জনগণ চাই নেতা বিনয়ী হোক। কিন্তু নিজেরা? নিজেকে অন্যের সমকক্ষ ভাবা যতটা কঠিন, ততটাই অবাস্তব এই সমাজে। আমরা যতই `অন্তর্ভুক্তি কিংবা সবার অংশগ্রহণে বিশ্বাসী`  শব্দগুলি ব্যবহার করি, হৃদয়ে তখনও শ্রেণীবিভাজনের দুর্গ চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।

ফলাফল? বিনয় এখন একটা লোক দেখানো ধর্ম, যার উপাসনা হয় শুধু ক্যামেরার ফ্ল্যাশে, আর যার মৃতদেহ আজ সমাজের প্রতিটি কর্পোরেট সেমিনারে, মিডিয়ার আলোয়, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে শোভা পাচ্ছে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তারা বলেন, “আমি সবাইকে সমান চোখে দেখি।” কিন্তু নিচে বসা পরিচ্ছন্নতা কর্মীর দিকে তাকাতেও ভুলে যান। লজ্জা হয় না আমাদের?
যে সমাজে একজন শিক্ষক বলেন, “আমি তোমাদের বন্ধু”—তারপর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কোনো ছাত্র “নমস্কার বা সালাম” বললে মুখ ঘুরিয়ে নেন, যে সমাজে কনভোকেশনে ছাত্ররা দাঁড়িয়ে থাকে, আর অতিথিরা দেড় ঘণ্টা দেরিতে এসে বলেন, “বিনয় হলো সময়-জ্ঞান,” সেই সমাজ সত্যিই “সুশিক্ষিত” কিনা, প্রশ্ন ওঠে। এই সমাজে এমনও মানুষ আছেন, যারা তাঁদের কাজের লোককে নাম ধরে ডাকেন, তাদের খেতে বসান নিজের সঙ্গে, কিন্তু বাইরের লোক এলে বলেন, “ও একটু দূরে বসে খাক, আপনি অস্বস্তিতে পড়বেন না।” এই দ্বিচারিতা, এই ভণ্ডামির ফাঁদেই বিনয়ের মৃত্যু ঘটেছে। যেদিন সমাজের শ্রেষ্ঠজনেরা সত্যিকারের ছোটজনদের পাশে দাঁড়াতে শিখবে, যেদিন "আমি কে" বলার আগে কেউ একবার ভাববে, "সামনে যিনি আছেন তিনিও মানুষ", সেদিন বিনয় আবার জন্ম নেবে। ততদিন পর্যন্ত, আমরা শুধু একটা মৃতদেহ বহন করে চলছি—নামের নাম বিনয়, আসলে ভান, প্রচার আর কৃত্রিম সৌজন্যের ফসিল।

তবে আমাকে বলতেই হচ্ছে ,বিনয় আজ মারা গেছে। তার মৃত্যু কেউ টের পায়নি, কারণ তার অন্ত্যেষ্টি ছিল খুব জমকালো। নামী দামী বক্তারা বক্তৃতা দিলেন, কর্পোরেট নেতা চোখ ভেজালেন, মিডিয়া বলল, “একটি যুগের অবসান।” কিন্তু আসলে তা ছিল এক বোকা জাতির আত্মতুষ্টির উৎসব, যেখানে সবাই বলল, "বিনয় তো এখনো আছে, শুধু একটু বদলে গেছে।" হ্যাঁ, বদলে গেছে বটে, মনে নয়, মঞ্চে; হৃদয়ে নয়, হ্যাশট্যাগে, মানুষেরা সাথে নয়, সোশাল মিডিয়াতে। তবু আশার কথা— সে আবার জন্ম নেবে। যেদিন কোনো রিকশাওয়ালার প্রতি ধন্যবাদ দিতে আমরা লজ্জা পাব না, যেদিন কোনো পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে 'ভাই' বা 'আপনি' বলে ডাকতে বুক ধড়ফড় করবে না, যেদিন মঞ্চে ওঠার আগেই মানুষ আয়নায় তাকিয়ে নিজের ভেতরের অহংকে চিনবে, সেদিন বিনয়ের পুনর্জন্ম হবে। সে জন্ম হবে শব্দে নয়, নীরবতায়। হবে পোস্টে নয়, ব্যবহারে। শিক্ষার সার্টিফিকেটে নয়, প্রতিদিনের ছোট ছোট কর্মে। যেদিন মানুষ শিক্ষার সাথে সাথে হৃদয়ের পাঠও শিখবে, যেদিন বিনয় হবে আচরণ, অভিনয় নয়— সেদিন বিনয় ফিরবে। শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার নয়, সমতার সৈনিক হয়ে। ততদিন, সে শুধু স্মৃতিতে বাঁচবে—আর আমাদের বিবেকের কাঠগড়ায়।

ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট