শ্রীচরণেষু দাদা: ১৬


মিটফোর্ডের অলিতে-গলিতে নামে নতুন ভোরের আমেজ। বুড়িগঙ্গার বুক থেকে ভেসে আসে জলজ বাতাসের ঘ্রাণ।
রাতের শেষ আঁধারটা শহরের মাথা থেকে ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ে। সোনালি আলোর ঢল নামে চারিদিকে। হালকা নরম রোদের উষ্ণতা পুরনো লাল ইটের কারখানার গায়ে গায়ে ছড়িয়ে আছে। কারখানার টিনের ছাদে শিশিরগুলো শুকিয়ে গেছে কোন এক অদৃশ্য জ্বালায়। ছাদ যেন নিজের বুকে সঞ্চয় করে রেখেছে বিগত দিনের ঘাম, শোরগোল আর স্বপ্ন ভাঙার গল্প।
আজ পাখিরাও আনন্দে পত পত করে ডানার ঝাপটায় উড়ে যায় গন্তব্যে। মাথার উপরে উঠে ডাকে। পুরনো ঢাকার প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরা মিটফোর্ড আজও জেগে ওঠে তার নিজস্ব ছন্দে। তবে ভাষাটা হলো লোহার ঘর্ষণ, বোতল ভাঙার টুংটাং, কেমিক্যালের গন্ধমাখা বাতাসে মানুষের ব্যস্ততা। গেটের বাইরে তখন কয়েকজন শ্রমিক দাঁড়িয়ে। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ কাঁধে ব্যাগ ঠিক করছে, আর কেউ কেউ অর্ধ ঘুমে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। জীবন যেন তাদের কাছে আজও এক দীর্ঘ দায়িত্বের নাম।
এই ভোরের মধ্যেই, শহরের নিঃশব্দ আলোয় নিজের নতুন ছোট্ট ঘরের মরিচে ধরা টিনের জানালাটা খুলে দাঁড়ায় অরুণ। জানালার বাইরের আলো-ছায়ার খেলায় তার চোখ দুটো আজ অনেক শান্ত, অনেক পরিপক্ব। সেই পুরনো বিস্ময়ের স্থানে এখন এক নিরুত্তাপ দৃঢ়তা, আর হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা কিছুটা শঙ্কার কুয়াশা।
আজ ঠিক দুই মাস দশ দিন হলো সে এই কারখানাটিতে যোগ দিয়েছে। এইখানে যোগ দেওয়ার আগে, সে ছিল এক অস্থির তরুণ। গুলিস্তানের জনারণ্যে হাঁটতে হাঁটতে গলায় বাক্স ঝোলানো এক হকার। প্রতিটি মোড়ে দাঁড়িয়ে মানুষকে থামাতে চাইত তার স্বপ্নের ছোট্ট দৌলতে। রোদ-বৃষ্টি, ধুলো-ধোঁয়া, হর্ন আর হুড়োহুড়ির মাঝে সে খুঁজত টিকে থাকার শেষ ভরসাগুলো। গুলিস্তানের অলিগলিতে তার প্রতিটি পা ফেলাই ছিল এক একটি প্রতিজ্ঞার মতো। যেন একদিন সে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠবে এই বেঁচে থাকার অন্তহীন ক্লান্তি থেকে।
আজ সেই পথ পেরিয়ে এসেছে সে। এখনো হয়ত বহু পথ বাকি। কিন্তু জানালার ওপাশে দেখা যায় যে ভোরটা, তা শুধু আর সূর্য ওঠার প্রতীক্ষা নয়। এ এক নতুন জীবনের শুরু। অরুণের ভেতরের আলোয় ধরা প্রথম সকালের আলপনা।
কিন্তু আজ সে দাঁড়িয়ে আছে অন্য এক জীবনের সামনে।
মিটফোর্ড কেমিক্যাল ওয়ার্কসের গুদামের ছায়া পেরিয়ে, সে এখন—সুপারভাইজার।
তার পায়ের নিচে থাকা মেঝে আর শুধু মাটি নয়—এখন সেখানে একটা নাম লেখা আছে, একটা দায়িত্ব, একটা পরিচয়।
আর ছাদের ওপরে যে রোদের ছায়া পড়ে থাকে নিঃশব্দে, সেটা যেন তাকে আজ বলে যাচ্ছে—
“তুমি বদলে গেছো, অরুণ। আজ থেকে তুমি শুধু একজন শ্রমিক নও, তুমি একজন পথ-রেখা।”
সে ধীরে ধীরে দেয়ালের ভাঙ্গা আয়নার দিকে তাকায়। সেই পুরনো শার্টে হাত বুলিয়ে নেয়, মুখ ধোয়, আর মনে মনে বলে—
“এই দিনটা শুধুই আরেকটা দিন নয়। এটা আমার নতুন শুরু।”
তারপর সে ব্যাগটা কাঁধে তোলে।
দরজার গায়ে হেলান দিয়ে পড়ে থাকা এক পুরনো পত্রিকা। সে দিকে অরুণের খেয়াল নেই। কারণ আজ তার মন, চোখ, হৃদয়—সব কিছু বাঁধা নতুন একটি ছকে।
বাতাসের ঝটকা লাগে দরজায়। পত্রিকার পাতা উলটে যার। তার শব্দ মিশে যায় গলির চারিপাশে সকালের কোলাহলে।
এমন সকাল অরুণের জীবনে আগে কখনো আসেনি।
আর এই সকালটা তার জীবনের প্রথম সত্যিকারের জয়গান।
মাত্র দুই মাসেই যেন তার জীবন পাল্টে গেছে এক অলক্ষণীয় ঋতুর মতো। ধূসর থেকে রঙিন, অস্পষ্ট থেকে স্বচ্ছ। সত্যি বলতে কী, এই বদলটা আক্ষরিক অর্থেই রঙের মতো ছড়িয়ে পড়েছে তার চারপাশে, তার দৃষ্টিতে, এমনকি তার নিঃশ্বাসে।
আগে সকাল মানেই ছিল ক্লান্ত চোখে ঘুম-চোখ সরিয়ে, হুড়োহুড়ি করে বাক্সটা কাঁধে তোলা। ধুলো-মলিন গলির মধ্যে দিয়ে ছুটে যাওয়া এক অনিশ্চিত জীবনের পেছনে, যেখানে প্রত্যাখ্যান ছিল প্রাত্যহিক সত্য, আর বেঁচে থাকার চেষ্টাটুকুই যেন ছিল সবচেয়ে বড় সংগ্রাম।
আর এখন?
সকাল মানেই দায়িত্ব।
নিয়মে বাঁধা এক জীবন, কিন্তু সেই নিয়মের মধ্যে গেঁথে আছে এক আশ্চর্য স্বপ্নের বীজ—যা প্রতিদিন একটু একটু করে অঙ্কুর গজাচ্ছে, ভিতর থেকে।
প্রতিদিন ঠিক সকাল আটটায় অরুণ পেরিয়ে যায় কারখানার লোহার বিশাল গেট। সে আর ঘড়ির দিকে তাকায় না—তাকানোর প্রয়োজনও পড়ে না, কারণ এখন সময় যেন ওর বুকের ভেতরেই শব্দ তোলে। হৃদয়ের গভীর কোনায় এক অনভ্যস্ত নিয়মিততা জন্ম নিয়েছে। টিকটিক করে চলে এক আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস। যেন সময় এখন তারই অংশ, তারই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বাঁধা।
প্রথম মাসের বেতন হাতে পেয়েই সে গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে কিনে নেয় একটা পুরনো ঘড়ি। খুব দামি কিছু নয়, ফিতেটা একটু ছেঁড়া, কাচে হালকা দাগ। তবু সেটাই তার কাছে অনন্য। যেন এক প্রহরীর মতো, তাকে সময়ের নিয়মে আটকে রাখতে নয়, বরং জীবনের ছন্দে চালিয়ে নিতে পাশে থাকবে। কারখানায় যেন কখনো দেরি না হয়—এই সরল চিন্তাটাই ছিল কেনার পেছনে তাগিদ।
কিন্তু আসলে সে ঘড়িটা সময় দেখার জন্য নয়, বরং নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। সে বদলেছে, এখন সে সময়ের পেছনে ছুটে নয়, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটে। পরনে এখনো সেই পুরনো প্যান্টটা। শার্টটাও আগের মতোই ফিকে রঙের। কিন্তু যেটা বদলেছে, তা হলো অরুণের ভিতরটা। বুকভরা যে দৃঢ়তা আজ তার, তা নতুন—ঝকঝকে, স্থির, অনড়।
যেটা একসময় ছিল কেবল বেঁচে থাকার লড়াই, এখন তা রূপ নিয়েছে কিছু গড়ে তোলার তৃষ্ণায়। জীবনের স্বর এখন আর নিছক কোলাহল নয়—এ এক নতুন ছন্দ, যেখানে প্রতিটি সকাল খুলে দেয় সম্ভাবনার নীরব এক দরজা।
সে এখন জানে, কোন সেকশনে কতজন লোক আছে। কে সকালে দেরি করে, কার কাজ নিখুঁত, আর কারটা নজর চাই—সব তার মনের খাতায় যেন এক নিখুঁত ছকের মতো গাঁথা।
বাবর চাচা এখানকার অনেকদিনের কর্মী। সবাই তাঁকে ‘চাচা’ বলেই ডাকে। প্রথম দিন থেকেই অরুণকে পছন্দ করে। বাবর চাচাই হাতে ধরে অরুণকে কাজ শিখিয়েছেন।
চাচা মাঝে মাঝে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
— “এই বয়সে এত গুছিয়ে কাজ শিখলে কোথায়, বাবাজী?”
অরুণ হেসে উত্তর দেয়,
— “শেখা নয় চাচা, গড়েছি। নিজের ভেতর থেকেই।”
প্যাকিং ইউনিট থেকে বোতল পরিষ্কারের ঘর, কেমিক্যাল মেশানোর নিঃশব্দ টেবিল—প্রতিটি কোণেই তার চোখ যায়। প্রতিটি ছন্দে সে খোঁজে একধরনের শৃঙ্খলা, যেন কাজে লুকানো থাকে জীবনের নিজস্ব সংগীত।
একসময় যে ছেলেটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে ডাকত, “সিগারেট স্যার? এক টাকা! ভালো মাল!”, আজ সে নিজের কথা না বলেই, নিঃশব্দে কাজের ভেতর বুনে যাচ্ছে নিজের পরিচয়।
মনে হয়, জীবন যেন এক বিশাল মঞ্চ—আর সে, এতদিন যাকে সবাই ভাবত পার্শ্বচরিত্র, এখন নিজের জন্যই হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় চরিত্র।
দর্শক থাকুক বা না থাকুক, অরুণ প্রতিদিন এক নিখুঁত সংযমে অভিনয় করে যায়—যার প্রতিটি দৃশ্যেই সে নিজেকে একটু একটু করে নতুন করে গড়ে।
এই কদিনেই ভেতরটা বদলে গেছে অরুণের। তবে সে পরিবর্তন চেঁচিয়ে কিছু জানায় না—
উঠে আসে নিঃশব্দ ঘামের রেখায়, প্রতিদিনের কাজের নিপুণতায়।
একসময় সন্ধেবেলা সে ফিরত রোদে পোড়া ক্লান্ত শরীর নিয়ে। একটা পরাজয়ের মতো ভারী মনে হতো দিনটা।
আর এখন?
সারাদিনের শেষে যে ক্লান্তি জমে, তা যেন বিজয়ের মৃদু চিহ্ন। শরীরে জমা কষ্ট, অথচ হৃদয়ে প্রশান্তির এক ধ্বনি।
জীবন তাকে সংকুচিত করেনি, বরং এই দুই মাসেই একটু একটু করে মনটাকে বিশাল করে তুলেছে। কথায় নয়, কাজে। অভিযোগে নয়, অর্জনে।
আজ যেন ভবিষ্যতের রেখাগুলো আঁকা তার হাতের তালুতে। ময়লা লেগে থাকলেও, দাগগুলো স্পষ্ট।
মাথা নিচু নয়, বরং দৃঢ় এক দৃষ্টিতে সে দেখে নিজেকেই। যেখানে প্রতিটি সময়, প্রতিটি দিন, তাকে একটু করে গড়ে তোলে।
মেশিনের গর্জনের ভেতরেও আলাদা করে শোনা যায় বোতলের ঘষাঘষির ঝংকার। শিশি ভরাটের টুপটাপ শব্দ। এক ধরনের শিল্পসুলভ ছন্দ, যেন দৈনন্দিন শ্রমও একটা গান হয়ে উঠেছে।
এই শব্দগুলোর মাঝেই অরুণের হৃদয়ে ধীরে ধীরে জাগে এক গভীর আনন্দ—
সেটা কেবল বেতনের টাকায় সন্তুষ্টির নয়, বরং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর গর্বে পূর্ণ এক নীরব উল্লাস। শামীম, মহিম, আকবর, বাবর চাচা—সবাই এখন তার অধীনে কাজ করে। তবু তাদের মাঝে সম্পর্কটা কখনও শাসনের নয়, বরং একধরনের নীরব শ্রদ্ধা আর সহমর্মিতার।
পঁচিশজনেরও বেশি শ্রমিকের দায়িত্ব এখন অরুণের কাঁধে। তাদের মধ্যে সে একমাত্র হিন্দু—তবু কারও চোখে নেই কোনো ভেদাভেদ, নেই দূরত্ব। সবাই তাকে ডাকে “অরুণ দা” বলে। বাবর চাচা “বাবাজী” বলেই ডাকে। অরুণ যেন নিজেরই সন্তান।
এই ডাকের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে গ্রহণযোগ্যতার এক নরম ছায়া,
আর অরুণ জানে—এই ভালোবাসা অর্জন করা যায়, দাবি করে নেওয়া যায় না।
একদিন দুপুরে শামীম তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল,
— “অরুণদা, আগে ভাবতাম তুমি বেশি আদিখ্যেতা কর... এখন দেখি, এই আদিখ্যেতার নামই বোধহয় নিষ্ঠা।”
অরুণ হেসে ফেলেছিল,
— “চাকরি করতে আইছি, নাটক না। কাজ ভালো কইরা করি—এইডাই যদি আদিখ্যেতা হয়, তাইলে হোক।” মহিম চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে এসে বলেছিল,
“তোমার কথায় রাগ উঠে না, কইতাছি। আগে কেউ গালি দিলে গলা চড়িয়ে উঠতাম, তুমি কিছু বললে মনটা চুপ হয়ে যায়।”
অরুণ শুধু বলেছিল,— “রাগে না, বরং কাজে দ্যাখাও নিজেকে।”
এক দুপুরে আকবর চুপিচুপি একখানা আম ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,
— “এইটা আমার বাগানের। তুমি খুব ভালো মানুষ অরুণদা।” সেই একখানা আম যেন হাজারটা মাইনে থেকেও বড় হয়ে উঠেছিল সেদিন অরুণের কাছে। দুহাতে আকবরকে গলায় জড়িয়ে ধরে বলেছিল “তুমিও যে বড্ডো ভালা, আকবর ভাই।“
অরুণের চোখ ঘোলাটে হয়ে আসছে।
অফিসের দ্বিতীয় মাস তখন শেষের দিকে। অরুণ প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ত ছিল নিজের কাজে। দুপুর পার হতে না হতেই কায়সার সাহেবের ছেলেটা এসে খবর দিল,
— “কায়সার সাব আপনাকে ডাকতাছে।”
অরুণ কিছুটা চমকে উঠল। হঠাৎ? কোনো ভুল হয়ে গেল নাকি? হাতের খাতা বন্ধ করে, ধীরে পা ফেলল দোতলার সিঁড়ির দিকে।
অফিস ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে বিকেলের রোদ ঢুকছিল। রোদের ফালিটা যেন এক অনন্ত আলোয় ডুবে রেখেছিল ঘরের ধুলোবালি, পুরনো ফাইল, আর কায়সার সাহেবের সাদা পাঞ্জাবির কাঁধ। চেহারায় তার চিরচেনা স্থিরতা, কিন্তু আজ যেন চোখের কোণে একরকম স্নিগ্ধতা জমেছে।
তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন না, কিন্তু ভর করে টেবিলের ওপর হাত রেখে একটু এগিয়ে এলেন অরুণের দিকে। নরম কণ্ঠে বললেন,
— “তুমি জানো, আমি মানুষ দেখি কাজের ভেতর দিয়ে। মুখ দেখে না। তুমি কাজটা হৃদয় দিয়ে করো, অরুণ। আমি সব লক্ষ্য করেছি।”
অরুণ চুপ। দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে, বুকের ভিতর ধুকপুক করছে—ঠিক যেন স্কুলের দিনে ফলাফল শোনার আগের মুহূর্ত।
— “আজ থেকে তুমি সুপারভাইজার। তোমার মাইনে হবে তিনশো বিশ টাকা। আর এই টিমটাকেই তুমি সামলাবে। দায়িত্বটা শুধু একটা পদ নয়—এটা বিশ্বাস।”
শব্দগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবে উচ্চারিত হলেও, অরুণের বুকের ভিতর যেন বোমা ফাটল। সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু গলার ভেতর দলা পাকানো এক আবেগ সবকিছু আটকে দিল।
শেষমেশ অনেক কষ্টে ঠোঁট কাঁপিয়ে বলল,
— “আপনার বিশ্বাসটা... ফিরে পেতেও ভয় লাগে, স্যার। এইরকম কিছু কখনো পাইনি...”
কায়সার সাহেব উঠে এলেন চেয়ার ছেড়ে। ধীরে অরুণের কাঁধে হাত রাখলেন। কাঁধের ওপর তাঁর হাতটা যেন একটা আশ্বাসের ছায়া—নরম, ভারী, অথচ দিগন্ত বিস্তার করা।
বললেন, “ভয় পেও না। ভয় মানুষকে ছোট করে। আমি জানি, তুমি শুধু কাজ না, বিশ্বাসটাও বহন করবে। এই শহর বিশ্বাসে বড় হয়, প্রতারণায় নয়।”
অরুণ মাথা নিচু করে চোখের জল লুকায়। এমনভাবে আগে কেউ কথা বলেনি। এমন করে তাকে কেউ ছুঁয়েও দেখেনি।
কায়সার সাহেব একটু থেমে বললেন,
— “চলো, তোমার নতুন জায়গাটা দেখে আসো। আমাদের বাড়ীর সাথেই দাড়োয়ানদের থাকার কয়েকটি রুম আছে। তুমি ওখানেই একটি রুমে থাকবে। তাছাড়া আমার একটি ছোট্ট বোন আছে। `শাকিলা`-খুব ভালো মেয়ে। ক্লাস সিক্সে পড়ে। মাঝে মধ্যে তুমি ওকে সকালে স্কুলে দিয়ে আসবে। কি পারবে না?”
-“পারবো, স্যার”
দুজনে একসাথে কারখানার গেট পেরিয়ে ছোট গলির ভেতর ঢুকে পড়ে। গলির দুই পাশে পুরনো বাড়ি, ধুলোমাখা বাগান, ছেলেরা লাঠি দিয়ে সাইকেলের চাকা ঘোরাচ্ছে।
বাঁদিকে একটা তিনতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় তারা। বাড়ির সামনে একখানা ছাতিমগাছ। নিচে একটা কাঠের বেঞ্চে একজন বৃদ্ধ বসে রোদ পোহাচ্ছে।
— “এই বাড়ির একতলায় আমি থাকি,” বললেন কায়সার সাহেব। “পেছনে আমাদের দারোয়ানদের থাকার ব্যবস্থা আছে।
একটি রুমে তুমি থাকবে।
অরুণ কিছু বলে না। শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকে বাড়িটার দিকে। মনে হয়, সেই পুরনো ফুটো-ছাদের ঘর থেকে হেঁটে হেঁটে সে যেন সত্যিই অন্য এক পৃথিবীতে চলে এসেছে।
তখনই বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ায় এক কিশোরী। স্কুল ইউনিফর্মে, হাতে বইয়ের ব্যাগ, চোখে মিষ্টি কৌতূহল।
কায়সার সাহেব চোখ তুলে বলেন,
— “শাকিলা, এই তোমার অরুণ ভাই। আমাদের ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। এখন থেকে সুপারভাইজার।”
মেয়েটি একটু হেসে মাথা নাড়ে। চোখে একরকম সরলতা, যা শহরে খুব কম দেখা যায়। নিচে নেমে এসে সে মৃদু গলায় বলে,
— “ভাইয়া, আপনি অনেক কাজ করেন শুনেছি। ক্লান্ত লাগে না?”
অরুণ একটু চমকে যায়, তারপর নিজের অজান্তেই হেসে ফেলে।
— “লাগে... কিন্তু এই ক্লান্তিটাও তো নিজের হয়ে গেছে এখন। তাই ভালোও লাগে।”
শাকিলা আর কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়, কিন্তু তার সেই চোখের হাসিটুকু যেন রয়ে যায় বাতাসে।
কায়সার সাহেব একবার অরুণের দিকে তাকান,
— “আমার এই বোনটা খুব কৌতূহলী। ভালো-মন্দ বুঝে নিতে সময় লাগে না ওর।”
অরুণ মাথা নিচু করে বলে,
— “বুঝতে পারে ও... চোখে বোঝা যায়।”
আকাশে তখন সন্ধ্যার রঙ। ছাতিমগাছের পাতায় বাতাসের নরম দোলা। আর সেই দোলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে অরুণ—এক নতুন ভূমিতে, এক নতুন পরিচয়ে।
জীবনে এমন মুহূর্ত আসে, যখন মানুষ জানে—পুরনো জীবনের সাথে তার যে সেতু ছিল, সেটা আর ফিরে যাবে না। অরুণেরও ঠিক সেই মুহূর্ত। তবু ভেতরটা ভয়ে নয়, শান্তিতে ভরে ওঠে।
সে জানে, এবার সত্যি কিছু শুরু হলো।
এক সময় কায়সার সাহেব নিজে অরুণকে নিয়ে এলেন তাঁর নতুন ঠিকানায়। ঘরটি খুব বড় না হলেও পরিচ্ছন্ন ও গোছানো। জানালার পাশে একটি টেবিল, পাশে একটা খাট—সব কিছুই যেন নতুন অতিথিকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।
সবকিছু ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিলেন কায়সার সাহেব। এমনকি আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কেও কিছুটা বলে দিলেন। তারপর এক নিঃশ্বাসে বললেন, "তোমার ঠিকানা এখন এটা, অরুণ। এখান থেকেই শুরু হবে নতুন পথচলা।"
কয়েক মুহূর্ত নীরব দাঁড়িয়ে থেকে, এক অদৃশ্য ভার ফেলে রেখে, তিনি ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন।
অরুণ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। কারখানা থেকে ফেরার পথে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল যা কিছু ছিল—একটা ছোট ব্যাগ, কিছু পোশাক, পুরনো কিছু কাগজপত্র আর অনেকগুলো স্মৃতি। এখন থেকে এই ঘরেই তার সকাল হবে, এই ঘরেই রাত্রি।
ছিমছাম, পরিপাটি একখানা ঘর—কোনো অতিরিক্ততা নেই, তবু যেন একধরনের শান্তির স্পর্শ লেগে আছে চারপাশে। ঘরের এক পাশে বাগান ঘেঁষা দুটি জানালা খুলে আছে হালকা হাওয়ার জন্য। আর সেই হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসছে দূরের বুড়িগঙ্গার ঢেউয়ের মৃদু গুঞ্জন। এক স্নিগ্ধ সঙ্গীতের মতো, যা মনে করিয়ে দেয়, জীবন সত্যিই একটু বদলেছে।
খাটে একখানা মশারি টাঙ্গানো। পাশে কেরোসিন ল্যাম্পের আলোয় থেমে থাকা ছায়া। সে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকায়। রাতের চাঁদ তখন আকাশের অনেক ওপরে।
তার বুকের ভেতরে হঠাৎ জেগে ওঠে একধরনের কান্না। না, সেটা দুঃখের নয়, সেটা একরকম প্রশান্তির। মনে পড়ে যায় তমাল, আসলাম, সেই পুরনো ঘর।
মনে পড়ে যায় ছবিটার কথা। তিনজনের ছবি। নবাবপুরের জোছনা ফটোগ্রাফি। ছবিটার কথা মনে পড়তেই ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলে,
— “তোরা ভালো থাকিস”
এক সময় বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয় অরুণ।
চাঁদের আলো ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে নিঃশব্দে। বাইরে দূর থেকে ভেসে আসে কোনো রিকশার টুংটাং ঘণ্টা। অরুণ চোখ বন্ধ করে। মনের ভিতর রয়ে যায় বাবর চাচার হাতের ছোঁয়া, শামীমের কথাগুলো, আর কায়সার সাহেবের চোখের সেই অদ্ভুত মমতা।
তার বুকের ভেতরে এক নতুন সময় জন্ম নিচ্ছে। এখনো অনেক পথ বাকি। ভুলও হবে, ক্লান্তিও আসবে, হয়ত ঠেকে ঠেকে চলতে হবে—
তবু আজ থেকে সে জানে, এই পথটা তার নিজের তৈরি করা। এটা কেবল চাকরি নয়, কেবল পদোন্নতি নয়—এ এক আত্মবিশ্বাসের আলপথ। যা একদিন অনেক দূরে নিয়ে যাবে অরুণকে।
আর যখন নতুন দিনের প্রথম রোদের আলো কারখানার টিনে পড়বে, তখন হয়ত কেউ আরেক অরুণকে দেখবে। না, কেবল একজন সুপারভাইজার নয়, বরং এক জলছাপ হয়ে থাকা গল্পের মানুষ। যার প্রতিটি দিন নিজেই বলে যায়—
"জীবন বদলায়, যদি কেউ নিঃশব্দে বদলে দিতে জানে।"
চলবে—
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট